নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্বপ্নচুরির ভয়।

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:১৪

ফুটবলের দাম পঁচাশি টাকা।



দামাদামি করলে দু’টাকা পর্যন্ত কমানো সম্ভব। বেঁচে যাওয়া সেই দু’টাকায় নারকেল দেয়া স্যাকারিনের লাল নীল আইসক্রিমও পাওয়া যায়। কিন্তু এই দু’টাকা বাঁচাতে হলে আগেতো পঁচাশি টাকা জোগড় করতে হবে। ঐ পঁচাশি টাকা জোগাড়ের ঝক্কিটাই আসল। আকাশ-পাতাল।



বাবা তখন ঢাকায় থাকেন। বাড়িতে আমি, মা, ছোট ভাই আর বু। বু মানে দাদী। সেকালে আমরা দাদীকে বু-ই বলতাম। দাদীকে ‘বু’ ডাকা নিয়ে মজার একটা বিষয় ছিলো। ‘বু’ শব্দটা এসেছে ‘বুবু’ থেকে। বুবু মানে বোন। দাদীতো বোনই। আমার বাবাকে আমি যেমন বাবা ডাকি, দাদীও তাই। সুতরাং দাদীতো আমার বোনই। বুবু। বু। কিন্তু ঝামেলা হতো নানী বাড়ি গেলে। নানী প্রথমেই যেটা জিজ্ঞেস করতেন, সেটা হলো, ‘কি নানা ভাই, তোমার বিবি কেমন আছে?’। ‘বিবি’ শব্দের অর্থ না বুঝলেও এই বিবি যে সেই বু-ই, সেটা বুঝতে তেমন অসুবিধা হতোনা আমার। ঘাড় নাড়িয়ে জবাব দিতাম ‘বু ভালো আছে’।



বিবি শব্দের অর্থ বুঝেছিলাম আরো অনেক পরে। এই বিবি হলো মিয়া-বিবি’র বিবি। বিবি মানে বউ। এদেশে দাদীকে একই সাথে বোন আর বউ বানানোর অর্থ কি কে জানে!



যাই হোক, বাড়িতে আমি, মা, ছোট ভাই আর বু। বাবা ঢাকা থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠান। টাকার সাথে থাকে মাকে লেখা একখানা চিঠি। কোথায় কত টাকা কিভাবে খরচ হবে তার ছোটখাটো নির্দেশনা থাকে চিঠি জুড়ে। বর্ষকাল শুরু হতেই সেই চিঠির জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে থাকি। মায়ের কাছে লেখা বাবার চিঠির জন্য আমার উদগ্রীব হওয়ার কথা না। কিন্তু আমি হই! কারণ বর্ষা মৌসুম শুরু হতেই যেকোন একমাসে বাবা প্রতিমাসের খরচের বাইরে একশ টাকা পাঠাবেন। এই একশ টাকা আমার জন্য। যার পঁচাশি টাকায় ফুটবল কেনা হবে। বাকী পনেরো টাকা যাওয়া-আসার খরচ। আসেপাশের হাট-বাজারে ফুটবল পাওয়া যায়না। ফুটবল পেতে হলে যেতে হবে দূরের টরকী বন্দরে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছেন আমার মা। তিনি চান না এই ফুটবল নিয়ে আমি রোদ বৃষ্টিতে মাঠে-ঘাটে, বন-বাদারে ঘুরি। তিনি তাই আমার কাছে বেমালুম চেপে যান আমার স্বপ্নের ফুটবল বাবদ বাবার বরাদ্দ দেয়া একশ টাকার কথা। আমি অবশ্য ছেড়ে দেয়ার পাত্র না। মাকে লেখা বাবার চিঠিগুলো কোথায় থাকে তা আমি জানি। চুপিচুপি সেই চিঠির স্তুপ থেকে আমি ক্রমাগত চিঠি চুরি করি। পুরো চিঠি পড়ার ধৈর্য্য আমার নেই। আমি একপলকে চিঠির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দৃষ্টি বোলাই। সেই দৃষ্টিতে দুটি মাত্র শব্দ খুঁজি, একশ টাকা, আর ফুটবল।



