নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গৃহী

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:২১

-'গীতের লগে গৃহের বড়ই দুশমনি বাবা!'



- 'কি রকম দুশমনি?'



- 'গৃহে থাইকলে গীত হয় না। গীত গাইতে হইলে গৃহ ছাড়তে হয়, জগত সংসার দেখতে হয়, মানুষ দেখতে হয়। নানান মানুষ, নানান জীবন। আর এইসব মানুষের মইধ্যেই থাকে গীত। সংসার হইলো বাজান মায়া। এক্কেরে মায়া। এই মায়ায় ভালোবাসা থাকে শুধু পরিবার পরিজনের জইন্যে। আর কারোর জইন্যে না। এই জইন্যে গীত গাইতে হইলে গৃহ ত্যাগ অতি জরুরী কর্ম বাজান, অতি জরুরী কর্ম'।



গ্রাম গঞ্জের মানুষ মাত্রই 'স্বভাব দার্শনিক'।

তাদের কথায় কথায় জীবনের গভীরতম সব দর্শন। মজিদ ফকিরও তার ব্যাতিক্রম না। সে বসে আছে মেঝেতে পা ছড়িয়ে। তার থুঁতনি জুড়ে পাতলা দাঁড়ি। সে সেই দাঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, 'কিন্তু আমি পারি নাই বাজান, গীতের জন্য গৃহ ছাড়তে পারি নাই। আবার ধরতেও পারি নাই। আমি আছি মাঝামাঝি। না ঘাটের, না ঘরের। না সংসারী হইলাম, না গৃহ ত্যাগী হইলাম'।



আমি মানুষটার দিকে তাকালাম। এই তাকানোর অর্থ মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করা। আমি তেমন কিছুই বুঝলাম না। রাস্তাঘাটে হরহামেশা দেখা আর আট-দশটা সাধারণ হতদরীদ্র মানুষের মতই চেহারা। গাল ভাঙা। গায়ে হাফ হাতা ফতুয়া। ফতুয়ার আসল রঙ কি ছিল বোঝা যাচ্ছে না। কেমন ধোয়াটে একটা কালার। ফতুয়াতে বুকের কাছে পকেট থাকে না। এর আছে। বুকের কাছে গাড় নীল রঙের পকেট। এই পকেট আলাদা লাগানো হয়েছে।



মজিদ ফকির কাশল। কাশির দমকে তার হাড় জিরজিরে শরীরের পাঁজর অবধি কেপে উঠলো। আমার মনে হোল আমি যেন ঝন ঝন আওয়াজ শুনলাম। ব্যাটার শরীরের কলকব্জা সব ঢিলা হয়ে আছে। তার বুকও হাপরের মতন ওঠা নামা করছে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে ভীতিকর। একে দ্রুত বিদায় করা দরকার। আমি অফিসের কাজে এসেছি। দিন তিনেকের ফিল্ড ভিজিট শেষে চলে যাবো। এই নির্জন অচেনা অজানা গ্রামে আপদ বালাই থেকে যত দূরে থাকা যায় তত মঙ্গল।



আমি মনির কে ডাকলাম। মনির এই রেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার। সে সন্ধ্যেবেলা মজিদ ফকিরকে ধরে নিয়ে এসেছে! এই লোক নাকি গান গায়। অপূর্ব সুন্দর গান। সেই গান শুনে নাকি পশুপক্ষি পর্যন্ত সাড়া শব্দ বন্ধ করে দেয়!



কিন্তু সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত মজিদ ফকিরের গলা থেকে একটা গান তো দূরে থাক, সুর দেয়া শব্দ পর্যন্ত শুনলাম না। গান গাওয়ার কথা বলে দুই প্যাকেট সিগারেট নিয়েছে। মেঝেতে বসে গত একঘণ্টায় সে সিগারেটের স্তুপ করে ফেলেছে । এবং এই বিষয়ে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বরং মাঝে মাঝে কাশি বন্ধ করে তীব্র শব্দে খখাৎ করে কফ ফেলে।



মনির এসে বলল, 'এর আজকে গান শোনানোর ইচ্ছা নাই, ইচ্ছা না হইলে সে কিছু করে না। পঞ্চাশ টেকার লাল নোট দিলেও করে না'।

মজিদ ফকির জবাব দিল না। সে খকাশ খকাশ করে কেশে চলেছে। কাশির তীব্র দমকে শরীর কাঁপছে। আমি বললাম, 'আপনার কথা আর কাশিতো মাশাল্লাহ ভালোই শুনলাম। বিড়িও কিনে দিলাম প্যাকেট দুই। কিন্তু গানতো শুনাইলেন না'!



