![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...
দো-চালা এইটুকুন এক ঘর।
সেই ঘরের অর্ধেক জুড়ে একখানা চৌকি, বাকি অর্ধেক জুড়ে ভাতের হাড়ি, থালা-বাসন, ভাজ করা পাটি। খাল থেকে আঠালো কাদা এনে কাচা মাটির সেই মেঝে লেপে দিতেন আমার মা। ইশ ঝকঝকে সেই মেঝে কি সুন্দর যে দেখাতো! সমস্যা হতো বর্ষায়। ভরা বাদলে সেই ঝকঝকে মেঝেখানা হয়ে যেত স্যাঁতসেঁতে। একটু বৃষ্টিতেই হোগলা পাতার বেড়া চুইয়ে বৃষ্টির ছাট এসে ধুয়ে দিত মেঝে। বেড়ার ফাঁক গলে টুপটাপ ঘরে এসে ঢুকত ছোট ব্যাঙ, লম্বা কেঁচো। মেঝেতে যখন পাটি পেতে ভাত খেতে বসতাম!এহ! ভাতের থালার পাশে এই কেঁচো-ব্যাঙ দেখে ঘেন্নায় আমার পেট উল্টে বমি এসে যেত!
-‘এহ! এমন ভদ্দরলোক ঘরে দিয়া আল্লায় আমারে ফালাইছে এক ফ্যাসাদে!’ গজ গজ করতে করতে মা সেই ব্যাঙ কেঁচো ঘর থেকে সাফ করতেন, পাতার বেড়ার চারপাশে চটের বস্তা গুঁজে দিতেন। আমার তবুও আর ভাত খাওয়া হতো না, আমি এক হাতে মুখ চেপে ঘর থেকে বেরুতাম। বাইরে প্রবল বৃষ্টি, সেই বৃষ্টিতে মেঝো চাচাদের ঝকঝকে ইটের দালানখানা দেখে বুকের ভেতর কেমন ওলটপালট হয়ে যেত!
ইশ! অমন একটা ঘর যদি আমাদের থাকতো!
আফসোসের আয়ুষ্কাল অবশ্য ওই পর্যন্তই। এর পর তুমুল বৃষ্টিতে মিশে যাওয়া। ছুটে যেতাম দিগ্বিদিক। আকাশ ফাটিয়ে মেঘের গর্জন, বিদ্যুৎ চমক আমরা থোরাই কেয়ার করি। আমরা দুষ্টু ছেলের দল ফুটবল নিয়ে নেমে যাই মাঠের হাঁটু পানিতে। অন্ধকারের মতন সেই গাড়-প্রগার বৃষ্টিতে যখন বিদ্যুৎ চমকায়, কাছে কোথাও সশব্দে বাজ পড়ে, আমরা হেসে গড়াগড়ি খাই। কেউ একজন বলে ওঠে, ‘আন্ধারে খ্যালতে পারতেছিনা দেইক্ষ্যা আল্লায় লাইট জ্বালাইতেছে!’।
মাঠ-ঘাট-পথ সব মিলে মিশে একাকার। সেই বৃষ্টিতে কাটে সকাল দুপুর সন্ধ্যা। বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান। বাড়ীর পাশের ছোট্ট আড়িয়াল খা নদ। সেই নদের গা জুড়ে খই হয়ে ফোটে তুমুল বৃষ্টির ফোটা। আমরা মিশে যাই, মিলে মিশে একাকার। বৃষ্টি-দিন-সন্ধ্যা-দুপুর- আমরা সব। ভর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই রক্ত চক্ষু মা চুলার কাঠ নিয়ে তেরে আসেন। চুলের মুঠি ধরে নিয়ে যান পুকুরে, তার পর কি ভয়াবহ নির্মমতায় ডলে ডলে সাফ করেন গা। সেই ভয়াবহ ডলায় লাল লাল দাগ উঠে যায় ছোট্ট শরীর জুড়ে। ঘরে ঢুকিয়ে সর্ষে তেলের কৌটা বের করেন। ঝাঁঝে গন্ধে চোখে পানি চলে আসে। শীতে ঠকঠক কাঁপতে কাঁপতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। মা সেই তিরিক্ষী মেজাজের ঝাঁঝালো সরিষা তেলে মালিশ করেন পুরো শরীর, তারপর কাঁথা পেচিয়ে চৌকীর একপাশে ছুড়ে ফেলেন। খানিক বাদে ছোট্ট বাঁটি ভর্তি ঝাঁঝালো পেঁয়াজ আর সরষে তেল মাখানো মোটা চালের লাল মুড়ি। খেতে খেতে আবারো চোখের জলে নাকের জলে একাকার দুনিয়া। আর অপেক্ষার আগামী দিন, আরও একটি বৃষ্টির দিন। আহা বৃষ্টি! টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ ছাড়িয়েও ভেসে আসে মা’র ভীষণ গলা,-‘ এই পোলা লইয়া আমি কই যামু! পানি পাইলে আর কতা নাই, বিষটি বাদলা পাইলে পাগল হইয়া যায়। আল্লাহ তুমি এর জ্বর-জারি দিওনা আল্লাহ! এরে লইয়া আমি কই যামু?’
নাহ, জ্বরের সাধ্য ছিলোনা, বৃষ্টিতে ভিজেছি বলে সেই আমাকে ছোয়!
তারপর, বাড়ী ছেড়েছি সেই কবে? সেই স্যতাসেতে ঘর নেই, ব্যাঙ কেঁচোর মেঝে নেই, সরষে তেলে ঝাঁঝ নেই, সেই পেঁয়াজ নেই, লাল মুড়ি নেই, সেই বৃষ্টিও নেই...
গতকাল অফিস থেকে বাসায় ফিরছি, সিএনজিতে উঠতেই তুমুল বৃষ্টি। বহু কষ্টে সেই বৃষ্টির ভেজা বাঁচিয়ে বাসায় এসে দেখি, নাহ, খানিকটাতো ভিজেই গেছি। তারপর, রাত থেকেই জ্বর, অবিরাম সর্দী, অসহ্য মাথা ব্যাথা। কিন্তু এর চেয়ে বেশি কাহিল হলাম বুকের ভেতর এক অদ্ভুত যন্ত্রণায়। কোথায় যেন, চুপ চুপ জেগে উঠলো সেইসব বৃষ্টির দিন। সেই মেঠো পথ, সেই কাদা জল মাঠ, সেই খই ফোটা বৃষ্টির আড়িয়াল খা। সেই আমি! সেই সব দিন। সেইসব সোনারং।
কে যেন বুকের ভেতর সেই অদ্ভুত যন্ত্রণায় অস্ফুট স্বরে আমার কাছে জানতে চায়-
‘কে বদলালো? তুমি? না বৃষ্টি?’
০২ রা মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৩৫
সাদাত হোসাইন বলেছেন:
©somewhere in net ltd.
১|
০২ রা মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২৩
কালোপরী বলেছেন: