নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

সোবহান সাহেব মারা গেলেন

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:১৬

সোবহান সাহেব মারা গেলেন ভোর বেলা।



ঠিক ভোর বেলা না। ফজরের খানিক আগে। তিনি ওজু করে জায়নামাজেই বসে ছিলেন। আজান হলেই নামাজ পড়বেন। বেশ কিছুদিন ধরেই শেষরাতে তার ঘুম হতো না। তিনি মটকা মেরে বিছানায় পড়ে থাকতেন। কিন্তু শেষরাতে ঘুমের আশায় বিছানায় মটকা মেরে পড়ে থাকার মতোন যন্ত্রণার কিছু হয় না। এ সময় কান থাকে প্রবল সজাগ। আর বাকী পৃথিবী সুনসান। খুট করে শব্দ হলেও কানের ভেতর গিয়ে লাগে। সোবহান সাহেবের খাটের তলায় এক ধেঁড়ে ইদুর দিব্যি সংসার সাজিয়ে বসেছে। সোনার সংসার। সেই ইদুর শেষ রাতের দিকে নাতিপুতি নিয়ে ঠাকুরমার ঝুলি খুলে বসে। কুটকুট করে গল্প করে, নাকি গুড়-মুড়ি খায় কে জানে। কিন্তু সেই খুটখাট শব্দে সোবহান সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি প্রবল বিরক্তিতে উঠে হুশহাশ করেন। সুইচ টিপে বাতি জ্বালান। ধেঁড়ে ইঁদুরটা দলবল নিয়ে তার সামনে দিয়ে দুলকি চালে হেঁটে যায়। ফিরেও তাকায় না। যেন সেও জানে, এই বয়সে সোবহান সাহেবকে পাত্তা দেয়ার কিছু নাই।



তিনি জায়নামাজেই বসে ছিলেন। মারা যাওয়ার সময় সেই জায়নামাজেই শুয়ে পড়েছিলেন। বুকের বা দিকে একটা চিনচিনে ব্যাথা। ব্যাস, আর কিছু না। তিনি তখনো বোঝেন নি যে তিনি মারা যাচ্ছেন। বরং দিব্যি একটা আরাম আরাম ভাব লাগছিলো শরীর জুড়ে। এপ্রিলের কড়া গরমে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। আরামে তার চোখ বুঁজে আসছিলো। অথচ এখন কিনা দেখছেন তিনি মারা গেছেন। কি আশ্চর্য!



সোবাহান সাহেব সত্যি সত্যি আশ্চর্য হয়েছেন। আশ্চর্য হবার অবশ্য কারণও আছে। অতি যৌক্তিক কারণ। তিনি মারা গেছেন অথচ সব শুনতে পাচ্ছেন। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন সবকিছু। গুমগুম করে মেঘ ডাকছে আকাশে। দোতলায় কেউ চিৎকার করে কথা বলছে। যে খাটিয়াতে তিনি শুয়ে আছেন, সেই খাটিয়াকে ঘিরে দুটো বাচ্চা ছেলে দৌঁড়াচ্ছে আর ‘কু ঝিক ঝিক, কু ঝিক ঝিক’ শব্দ করছে। এমন কি পাশের বাড়ির দোতলা বা তিনতলা থেকে তীব্র শব্দে হিন্দি গান ভেসে আসছে, মুন্নি বদনাম হোয়ে, ডারলিং তেরে লিয়ে...।



এই হলো ঢাকা শহরের অবস্থা! পাশের বাসায় একটা মানুষ মারা গেছে অথচ এই নিয়ে কারো একটু সহানুভূতি পর্যন্ত নেই। থাকবে কি করে! প্রতিবেশীকে মানুষ চেনে না পর্যন্ত। মানুষের সম্পর্কগুলো দিন দিন কেমন ঠুনকো হয়ে যাচ্ছে। জীবিত থাকতে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতেন সোবহান সাহেব। শুধু ভাবতেনই না, এই নিয়ে তিনি পত্রিকাতে লিখেছেনও। লেখার শিরোনাম ছিলো, ‘সম্পর্কের সেকাল-একাল।’



আহা! সে কি সময়টাইনা ছিলো। মানুষের জন্য মানুষের কি টান! সোবহান সাহেবের বাবা মারা গেলেন মাঘ মাসের এক রাতে। হাড় কাঁপানো শীত। সেই শীতে বাঘ-মহিষ পর্যন্ত ঠকঠক করে কাঁপে। সোবহান সাহেবের বাবাই বলতেন,

‘পৌষের শীত মইষের গায়,

মাঘের শীত বাঘের গায়।’



সেই ‘বাঘ কাঁপা শীতে’ মারা গেলেন তারা বাবা। তাও মাঝরাতে। মানুষ তখন লেপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুম। সোবহান সাহেব শীতে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝো চাচার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর এক চিৎকারে তার ‘দাঁত কবাটি’। দাঁত কবাটি মানে দাঁতে কবাট লেগে এখন-তখন অবস্থা। কবাট হলো গিয়ে দরজা। অর্থাৎ সোবহান সাহেব পিতৃশোকে নিজেই দাঁতে দাঁত খিল লেগে যাই যাই অবস্থা। সেই রাতে আশে পাশের মানুষ লেপ-কাঁথা রেখে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলো। মৃতের দাফনের যোগাড়-যন্ত্র শুরু হয়ে গেলো। গাঁয়ের বৌ-ঝিয়েরা সুর করে ঘরের ভেতর মিহি স্বরে কোরআন শরিফ পড়ছে। শোকার্ত বাড়ির মানুষের খাওযা-দাওয়ার ব্যাবস্থা কি? এই বাড়িতে তো আর দিন তিনেক চুলায় আগুন জ্বালানো যাবে না।



কিসের রান্না কিসের কি! গামলার পর গামলা ভাত আসতে শুরু করলো সব বাড়ি থেকে। হোগলা পেতে লম্বা বারান্দার এক কোনায় ঢালা হতে থাকলো সেই ভাত। নানান রঙের ভাতের ছোট-খাটো একটা স্তুপ হয়ে গেলো সেখানে। গামলার পর গামলা শালুন। মাছ, মুরগীর শালুন। সাথে চালতা দেয়া ডাল। বাড়ি ভর্তি শত শত লোক। তারা সুর করে কাঁদছে। দোয়া করছে। মৃতের জীবতাবস্থার ভালো ভালো গুণের কথা বলছে। সেই ভাত-শালুনের স্তুপের পাশে লম্বা লাইনে বসে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। এই খাওয়া বেড়ে দেয়ার জন্য দু’চার জন নিজ দায়িত্বে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বাড়ির উঠানে বিশাল নামাজের জামাত হচ্ছে। সেই জামাতের নামাজ শেষে লম্বা মোনাজাত। মোনাজাতে কান্নার ঢেউ ওঠে। সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে অন্দর মহলেও। নারী-পুরুষের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। হয়তো পৌছে যায় সাত আসমানেও।



আহা! কি মরণটাই না ছিলো।



মরে গিয়েও সোবহান সাহেবের বুকের ভেতরটা আনচান করতে থাকে। বেঁচে থাকলে খুব দুঃখ দুঃখ ভাব নিয়ে হয়তো লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাসও দিয়ে ফেলা যেত।



সোবহান সাহেব শুয়ে আছেন সবুজ রঙের লোহার খাটিয়ায়। খাটিয়া আনা হয়েছে মোহাম্মদপুর জামে মসজিদ থেকে। সেই খাটিয়া রাখা হয়েছে বাসার সামনে যে ছোট্ট উঠান আছে সেখানে। পুরানো আমলের এই বাড়িটা সোবহান সাহেব বহু কষ্টে কিনেছিলেন। দোতলা বাড়ি। সামনে এক চিলতে উঠানও আছে। সেই উঠানের একপাশে দুটি আমগাছ, দুটি কামিনী ফুলের গাছ। এই গাছে ধবধবে সাদ ফুল ফোটে। পূর্ণিমার রাতে সেই ফুল জোছনার ফুল হয়ে ফোটে। সোবহান সাহেব চন্দ্রাহতের মতো তাকিয়ে থাকতেন। তার চোখভর্তি ঘোর। একটা পেয়ারা গাছও আছে। পেয়ারা গাছটার ডালপালা বাড়ির দোতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। কি নরম ছায়া এই গাছের। ছোট ছোট পেয়ারা ধরে গাছে, সেই পেয়ারা চিনির মতো মিষ্টি।



সোবহান সাহেব বেশ কয়েকবার লেবু চা-তে চিনির বদলে একটুকরো পেয়ারা ফেলে খেয়ে দেখেছেন। স্বাদ ভালো। তিনি এই চা মুগ্ধ হয়ে খেতেন। সমস্যা হচ্ছে, তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে এই চা তাকে খেতে হতো লুকিয়ে লুকিয়ে। ছেলে, ছেলের বৌরা দেখলে ঝামেলা আছে। তাদের ধারণা সোবহান সাহেবের মাথায় সমস্যা আছে। বয়স হলে এরকম সমস্যা অবশ্য সবারই একটু-আধটু থাকে।



সোবহান সাহেব সেই পেয়ারা গাছের তলায় খাটিয়াতে শুয়ে আছেন। খাটিয়া থেকে খানিকটা দূরেই রাবেয়া খাতুনের কবর। রাবেয়া খাতুন তার স্ত্রী। বছর তিনেক আগে মারা গেছেন। সোবহান সাহেবের ছেলেরা চেয়েছিলেন মায়ের কবর গ্রামে হোক। সোবহান সাহেবের জন্য পারেন নি। তিনি চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরেও ছেলে মেয়ের কাছাকাছি থাকতে। ব্যাস্ত ছেলে-মেয়েরা কবর দেখতে যে গ্রামের বাড়ি যাবে, সোবহান সাহেবের তা বিশ্বাস করেন না। তিনি একপ্রকার জোর করেই এই উঠানের একপাশে রাবেয়া খাতুনকে কবর দিয়েছেন। এবং ছেলে-মেয়েদের বলে দিয়েছিলেন, নিজের কবরও যাতে এখানে হয়। রাবেয়া খাতুনের পাশে।



শুয়ে থাকতে থাকতেই তার মনে হলো বাড়িতে একটা বড়ই গাছ লাগানো খুবই দরকার ছিলো। এই যে তিনি মারা গেলেন। এখন বড়ই পাতা দরকার হবে। ‘বড়ই পাতা গরম জলে, শোয়াইয়া মশারীর তলে...’। নাহ! কাজটা তিনি মোটেই ঠিক করেন নি। দুই দিনের দুনিয়ার চিন্তায় তিনি আসল চিন্তাই বাদ দিয়েছেন। এখন বড়ই পাতা এরা কই পাবে? ঢাকা শহরে এই জিনিস পেতে ভালো ঝামেলা হওয়ার কথা। এরা তার জন্য কোন ঝামেলা করবে বলে মনে হয় না। শেষ পর্যন্ত বড়ই পাতা ছাড়াই গোসল?



সোবহান সাহেবের বুক চিরে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোতে চাইলো। কিন্তু দীর্ঘশ্বাস কোত্থেকে বেরোবে? তারতো শ্বাসই নেই। মরা মানুষের আবার শ্বাস-দীর্ঘশ্বাস কি!



এই সময় গুমগুম করে আবার মেঘ ডেকে উঠলো। সোবহান সাহেব কিছুটা চিন্তিত বোধ করছেন। তিনি সব কিছু শুনতে পেলেও কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু তার অনুমানশক্তি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে। তিনি শব্দ শুনেই অনুমান করতে পারছেন অনেক কিছু। যেমন, তার খাটের চারপাশে ‘কু ঝিক ঝিক, কু ঝিক ঝিক’ শব্দে দুটি বাচ্চা ছেলে দৌঁড়াচ্ছে। কিন্তু এরা যে ছেলে, সেটা সোবহান সাহেবের জানার কথা না। বাচ্চা ছেলে-মেয়ের কণ্ঠ না দেখে আলাদা করা কঠিন। কিন্তু তিনি শুধু আলাদা করতেই পারছেন না। বরং বাচ্চা ছেলে দুটার বয়সও অনুমান করতে পারছেন। এমনকি বাচ্চা দুটোর গায়ের পোষাক পর্যন্ত। কমলা রঙের হাফপ্যান্ট পড়া ছোট ছেলেটা বেশী ত্যাদর। সে দৌড়ানোর সময় আবার হাত বাড়িয়ে সোবহান সাহেবের পায়ের পাতা ছুঁয়ে দিচ্ছে। সোবহান সাহেব অবশ্য সেই ছোঁয়া টের পাচ্ছেন না। পাবার কথাও না।



সোবহান সাহেব আকাশের মেঘ নিয়ে চিন্তিত। গুমগুম শব্দে মেঘ ডেকেই চলছে। যেকোন সময় বৃষ্টি নেমে যেতে পারে। এরা দেরী করছে কেন? করছে কি এরা? শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি নেমে গেলে কবরের ভেতর পানি ঢুকে যাবে। সেই কাদা পানিতে মাখামাখি হয়ে শুয়ে থাকতে কেমন লাগবে কে জানে! অনেককেই হয়তো এরকম কাদা বৃষ্টিতে কবরে যেতে হয়েছে। তাদের কেমন লেগেছিলো সেটা জানার উপায় অবশ্য নেই। আচ্ছা তারাও কি মরে যাবার পরে সোবহান সাহেবের মতো এমন করে সবকিছু শুনতে পেয়েছিলেন? চিন্তা করতে পেরেছিলেন?



সোবহান সাহেব আবার চিন্তায় পড়ে গেলেন। গভীর চিন্তায়। মরে যাবার পরে কি হয়, তা জানার কোন উপায় নেই। উপায় থাকলে ভালো হতো। অনেক রহস্যই জানা যেতো। সব লাশেরাই তার মতো করে ভাবতে পারে কিনা জানা যেতো। চূড়ান্ত রহস্য ভেদ হতো। অবশ্য চূড়ান্ত রহস্য ভেদ না হয়ে ভালোই হয়েছে। রহস্য ছাড়া জগৎ-সংসার জমে না। জগৎ-সংসার জমতে হলে রহস্য লাগে। রহস্য ছাড়া জগৎ-সংসার হয়ে যেতো নুন ছাড়া পান্তাভাতের মতো। শুধু নুন না, সেই পান্তা ভাতে পেঁয়াজ মরিচও নাই।



সোবহান সাহেবের লাশ মাটি দেয়া নিয়ে ঝামেলা হওয়ার কথা না। এই জন্য আজিমপুর গোরস্থানে যেতে হবে না। গ্রামেও না। তার কবরের জায়গা ঠিক করাই আছে। উঠানের এই পেয়ারা গাছের গোড়ায়ই তার কবর হবে। এটা সোবহান সাহেবের ইচ্ছা। ঘুমের মতোন শান্ত এই উঠান দেখেই বাড়ি কিনেছিলেন সোবহান সাহেব। অবশ্য এই উঠানওয়ালা বাড়ি নিয়ে ঝক্কিও তাকে কম পোহাতে হয় নি। সবারই শকুনের চোখ এই বাড়ির উপর। পাড়ার ছিঁচকে মাস্তান, রাজনৈতিক নেতা, ডেভালপার, এমনকি নিজের ছেলে-মেয়ে পর্যন্ত। পড়বেই বা না কেন?



এই শহরে এক আঙুল জমির দামও লাখ টাকা। এই উঠানওয়ালা বাড়িতো সেখানে আলাদীনের প্রদ্বিপ। সোবহান সাহেব বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন এই বাড়ি। বড় ছেলে আশফাক প্রমোটারদের দিয়ে বাড়ি এপার্টমেন্ট করার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলো। সামনের উঠানজুড়ে মোটামুটি একটা মার্কেটও করে ফেলা যায়। প্রমোটারদের দিলে তারা সব করে দিবে। সোবহান সাহেব শুধু বসে বসে টাকা গুনবেন। আশফাকের এই প্রস্তাবে বাকী তিন ছেলেরও সায় ছিলো। সোবহান সাহেব সব শুনতেন তারপর গম্ভীর স্বরে বলতেন ‘হুম’।



ওই ‘হুম’ এর বেশী কিছু সোবহান সাহেব আর বলতেন না। ছেলেরাও কিছু বলতে পারতো না। খেয়ে- না খেয়ে এই বাড়ি কিনেছে বাপ। তাদের আর কি বলার আছে? তারপরও ভেতরে ভেতরে তাদের প্লান-পরিকল্পনা যে চলতো না, তাতো না। সোবহান সাহেব সবই টের পেতেন। আর টের পেতেন বলেই কিনা কে জানে, টুপ করে রাবেয়া খাতুনকে কবর দিয়ে দিলেন পেয়ারা গাছের তলায়। সাথে বাড়ীটারও যেন একটা বন্দোবস্ত করে ফেললেন। যে মাটিতে মায়ের কবর, সে মাটি আর যাই হোক, কোদাল চালিয়ে উপড়ে ফেলাতো আর যায় না। দু’দিন বাদে সোবহান সাহেবও যখন শুয়ে পড়বেন নিজের স্ত্রীর পাশের কবরে, তখন আর কি! বাধ্য হয়ে অন্তত এই উঠানটুকু রাখতেই হবে ছেলেদের। দোতলা বাড়িটা ভেঙে তারা যা ইচ্ছা করুক। উঠানটা শেষমেশ টিকেই গেলো।



নিজের বুদ্ধির গর্বে আরেকটু হলেই সোবহান সাহেবের বুকটা ফুলে উঠতো। ভাগ্যিস তিনি বেঁচে নেই। শুয়ে আছেন খাটিয়ার ভেতর লাশ হয়ে।



কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এখনো ছেলেদের কারো খোঁজ-খবর পর্যন্ত নেই। দোতলা থেকে অনেকগুলো এলোমেলো কণ্ঠের চিৎকার চেচামেচির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন সোবহান সাহেব। এবং তার বেশ একটা ফুরফুরে লাগছিলো। তিনি মারা যাওয়ায় তার ছেলেরা তাহলে বেশ কান্নাকাটিও করছে! বাহ, এই না হলে মৃত্যু। নিজের ছেলে-মেয়েরা গলা ফাঁটিয়ে কাঁদবে। আশে পাশের লোকজন এসে শান্তনা দিবে। ছেলে-মেয়েরা কাঁদতে কাঁদতে বাবার গুণকীর্তন করবে, দু-চার বেলা না খেয়ে থাকবে। এসব দেখে মানুষজন আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলবে, আহারে, আহারে।