এই একশ টাকার জন্য আমার রাতে ঘুম হয় না। মক্তবে আরবী পড়তে গেলে চোখ আটকে থাকে ছেপাড়া-আমপাড়ার প্রতি লাইন শেষে বৃত্তাকার বিরাম চিহ্নের দিকে। সেই গোল বিরাম চিহ্নর ভেতর আমি ধীরে ধীরে ফুটবল দেখি। একসময় আমপাড়ার পাতাজুড়ে কিলবিল করতে থাকে অজস্র ছোট ছোট ফুটবল। আমার পড়া শিকেয় ওঠে। আমি অদ্ভুত তন্ময়তায় সেই ফুটবল নিয়ে বর্ষায় ডুবে যাওয়া সবুজ ঘাষের মাঠ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াই। বড় হুজুরের লকলকে বেতের ডগা সপাং করে ছোবল মারে আমার পিঠে। আর গর্জে ওঠে বড় হুজুরের বজ্র কণ্ঠ, 'মুখে কি ঠাডা পড়ছে, শব্দ কই? শব্দ কইরা পড়। বুলন্দ আওয়াজ হবে!'



প্রতিবারই আমার আরাধ্য ফুটবলের সেই একশ টাকা আদায় করতে আমার মাথার ঘাম পায়ে পড়ে। সেবার পায়ের ঘাম মাথায় উঠিয়েও লাভ কোন হলো না। ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠেছি। ঊনপঞ্চাশ জনের মধ্যে আমার রোল নাম্বার হয়েছে তেতাল্লিশ। সুতরাং আম্মার কঠোর নিষেধাজ্ঞা, কোনভাবেই ফুটবল নয়। শেষ অবধি চুরি করা ছাড়া আমার আর উপায় রইলো না।



মানুষ সম্ভবত জন্মগতভাবেই চোর। নানান রকম চুরির মধ্যেই তার বসবাস। সে সুযোগ পেলেই চুরি করে। ছিঁচকে চুরি, পুকুর চুরি, সিঁধেল চুরি। ডাকাত, পকেটমার, ছিনতাইয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। ক্লাসে-অফিসে চুরি করে ঘুম, পরীক্ষার হলে অন্যের খাতা দেখা, চুরি করে চিঠি পড়া, মেয়ে দেখা, সিনেমা দেখা, আচার, আইসক্রিম, চকোলেট খাওয়া, ক্লাসে বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই পড়া, কোন এক গোপন মন খারাপের দিনে বাথরুমে ঢুকে পানির টেপ খুলে ছলছল জলের শব্দে লুকিয়ে চুরি করে কাঁদা! মানুষের জীবনে চৌর্যবৃত্তিতে পূর্ণ। চুরি তার অস্থিতে, চুরি তার মজ্জায়।



আমিও চুরি করলাম। এক কাক ভোরে আম্মার টাকার ব্যাগ থেকে একশ টাকা চুরি করে আমি আমার স্বপ্নের সেই ফুটবল কিনতে চললাম। সাথে তিন বন্ধু ছালেক, পলাশ, সবুজ। ফোর মাস্কেটিয়ার্স। ফুটবল নিয়ে গাঁয়ে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাইলের পর মাইল তাঁতানো সূর্য মাথায় নিয়ে আমরা পায়ে হেঁটে ফিরেছি। পায়ের তালুতে টসটসে ফোস্কা। সারা শরীর জুড়ে ব্যাথা। আর বাড়িতে আম্মা খড়িকাঠে তেল মাখিয়ে বিভিষণ হয়ে অপেক্ষায় আছেন নিশ্চিত। গেলেই দুমদাম পড়বে পিঠে। আমরা অবশ্য সেসব বেমালুম ভুলেই গেলাম। সামনেই স্কুলের সবুজ মাঠ। ইরানী গালিচার মতন কি সুন্দর নরম ঘাস। মাঠের পাশে আড়িয়াল খাঁ’র ফুড়ফুড়ে বাতাস। সে বাতাসে হাতের চকচকে ফুটবলটাও যেন আড়মোড়া ভাঙে। ইশ্! কত নির্ঘুম রাতের স্বপ্ন আমার হাতে। কত চুপিচুপি কান্নার ফোটা ফোটা জল। আমি সবাইকে অবাক করে দিয়ে দৌঁড়ে উঁচু রাস্তা থেকে এক নি:শ্বাসে নেমে এলাম মাঠে। সবুজ পেলব ঘাসে পা দিতেই যেন শরীরের শিরায় শিরায় পৌছে গেলো অদ্ভুত শিহরণ। হাতের ফুটবলটাকে দুহাতে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলাম। আহ!



