নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বোধ (শেষ পর্ব)

২২ শে মে, ২০১৩ সকাল ১১:৫২

৫.

বাড়ির কাছে আসতে আসতে গনগনে সূর্য তেতে উঠে। টানা বরষা শেষে পরিষ্কার আকাশ। শফিক ভাই আর ভাবী নৌকা থেকে কিভাবে নামবে তাই নিয়ে ভাবছিলাম আমি। বড় চাচা দেখি পুকুর পাড়ের দিকে ঘুড়িয়ে নিয়েছে নৌকা। ওদিকটায় দুটো কাটা খেজুর গাছের অস্থায়ী ঘাট আছে। নৌকা থেকে লাফিয়ে সেই ঘাটের ওপর শুকনো জায়গায় নামা যায়। বড় চাচা খুব সাবধানে সেখানে নৌকা ভেড়ালেন। তারপর নিজে হাঁটু পানিতে নেমে নৌকাটাকে শক্ত করে জামগাছটার সাথে বাঁধেন।



‘মা আর রুবি কই বাবা? আমি আসবো ওরা জানে না?’



শফিক ভাইয়ের গলায় স্পষ্ট বিরক্তি। আমারও খানিকটা অবাক লাগে। শফিক ভাই বউ নিয়ে ঢাকা থেকে আসবে, সাথে আসবে বোধন। এতোদিন ধরে চাচী আর রুবি বু’র এতো আয়োজন, অথচ কই ওরা? ওদেরতো পুকুরপাড় এসে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। বড় চাচাও খানিকটা অবাক হয়েছেন। তিনি কলাগাছের ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোথাও কেউ নেই। কেমন থমথমে চারপাশ। আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠলো। বড় চাচা গলা চড়িয়ে ডাকলেন, ‘রুবিনা, ও রুবিনা। ও শফিকের মা, কই তোমরা?’



কিন্তু কোথাও কোন সাড়া নেই।



বড় চাচা আবারো চেঁচালেন, ‘ও শফিকের মা, ও রুবিনা, কই তোরা? শফিকতো বউ লইয়া আইয়া পড়ছে, আমার দাদাভাইও আসছে।’



কোন সাড়া নেই কোথাও। শফিক ভাই বোধনকে কোলে নিয়ে নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ালো। তার ফর্সা মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। বড় চাচা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তার কপাল কুঁচকে আছে। তিনি হাঁটু পানি থেকে উঠলেন। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কাদায় মাখামাখি। সেই কাদা মাখা পা নিয়েই তিনি বাড়ির দিকে এগুলেন, ‘রুবিনা, কই তোরা? তোর ভাইতো আইয়া পড়ছে।’



আমি টুপ করে নৌকার গলুই থেকে নেমে বড় চাচার পিছু নিলাম। শফিক ভাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে ঘুমাচ্ছে বোধন। নৌকার উপর শক্ত হয়ে বসে আছে ভাবী। তার আগুন চোখের সামনে শফিক ভাইকে কেমন দিশেহারা লাগছে।



আমি দৌঁড়ে এসে বড় চাচার পাশে হাঁটতে থাকি। বড় চাচা ফের গলা চড়িয়ে ডাকতে যাবেন ঠিক তখনই কান্নার শব্দটা কানে আসে। বড় চাচীর গলা! চাচী চিৎকার করে কাঁদছেন। সাথে আরো কেউ। হ্যা, রুবি বু। এবার স্পষ্ট কান্নার শব্দ। রুবি বু আর বড় চাচী চিৎকার করে কাঁদছে। দৌড়ে সামনের খোলা বারান্দাটা পার হই আমি আর বড় চাচা। পেছনের বারান্দার কাছে এসে থমকে দাঁড়াই আমি। বড় চাচা দৌড়ে যান ছোট্ট জটলাটার কাছে। আমি পায়ে পায়ে আগাই।



