নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বোধ

২০ শে মে, ২০১৩ দুপুর ২:৩০

১.

ভরা বরষার মৌসুম।

বরষা মানে বরষা। কান ঝিম্ মেরে দেয়া বরষা। একটানা পনের দিন বৃষ্টি। রাত দিন একাকার। এই বৃষ্টি যে অদূর ভবিষ্যতে থামবে তার কোন লক্ষণ নেই। টিনের চালের বৃষ্টি- ঝিম্ম্ম্ ঝিম্ম্ম্। একটানা শব্দ। বৃষ্টির তিন দিনের মাথায় সবার কান তব্দা। সেই তব্দা দেয়া কানে একটা মাত্র শব্দ, ঝিম্ম্ম্, ঝিম্ম্ম্। আমি তখন হাফপ্যান্ট পড়া টিনটিনে বালক। লম্বা সরু সরু পা। সেই পা দেখে আমার নানি প্রায়ই শ্লোক বলেন-



‘বাঁশের কঞ্চি, কইঞ্চা

হইয়া গেলো ধইঞ্চা

ধইঞ্চা দিয়া বরই পারি

পড়েনা বরই, লারি চারি...’



এতই শুকনা যে তা দিয়ে গাছের বড়ইও পাড়া যায়না, শুধু নেড়ে চেড়ে দেখা যায়।



শার্টের কলারের পাশ দিয়ে আমার কন্ঠার হাড় দেখা যায়। সেই উঁচু কন্ঠার হাড়ের ফাঁকে নাকি আধসের চাল ধরে। আমার কাজ হলো টেনে টুনে সেই উঁচু কন্ঠার হাড় শার্টের কলার দিয়ে ঢেকে রাখা। আর সুযোগ পেলেই বড় চাচাদের ঘরে ঢুকে পড়া। ঘরে ঢুকে জানালার ফাঁক দিয়ে আমি আমার টিনটিনে লম্বা পা জোড়া বের করে দেই। ছটাৎ ছটাৎ ইয়া বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে সেই টিনটিনে পায়ে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। আর অবাক হয়ে শুনি টিনের চালে ঝিম্ম্ম্ ঝিম্ম্ম্ একটানা শব্দ।



বৃষ্টির শব্দ। আহা!!



আমাদের বাড়িতে দুটো ঘর। আমাদের আর বড় চাচাদের। বড় চাচাদের ঘরখানা টিনের। এই ঘর শফিক ভাই করে দিয়েছে। শফিক ভাই বড় চাচার ছেলে। ঢাকায় চাকরি করেন। বছরে একবার দু’বার আসেন। শেষ কয়েক বছর আর আসে নি। শফিক ভাইয়ের বউ গ্রামের কাদা জল সহ্য করতে পারে না। তাদের একটা ছেলেও আছে। ছেলের নাম বোধন। বছর তিনেক বয়স। এবার নাকি শফিক ভাইয়ের বউ গ্রামের বর্ষা দেখতে চেয়েছে। খবর শোনার পর থেকে বড় চাচীর আর বিরাম নেই। সকাল-সন্ধ্যা তুমুল আয়োজন। নারকেলের চিড়ে করেন, নানা রকম পিঠে। বড় পাতিল ভর্তি পানি দেয়া জিওল মাছ- শৌল, শিং, কৈ। ফুলতোলা প্লেট, গ্লাস, বাটি, বিছানার চাদর। চাচীর সাথে সমান তালে ছোটে রুবি বুও। রুবি বু শফিক ভাইয়ের ছোট বোন। আমার চেয়ে বছর পাঁচেকের বড়। তবু তার সাথে আমার রোজ ঝগড়া হয়। রুবি বুর বেণী করা চুলের ভেতর আমি কাকরোলের খোসা গুঁজে দেই। রুবি বু রেগে মেগে আমাকে তাড়া করে। কিন্তু টিনটিনে আমি হাওয়ার আগে ছুটি। রুবি বু’র সাধ্য কি ছোয়?



রুবি বু অবশ্য আমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেয় না। সেবার বড় চাচাদের ঘরে দুপুরে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম থেকে উঠে ঘরে আসতেই মা রে রে করে তেড়ে আসলেন। আমিতো অবাক। হয়েছে কি? মা আমাকে টেনে নিয়ে তার হাতের তালুতে আটকানো ছোট আয়নাখানায় মুখ দেখতে দিলেন। আমি হতভম্ব। ঘুমের মধ্যে রুবি বু আমার অর্ধেক মাথা কামিয়ে ন্যাড়া করে দিয়েছে!



সেই রুবি বুও শফিক ভাই আসবে শুনে হরিণীর মতো ছুটছে। দুটো ধবধবে সাদা বালিশের কভারও বানিয়ে ফেলেছে। সেই কভারে লাল-সবুজ সুতোয় লেখা ‘সুইট ড্রিমস’। আর শফিক ভাইয়ের ছোট্ট ছেলেটার জন্য কি সুন্দর টুকটুকে লাল ছোট্ট একটা বালিশের কভার। তারওপর কাঁচা হাতে লেখা ‘বোধ বাবা’।



রুবি বু বোধনের ‘ন’ দিতে ভুলে গেছে। বোধন হয়ে গেছে বোধ!



