নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

কে সে?

০৫ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ৯:৩৮

আমার খুব ইচ্ছে হয় মানুষটার গা ঘেঁষে বসি, বসে জিজ্ঞেস করি, 'আপনি কি আমাকে আর আগের মতো ভালবাসেন না?' আমার জিজ্ঞেস করা হয় না। মানুষের অনেক ভাবনা ভাবনা অবধিই থেকে যায়, বলা হয়ে ওঠে না। এই ভাবনাটাও।



আমি নাকি দেখতেও অবিকল এই মানুষটার মতো হয়েছি। কাঠে বাঁধানো ফ্রেমে মানুষটার একটা ছবি ছিল। টিনটিনে এক কিশোর, সাদা শার্ট আর হাফ প্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে স্টুডিওর দেয়ালে হেলান দিয়ে। তার চোখভর্তি রাজ্যের কৌতূহল! সেই কৌতূহলী চোখভর্তি মায়া। আমি আমার এক জনমে সেই মানুষটার মায়ায় অসংখ্যবার স্তম্ভিত হয়েছি! ভেবে অবাক হয়েছি, মানুষের এতো ছোট্ট বুকে এমন অসীম ভালোবাসা কি করে থাকে!



আমার মা বলেন, আমি নাকি মানুষটার সবকিছু পেয়েছি। দোষ-গুণ সব। আমার কারণে অকারণে মন খারাপ হয়। তুচ্ছ কারণে চোখভর্তি জল চলে আসে। বাইরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনলেও আমার ঠাণ্ডা লেগে যায়। জ্বর-সরদি-কাশি আমার বারো মাসি অসুখ। মানুষটারও এসব অবিকল এমনই ছিল। আমার মা প্রায়ই আমার নাম ধরে ডাকতে গিয়ে মানুষটার নাম ধরে ডাকেন। আমার লম্বা নাকের রহস্য আর কিছুই না, এই মানুষটি ছাড়া।



আমি তখন ক্লাস থ্রী-ফোরে পড়ি। মানুষটা হঠাৎ একটা পত্রিকা হাতে নিয়ে এসে আমাকে চুপিচুপি দেখিয়ে বললেন, 'দেখতো এখানে কি লেখা?' আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখি, তিনি আমাকে নিয়ে এক ছড়া লিখেছেন, সেই ছড়া ছাপা হয়েছে একটি মাসিক ম্যাগাজিনে। সেই ছড়ার প্রথম দুই লাইন, 'ছোট্ট মামা সাদাত ক্লাস থ্রীতে পড়ে, 'অমুক পত্রিকা' হাতে পেলে আনন্দে যায় ভরে'। আমি সেই ছড়া পড়ে কি কোনভাবে উদ্দীপ্ত হই? কি জানি? সে কতকাল আগের কথা! ঢের আগের!



স্মৃতিরা অদ্ভুত অকৃতজ্ঞতায় স্মৃতিভ্রষ্ট হয়!



তিনি মোটরবাইক চালাতে পারতেন। তবে তারও আগে চালাতেন সাইকেল। আমরা তার সাইকেলের পেছনে চাপতে যথেষ্টই বিরক্ত হতাম। কারণ পুরোটা পথে তিনি অসংখ্য জায়গায় সাইকেল থামাবেন। পথে যাকে দেখবেন, মনে হবে তিনিই তার অতি আপনজন। সুতরাং সাইকেল থামিয়ে তিনি তার সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলবেন। কথা শেষে সাইকেলে উঠবেন, দু'পা প্যাডেল চাপতেই তিনি আবার সাইকেল থামাবেন, সামনে তার আরও এক অতি আপনজন। তিনি ঝকমকে চোখে সেই আপনজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলবেন। ছোট্ট আমি চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে তার সাইকেলের পেছনে বসে থাকবো, 'মানুষটার সমস্যা কি?'



তিনি সাইকেলে উঠবেন, যতক্ষণ সাইকেল চলবে, তিনি গুটুর গুটুর করে গল্প করতে থাকবেন, রাজ্যের গল্প। সেই গল্পের আমি কিছু বুঝি না। তাতে রূপকথার গল্প যেমন আছে, আছে রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শনের মতোন কঠিনসব বিষয়। আমি হা করে সেই গল্প শুনি। যদিও বুঝি না কিছুই।



সেবার তার বাইকের পেছনে বসেছি আমি আর আমার ছোট ভাই জামান। দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে তার সাথে বাড়ি ফিরবো। কিন্তু কিছুদূর যেতেই জামান ঘ্যান ঘ্যান করে কান্না শুরু করে। কিন্তু কেন কাঁদে সে বলে না। বাইক থামালেই সে চুপ, চালাতেই শুরু হয় ঘ্যান ঘ্যান। তিনি ৩০ মিনিটের পথ ৩ ঘণ্টায় পাড়ি দেন। কারণ প্রতি দুই মিনিটে তাকে একবার করে মিনিট পাঁচেকের জন্য থামতে হয়। জামানকে চরম ধৈর্য নিয়ে জিজ্ঞেস করতে হয়, কি হয়েছে?'