দু’জন দু’জন ভাগ করে চার জন মিলে শুরু হবে খেলা। তার আগে ছালেককে গোলকিপার বানিয়ে প্র্যাকটিস হিসেবে আমি, সবুজ, পলাশ প্রত্যেকে একটা করে পেনাল্টি কিক করবো। বলটা যেহেতু আমার, সুতরাং সবুজ ঘাষের বুকে বলটাকে প্রথম পায়ের ছোয়া দেয়ার অধিকারও আমারই। গাছের শুকনো ডাল দিয়ে বানানো গোলপোস্টের মাঝখানে দাঁড়ালো ছালেক। আমি বলটাকে ঘাষের ওপর বসালাম। তারপর এক পা এক পা করে পেছাতে থাকলাম। নিজেকে আমার তখন আর্জেন্টিনার বাতিস্তুতা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে গ্যালারিভর্তি দর্শক চিৎকার করছে আমার নাম ধরে। সাথে গোল, গোল, গোল বজ্রধ্বনি।



আমি আরো খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে তারপর ঘুরলাম। আট-দশ পা দূরেই বলটা চকচক করে যেন আমাকেই ডাকছে। গোলপোস্টের ভেতরে প্রবল আত্মবিশ্বাসে ওয়ার্ম আপ করছে ছালেক। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় তাকিয়ে আছে পলাশ আর সবুজ। আমি দৌড় শুরু করলাম। সামনেই বল। একদম কাছে। ছালেক শকুনের চোখে তাকিয়ে আছে বলের দিকে। আমি নিশ্চিত, বলে লাথি মারার সাথে সাথেই চারপাশের শব্দগুলো আরো গর্জে উঠবে, গোওওওল... গোওওওল...। আমি বাতাসের বেগে বলের কাছে পৌছে গেলাম, তারপর বিদ্যুৎ গতিতে লাথি দিলাম বলে।



কি হয়েছিলো জানি না। আমি পা পিছলে পড়ে গেলাম মাটিতে। বলটা আঙুলে লেগে খানিকটা গড়িয়ে সামনে গিয়ে থেমে গেল। অসহ্য যন্ত্রণায় পায়ের গোড়ালি যেন ছিড়ে গেল। আমি মাটিতে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় চোখ বুঁজলাম। চোখের ভেতর যেন জ্বলে উঠলো অজস্র জোনাকী। মচকে যাওয়া পা নিয়ে চোখ খুললাম। ক্রমশই ঝাপসা চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠলো চকচকে বলটা। তীব্র ব্যাথা উপচে আমার অভিমান হতে লাগলো। প্রবল অভিমান। আমি প্রবল অভিমান নিয়ে একবার সেই বলের দিকে তাকাই, একবার প্রগাঢ় সবুজ ঘাসের দিকে তাকাই। আমার চোখ ভর্তি অভিযোগ। ঐ ঘাসের প্রতি, ঐ বলের প্রতি। আর কারো প্রতি কি? ঐ আকাশে যিনি থাকেন? তার প্রতি?



আমার অভিমান হতে থাকে। কান্না পেতে থাকে। আমার চোখ জোড়া আবার ঝাপসা হয়ে আসে। আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি।



ঘাষের ভেতর ডুবে থাকে আমার নির্ঘুম রাত, ঝাপসা স্বপ্ন, কষ্ট আর দলা পাকানো কান্না।



শেষের আগে-



[একটি সাধারণ মন খারাপের, কষ্টের, না পাওয়ার কিংবা স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প হয়তো এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু গল্প এবং জীবনের ঐ কিশোর চরিত্রটি ‘আমি'। ‘এই আমি’ বলেই হয়তো আমার ভাগ্য আমার ওই অতটুকুন মন খারাপ কিংবা কষ্ট কিংবা না পাওয়া কিংবা স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট দিয়েই খুশি হতে পারে নি। তার আরো বেশি কিছু চাই। আমাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়া, ভেঙে চুড়ে সমূলে উপড়ে ফেলা।]