কিন্তু সোবহান সাহেব কিঞ্চিত হতভম্ব হয়ে গেলেন। যাকে তিনি এতক্ষণ কান্না ভাবছিলেন, আসলে তা কান্না না। চেঁচামেচি। মরে গিয়ে এই হয়েছে তার সমস্যা। আগে কানে যা শুনতেন এখন শুনছেন তার দশগুণ বেশী। শুনতে না চাইলেও শুনছেন। শরীর মরে গিয়ে সম্ভবত ইন্দ্রিয় সব জেগে উঠেছে। কিন্তু ছেলেরা চেঁচামেচি করছে কেন? অ্যাম্বুলেন্স আনার কথা হচ্ছে কেন? তিনি কি তাহলে এখনো বেঁচে আছেন? সোবহান সাহেব বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তিনি কি তাহলে এ যাত্রা বেঁচে গেলেন? কিন্তু মরেতো খারাপ লাগছিলো না তার। বেশ একটা উপভোগ্য ব্যাপার-স্যাপার। কষ্ট-টষ্টও তেমন নেই। আসলেইতো, মৃত্যুতো এমন সহজ হওয়ার কথা না। তাহলে কি তিনি বেঁচে আছেন? সোবহান সাহেব মোটামুটি ভালো রকমের বিপদে পড়েছেন। তিনি বুঝতেই পারছেন না, তিনি বেঁচে আছেন না মরে গেছেন।



সোবহান সাহেব কিছুটা ঝিম মেরে গেছেন। বৃষ্টিটা মনে হয় শুরুই হয়ে গেলো। কিন্তু কেউতো তার দিকে খেয়ালই করছে না। এই মাত্র টুপ করে দুফোটা বৃষ্টি পড়লো তার বুকের বা দিকটায়। ওরা তাকে বৃষ্টির মধ্যেও বাইরে শুইয়ে রাখবে নাকি! তিনি যদি মরে গিয়ে না থাকেন তাহলে ওরা তাকে বাইরে এনে শুইয়ে রেখেছে কেন? এই যে বৃষ্টি হচ্ছে, ওরা কি দেখছে না? এই প্রথম তার যেন খানিকটা দুঃখ দুঃখ লাগতে লাগলো। অ্যাম্বুলেন্সে কি তাকে হাসপাতালে নেওয়া হবে? কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স আনা নিয়ে এতো দেরী হচ্ছে কেন? সেই তখন থেকে সবাই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কথা বলছে, কিন্তু এতা দেরী হচ্ছে কেন? সোবহান সাহেব আর কিছু ভাবতে চাইলেন না। তিনি ঝিম মেরে গেছেন।



উপরের চেঁচামেচির শব্দগুলো ক্রমশই নিচে নেমে আসছে। তার চার ছেলেই আছে। তাদের কথা শুনে বোঝা গেলো অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করে দেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স চলে আসবে। সোবহান সাহেব খুশি হবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। তবে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ছেলেদের ছোটাছুটি দেখে তার খারাপ লাগছে না। বরং ভালোই লাগছে। ছেলেরা তাহলে চাচ্ছে তাদের বাবা বেঁচে থাকুক।



‘কি হলো বাবারা, লাশ আর কতক্ষণ এমনে ফালায় রাখবা? বিষ্টি-বাদলা শুরু হয়া গেলোতো।’ মসজিদের ইমাম সাহেবের গলা।



কিন্তু ইমাম সাহেব তাকে লাশ বলছেন কেন? সোবহান সাহেব আবারো চিন্তত হয়ে পড়লেন। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি কি তাহলে সত্যি সত্যিই মারা গেছেন? ইমাম সাহেব তাকে যেহেতু লাশ বলে সম্বোধন করেছেন, তারমানে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স কেন তাহলে?



‘সিদ্ধান্ত নিতে একটু দেরী হয়ে গেলো ইমাম চাচা।’ সোবহান সাহেবের বড় ছেলে আশফাকের গলা শোনা গেলো।



‘কি সিদ্ধান্ত বড় বেটা?’ ইমাম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।



‘আব্বার লাশ গ্রামে দাফন হবে। এই সিদ্ধান্তর জন্যই দেরী হয়ে গেলো চাচা। অ্যাম্বুলেন্সে লাশ নিয়া যাব। অ্যাম্বুলেন্স আসতেছে।’