জামান সাথে সাথে কান্না বন্ধ করে মুখে কুলুপ এঁটে শক্ত হয়ে বসে থাকে, কন জবাব দেয় না। তিনি মমতা জড়ানো গলায় বলেন, 'বলো, কি হয়েছে, বলো'।



জামান জবাব দেয় না। সে দাঁতমুখ শক্ত করে বসে থাকে। ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় রহস্য জট খোলে। বাইকের যে পাইপটা দিয়ে গরম ধোয়া বের হয়, জামানের পা বার বার সেটাতে লাগছিল। তার পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। তিনি একটুও রাগেন না। ব্যাগ খুলে তোয়ালে বের করেন। সেই তোয়ালে নিজের কোলের উপর পাতেন। তারপর জামানকে পেছন থেকে এনে সেখানে অদ্ভুত কায়দায় বসান। এবং সেই অবিশ্বাস্য অবস্থায় বাইক চালিয়ে ঘণ্টা তিনেকের চেষ্টায় বাড়ি পৌঁছান। ছোট্ট আমিও অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। মানুষটা এমন কেন!!



তিনি যখন বাড়ি আসেন, কিংবা আমি যখন তাদের বাড়িতে যাই, অবধারিত বিষয় হলো, আমি রাতে তার কোলের ভেতর গুটিসুটি মেরে রাজ্যের গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাব। আমার ঘুম ভাঙবে কাকডাকা ভোরে। তিনি তখন অপার্থিব কণ্ঠে সুর করে নামাজের ভেতর কোরআনের আয়াত পড়ছেন। কিংবা জায়নামাজে বসে অপূর্ব গলায় কোরআন শরিফ পড়ছেন। আমি চোখ বন্ধ করে সেই সুরের ভেতর তন্ময় হয়ে ডুবে থাকতাম। পৃথিবীটাকে কেমন অদ্ভুত ঘোর লাগা স্বপ্ন মনে হত।



ইশ! এই স্বপ্ন যদি শেষ না হত!



কিন্তু ঘুম ভাঙে, স্বপ্নরা শেষ হয়। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। মানুষটা বিয়ে করে ফেললেন। পরীর মতন সুন্দর এক বউ। কিন্তু আমি সেই বউকে দু'চোক্ষে দেখতে পারি না। কারণ, আমি আর এখন সেই মানুষটার সাথে ঘুমাতে পারি না। মানুষটা ধীরে ধীরে ক্রমশই ব্যস্ত হয়ে পড়েন নতুন জীবনে। আমার চুপিচুপি অভিমান হয়। আমি অভিমানে গাল ফুলিয়ে বসে থাকি।



আমি তখন ইউনিভার্সটিতে পড়ি। আব্বা স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেছেন। ঘোর দুঃসময়। তিনি তার সীমীত সাধ্যের সবটুকু ছায়া মেলে আমাদের ঢেকে রাখার চেষ্টা করলেন। মানুষটা তখন তার ১ ছেলে, ৩ মেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে যাত্রাবাড়ী থাকেন। আমি তখন ঘন ঘন তার বাসায় যাই। আমি সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি তিনি নেই, অফিসে চলে গেছেন। কিন্তু ঘুম ঘুম চোখে আমি আমার ডান হাতখানা নিশ্চিন্তে মাথার বালিশের তলায় চালান করে দেই। সেখানে কড়করে পাঁচশ টাকার নোট। কখনও এক, কখনও দুই, কখনও তিন কিংবা চারখানা। তিনি রেখে গেছেন।



আমি আবার ঘুমাই।



আমি হলে থাকি। জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির মীর মশাররফ হোসেন হল। সেবার প্রবল জ্বর। জ্বরের এস্পার অস্পার অবস্থা। হয় জ্বর থাকবে না হয় আমি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমাকে রেখে জ্বরই পালাল। কিন্তু পালানোর আগে আমার দফা রফা করে গেল! আমি মরার মত পড়ে রইলাম এ ব্লকের ৪০১ নম্বর সিঙ্গেল রুমটায়। সমস্যা হচ্ছে অসুখ বিসুখ হলে আমি কাউকে জানাই না। বাড়িতেতো না-ই। সেবারও জানালাম না। জানালাম, জ্বর ছেড়ে দেয়ার পরে। আম্মা হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলেন, বললেন, 'বাজান, ও বাজান, আমি ঢাকা আহি? ঢাকা?'