মজিদ ফকির আমার দিকে তাকাল। অদ্ভুত ব্যাপার, তার চোখ জোড়া চকচক করছে। এই ধরণের ক্ষয়ে যাওয়া মানুষের চোখ চকচক করে না, তাদের চোখ থাকে মৃত মাছের চোখের মতন। কিন্তু এর চোখ আশ্চর্য উজ্জ্বল।



সে বলল, 'আমার গলায় আর সুর নাই বাজান। বিড়ি সিরকেট সব শেষ কইরে ফেলছে। অখন গীত গাইলে আপনের অসম্মান হইবে। তয় আপনের অসম্মান বড় কথা না, বড় কথা হইলো গীতের অসম্মান। মানুষের চেয়ে গীতের সম্মান অধিক'।



আমি বললাম, 'আপনি গান না গাইলে বিদায় হন। অনেকক্ষণ আপনার বকবকানি শুনেছি, মাথা ধরে গেছে। এইবার যান'।



- 'কিন্তু বাজান, আপনে যে আমারে বিড়ি খাওয়াইলেন, বিড়ির দাম আমি কিভাবে শোধ দিব?'

আমি বললাম, 'বিড়ির দাম শোধ দিতে হবে না, আপনি এখন যান'।



মজিদ ফকির উঠে দাঁড়ালো, তার হাত পা কাঁপছে। সে সেই কাঁপা কাঁপা হাতে তার কাঁধের ঝোলা থেকে দোতরাটা বের করল। তারপর বলল, আমি কারোর কাছে কর্জ থাকি না বাজান, আপনের বিড়ির ঋণ আমি শোধ দিব। কিন্তু আমার কাছে টেকা পয়সা কিছু নাই। কামাই রোজগারও নাই। পরিবারের কেউ আমারে দেখতেও পারে না। এই গীতের জন্য। আমারে কেউ দেখতে পারে না। দেখেন না বাজান, আমার এই দোতরাখানও না। দেখেন এর তার দুইখানও ছেড়া। গীত গাইবো কেমনে! তয়, আফনেরে আমি গীত শোনাবো'।



আমি বললাম, 'কখন শোনাবেন? আমিতো চলেই যাবো!'



মজিদ ফকির বলল, 'শোনাবো বাজান, সময় হইলেই শোনাবো। ছয় সাত মাস ধইরে এই দোতরাখান নষ্ট হইছে, শ দুয়েক টেকার জন্য ঠিক করাইতে পারি নাই। তয় আফনে যাবার আগেই ঠিক করাইব'।



- কিভাবে ঠিক করাবেন? টেকা পাবেন কই?'



মজিদ ফকির এই প্রশ্নের জবাব দিল না। সে দরজার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেলো।



রাতের খাবার টেবিলে মনির বলল, 'স্যার, সে আপনারে গান শোনাইব, সে যখন বলছে, অবশ্যই শোনাইব'।



আমি বললাম, 'কিন্তু কিভাবে শোনাবে? সেতো কথাই বলতে পারে না। শুধু কাশে।

মনির বলল, হের একখান প্লান আছে?



- 'কি প্লান?'