পেছনের বারান্দার মেঝেতে রুবি বু দু’পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার কোলের ওপর সাদা ধবধবে একটা বাছুর। চোখ দুটো খোলা। নিঃসাড়। বড় চাচী বাছুরের পা দুখানা দুহাতে আগলে ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন। পাশে আঁচলে মুখ চেপে বসে আছেন মা। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন শূন্য চোখে। বাছুরটার পুরো শরীর জল-কাদায় মাখামাখি। মিইয়ে যাওয়া পশমী শরীর থেকে ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা জল। ভিজে যাচ্ছে খড়, বিচালি, মাটির মেঝে। পাশেই সদ্য প্রসূতি কালু রক্তমাখা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার মাটিতে পা ঘষছে কালু। অস্থির হয়ে আছে পুরো শরীর। ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন বড় চাচা। তারপর ছোঁ মেরে রুবি বু’র কোল থেকে নিয়ে নিলেন বাছুরটা।



রুবি বু চিৎকার করে বড় চাচাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো, ‘বাবা, তুমি যহন বাইর হইছো, তহনই কালু বিয়াইছে বাবা। কালুর বাছুরডা পানিতে পইরা গেছিলো। আমরা কেউ দেহি নাই বাবা, কেউ দেহি নাই।’



মৃত বাছুরটার কাদা-জলে মাখামাখি ছোট্ট শরীর তখন শক্ত হয়ে গেছে। সরু সরু চারখানা টিনটিনে পা ক্রমশই ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে আসছে।



বড় চাচা পাগলের মতো জান্তব স্বরে গোঙাতে লাগলেন, ‘না, না, না, না, না...।’ তার শক্ত হাতগুলো ক্রমশই বাছুরটার প্রাণহীন টানটান সোজা পাগুলো ভাঁজ করে দিতে থাকে। কিন্তু মৃত বাছুরটার শরীর সাড়া দেয় না। বড় চাচার মুখ থেকে বের হওয়া গোঙানিও তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, ‘না, না, না, না...।’



‘বাবা! মা!’



শফিক ভাইয়ের কণ্ঠে সবাই ফিরে তাকায়। বোধনকে কোলে করে পেছনের বরান্দায় এসে কখন দাঁড়িয়েছে শফিক ভাই, আমরা কেউ টেরই পাইনি। পাশে আধভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাবী। শফিক ভাইকে দেখে যেন বাঁধ ভাঙে বড় চাচার। চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন তিনি, ‘বাবারে, এইডা আমি কি করলাম! এইডা কি করলাম আমি! আমি নিজ হাতে বাছুরডারে খুন করলাম। নিজ হাতে।’



বড় চাচী, রুবি বু, বাবা, মা, আমি, আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই, ‘কি বলছে বড় চাচা!’



বড় চাচা বাছুরটার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরেন, তারপর চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন, ‘আমি নিজ হাতে তোরে খুন করছি, নিজ হাতে খুন করছি।’



হঠাৎ আমার দিকে চোখ ফেরান বড় চাচা, বাছুরটার মুখের সাথে নিজের গাল চেপে ধরে কেঁদে ওঠেন, ‘আনুরে, ও আনু, বেয়ান বেলা পানিতে কিছু পড়নের যেই আওয়াজ তুই হুনছিলি তহনই ও হইছে, তহনই ও পানিতে গিয়া ঝুপ কইরা পড়ছে রে আনু। আনুরে, আমি তহন কেন গিয়া দেখলাম না, কেন দেখলাম না।’



বড় চাচা দুই হাতে থপাথপ বুক চাপড়াতে থাকেন। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মৃত বাছুরটার চোখজোড়া তখনও তাকিয়ে আছে। কাজল কালো জল ছলছলে একজোড়া চোখ।



আমি সেই চোখে তাকিয়ে থাকি। আমি চোখ ফেরাতে পারি না।



বড় চাচা শফিক ভাইকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। বড় চাচার হাত ছাড়িয়ে হঠাৎ কঠিন গলায় চেঁচিয়ে ওঠেন শফিক ভাই, ‘অনেক হইছে বাবা, অনেক হইছে। আমার এই বাড়িতে আসাটাই ভুল হইছে। একটা বাছুরের জন্য তোমরা জীবন দিয়া দিতেছো। আর এইযে আমি এতোদিন পর বাড়িত আসছি। আমার এইটুক ছেলে আসছে, বউ আসছে, তোমাগো কাছে হের কোন মূল্য নাই! আমাগো চেয়ে তোমাগোর কাছে একটা পশুর মূল্য এতো বেশি?’



