![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...
এই গল্পটাও আমার।
গল্পের শুরুটা অনেকেরই জানা, এবার গল্পের মাঝামাঝি।
আমাদের ঘর তখন রাস্তার সাথে। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার ফাঁকফোঁকর দিয়ে হুহু করে হাওয়া আসে। শুধু যে হাওয়া আসে, তা না। হাওয়ার সাথে আসে হাওয়ার শব্দও। রাস্তায় কেউ গলা খাঁকড়ি দিলে তার শব্দও আসে। থুথু ফেললে তার শব্দ আসে। মাঝরাতে কোন নিঃসঙ্গ প্রেমিকের মন বিষণ্ণ করা গানের সুর ভেসে আসে, বাড়ির পাশের ডোবার জলে গলা অবধি বের করা কোলা ব্যাঙের একটানা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর ঘ্যাঙও আসে।
এই সুযোগ আম্মা হেলায় হারাতে চান না। খানিক পরপর এসে ধমক দিয়ে বলেন, 'কি ভ্যানভ্যান কইরা মাছির মতন পড়োশ? রাস্তার মাইনসে যদি না-ই বোঝলো যে এই বাড়িতে গুরাগারা (বাচ্চা ছেলেপুলে) আছে, হেরা পড়াশুনা করে, তাইলে আর হেই পড়া পইড়া লাভ কি? নিজের পড়া যদি নিজের কানেই না ঢোকে তাইলে কি সেই পড়া মুখস্ত হয়? পড় পড়, জোরে জোরে পড়। রাস্তার মাইনসে য্যান হুনে।'
আমরা বাড়ি মাথায় তুলে চেঁচাই, 'স্যার, আই বেগ টু স্টেট দ্যাট মাই ফাদার ইজ দ্যা অনলি আরনিং মেম্বার অফ মাই ফ্যামিলি। মাই ফ্যামিলি ইজ কনসিস্টেড অফ এইট মেম্বার...'
আমরা ভাই বোন বাবা মা মিলে মোটেই আট জন না। মাত্র ৪ জন তখন। আমি, ছোট ভাই, আম্মা, আব্বা, আব্বা ঢাকায় থাকেন। তবে সাথে থাকেন দাদী। উপরের ইংরেজী লাইনগুলো আসলে ছিল ফুল ফ্রী স্টুডেন্টশিপ চাহিয়া প্রধান শিক্ষকের নিকট ইংরেজিতে অ্যাপ্লিকেশন পড়া মুখস্ত প্রক্রিয়া। আমাদের স্কুলে নতুন হেডমাস্টার এসেছেন ভালো করে পড়া মুখস্ত না করলে... বাকিটা না বলি। তবে পড়া যে মাশাল্লাহ ভালো হয়েছিলো, তা প্রমাণিত। এখন অবধি সেই লাইনগুলো ঠোঁটের আগায় মুখস্ত হয়ে ঠোঁটস্ত।
সমস্যা হচ্ছে, আমার পড়তে ভালো লাগে না। আমাদের বই তখন সাদা কালো। আমার একটা লাল কালির বলপয়েন্ট কলম ছিল, আমি পড়াশোনা বাদ দিয়ে সেই লাল কালির কলম দিয়ে সাদাকালো বইয়ের পাতার সাদাকালো ফুলের ছবিগুলো রঙ্গিন করি, গাঁয়ের বধুর ছবির কপালে লাল রঙের টিপ আঁকি, শাড়ীর আচল রঙ করি। আরও একটা কাজ করি, কোন গল্প পড়ে ভালো না লাগলে, বাংলা বইয়ের সেই গল্পের পাশে এবং নিচের ফাঁকা জায়গায় গল্পের বাকী অংশগুলো নিজের মতো করে লিখি।
লিখে বাকী অংশের সাথে মিলিয়ে দেখে নিজেই খুশি হই, বাহ, ফিনিশিংতো মারাত্মক হইছে!
ফিনিশিং মারত্মক হয় কি না জানি না, তবে আমার কানের লতি নিয়মিতভাবেই মারাত্মক লাল হতে থাকে। আমার এই বইভরতি 'দাগাদাগি' আমার মায়ের দুই চোখের বিষ। শিক্ষকদেরও। বইয়ের পাতায় যারা দাগাদাগি করে, তাদের বিদ্যা শিক্ষা হয় না, ইহা প্রণিধানযোগ্য বিদ্যাশিক্ষা নীতিমালার অংশ। এবং অতীব সইত্য। সুতরাং, আমার যে পড়ালেখা হবে না, সে বিষয়ে কারো কোন সন্দেহ নাই। আমারও না। আমি অবশ্য তাতে খুশি। তুমুল আনন্দ নিয়ে দাগাদাগির পর্ব যদি তাতে শুরু হয়!