- 'এই প্লানের কথা খালি হেয় আর আমি জানি, আর কেউ জানে না'।



আমি প্ল্যান শোনার আর কোন আগ্রহ বোধ করলাম না। মনিরকে বললাম মশারি টানাতে। শুয়ে পড়বো। খুব ভোরে উঠতে হবে।



শুতে গিয়ে দেখলাম মনির কয়েল ধরাচ্ছে। মশার খুব উৎপাত। আমি বললাম, মনির কয়েল দিও না, আমি কয়েলের ধোয়া সহ্য করতে পারি না।



মনির বলল, 'মশা দেখছেন স্যার? আফনেরে উরাই লইয়া যাইব'।



আমি বললাম, 'থাকুক মশা। ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে দেব'।



কথাটা বলেই মনে হোল, ফ্যান পাবো কোথায়? এই অজপারা গায়েতো ইলেক্ট্রিসিটিই নেই! মনির অবশ্য এই বিষয়ে কোন কথা বলল না। সে বলল মজিদ ফকিরের বিষয়ে, 'হের মাথায় দোষ আছে স্যার। সারাজীবনে এই গান গান কইরাই সব হারাইল। ঘরে না কেউ দেখতে পারে, না বাইরে। শুধু আমার লগে একটু খাতির। সুখ দুঃখের কথা কয়। আমি ওরে বলিছি, আপনে গানের খুব সমঝদার, এই শুইনা সে আপনেরে গান শুনাইবার জন্য পাগল হইছে। গাঁও গ্রামে সবাইতো হেরে পাগল কয়। গান গাইলে ঢিল ছোড়ে'।



- 'কিন্তু সেতো গানই গাইতে পারে না। ওইরকম কাশলে কেউ গাইবে কি করে!'



- 'এইখানে একটা জাদু আছে স্যার। হের যেই দোতোরাখান দেখছেন, ওইটা যখন বাজাইতে পারে, তার গলায় অটোমেটিক সুর বাইর হয়। কিন্তু টেকার জন্য পারতেছে না। তিনশ টেকা লাগব। তিনশ টেকা তারে কে দিব?'



এই ধরণের ধান্দাবাজ মানুষদের আমার চেনা আছে। এরা নানান ধান্দা করে বেঁচে থাকে। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলিং। আমি নিশ্চিত, মনির আর মজিদ ফকির মিলে রেস্ট হাউজে আসা গেস্টদের সাথে এই একই ফন্দিতে ধান্দাবাজি করে। মজিদ ফকিরের গল্পগুলা হয়তো পাল্টায়। কিন্তু ধান্দাটা ওই একই,- টাকা!'



আমি কথা না বলে পাশ ফিরে শুই। মনির কাঁচুমাচু করে বিছানার পাশে খানিক সরে এসে বলে, 'স্যার, তার যেই প্ল্যানের কথা বলছিলাম, সেইটা শুনবেন?'



আমি জবাব দেই না। মনির আবার বলে, 'হের একটা মোরগ আছে। খাশির সমান মোরগ। এই মোরগ তার বউ বহুদিন ধইরা পালতেছে! রামচরনের হাটে নিলে শ পাঁচেক টেকায় বেচতে পারবো, ওইটা বেইচাই সে তার দোতরা ঠিক করবো। এই হইলো তার প্ল্যান। কিন্তু সমস্যা হইছে তার বউ। সে এই মোরগ এখন বেচতে দিব না। বেচবো আশ্বিন মাসে, তখন মোরগের দাম চড়া। ঘরের ছনের বেড়া জায়গায় জায়গায় ধ্বইসা গেছে, সে মোরগ বিক্রির টেকায় বেড়া ঠিক করবো। ঘরে জোয়ান দুইটা মাইয়া, রাইত বিরাইতে বড় ভয়'।



এই ধান্দাবাজির ঘটনা আমার পরিচিত। গল্পও। জীবনেতো কম মানুষ দেখি নি! কম জায়গাও ঘুরি নি। এরা ভুল মানুষকে বেছে নিয়েছে। আমি গভীর ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। মাঝে মাঝে নাকও ডাকছি। এর পরেও যদি মনির তার গল্প চালিয়ে যায়, বুঝতে হবে সে আসলেই ধান্দাবাজ। ঘটনা সত্য হলে আমার আচরণে তার আহত হবার কথা। আহত- অপমানিত হয়ে চলে যাবার কথা! কিন্তু মনির গেলো না, সে ইনিয়েবিনিয়ে বলতেই লাগলো, 'এখন সে প্ল্যান করতেছে, মোরগ চুরি করবে। তারপর রামচরনের বাজারে গিয়া বিক্রি করে দোতরা ঠিক করাবে, তারপর আর বাড়ি ফিরবে না, এইটা কোন কথা, আফনেই বলেন স্যার? এইটা কোন কথা? আরে ব্যাটা, তোর ঘরে জোয়ান মাইয়া, তোর আগে বেড়া দরকার? না দোতরা দরকার?'



