নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বন্ধু

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:১৫

বীভৎস দৃশ্য!



মানুষটা হা করে আছে, সেই হা দিয়ে ভয়ংকর গো গো শব্দ বেরুচ্ছে। অনবরত লালা ঝরছে মুখ বেয়ে। সে কথা বলতে পারে না। শুধু যে কথা বলতে পারে না, তা- না। তার হাত পা-ও সব উল্টো দিকে বাঁকা। অদ্ভুতভাবে শরীর বাঁকিয়ে হাঁটে। চিবুকের নিচে কয়েক গোছা দাড়ি। এবং মাথায় টুপি। খানিক পরপর মাথা এলিয়ে পেটের কাছে নিয়ে আসে। এবং অদ্ভুত স্বরে গুঙিয়ে ওঠে। তারপর সেই বাঁকা হাতেই চক দিয়ে পোড়া মাটির হাড়ির উপর হিজিবিজি দাগ কাটতে থাকে।



সেই দাগ দেখে কিছু বোঝা অসম্ভব! কিন্তু লোকটার সাথে কৃশকায় এক মহিলা, তিনি মিনিট দুয়েক সেই দাগের দিকে তীঘ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত গলায় বললেন, 'আফনের নাতির বিপদ আছে, মহাবিপদ, বিপদ আসবে পানি পথে'।



আমার দাদী, যাকে আমি বু বলি, তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, 'ওই মাতারী, কি কও এইগুলান? আমার নাতির বিপদ হইব কোন দুঃখে?'



বু'র কথার উত্তরে মহিলা চটাং করে উঠলেন, 'লুলা ফকির হাঁড়িতে যা লিখছে, আমি তাই কইছি। হাড়ির দাগ দেইখা যা ঠাহর পাইছি, তাই কইছি, বিশ্বাস অবিশ্বাস আফনের ব্যাপার'।



দাদী যেন খানিক ভয় পেলেন। তিনি খপ করে মহিলার হাত ধরে বললেন, 'চ্যাতো ক্যান? উনারে আরেকবার আমার নাতীর বিপদ আপদ গুইন্যা কইতে কও'।



সে আবারও চটাং করে জবাব দিল, 'পারুম না। ম্যালা টাইম দিছি আফনেরে। হের টাইমের মুল্য আছে। গ্রামে আরও বহুত বাড়ী যাওন লাগতো। আফনে হাদিয়া দেন, হাদিয়া নিয়া বিদায় হই। একটা মুরগা, দুই সের ধান আর নগদ ৫ টাহা'।



দাদী আর কিছু বললেন না, তিনি উঠে গিয়ে ঘর থেকে ধান, মুরগীর খোপ থেকে মুরগী, আর তার জমানো টাকার কৌটা থেকে ৫ টাকা এনে মহিলার হাতে দিলেন। মহিলা লুলা ফকিরকে সাথে নিয়ে হেঁটে উঠোন পেরিয়ে বাড়ির বার হলেন। বু তার কোঁচকান চামড়ার চোখ জোড়া তুলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।



অত্যাচার শুরু হল আমার উপর। আমার তখন ৬/৭ বছর বয়স। বু সেই ছয় সাত বছরের আমাকে রোজ কোলে নিয়ে পুকুরে নামেন, কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে সকাল বিকাল সাঁতার শেখান। আমার ঠাণ্ডায় হেঁচকি ওঠে, কিন্তু বু'র তাতে কিছু মায়া হয় না। তিনি আমাকে বিশ্বসেরা সাতারু বানাবেন! লুলা ফকিরের ভবিষ্যৎবাণী তার নাতির পানি পথের বিপদের সকল পথ রুদ্ধ করবেন!



প্রচেষ্টা কাজে লেগেছে। আমি দিব্যি একালের মাইকেল ফেলপস হয়ে উঠলাম অল্পদিনেই। খাল, বিল, পুকুর দাপিয়ে বেড়াই। যেন জলে ভেসে যাওয়া মাছের শরীর। বর্ষাকাল আমার পৌষমাস। সেই পৌষমাস জুড়ে আমি হয়ে যাই জলবালক। জলের ভেতর বাস এক দুরন্ত জলজ। কিন্তু সারাটা ক্ষণ বু তীঘ্ন দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করেন না। পাছে সেই পানিপথের মহাবিপদ ঘটে যায়। ভাগ্য তখন অবধি ভালো, মহাবিপদ কেন, জলের ভেতর কোন বিপদই ঘটে না। বরং ক্রমশই আমি যেন হয়ে উঠি জলচর।