সব ক’জোড়া চোখ নিমেষে শফিক ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকায়। প্রচন্ড রাগে শফিক ভাইয়ের কপালের শিরা ফুলে আছে। শফিক ভাই ঘুমন্ত বোধনকে ভাবীর কোলে দিয়ে বারান্দার মাঝখানে এসে দাঁড়ায়। তারপর চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘মা, রুবি, তোমরা জানো না আজকে আমি আসতেছি? অগোরে নিয়া আসতেছি, জানো না তোমরা?’



বড় চাচার কান্না পুরোপুরি থেমে গেছে। কালুর সামনে রাখা খড়ের গাদার উপর বসে পড়েছেন তিনি। শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন শফিক ভাইয়ের দিকে।



‘একটা গরু-ছাগলের বাচ্চার জন্য তোমাগো যতোটা মায়া হেইডাতো মনে হয় আমার ছেলের জন্যও তোমাগো নাই। আমার ছেলের জন্য দূরের থাক, আমার জন্যও নাই।'



বড় চাচী, রুবি বু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে শফিক ভাইয়ের দিকে। কারো মুখে কোন কথা নেই। শফিক ভাই রুবি বু’র হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো, তারপর ভাবীর কোলে ঘুমন্ত বোধনকে দেখিয়ে বললো, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, কেমনে কইরা ঘুমাইতেছে।’ ভাবীকে দেখিয়ে বললো, ‘আর এই মহিলাডারে দ্যাখ, নৌকার তন নামতে গিয়া কেমনে গোসল কইরা উঠছে। আর তোরা এইখানে একটা মরা বাছুর লইয়া পূজা করতেছোস! এই বাড়িতে আমি কেন আসমু? ওরা কেন আসবো?’



রুবি বু, বড় চাচী, বড় চাচা সবাই যেন নড়তেও ভুলে গেছে। স্থির হয়ে আছে প্রতিটি শরীর। শফিক ভাই যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন, ‘কি, তোমরা কেউ নড়বা না এইখান থেইকা? পূজা করবা? পূজা? এই মরা বাছুর লইয়া পূজা করবা?’ নিচু হয়ে বাছুরটার একটা কান ধরে মৃত শরীরটা টেনে টেনে বারান্দার এক কোনায় নিয়ে গেলো শফিক ভাই।



কালু কি বুঝলো কে জানে। গলায় বাঁধা দড়িটা ছেড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো। সামনের পা দুখানা সজোরে ঠুকতে থাকলো মাটির সঙ্গে। আকাশ ফাঁটিয়ে চিৎকার করে উঠলো, ‘হাম্বাআআআ!’ সে চিৎকারে কান্না ছিলো, তীব্র কষ্ট ছিলো, আর্তনাদ ছিলো।

আর কি কিছু ছিলো?