এবার আমার চূড়ান্ত বিরক্ত লাগছে। আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম। তারপর কড়া গলায় বললাম, 'মনির এই মুহূর্তে ঘর থেকে বের হও, আমি ঘুমাবো'।



মনির আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি গরমের ভেতর কাঁথা টেনে নিয়ে মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।



২।



পরদিন সকালে মজিদ ফকিরের সাথে দেখা।

সে বাঁশের সাঁকোর নিচে গলা পানিতে ডুবে দাঁড়িয়ে গো গো করছে। আমি মনিরকে বললাম, 'ব্যাপার কি মনির? সে এমন করছে কেন?'



মনির বলল, 'বললেতো স্যার বিশ্বাস করবেন না, সে আপনেরে গান শুনানোর জন্য গলার ব্যায়াম করতেছে। তার ওস্তাদে নাকি বলেছিল, গলা পানিতে ডুবে রেওয়াজ করলে গলায় সুর আসে'।

বলেই মনির ফ্যা ফ্যা করে হাসল। আমি মজিদ ফকিরের দিকে তাকালাম। সে চোখ বন্ধ করে গলা পানিতে রেওয়াজ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার গলা থেকে সুরের বদলে খকাশ খকাশ শব্দে কাশি বের হচ্ছে'।



আমার হঠাৎ কি হোল, মানিব্যাগ খুলে পাঁচশ টাকার একখানা নোট ছুড়ে দিলাম মনিরের দিকে, 'নাও, এইটা নিয়ে এখান থেকে ভাগো'।



মনির চোখ দুখানা গোলগোল করে আমার দিকে খানিক্ষন তাকিয়ে রইলো। আমি হনহন করে হেঁটে চলে আসলাম, 'ধান্দাবাজির একটা সীমা থাকা উচিত!'



৩।



আমার তিন দিন শেষ। অন্ধকার থাকতে থাকতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছি। রেডি হয়ে সকাল সকাল রওনা দিতে হবে, না হলে অত দূরের ট্রেন স্টেশনে পৌঁছেও হয়তো ট্রেন মিস করে ফেলব। মজিদ ফকিরের ব্যাপারে ঘটনা যা ভেবেছিলাম তা-ই। সেদিনের সেই ঘটনার পর মজিদ ব্যাপারির আর কোন খোঁজ নেই। অনুমিতভাবেই মনিরের উত্তর, সে কিছু জানে না। টাকা দেয়ার পর মজিদ ফকির রামচরনের হাটে যাবার কথা বলে সেই যে গেছে, আর খোঁজ নেই। মনিরের উত্তর যে এই হবে, এ-ও আমার জানা!



মনির টেবিলে ভাত দিয়েছে। আমি ভাত খেতে বসে বললাম, 'কই? তোমার মিয়া তানসেন কই? তানসেন মজিদ ফকির? তার দোতরা ঠিক হয়েছে? আমাকে গান শোনানোর ইচ্ছার কতদূর?'



মনির এই কথার কোন জবাব দিল না। আমি তরকারি মেখে ভাত মাখাচ্ছি, এই মুহূর্তে মজিদ ফকির আসলো। তার গায়ে ধোয়া ইস্ত্রী করা পরিস্কার জামা। পরিপাটি করে চুল আঁচড়ানো। সাথে ফুটফুটে এক আট দশ বছর বয়সের মেয়ে। তার হাতভরতি টুকটুকে লাল চুড়ি।



আমি বললাম, 'কি হে মজিদ সাহেব, আপনার দোতরা ঠিক হয়েছে?'

জবাবে মজিদ ফকির কথা বলল না। বার দুয়েক কাশল। তারপর হঠাৎ মিনমিন করে বলল, 'আফনে একটু আমার বাড়িত আসবেন বাজান, এইতো হাটা কদমে দুই কাইতের পথ'।



আমি বললাম, কেন মজিদ? বাড়িতে কেন?