মচকে যাওয়া পা আর বুকভর্তি অজস্র অভিমান নিয়ে আমি ঘাসের ভেতর শুয়ে রইলাম। ডান পা নড়াতেই টের পেল তীব্র ব্যাথায় অবশ হয়ে আছে পুরো শরীর। ছালেক আর পলাশ আমাকে তুলে নিয়ে মাঠের পাশের কামিনী গাছের তলায় ছোট্ট শহিদ মিনারটার তেল চকচকে বেদীতে বসিয়ে দিলো। আমি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছি সামনে। সেখানে দিগন্তে নীল আকাশ, এক চিলতে মেঘ, একটি চিল, সবুজ ঘাস, দুটি শালিক, সারি সারি গাছ, গাছের ছায়া অথবা কিছুই না। কিছুই না।



চকচকে ফুটবলটা মাঠের মাঝখানে পড়ে আছে একা। সবুজ, পলাশ আর ছালেক মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। ইশ্ কত আশা করেই না মাঠে নেমেছিলো ওরা। কিন্তু খেলতে আর পারলো কই! যার বল, সেই যখন খেলতে পারলো না তখন ওদের কি আর...!



ওদের এমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার কেমন মন খারাপ হয়ে গেল। আস্তে করে পলাশকে ডেকে বললাম, ‘এই, যা যা, তোরা খ্যাল, আমি দেখি। বাড়িতে গেলে বু তেল মালিশ কইরা দিলেই পা ভালো হইয়া যাইবো। দুই তিন দিন পরতো আমি খ্যালতেই পারমু।’



পলাশ আর সবুজ কিছুটা ইতস্তত করে। ছালেক মাঠের মাঝখান থেকে বা পায়ের আলতো টোকায় বলটা গড়িয়ে দেয় পলাশের দিকে। তিনজন গোল হয়ে দাঁড়ায় মাঠে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তিনজনেতো আর খেলা যায় না। অন্তত আরো একজন চাই। মাঠের কোনায় অবশ্য আলামিন ভাইকে দেখা যাচ্ছে। সমস্য হচ্ছে আলামিন ভাই উপরের ক্লাসে পড়েন। ক্লাশ সেভেনে। তারচেয়েও বড় কথা, আলামিন ভাই গায়ে গতরে বিশাল সাইজের। দুষ্টু ছেলের দল আঁড়ালে আবডালে তাকে ‘আটার বস্তা’ বলে ডাকে। এই লোককে খেলায় নিলে মহাবিপদ। এর শক্তির কাছে বাকী সবাই নস্যে। কিন্তু উপায় কি আর!



পলাশ আমার কাছে গিয়ে সসঙ্কোচে জানতে চায় আলামিন ভাইকে খেলায় নিবে কিনা? আমি বুঝতে পারি না। আলামিন ভাইকে আমার ভয়। খেলার মাঠে আলামিন ভাই ছোটদেরকে ল্যাঙ মেরে পা ভেঙে দেন। ইচ্ছে করেই শরীর লক্ষ্য করে জোরে জোরে বল মারেন। সেই বল যেখানে লাগে সেখানে লাল চাকতির মতো গোল গোল দাগ পর্যন্ত পড়ে যায়। কিন্তু সারাদিন ওরা তিনজন এতো কষ্ট করেছে এই বলটার জন্য। এই রোদ মাথায় কিছু না খেয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটেছে! ওদের আনন্দটাকে চুরি করতে ইচ্ছে হলোনা আমার। আমি কাঁধ নাড়িয়ে সায় দেই।



খেলা শুরু হয়। পলাশের টিনটিনে শরীর। সে বল নিয়ে বাতাসের বেগে ছুটতে পারে। খেলা শুরু হতেই সে তিড়িং বিড়িং করে আলামিন ভাইকে কাটিয়ে একটা গোল দিয়ে দেয়। আলামিন ভাই ফুঁসে ওঠেন। খেপে যান তিনি। কয়েকবার চেষ্টা করেও পলাশকে ল্যাঙ মারতে পারেন না। টিনটিনে শরীরের পলাশ বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সরে যায়। আলামিন ভাই রাগে ক্ষোভে ষাড়ের মতো ফুঁসতে থাকেন। শেষমেস বল নিয়ে পলাশের দিকে তেড়ে যান। পলাশ ভয় পেয়ে যায়। আলামিন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা বুঝতে পারে। দৌঁড়ে মাঠের এক কোনায় কচুরিপানা ডোবাটার দিকে সরে যায়। কিন্তু আলামিন ভাই বল নিয়ে পলাশের পিছু পিছু ছুঁটতে থাকেন। ডোবার কাছাকাছি গিয়ে পলাশের আর সরে যাওয়ার জায়গা থাকে না। আলামিন ভাইয়ের মুখে মুহুর্তেই ক্রুর হাসি ফুটে ওঠে। তিনি দৌঁড়ে এসে শরীরের সব শক্তি দিয়ে সজোড়ে পলাশ কে লক্ষ্য করে কিক করেন বলে। আগুনের গোলার মতোন বলটা ছুটে যায় টিনটিনে পলাশের দিকে। কিন্ত পলাশ তার পলকা শরীরটা মুহুর্তে বা পাশে ছুঁড়ে দেয়। বলটা বিদ্যুৎ বেগে উড়ে যায়।