বড় চাচা পাথর হয়ে বসে আছেন। যেন কোন মানুষ নন, একটা প্রাণহীন খড়ের গাদা। খোলা বারান্দার মাটির মেঝে ছুঁই ছুঁই বন্যার পানি। তীব্র স্রোতে আরো পানি বাড়ার আভাস। শফিক ভাই তার চকচকে চামড়ার জুতো পড়া পায়ের এক ধাক্কায় বাছুরটার মৃত শরীরটা ফেলে দিলো জলের স্রোতে, ‘নেও, এইবারতো হইছে। পূজা শেষ। এহন ঘরে চলো।’



বাছুরটার শরীর ঝুপ করে পড়লো পানির স্রোতে, তারপর ডুবে গেলো। এবং সাথে সাথেই অদ্ভুতভাবে শান্ত হয়ে গেলো কালু। একদম শান্ত। বোধনকে ভাবীর কোল থেকে নিয়ে শফিক ভাই ঘরে গেলেন। মা বাবা চুপচাপ চলে গেলেন ঘরে। খানিক বাদে রুবি বু, বড় চাচীও। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম বারান্দার বাইরে, আমগাছটায় হেলান দিয়ে। আর বড় চাচা কালুর সামনে খড়ের গাদায় চুপচাপ বসে আছেন। তার শূন্য দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে, বাছুরটার মৃত শরীর যেখানে ডুবেছে, ঠিক সেখানে। কালুও। কালুর বড় বড় চোখ দুটো পলকহীন তাকিয়ে আছে পানির স্রোতে। কান্না কিনা জানি না, তবে ওর চোখের কোল ভিজে আরো কালো হয়ে আছে। কালুর চোখ পৃথিবীর সুন্দরতম চোখ। ওই চোখে আমি রোজ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।



কিন্তু সেই চোখে আজ চোখ পড়তেই আমি ভয়ে কেমন কুঁকড়ে গেলাম।



৬.

ভোরের এখনো অনেক বাকী।



কিন্তু আমার ঘুম ভেঙে গেছে। শেষরাতে ঠান্ডা পড়েছে বলেই হয়তো। একটা পাতলা কাঁথা হলে ভালো হতো। আরাম করে ঘুমানো যেত। বড় চাচা অবশ্য আরাম করেই ঘুমাচ্ছেন। দেখে ভালো লাগছে। গত দুরাত একফোঁটা ঘুমান নি। বানের পানি বেড়েছে হু হু করে। উঠান ডুবে গেছে পুরোপুরি, বারান্দার খানিকটাও। গতকাল সন্ধ্যায় ঘরের ভেতরও পানি উঠে গেছে। শেষ পর্যন্ত মা-বাবাও এঘরে উঠে এসেছেন। সেদিনের পর, শফিক ভাইয়ের বাছুরের ঘটনা নিয়ে আর কোন কথা বলেনি কেউ। কেউ না।



বড় চাচাও যেন সব ভুলে গেছেন। সারাদিন কাজ, কাজ আর কাজ। উঠোনে বাঁশের উঁচু মাচা বেঁধেছেন। সেখানে তুলে দিয়েছেন হাঁস-মুরগীর খোপ। বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে প্লাস্টিকের নীল পলিথিন দিয়ে সেই খোপ ঢেকেও দিয়েছেন। ধানের গোলা উঁচু করেছেন আরো। ঘরের চৌকিগুলোও। ছোট নৌকাখানা আলকাতরা মেখে শুকাতে দিয়েছেন। বড় বন্যার প্রস্তুতি!

কালুর ঘরেও পানি ঢুকেছে গতকাল। আমাদের ছনের ঘর থেকে চৌকিখানা এনে তারওপর কালুকে তুলে দিয়েছেন বাবা। কালুর কাছে একদিন আর যান নি বড় চাচা।



আমাকে বলতেন কালুর জন্য খড়, খইল, ভূসি দিয়ে দিতে। কালুকে দেখলে আমার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। সেটা ভয় না কষ্ট আমি জানি না। আমি কালুর কাছাকাছি যাই না। দূর থেকে কালুকে খাবার দিয়ে চলে আসি। কালু সামান্য খড় মুখে নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে খড়ের ভেতর। ওর চোয়াল ক্রমাগত নড়ে। ক্ষণে ক্ষণে শরীরটা মৃদু কেঁপে ওঠে। চোখের নিচের অনেকটা জায়গা জুড়ে গাড় কালো ভেজা দাগ। আমি বড় চাচাকে কিছু বলি না। বড় চাচাও আমাকে না। আমরা কেউই কাউকে না।