মজিদ এই কেন'র কোন উত্তর দিল না। আবারো খকাশ খকাশ করে কাশল। তারপর আগের মতোই বলল, 'আফনে একটু আমার বাড়িত আসবেন বাজান, হাটা কদমে দুই কাইতের পথ'।



আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না। হাটা কদমের পথে দুই কাইত দিয়ে মজিদ ফকিরের বাড়ির উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরুলাম।



৪/



আমি বসে আছি চটের বস্তার উপর মেঝেতে।



মজিদ ফকিরের ঘরে বসতে দেয়ার মতো আর কিছু নেই। কোন মানুষের দারিদ্র এতো প্রকট হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। মনে হচ্ছে, যে কোন সময় এই ঘরের চাল, বেড়া ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে। আমি সেই ঝুরঝুরে ঘরের মেঝেতে ছেড়া চটের বস্তার উপর বসে আছি। আমার পাশে চটের বস্তার উপর একটা একশ টাকার নোট, দুটা দশ টাকার নোট, আর একটা এক টাকার কয়েন। মোট একশ একুশ টাকা। মজিদ ফকির ঘরের কোণে কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে, তার বুকের কাছে দুই হাত দিয়ে ধরা দোতরা। দোতোরার তার ঠিক হয়েছে। মজিদ ফকিরের বউ আচলে মুখ চেপে বসে আছে। তার চোখ লাল। নিশ্চয়ই কেঁদেছে। ১২-১৩ বছরের একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার আচল ধরে। মজিদ মিয়া হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল, 'এইখানে দএক্শ একুইশ টেকা আছে বাজান। দুইশ' টেকা লাগছিল বাজান দোতরা ঠিক করতে, কিন্তু ছোড মাইয়াডার জন্য কয়গাছ চুড়ি আনতে মন চাইছিল, কোনদিন তো কিছু দিতে পারি না, লাল টুকটুক চুড়ি দেইখা খুব শখ হইলো, তখন ভাবলাম বড় মাইয়াডার জইন্য কিছু কিনি, তহন হের জন্যও কেনলাম, লগে এক শিশি নাইকোল তেলও কেনলাম, তহন ভাবলাম, বউডার জন্যও কিছু কিনি, মল্লিকপাড়ার তাঁতিগো কাছে একশ টেকায় শাড়ি কেনন যায়, সেইখানে গিয়া একখান শাড়িও কিন্না ফালাইছি বাজান, ভাবছিলাম, মোরগটা বেইচা দোতরাটা ঠিক করবো, কিন্তু বউয়ের জন্য পারি নাই, আফনে বাজান টেকা দিছেন দোতোরা ঠিক করতে। কিন্তু আমি গীতের জইন্য টেকা নিয়া এইসব কি করলাম! এই শরমে আফনেরে এই কয়দিন দেহা দিতে পারি নাই বাজান, আফনের ঋণ আমি কেমনে শোধ করবো বাজান?



আমি কোন কথা বললাম না। চুপচাপ মজিদ ফকিরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মজিদ ফকির আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'বাজান, আমার ঘরে চাইরডা ডাইল ভাত খাইতে হইব আপনের। চাইরডা ডাইল ভাত। তারপর আমি গীত ধরব।''



মজিদ ফকিরের বড় মেয়ে গামলা ভর্তি ভাত এনে আমার সামনে রাখল। গ্লাসভর্তি পানি। বড় একটা বাটি। সেই বাটি ভর্তি তরকারি। খাশির রানের সমান বড় বড় দুইখান মোরগের রান! বিশাল বিশাল মাংসের টুকরা। সেই মোরগ!



সেই মোরগ!