সেখানে সারি সারি খেজুর গাছ। গাছের মাথায় সজারুর শরীরের মতো অজস্র কাঁটা। বলটা উড়ে গিয়ে সেই বিভৎস, ভয়ংকর কাঁটার ভেতর আটকে যায়। চকচকে বলটার পুরো শরীর জুড়ে বেঁধে গজালের মতো ভয়ঙ্কর তীঘ্ন কাঁটা। বলের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে ফুসফুস শব্দে বের হয়ে যেতে থাকে বাতাস। আমি আমার মচকে যাওয়া পা নিয়ে, তীব্র ব্যাথা নিয়ে ছুটে আসি। খেজুর গাছের মাথায় কাঁটাবিদ্ধ পাম্প বিহীন নেতিয়ে পড়া বলটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি আমি। তাকিয়েই থাকে। আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। আমি আমার পায়ের দিকে তাকাই। পায়ের গোড়ালিটা বিভৎসরকম ফুলে আছে। ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে আমার শরীর। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমি শ্বাস নিতে পারি না।



আমার চোখের ভেতর জ্বালা করে ওঠে। আমি হঠাৎ মাটিতে শুয়ে পড়ি। সুঁচালো সবুজ ঘাসগুলো আমার শার্ট ভেদ করে সারা শরীরজুড়ে যন্ত্রণায় বেঁধে। কিলবিল করে। আমি চোখ বন্ধ করি। দু’ফোঁটা জল বেরোতে গিয়েও চোখের পাপড়ি ভিজিয়ে স্থির হয়ে রয়। আমি তাকাই। উপরে সীমাহিন আকাশ। কি বিশাল। কি গভীর। কি শূন্য। কে আছেন ওখানে?



আমার ভয় হতে থাকে। আমি নিজেকে আর খুঁজে পাই না। আমার নিজেকেও শূন্য মনে হয়। সব কিছু শূন্য মনে হয়। প্রার্থনার সকল সময়। শূন্য মনে হয়। শূন্য মনে হয়।



আমি আর কাঁদি না। অভিমানও করি না, আমার আর কোন অভিযোগ নেই। কারো কাছে নেই। আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি । আমার চোখ আর ঝাপসা হয়ে আসে না। আমার বুকের ভেতর কেবল তিরতির করে কাঁপতে থাকে। ভয় হতে থাকে। তীব্র ভয়। এই ভয়টা আর কখনোই পিছু ছাড়ে না। কখনোই না। আজও না। আমি নিজের ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাই। আমাকে সেই ভয়টা তাড়া করে বেড়ায়। তাড়া করে বেড়ায়। আজো তাড়া করে বেড়ায়। প্রতি মুহুর্তে তাড়া করে বেড়ায়।



স্বপ্নচুরির ভয়।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:২৩

স্বপনবাজ বলেছেন: খুব সুন্দর করে লিখেছেন!
ভালো লাগলো, ছোট বেলা মিস করি

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:২৫

সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

২| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:৩১

ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
চমৎকার লিখা। খুব ভাল্লাগসে ||

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৩

সাদাত হোসাইন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ! :)

৩| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:৪৩

শাকিল ১৭০৫ বলেছেন: চমৎকার হইছে

৪| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:৫০

সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ। :)

৫| ১৪ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৩:০৬

s r jony বলেছেন:
অসাধারন !অসাধারন !!

++++++++

১৪ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৩:১৬

সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ! ধন্যবাদ!!
:)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.