সেদিন বইয়ের পাতায় অমন এক গল্পের ফিনিশিং লিখে রেখেছি। স্কুলে নতুন হেডমাস্টার বাঘের মতন রাগী। কথায় কথায় লাইব্রেরীতে নিয়ে পিঠে জোড়া বেতের নৃত্য শুরু করেন। ছাত্ররা সব তার ভয়ে অস্থির। তবে, আশার কথা এই স্যারকে শিক্ষকরা কেউ পছন্দ করে না। বেশিদিন এই অবস্থা চালাতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া অন্য এলাকা থেকে কেউ হেডমাস্টার হিসেবে এসে এই স্কুলে বেশীদিন টিকতেও পারে নি। অল্পদিনেই তাদের নানান ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। সেই ঝামেলা তারা সামলাতে পারেন না। শেষপর্যন্ত নানান অপবাদ মাথায় নিয়ে রাতের আধারে চুপিচুপি গাঁ ছাড়েন। তবে সবাই বলাবলি করছে, এই নতুন স্যার অন্যদের চেয়ে আলাদা। ইনি পারবেন। গ্রামভর্তি গিজগিজে গরু ছাগলগুলো মানুষ করবেন।
স্যার আমার লাল কালির দাগাদাগির সেই বই দেখে চশমার ফাঁক দিয়ে তীঘ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, লাইব্রেরীতে আয়।
আমার মনে হোল, আমার কলিজা শুকিয়ে গেছে। বুক ধড়ফড় করছে। প্রবল পানির তেষ্টা পেয়েছে। আমি তার পিছু পিছু লাইব্রেরীতে গেলাম। হাঁটতে গিয়ে আমার টিনটিনে পা জোড়া কাঁপছে। এমনই কপাল, আজ জামাও পড়ে আসছি সবচেয়ে পাতলাটা। এখন, বেতের বাড়ির ভরসা পিঠ আর আল্লাহ!
আল্লাহর নাম জপতে জপতে স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, স্যার তেমন কোন কথা বললেন না, গম্ভীর মুখে টেবিলের দেরাজ খুললেন, দেরাজ থেকে লাল মলাটের একটা খাতা বের করলেন। ভেতরে ধবধবে সাদা খাতা, খাতার পাতায় রুলটানা কাগজ। স্যার সেই খাতাখানা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, 'তোর হাতের লেখার অবস্থাতো দেখি যাচ্ছে তাই। দেখলে মনে হয় কাউয়ার পায়ে দোয়াতের কালি মাইখা ছাইড়া দিছে, সেই কাউয়া হাইটা গেছে খাতার উপর দিয়া, কাউয়ার পায়ের কালির ছাপ হইছে তোর হাতের অক্ষর! যা যা, এই খাতায় ডেইলি হাতের লেখা লিখবি। রুলটানা কাগজে হাতের লেখা সোজা হইব।
আমি অবাক চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার হাতের লেখা খারাপ না। বরং ক্লাশের আর সবার চেয়ে ভালো। তাহলে? স্যার ধমক দিয়ে বললেন, 'খাড়াইয়া আছস কোন দুঃখে, যা ক্লাশে যা। যা।'
আমি ক্লাশে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এই মুহূর্তে স্যার আবার ডাকলেন। হাতের লেখা যে লিখবি, কি লিখবি সেই লেখায়?
কি না কি বলে আবার ধরা খাই। আমি তাই নিরাপদ পথে হাঁটলাম। ভয়ে ভয়ে বললাম, আপনে যা বলবেন, তাই ই লিখব।
স্যার খানিকক্ষণ, আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, লাল কালির কলম দিয়া বইয়ের পৃষ্ঠায় বানাইয়া বানাইইয়া যেই গল্প কবিতা লেখস, ওইগুলা অখন থেইকা আর বইয়ের উপর লিখবি না। লিখবি এই খাতায়। তারিখ দিয়া লিখবি। আর মাস শেষে আমারে দেখাবি।'
আমি আবারও অবাক চোখে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ঘটনা কি?
ঘটনা যাই হোক, আমি রোজ নিয়ম করে সেই খাতা ভর্তি এটা সেটা লিখি, স্যারকে দেখাবার কথা ভাবি। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, স্যার আর আমাকে ডাকেন না। হয়তো ভুলেই গেছেন। বহুদিন পর স্যারের কাছে একদিন যাই, ভয়ে ভয়ে বলি, স্যার, সেই খাতাটা?