সোবহান সাহেব দিব্যি বুঝতে পারছেন, আশফাকের পাশেই দাঁড়ানো তার বাকী তিন ছেলে। ছোট ছেলেটা অফহোয়াইট একটা পাঞ্জাবী পড়েছে। সেই পাঞ্জাবীতে কেউ পানের পিক ফেলেছে। দাগটা কটকট করছে। আশফাকের কথা শেষ হবার আগেই অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনতে পেলেন সোবহান সাহেব। অ্যাম্বুলেন্স এসেছে। গেট খোলারও শব্দ হলো।

‘কিন্তু সোবহান সাবতো বলছিলো এইখানেই তার কবর হইবো?’ ইমামের বিস্মিত কণ্ঠ টের পান সোবহান সাহেব।



‘হ চাচা, আব্বাতো বলছিলো। কিন্তু এইটুক উঠানে দুই দুইটা কবর হলে আরতো জায়গাই থাকে না। কি করবো বলেন চাচা! আমরা চার চারটা ভাই। বাচ্চা-কাচ্চা বড় হচ্ছে। অনেক কিছুই বিবেচনা করতে হয়।’



আশফাক থামে। কেউ কোন কথা বলে না। ইমাম সাহেবও না। মেঝো ছেলে মুশফিকের গলা খাকড়ির আওয়াজ শোনা যায়। আশফাকই আবার শুরু করে, ‘আমরা চার ভাই-ই আলাপ আলোচনা করছি। গ্রামেতো কোন অসুবিধা নাই। অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে। পাড়া-প্রতিবেশী আছে। আর আমরাতো বছর বছর যাবই...।’ কথাটা শেষ করে না আশফাক। বুঝতে পারে না কথাটা বলা ঠিক হলো কি না। আশফাকের কথার রেশ যেন থেকে যায়। এক ধরনের প্রতিধ্বনি হয় নিঃশব্দতায়।



নিরবতা ভাঙেন ইমাম সাহেব, ‘হ, সেইটাই মিয়ারা। মরা লাশের আবার শহর গ্রাম কি? সাড়ে তিন হাত মাটি পাইলেই হইলো। বেশি মাটি দরকার আমাগো, আমরা যারা বাইচা আছি। ড্রইং রুম, বেড রুম, ডাইনিং রুম, রিডিং রুম আরো কত রুম দরকার।’ একটু থামেন ইমাম সাহেব, তারপর বলেন, ‘যাও তাইলে বাবারা, বেলা থাকতে থাকতে রওনা দেও।’ ইমাম সাহেব দ্রæত পায়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তার স্যান্ডেলের শব্দ পর্যন্ত টের পান সোবহান সাহেব।



সোবহান সাহেবের কেমন একটা ঘোর ঘোর লাগে। তিনি ধীরে ধীরে যেন সকল শব্দ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। চারপাশের শব্দগুলো যেন ক্রমশই অস্পষ্ট হয়ে যেতে থাকে। এই সময় খাটিয়াটা নড়ে ওঠে। খুব ধীরে। সোবহান সাহেব স্পষ্ট টের পান, তার খাটিয়াটা নড়ছে। খাটিয়াটা উঠছে। চার ছেলের শক্ত চওড়া কাঁধে সোবহান সাহেবের পলকা শরীরটা সহজেই উঠে যায়। অ্যাম্বুলেন্সের গেট খোলার শব্দ হয়। সোবহান সাহেব চার ছেলের শক্ত কাঁধে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন। উঠান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। ওরা কি তাহলে এই উঠানটা আর রাখবে না? দুটো আম গাছ, দুটো কামিনী গাছ এবং একটি পেয়ারা গাছ পেছনে পড়ে থাকে। সোবহান সাহেব চলে যাচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন। তিনি টের পাচ্ছেন তিনি দূরে কোথাও চলে যাচ্ছেন, দূরে। বহুদূরে। তিনি আর কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না।



