নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বোধ (৩)

২০ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:০৩

৩.

‘আনু, এই আনু। ওঠ্ ওঠ্।’



বড় চাচার ডাকে আমার ঘুম ভাঙে। আমি তড়িঘড়ি বিছানা ছাড়ি। বাইরে জমাট অন্ধকার। বড় চাচা তার বড় গামছাখানা দিয়ে আমার মাথা, পিঠ, বুক ঢেকে দেন। বাইরে বেরিয়েই চমকে ওঠেন তিনি। একরাতেই বন্যার পানি বেড়ে প্রায় ঘরের দাওয়ায় এসে ঠেকেছে। বড় চাচার মুখে চিন্তার ছায়া। তিনি আপনমনে বিড় বিড় করেন, ‘আল্লাহ, পানি না জানি এইবার আর কতো বাড়ে!



সাবধানে নৌকার গলুইয়ে আমাকে বসিয়ে দেন বড় চাচা। চাচী এবং রুবিবু এখনো ঘুমে। বড় চাচা হাঁক দিয়ে চাচীকে ডাকেন, ‘শফিকের মা, ও শফিকের মা।’



‘হ, কন।’ ভেতর থেকে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে সাড়া দেন চাচী।



‘তুমি খাওন দাওন রেডি করো, আমি শফিকরে লইয়া আসতেছি।’ বলেই ছোট্ট লাফে নৌকায় চড়েন বড় চাচা। অন্ধকারে নৌকার গলুইয়ে বসে আমি বড় চাচার দুলতে থাকা শরীরটা দেখি।



চারদিকে থই থই পানি। এবার নিশ্চয়ই বড় বন্যা হবে। বড় চাচা নৌকা ঘুড়িয়ে বাড়ির পেছন দিকে নিয়ে আসেন। পানি প্রায় ঘর ছুঁই ছুঁই। বড় চাচা বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেন। তারপর অন্ধকারেই আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘যুইত কইরা বয় দেহি আনু। দেখি গঞ্জে যাইতে কতক্ষণ লাগে। ঢাকার লঞ্চ আহনের আগেই পৌঁছাইতে হইবো।’



বড় চাচার হাতের বৈঠাখানা নড়ে ওঠে। ‘ঝুপ’ শব্দটা কানে আসে ঠিক তখুনি। কিছু একটা পানিতে পড়েছে কোথাও। কিন্তু বৈঠার শব্দে খুব একটা আলাদা করা যায়না শব্দটা।



‘বড় চাচা, পানিতে কি কিছু পড়লো? শব্দ হুনছেন?’ আমি বড় চাচাকে জিজ্ঞেস করি।



‘হ, হেরামই কিছু একটা হুনলাম মনে হয়।’



‘কি পড়লো?’



পূবাকাশ তখন খানিকটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু বাড়ির পাশেই ঘন বাঁশঝাড়ে অন্ধকার হয়ে আছে জায়গাটা।



‘এই আন্ধারেতো কিছু দেখা যাইবোনারে। আর তোর ভাইয়ের লঞ্চও চইলা আইবো।’



-‘মাছ টাছ হইবো মনে হয়।’ বড় চাচার তাড়া দেখে আমি তাকে আশ্বস্ত করি।



-‘হ, তাই হইবো। পানি যেমনে বাড়তেছে, গ্রামের সকলের পুকুরই ডুইবা গেছে মনে হয়। পুকুরের মাছ এহন সব বানের পানিতে।’



বড় চাচা দ্রুত বৈঠা মারেন। আমি আধো-অন্ধকারে কালো পানিতে তাকিয়ে থাকি। এলোমেলো ঢেউ। ভোরের নরম হাওয়ায় শরীর কেমন অ™ভুত শীতলতায় আচ্ছন্ন হয়। আমি গলুই থেকে পা বাড়িয়ে আঙুলের ডগায় পানি ছুঁই।



ইশ্ কি ঠান্ডা!





৪.

শফিক ভাই টুপ করে নৌকায় উঠে পড়ে। তার কোলে বোধন।



বড় চাচা কয়েকবার চেষ্টা করলেন নাতিকে কোলে নিতে। কিন্তু বোধন কোনভাবেই গেলো না। সম্ভবত বড় চাচার লম্বা এলোমেলো দাড়ি তার পছন্দ হয়নি। বিপত্তি বাঁধে ভাবীকে নিয়ে। সে শহুরে মেয়ে, কোনমতেই নৌকায় উঠতে পারে না। শেষ পর্যন্ত বোধনকে আমার কাছে দিয়ে শফিক ভাই ভাবীকে প্রায় কোলে করে নৌকায় তোলে। নৌকার পাটাতনে পাতা পাটিতে জড়সড় হয়ে বসে ভাবী। আতংকিত চোখ জোড়া পানিতে। ঢেউ তেমন নেই বললেই চলে। কিন্তু নৌকা খানিক দুলে উঠতেই ভাবীর চোখ মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। শফিক ভাই এবং বড় চাচা, দুজনই ভাবীকে অভয় দেন। কিন্তু ভাবীর ভয় তাতে কিছু কাটে বলে মনে হয় না।



ভাবী এক হাতে শক্ত করে নৌকার পাটাতন খামচে ধরে আছে, আরেক হাতে শফিক ভাইকে। আমি বোধনকে শফিক ভাইয়ের কাছে দিয়ে আবার নৌকার গলুইয়ে গিয়ে বসি। শফিক ভাই কেমন গম্ভীর হয়ে আছে। আগের সেই হাসিখুশি ভাবটা আর নেই।



আমাকে দেখে কেমন নিরস গলায় বললো, ‘কিরে আনু, কিছু খাস না নাকি? এমন পাটখড়ি হয়ে গেছিস কেন?’