মজিদ মিয়া চামচে করে আমার পাতে তুলে দিচ্ছে একেকটা মাংসের টুকরা। ৬ জোড়া চোখ নিস্পলক তাকিয়ে আছে আমার পাতের দিকে। মাংসের টুকরাগুলোর দিকে। আমার হঠাৎ মনে হোল, ওই ছনের ঘরের ছিন্ন বেড়ার প্রতিটি ছনের আঁশও আমার পাতে তাকিয়ে আছে। প্রতিটি ছিদ্র। জীর্ণ পোশাক। শীর্ণ হাড়।



আমি মজিদ ফকিরের দিকে তাকিয়ে বললাম, 'আগে গান হোক মজিদ মিয়া, খাওয়া পরে হবে, কই দেখি মা, এদিকে আসো, আজকে আমরা সবাই মিলে একসাথে পেট ভরে ভাত খাবো, তারপর গঞ্জের থেকে টিন এনে ঘরের বেড়া লাগাবো। তার আগে আসো দেখি, তোমার বাপ কত বড় গাতক হইছে? আসো দেখি'।



ছোট্ট মেয়েটা টুকটুক করে ভয়ে শংকায় আমার গাঁ ঘেঁসে দাড়ায়। আমি তাকে কলে টেনে বসাই।



মজিদ ফকির দোতরায় সুর তোলে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি। মজিদ ফকিরের গলার রগ ফুলে উঠেছে, তার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে। এক অপার্থিব সুর যেন গলে গলে ঝরছে তার গলা বেয়ে। সেই সুর এই জগতের না। এই চেনা পৃথিবীর না। আমি তাকিয়ে আছি মজিদ ফকিরের দিকে। সে শক্ত হাতে দোতরাখানা ধরে আছে বুকের সাথে। শক্ত হাতে। যেন খাঁচার ভেতর অচীন পাখি। এই দোতরাখানা যেন তার বুকের ভেতরের অচীন পাখি। আমার হঠাৎ মানুষটাকে খুব স্বার্থপর মনে হোল। খুব স্বার্থপর! মানুষটা আর কারো কথা কিছু ভাবল না? এই ঘরের কথা, ছেড়া বেড়ার কথা, শীর্ণ চালার কথা, কিচ্ছু না? এতো স্বার্থপর মানুষ হয়?



কিন্তু আট দশ বছরের ফুটফুটে মেয়েটার দিকে তাকাতেই দেখি তার হাতভর্তি টুকটুকে লাল চুড়ি, চোখভর্তি চকচকে আনন্দ। সে খানিক পরপর চোখভরতি বিস্ময় নিয়ে তার হাত ভর্তি চুড়ি দেখছে। আর টুংটাং শব্দ করছে। আমি তাকিয়ে দেখি, ওই কিশোরী মেয়েটি মাথাভরতি করে বহুদিনের রুক্ষ চুলে তেল মেখেছে, চকচকে পরিপাটি চুলের বেনুনীর মাথায় ফুলের মতো ফুঁটে আছে লাল ফিতে। আর ওই জীর্ণ চেহারার নারী? তার কণ্ঠা হাড় বের হওয়া শরীরে জড়িয়ে আছে মাত্র একশ টাকা দামের এক শাড়ী! সেই শাড়ীর সেই দৃশ্য যেন পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য। আমার হঠাৎ মনে হোল, এই শাড়ী, এই লাল চুলের ফিতা আর ওই চুড়ি, ওই নারকেল তেলের সবটুকু জুড়ে যা আছে তার নামই মায়া, তার নামই ভালোবাসা।



মজিদ ফকির এই ভালোবাসাটুকুই ছাড়তে চেয়েছিল। এই মায়াটুকুই ছাড়তে চেয়েছিল। হতে চেয়েছিল গৃহত্যাগী বাউল।



কিন্তু ভালোবাসা থেকে যায়, থেকেই যায়...

আর হয়তো তাই, ওই ঝঞ্জনঝনে বুকের ভেতর, খুকখুক কাশির ভেতর, ওই ছেড়া জামা গলার ভেতর, ছিন্ন বেড়ার ভেতর, শীর্ণ হারের ভেতর, মজিদ ফকিরের পরিত্যাক্ত বুকের ভেতর, কেমন চুপ করে, কেমন একলা একা, চুপিচুপি থেকে যায়, থেকে যায় গীত।



এতোটুকু ভালোবাসায় জেগে ওঠে

জেগে ওঠে, অপার্থিব সঙ্গীত।

-----------------------------------------------------------------

গৃহী/ সাদাত হোসাইন

০৬.০১.২০১৪

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.