সব কিছু কেমন নিস্তব্ধ, শব্দহীন। হঠাৎ কেমন তীব্র একটা ইচ্ছে হলো সোবহান সাহেবের। রাবেয়ার কি হবে? রাবেয়া খাতুনের? তার প্রবল ইচ্ছে হতে থাকলো খাটিয়ার ফাঁক দিয়ে রাবেয়া খাতুনের কবরটা একবার দেখার। একবার। পেয়ারা গাছটার গোড়ায়। একবার। কিন্তু কি করে দেখবেন



সোবহান সাহেবতো মারা গেছেন।

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +১১/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:২৪

আিম এক যাযাবর বলেছেন: সুন্দর হয়েছে গল্প, প্রথম ভালো লাগা এবং +++++.

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৩০

সাদাত হোসাইন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। :)

২| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৩৬

সানফ্লাওয়ার বলেছেন: মরা লাশের আবার শহর গ্রাম কি? সাড়ে তিন হাত মাটি পাইলেই হইলো। বেশি মাটি দরকার আমাগো, আমরা যারা বাইচা আছি। ড্রইং রুম, বেড রুম, ডাইনিং রুম, রিডিং রুম আরো কত রুম দরকার।’
ঠিকই বলেছেন। অনেক কষ্ট লাগছে লেখাটা পড়ে।

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৪৬

সাদাত হোসাইন বলেছেন: আপনার অনুভূতি ছুঁতে পেরেছি জেনে ভালো লাগলো...
:)

৩| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৪১

ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
বাহ, বেশ চমৎকার গল্প।
কিন্তু তার অনুমানশক্তি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে।-ঠিক করে নিয়েন।

ওয়েল ডান ||

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৪৪

সাদাত হোসাইন বলেছেন: ইন্সপায়ার্ড। অনেক ধন্যবাদ। আর বানান সংশোধনীর জন্য কৃতজ্ঞতা। :-)

৪| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৪৫

প‌্যাপিলন বলেছেন: গল্পে ভাল লাগা। তবে কিছু বিষয়ে বৈপরিত্য পোষণ করি। পরবর্তী প্রজন্মটা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকুক সেটাই কাম্য। আত্নসুখের কারণে, স্মৃতির মায়ায় পড়ে তাদের তাদের মতো করে প্রবাহিত হওয়াটাতে বাধা কাম্য নয়।যদিও গল্পতো গল্পই।

আর গল্পের ভাষা বেশ প্রাঞ্জল ও সুখপাঠ্য।

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৪৭

সাদাত হোসাইন বলেছেন: মতামতের জন্য ধন্যবাদ :-)

৫| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:১৫

লিন্‌কিন পার্ক বলেছেন:
অনবদ্য ++++

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:৩৪

সাদাত হোসাইন বলেছেন: ভালো লেগেছে জেনে অনুপ্রাণিত হলাম। অনেক ধন্যবাদ। :-)

৬| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:৪৩

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন:


++++++

১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:৫৪

সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৭| ১৪ ই মে, ২০১৩ দুপুর ২:৫৬

বাংলাদেশী দালাল বলেছেন:
পুরাটা পড়তে পারলাম না। মন খারাপ হয়ে গেল। বাকিটা পরে পড়ব।


প্লাস

৮| ১৪ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৩:০১

সাদাত হোসাইন বলেছেন: পুরোটা পড়া পর্যন্ত অপেক্ষায় রইলাম, সাথে পুরো অনুভূতিরও। ধন্যবাদ।
:-)

৯| ১৪ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৩:৪০

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: দারুণ গল্প। অবশ্য এই গল্পের ভাব অনুসারে এই বিশেষণটা ব্যবহার করা উচিত হল না, বলা উচিত দারুণ বিষন্ন গল্প। ভাল লেগেছে।

১৪ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৩:৫৭

সাদাত হোসাইন বলেছেন: আপনার বলার ধরনটা ভাল লাগলো।
ইন্সপায়ার্ড।
অনেক ধন্যবাদ।
:)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.