শফিক ভাই, ভাবি আজ চলে যাবেন। বড় চাচাকে ঘুম থেকে ডাকা দরকার। চাচা বলেছিলেন আলো ফোটার আগেই বের হবেন। নৌকা করে গঞ্জে দিয়ে আসতে হবে শফিক ভাইদের।

আমি বড় চাচাকে ডাকি, ‘চাচা, চাচা, ওঠেন। বেয়ান হইতে চললো মনে হয়।’



আমার আলতো ডাকেই বড় চাচা উঠে বসেন। তার চোখের কোথাও ঘুমের চিহ্ন নেই। বড় চাচা কি তাহলে ঘুমান নি?



‘তুই ঘুমাস নাই আনু?’ বড় চাচার গলা কি শান্ত!



‘ঘুম ভাইঙা গেলো চাচা।’ আমিও উঠে বসি। জামাটা মাথা গলিয়ে গায়ে জড়াই।



‘পানি তো আরো বাড়ছে রে আনু।’ বড় চাচা দড়ির উপর ঝোলানো গামছাটা কাঁধে ফেলেন। তারপর লুঙ্গিটা হাঁটুর উপর তুলে দু’ভাঁজ করে কোমড়ে বাঁধেন। ‘চল, নৌকাটা বাইর করি। আজান দিলে নামাজডা পইড়াই বাইর হইতে হইবো।’



বড় চাচী, রুবি বুও উঠে পড়েছেন। বড় চাচা রুবি বুকে ডেকে বলেন শফিক ভাইকে তুলে দিতে। আমি বড় চাচার হাত ধরে পানিতে নামি। ঠান্ডা! দরজার বাইরে আবছা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পানি ঠেলে আগাই আমরা। পেছনের বারান্দার সাথে আমগাছে নৌকাটা বাঁধা। চাচা আমাকে দুহাতে উঁচু করে নৌকায় তুলে দেন। তারপর বৈঠায় ভর দিয়ে নিজেও উঠে পড়েন। ভাঁজ খুলে হাঁটুর নিচে নামিয়ে আনেন লুঙ্গি। নৌকা থেকে কিছুটা ঝুঁকে বন্যার পানিতেই অজু সারেন বড় চাচা। এখনো আজান হয়নি। খানিকটা আলোকিত পূবাকাশ। সেই আবছা আলোয় আমি পেছনের বারান্দায় তাকাই। সেখানে চৌকির উপর শুয়ে আছে কালু। মৃদু নড়ছে ওর মাথা। বড় চাচা কাঁধের গামছা বিছিয়ে বসে পড়েন আজানের অপেক্ষায়। ভোরের তাজা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে ওঠে বড় চাচার লম্বা দাড়ি। নৌকার খুব কাছেই টুপ করে লাফিয়ে ওঠে ছোট মাছ। শান্ত পানিতে মৃদু ঢেউ ওঠে। ঢেউগুলো ছড়িয়ে পড়ে পুরো উঠোন জুড়ে। সেদিকে তাকিয়ে বড় চাচা জিজ্ঞেস করেন, ‘বেয়ান তো হইয়া আইলো, এহনো আজান হয় না কেন রে আনু?’



এই সময় চিৎকারটা কানে এলো। আকাশ ফাঁটানো চিৎকার।



‘বোধন! বোধন!!



যেন প্রবল ভয়ে আরো কেঁপে ওঠে উঠোনের ঢেউ। যেন ঝনঝন ভেঙে যায় ঘুমন্ত ভোর। শফিক ভাই, ভাবী, বড় চাচী আর রুবি বু’র চিৎকারের কণ্ঠগুলো আর আলাদা করা যায় না। আমি পাগলের মতো মাথা ঘুরিয়ে তাকাই। খোলা দরজা দিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মতো ছুটে আসছে রুবি বু। তার বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরা ভেজা চুপচুপে ছোট্ট এক শরীর। বোধন! বোধনের গা থেকে গলগল করে ঝরে পরছে পানি। কমলা রঙের উলের জামার ভেতর থেকে বোধনের ছোট্ট পেটখানা বেঢপ ফুলে আছে। রক্তহীন সাদা ফ্যাকাশে মুখ। প্রাণহীন!