হটাৎই একদিন বু'র কঠিন নির্দেশ, 'ভাই, তুমার হাতর (সাঁতার) শেখন শ্যাস হইছে। এইডা আছিল সাবধান হওনের লাইগ্যা। যাতে বিপদ আপদ আইলে পানির লগে যুদ্ধ করতে পারো। অক্ষন থেইকা আর পানিত যাওন যাইব না। দরকার না পড়লে পানির কাছ থেইকা দূরে থাকবা'।



আমি করুণ চোখে একবার বু'র দিকে তাকাই, একবার জলের দিকে। জলের কিন্তু জিতে যাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। সবচেয়ে বেশি জয়ের ক্ষমতা চোখের জলের। তবে এবার আমার জলপ্রেম বু'র কঠিন নির্দেশের কাছে অবলীলায় হেরে গেলো। আমি জলচ্যুত হলাম। নির্দেশে নির্বাসন!



দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। চুপিচুপি কখন যেন সেই লুলা ফকিরের কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি। আমি, আম্মা, আব্বা এমনকি বুও। মাঠে ফুটবল খেলা শেষে আমি তাই অবলীলায় ঝাঁপিয়ে পরি পাশের নদীর জলে। ফুটবল নিয়ে দাপাই স্কুলের বিশাল তালপুকুর। সে কি উচ্ছ্বল জীবন! আহা! জল মানেই জীবন!



কিন্তু জল যতটা জীবন ঠিক ততটাই বোধ করি মৃত্যুও।

কোন এক বর্ষার মেঘলা দুপুর। আমি সবে জ্বর থেকে উঠেছি। দুর্বল শরীর। কিন্তু বাড়ীর পাশের আড়িয়াল খাঁ তখন প্রমত্ত যুবক। তার দুইকুল জুড়ে থৈ থৈ জল। আমার কিংবা আমাদের সকলের চোখ চকচক করে ওঠে। আহা, আড়িয়াল খাঁ। আমি, অলিল, পলাশ, রিয়াদ, সবুজ দুপদাপ ঝাঁপিয়ে পড়ি আড়িয়াল খাঁ'য়। তীব্র স্রোত দেখে রোখ চেপে যায় সবার।



সবুজ হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে, 'ল, হাতোর (সাঁতার) দেই, পাল্লা দিয়া, যে আগে গাঙ পার হইয়া অইপার যাইতে পারবো, হেরে আমগো গাছের দুইডা লাল জাম্বুরা মাগনা দিমু'।



এর চেয়ে লোভনীয় কিছু হতে পারে? পারে না।

ইশ সেই জাম্বুরা!! টসটসে লাল জাম্বুরা!



ওরা মুহূর্তে লুঙ্গীতে মালকোঁচা মেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রমত্ত স্রোতে। আমি জ্বরের কথা ভুলে যাই। দুর্বল শরীরের কথা ভুলে যাই। যেন পাখির মত মনে হয় আমার নিজেকে। টুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ি। প্রবল স্রোত কেটে মাছের মতো এগিয়ে যাই। নদীর মাঝখানে। পেছনে তাকিয়ে দেখি অলিল, সবুজ, পলাশ অনেকটা দূরে। আমি মাথা ঘুড়িয়ে আবার হাত পা ছুড়ি। হেহ! ওরা আসতে আসতেতো আমি আরও একবার ফিরে যেতে পারবো! আমি উল্লাসে পা ছুড়ি। ওই তো দূরে ঘাসের সবুজ গালিচায় ছেয়ে আছে আড়িয়াল খা'র পাড়।



ওইতো!



হঠাৎ কি হল কে জানে! আলগা হয়ে গেলো লুঙ্গির কোমরের শক্ত বাঁধন। আমি প্রাণপণে সাঁতরাচ্ছি। জ্বরে দুর্বল শরীর হঠাৎ বিদ্রোহ করে ওঠে। যেন আর পারেনা! কিন্তু ফার্স্ট আমাকে হতেই হবে! পেছনে চিৎকার, গালি, উচ্ছ্বাস। আমার চোখের সামনে দূরে আড়িয়াল খাঁর তীর। আচমকা টের পাই, আমার কোমর থেকে খুলে লুঙ্গী জড়িয়ে গেছে পায়ে। মুহূর্তেই শীরদাড়ায় ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি আমার সবটুকু শক্তি দিয়ে হাত পা ছুড়লাম। চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি, চেষ্টা করছি... কিন্তু আমি ক্রমশই ডুবে যাচ্ছি, ডুবে যাচ্ছি আড়িয়াল খাঁয়... আমি চিৎকার করতে চাই... মুখের ভেতর গলগল করে ঢুকে পড়ে আড়িয়াল খাঁর ঘোলা পানি, আমার কাশি পায়... প্রবল ঢেউ এসে ঝাঁপটা মাড়ে মুখে! আমি ছিটকে যাই অনেকটা। একবার ডুবে যাই... আমার ভেসে উঠি। আবার ডুবে যাই। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার মায়ের বকুনীর কথা মনে পড়ে... বু'র উৎকণ্ঠিত চোখের কথা মনে পড়ে! মমতার্দ্র মুখের কথা মনে পড়ে... কিন্তু আমি ডুবে যাই... ডুবে যাই। এবং ডুবে যাই। আমি শ্বাস নিতে পারি না। আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। আমার আর কিছু মনে থাকেনা... শুধুই আড়িয়াল খাঁ... শুধুই জল।



এই জল জীবন নয়, মৃত্যুর, ভয়ের, সমাপ্তির।



এই জল লুলা ফকিরের ভবিষ্যৎবাণীর?