স্যারের তখন টালমাটাল অবস্থা। স্কুল কমিটি উনাকে আর রাখবে না। নানান ধরণের ষড়যন্ত্রে স্যারের অবস্থা তখন কাহিল। কিন্তু বিশাল সংসার নিয়ে এই চাকুরি তখন স্যারের খুব দরকার। উদ্ভ্রান্ত চোখে স্যার আমার দিকে তাকিয়ে থাক্লেন, তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, 'যা যা, ভাগ এইখান থেইকা, যাহ যাহ'।
আমি হতভম্ব হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার চোখে জল আসার কথা, আসলো না। স্যার তখন অন্যদিকে তাকিয়ে আরেক স্যারের সাথে মিনমিন করে কথা বলছেন, স্যারের কণ্ঠ জুড়ে মিনতি।
আমার চোখে এলেবেলে কারণেই জল এসে যায়। সেই আমি স্যারের অমন আচরণে কাঁদলাম না। কিন্তু বাড়ি এসে খাতাটা কুচিকুচি করে ছিঁড়ে খালের জলে ভাসিয়ে দিলাম। আর কাগজের টুকরাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, 'যা যা, ভাগ এইখান থেইকা, যাহ যাহ'।
সেদিন শীতের সন্ধ্যা।
অন্ধকারে চাদর গায়ে একটা লোক এসে প্রায় ফিসফিস করে আমার নাম ধরে ডাকল। আমি ঘর থেকে বেড়িয়ে দেখি 'স্যার!
স্যারের চোখ ভীতসন্ত্রস্ত! তিনি সেই ভীতসন্ত্রস্ত চোখে এদিক সেদিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমি চইল্যা যাইতেছি। তোর খাতাটা দে তো?'
আমি বললাম, 'কোন খাতা?'
স্যার অধৈর্য গলায় বললেন, 'যেই খাতাটা তোর হাতের লেখা ঠিক করনের লাইগা দিছিলাম'।
আমি কঠিন গলায় বললাম, 'আমার হাতের লেখা ঠিকই আছে, আপনের খাতা আমি কুচিকুচি কইরা ছির্যা পানিতে ভাসাই দিছি'।
স্যার কষে একটা চড় লাগালেন আমার গালে। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখ জুড়ে রাজ্যের বিস্ময়! স্যার দু পা সামনে এগিয়ে এসে আমার মাথাটা তার বুকের সাথে চেপে ধরলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, 'হাতের লেখা আরও ঠিক হওনের দরকার আছে, আরও অনেক ঠিক হওনের দরকার। আরও... তুই লিখতেই থাকবি, লিখতেই থাকবি।'
আমি স্যারের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। স্যারের গা থেকে সস্তা বিড়ির গন্ধ আসছে। সেই গন্ধে আমার পেট গুলিয়ে উঠছে। আমি দমবন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার মাথায় হাত রাখলেন। বিড়বিড় করে কি যেন বললেন। তারপর কালো চাঁদরে মাথা ঢেকে কালো অন্ধকারে মিশে গেলেন।
আমি তাকিয়ে রইলাম সেই অন্ধকারে। তাকিয়েই রইলাম
এখন, এই মুহূর্তেও আমি তাকিয়ে আছি ব্যালকনির বাইরে অন্ধকারে। তাকিয়েই আছি।
স্যার কি কোথাও আছেন? এই অন্ধকারের কোথাও?
পাতার পর পাতা হাতের লেখা লিখতে লিখতে কখন যেন আমি আস্ত বইও লিখে ফেলেছি। এমনকি এবার একটা উপন্যাসও! সেই উপন্যাস বইমেলায় চলেও এসেছে। শুক্রবার তার প্যাকেটও খোলা হবে। আমি অবাক চোখে অন্ধকারে তাকিয়ে আছি। তাকিয়েই আছি।
আমার হঠাৎ মনে হোল, ওই অন্ধকারের কোথাও থেকে স্যারও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু স্যারের চোখের ভাষা আমি পড়তে পাড়ছি না। আমি কি কিছু লিখতে পেড়েছি স্যার? আমার হাতের লেখা লিখতে লিখতে আমি কি কিছু লিখতে পেরেছি?
নাকি যা লিখচি, তা সেই কাউয়ার ঠ্যাঙের কালি পায়ে হেঁটে যাওয়া অক্ষরের মতন।
স্যার, আমার ভয় হচ্ছে...
২| ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৩৭
মহিদুল বেস্ট বলেছেন: মায়া জড়ানো লেখা!! হিম ধরে এসেছিল শেষে!
৩| ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:২৭
লাবনী আক্তার বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন সাদাত । খুব সাবলীল ভাবে আপনি লিখেন ভালো লাগে।
আপনার বইটা দেখা হয়েছে । গল্পের নায়িকার নাম মে বি আমার নামেই, অ্যাম আই রাইট?
নামটা দেখে হেসেছিলাম ।
গল্পটা পড়ব ইনশাল্লাহ। শুভকামনা রইল অনেক।
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫৬
পাঠক১৯৭১ বলেছেন: এ লেখার তুলনায় নিজকে অনেক উপরে নিয়ে গেছেন; দেখেন, যেন পড়ে না যান।