‘বাবা, বোধন! বোধন! বোধন নাই বাবা! বোধন রাইতে পানিতে ডুবছে বাবা!’ রুবি বু যেন উন্মাদ।



পেছনে পাগলের মতো ছুটে আসছেন বড় চাচী, ভাবী, শফিক ভাই। হতবুদ্ধ বড় চাচা যেন ঘোরের মধ্যে নৌকা থেকে নামেন। ছলকে ওঠা জল ভিজিয়ে দিলো পুরো শরীর। রুবি বু কাটা গাছের মতো ঝাপিয়ে পড়লো বড় চাচার বুকে। বড় চাচার শক্ত হাত দুখানা বোধনের ছোট্ট শরীর বুকে চেপে ধরে।



শফিক ভাইয়ের গলায় জান্তব আর্তনাদ, ‘বোধন, ও বোধন, ও বাবা, বাবা, আমার বোধন, আমার বোধন!’ শফিক ভাই যেন পুরোপুরি উন্মাদ। বড় চাচার গায়ের ভেজা জামাটা শক্ত হাতে ধরে টানছেন আর গোঙাচ্ছেন। বড় চাচা খুব ধীরে, খুব ধীরে বা হাতে শফিক ভাইকে কাছে টানলেন।

আল্লাহু আকবার... আল্লাহু আকবার...



ফজরের আজান হচ্ছে। বড় চাচা কোমর পানিতে বোধনকে বুকে চেপে দাঁড়িয়ে আছেন। খোলা চোখ জোড়া শূন্যে। শূন্য, নির্বাক, স্থির। শফিক ভাই বোধনের গালের সাথে গাল চেপে ধরে তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো, ‘বোধন! আমার বোধন।’ ঠিক সেই সময় বজ্রস্বরে গলা ফাঁটালো কালু, ‘হাম্বাআআআ...! হাম্বাআআআ...!’ শফিক ভাই আর কালুর তীব্র চিৎকারে কেঁপে কেঁপে উঠলো ভোরের আকাশ। ভোরের বাতাসে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল কালু আর শফিক ভাই। দুটো কণ্ঠ যেন আর আলাদা করা যায় না।



আমগাছের ডাল থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে গেলো একজোড়া নিশাচর পাখি।



-------------------------------- শেষ---------------------------------------------



'বোধ' গল্পের এটি শেষ পর্ব, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশ পড়তে ক্লিক করুনঃ

প্রথম পর্বঃ


Click This Link

দ্বিতীয় পর্বঃ

Click This Link

তৃতীয় পর্বঃ

Click This Link

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে মে, ২০১৩ রাত ৯:৫৯

একজন সুখীমানুষ বলেছেন: পুরো গল্পটি একবারে দিলে বেশি ভালো হতো। তারপরেও দ্রুতই সবগুলি পর্ব দিয়েছেন। সমস্তটাই দারুন লেগেছে।

২২ শে মে, ২০১৩ রাত ১০:৩২

সাদাত হোসাইন বলেছেন: আসলে গল্পটা একটু বড় বলে একসাথে দিতে সাহস করিনি, একসাথে দেয়ার কথা যে ভাবিনি, তা-না, কিন্তু শেষপর্যন্ত ঐযে, সাহস করে উঠতে পারিনি, এখন আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, একসাথে দিলেই বোধহয় ভালো করতাম।
আপনি যে পুরোটাই ধৈর্য ধরে পড়েছেন, এবং শেষ পর্যন্ত বলেছেন "সমস্তটাই দারুন লেগেছে" এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
:)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.