আমার আর কিছু মনে পড়ে না। চারপাশ জুড়ে অদ্ভুত অন্ধকার, ভয়, ক্লান্তি, মৃত্যু। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে তলিয়ে যাই, ভেসে যাই, এবং ভেসেই যাই... নিঃশব্দে, মৃত্যুতে...



কোথায় আমি?

পেটের ওপর কারো তীব্র চাপ পেয়ে জেগে উঠি।



চোখ মেলে তাকাই, ঝাপসা চোখ...আড়িয়াল খাঁ? প্রথমে কিছুই দেখিনা... তারপর ঝাপসা মুখগুলো ক্রমশই উজ্জ্বল হয়... পলাশ, অলিল, সবুজ, রিয়াদ... আমার পেটের ভেতর আবারও চাপ টের পাই... মুখ দিয়ে গলগল করে পানি বেরোয়... কেউ একজন মুখের ভেতর মুখ গুজে দেয়, বাতাস দেয়, আমি হা করে শ্বাস টানি... বুক ভরে শ্বাস নেই... আহ বাতাস! আহ আলো! আহ জীবন!! আমি চোখ মেলে তাকাই, আমার মাথার উপরে আকাশ। আকাশের উপরে কতোগুলো মুখ! সেই মুখ গুলো জুড়ে কী তীব্র কান্না! কি তীব্র আকুলতা! উৎকণ্ঠা! আমি আবার তাকাই।পলাশ হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, অলিল গায়ের সকল শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে, হাউমাউ করে কাঁদে... কাঁদে... আর কাঁদে... আমাকে অবাক করে দিয়ে সবুজ চটাস চটাস চুমু খায়। রিয়াস হঠাৎ আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে 'আল্লাহ! ও আল্লাহ!' ওর চোখভর্তি ছলছল জল। আমি তাকাই, আমার গা ভর্তি বালী... মুখ ভর্তি বালী, চোখ ভর্তি বালী... আমি আবার চোখ বন্ধ করি... চোখের ভেতর চোখ ভেসে ওঠে... অতোগুলা চোখ... পলাশ, অলিল, সবুজ... যা আমি আগে কখনো দেখিনি... এমন করে কখনও না...



এমন ভালোবাসায়...

এমন মমতায়...

এমন উৎকণ্ঠায়...



আর কখনও দেখি নি।

আমি কিছু বলিনি, কিছুই না। কেবল অদ্ভুত চোখে তাকিয়েছিলাম। অদ্ভুত চোখে!



কিন্তু আজ, কোন এক ঘুমভাঙা রাতে, টুপটাপ শিশিরের শব্দে, বর্ষার জলে, বুকের ভেতর হঠাৎ কোন এক অচিনপুরের পাখি চুপিচুপি এসে ফিসফিস করে ঠিক ডেকে যায়, 'বন্ধু, কে আছিস কোথায়?'

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:০৮

আজ আমি কোথাও যাবো না বলেছেন: ভালো লাগলো!! :)

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৫

সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন :)

২| ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:১৮

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: চমৎকার লেখনি।

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৬

সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন :)

৩| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:১৪

এরিস বলেছেন: স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে সেসব নিয়ে এভাবে লিখে যেতে আমি কাওকে দেখিনি।
আপনি সুন্দর লিখেন। আজকালকার দিনে অন্যদের মতো( আই অ্যাম নট এক্সেপশনাল) ফ্যান্টাসি থ্রিলার নিয়ে মাতামাতি না করে সহজ সরল স্বতঃস্ফূর্ত লিখে যাওয়াটা সত্যিই অবাক করে আমাকে। আপনার মতো যদি লিখতে পারতাম, এই আফসোস করিনা, তবে আক্ষেপ, যদি আপনার মতো আমার যদি একটি সমৃদ্ধ শৈশব থাকতো!!!

১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৬

সাদাত হোসাইন বলেছেন: আপনি এই যে এমন করে বলেন, এটাই আমার জন্য বিশেষ পাওয়া। এক্সেপশনাল.।

ভালোবাসা

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.