বড় চাচাদের ঘরখানা চৌচালা। সামনে পেছনে খোলা বারান্দা। সেই বারান্দায় এখন বড় চাচার হাঁস, মুরগী, ছাগল আর কালো একটা গাই থাকে। এই কুচকুচে কালো গাই। গাইয়ের নাম কালু। কালুর পেট ফুলে ঢোল। আজ কালের মধ্যেই বিয়োবে কালু। বড় চাচা মানত করেছেন, একটা বকনা (মেয়ে) বাছুর হলে ময়দানের মসজিদে দু’খানা ডাব আর চার সের দুধ দিয়ে আসবেন। চাচী দু’রাকাত নফল নামাজও মানত করেছেন। এবারের বরষায় মুরগীর খোপ আর গোয়াল ঘর ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। বড়চাচা তাই সবগুলোকে বারান্দায় তুলে এনেছেন। গাইয়ের চারপাশে যত্ন করে শুকনো খড় বিছিয়ে দিয়েছেন। ভেঁজা স্যাতস্যাতে মাটি যাতে গাইটাকে ছুঁতে না পারে।



আমাদের ঘরখানা ছনের। একটানা দুদিন বৃষ্টি হলেই আর রক্ষে নেই। শুকনো ছনের আড় ভেঙে যায়। বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে এখানে সেখানে। প্রথম প্রথম সেই জায়গাগুলোতে থালা বাটি পাতেন মা। তার দুদিন পরে গামলা। একসময় গামলাতেও আর কাজ হয়না। বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ে ছনের চাল। বাঁশের বেড়া। কেবল আমার বাবা ভেঙে পড়েন না। তিনি সেই ভাঙা ছনের চাল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আবার জোড়া লাগান। সাথে জোড়া লাগান প্লাস্টিকের বস্তা। রিলিফের টিন। আমার ঘরে মন বসেনা। স্যাঁতস্যাতে ভেঁজা ঘর। ঘরের মেঝেতে উঁকি দেয় বিশাল কেঁচো। ভাতের প্লেটের ভেতর লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ। আরশোলা। আমি তাই ছটফট করি বড় চাচাদের খটখটে শুকনো ঘরে যেতে। মাথার উপর চকচকে টিনের চাল। সেই চালে ঝিমমম ঝিমমম বৃষ্টির শব্দ। সেই শব্দে আমার কান তব্দা দেয়না। আমি মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনি। সাথে শুনি বড় চাচার পুঁথি পাঠ আর অদ্ভুত সব গল্প।



সেই গল্প পাতার, পাখির, প্রাণের, জীবনের।



বড় চাচা ‘প্রাণের’ মানুষ। ‘অবলা প্রাণের’। গাছ, পাখি, পশু বড় চাচার প্রাণ। রাস্তায় যে নেড়ি কুত্তাটা সকাল-সন্ধ্যা তারস্বরে ঘেউ ঘেউ করে। বড় চাচার পায়ের শব্দে সেও কুইকুই স্বরে মাথানিচু করে দৌঁড়ে আসে। তারপর বাধ্য ছেলের মতো গুটিগুটি হেঁটে যায় তার পিছু। বড় চাচা প্রতি সন্ধ্যায় পুকুর পাড়ের জামতলায় বসে থাকেন। দশাসই শরীরের কালো গাইটা দড়ি ছিঁড়ে তেড়েফুঁড়ে এসে বড় চাচার পাশে মাটিতে আধশোয়া হয়ে বসে। তারপর মাথাটা এলিয়ে দেয় তার কোলে। বড় চাচা আলতো হাতে ওর মাথায় হাত বুলান, কানে হাত বুলান, ঘাড়ে, পেটে, গলায় হাত বুলান। কালু চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে শুয়ে থাকে। বড় চাচার শক্ত হাত বিলি কেটে দেয় ওর শরীরের কালো চকচকে রেশম লোমে। হাতখানা খানিক থামতেই কালুর মাথা নড়ে ওঠে। আলতো ঢুঁস মারে বড় চাচার কোলে। কালো গাইয়ের শরীর জুড়ে বড় চাচার হাত আবার নড়ে ওঠে।



সে হাতভর্তি মমতা, সে হাতভর্তি ভালোবাসা।

(চলবে)



'বোধ' গল্পের এটি প্রথম পর্ব, আপনি দ্বিতীয়, তৃতীয় ও শেষ অংশ পড়তে ক্লিক করুনঃ

দ্বিতীয় পর্বঃ

Click This Link

তৃতীয় পর্বঃ

Click This Link

শেষ পর্বঃ

Click This Link

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.