অন্যসময় হলে হয়তো শফিক ভাইয়ের এমন কথায় আমি হেসে গড়াগড়ি খেতাম। কিন্তু শফিক ভাইয়ের এবারের কথা বলার ধরনে কিছু একটা ছিল। আমি কেমন জড়সড় হয়ে গেলাম। কোন উত্তর দিলাম না। শফিক ভাই অবশ্য উত্তর আশা করেছে বলে মনেও হলো না।



সে বড় চাচার দিকে ফিরে জানতে চাইলো, ‘বাবা, তোমার শরীরটা ভালো?’



‘হ, ভালোই। খালি ঠান্ডাডা একটু ঝামেলা করে।’



‘বাবা, বাড়িতে আসতে অনেক ঝামেলা। এই এতো কাদা পানি ডিঙাইয়া বাড়ি আসন যায় কও?’

শফিক ভাই বড় চাচার শরীর নিয়ে আর কিছু বলে না। বছর বছর বাড়ি আসা তার জন্য কতো ঝামেলার তা বোঝানোর চেষ্টা করে সে।



-‘তারওপর দেখছোতো বাবা, তোমাগো বউয়ের অবস্থা, নৌকায় চড়তে পারে না, পানি খাইতে পারে না। বোধনেরও এই পানি সহ্য হয় না, গোসল করতে পারে না।। কি যে করবো আমি!’



-‘কি আর করবি? বুড়া বাপ-মা যদ্দিন আছে, একটু কষ্টতো করতেই হইবো।’ বড় চাচার গলার স্বর নরম। সেই নরম স্বরের কোথায় যেন থইথই কান্না। পাথর জমাট কষ্ট।



‘শোন এইবার তোগো ভাল্লাগবো।’ বড় চাচা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন। ‘কালো গাইডা দুয়েকদিনের মধ্যেই বিয়াইবো। খাঁটি দুধ খাইতে পারবি। টাউনেতো খাঁটি দুধ বলতে কিছু নাই। কি না কি খাস! তারওপর নতুন বাছুর দেখলে আমার দাদাভাইয়েরও ভাল্লাগবো।’



‘এই গরু বাছুর নিয়া তোমাগো এতো আদিখ্যেতা আমার ভাল্লাগেনা বাবা। পারলেতো দেখি রাইতে কোলে নিয়া ঘুমাও। আর এইগুলার মধ্যে ভুলেও বোধনরে নিবা না বাবা।’



‘কেন রে শফিক, তোর মনে নাই, ছোডবেলায় তুই সাদা ধবধবা বাছুর দেখলে কি করতি?’



বড় চাচার কথা শেষ হয় না। শফিক ভাই চড়া গলায় বলে ওঠে, ‘ওইসব পুরান কাসুন্দি বাদ দাওতো বাবা, ছোড বেলায়তো তোমার মতোন নৌকা বাইয়া গরুর লইগা ঘাস কাটতেও গেছি। এহন কি আর...।’



হঠাৎ থেমে যায় শফিক ভাই। কথাটা বলা ঠিক হয়নি বুঝে মাঝপথে চুপ মেরে যায়।

বড় চাচা ফে ফে করে হাসেন। সেই হাসিতে বড় চাচাকে বড্ড বোকা বোকা লাগে। বড় চাচাকে ভীত, ন্যুজ্ব এক জরাগ্রস্ত মানুষ মনে হয়। একসময় বড় চাচার হাসি থেমে যায়। শফিক ভাই, ভাবী, আমি, আমরা কেউ কোন কথা বলি না। সবাই যেন বুঝে ফেলি এখন নৈঃশব্দের সময়।



অস্বস্তিকর নিরবতায় বৈঠার একটানা ছলাৎ ছলাৎ শব্দ খুব কানে বাজে।



(চলবে)

'বোধ' গল্পের এটি তৃতীয় পর্ব, পুরো গল্পটি পড়তে ক্লিক করুনঃ

প্রথম পর্বঃ
Click This Link

দ্বিতীয় পর্বঃ Click This Link

শেষ পর্বঃ

Click This Link

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:৪৫

একজন সুখীমানুষ বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন। গল্প লেখার হাত আপনার অসাধারন। চালিয়ে যান।

২২ শে মে, ২০১৩ রাত ১০:৩৬

সাদাত হোসাইন বলেছেন: আপনি কি জানেন, আপনার এই ছোট্ট মন্তব্যটা কি ভীষণ অনুপ্রেরণা আর আত্মবিশ্বাস জোগাল!!
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
:)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.