আমি বললাম, 'না, আপনের ঢাকা আহনের দরকার নাই, আমি অখন সুস্থ'।

আম্মা বললেন, 'না বাজান, তুমি মিছা কথা কইতাছো'।

আমি বললাম, 'আম্মা শুধু শুধু যন্ত্রণা দিবেন না তো, আমি অখন সুস্থ, এখন আপনে ঝামেলা করলে আমি ফোন টোন বন্ধ কইরা হল থেকে বাই হইয়া যামু'



এই হুমকিতে কাজ হল। আম্মা এই ইস্যুতে থামলেন। তবে সাথে সাথেই নতুন ইস্যু শুরু হল, 'ও বাজান, জ্বর জ্বারি হইলে মাইনষের মুখে রুচি থাহে না, কিছু খাইতে ভাল্লাগে না। তোমার কি খাইতে ইচ্ছা করতেছে বাজান?'



আমি মনে মনে চূড়ান্ত বিরক্ত হলাম। আমার কি খেতে ইচ্ছে করছে, সেটা জেনে আম্মা কি করবে! সে কি খাবার রান্না করে নিয়ে চলে আসবে! আমি বললাম, 'আমার কিছুই খেতে ইচ্ছা করতেছে না'।



এই কথা বলেই মনে হল, কথা সত্য না। আমার ঝাল ঝাল করে রাঁধা ঘন ঝোলের সাথে মুরগীর মাংসের ভুনা খেতে ইচ্ছা করছে। ঝোলের ভেতর দু এক টুকরা আলুও থাকে। এই খাবার আমার অসম্ভব পছন্দের। আমাদের এলাকার বিশেষ এই রান্না। গ্রামে এইটাকে বলে 'ওশ্নাইন্না' মাংস। আমার তখন ওশ্নাইন্না মাংস খাওয়ার জন্য জিহ্বার কাছে জল চলে এলো। ঠাণ্ডা সর্দিতে বন্ধ নাকেও আমি সেই ওশ্নাইন্না মাংশের গন্ধ পেতে থাকি।



আম্মা বলেন, 'না বাজান, সত্য কইরা কও, কি খাইতে ইচ্ছা করতেছে, কও বাজান, কও, তুমি না কইলে আমি আর এক নেলা ভাতও মুখে নিমু না'।



আমি চূড়ান্ত বিরক্ত নিয়ে বলি, 'আম্মা আমার ওশ্নাইন্না মাংশ দিয়া ভাত খাইতে ইচ্ছা করতেছে। বুঝছ এইবার?'



আম্মা আর কন কথা বলেন না। ফোনের ওপারে বসে কাঁদেন। আমি ফোন কেটে দেই।



দুর্বল শরীরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছি। রাত ১১ টায় খট খট শব্দে ঘুম ভাঙে। কেউ দরজার কড়া নাড়ছে। দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি। জ্বরের ঘোরে ভুল দেখছি না তো! সেই মানুষটা দাঁড়িয়ে আছেন। তার সাথে তার ক্লাস সেভেন এইটে পড়া ছেলেটাও। আমার হতভম্ব ভাব আর কাটে না। তিনি প্রবল মমতা নিয়ে আমার কপালে হাত রাখেন। কিন্তু আমার জ্বর টের পান না। কিভাবে টের পাবেন? তার নিজের গা-ও যে পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি। তিনি বালতিতে করে পানি এনে আমার গা মোছান। মাথা মোছান। তারপর তার সাথের ব্যাগ থেকে টিফিন ক্যারিয়ার বের করেন। টিফিন ক্যারিয়ার থেকে ধবধবে সাদা ভাত বের হয়। আর বের হয় ওশ্নাইন্না মুরগির মাংসের শালুন। আমি সেই ওশ্নাইন্না মুরগীর মাংসের শালুন দিয়ে গপগপ করে ভাত খাই।



তিনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।



আমার খাওয়া শেষ হলে যত্ন করে মুখ মুছিয়ে দেন। তারপর আম্মাকে ফোন দিতে বাইরে চলে যান। তখন রাত প্রায় বারো টা। তিনি এখন আবার এই জ্বর শরীরে সেই জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভারসিটি থেকে যাত্রাবাড়ী বাড়ি যাবেন। সকালে অফিস। সাথে করে ছেলেটাকে নিয়ে এসেছেন। ছেলেটার পকেটে এক টুকরো কাগজ। সেই কাগজে বাসার বিস্তারিত ঠিকানা লেখা। যদি জ্বরে অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথাও পড়ে যান। বা খারাপ কিছু ঘটে! আমি বন্ধ দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। দরজার বাইরে মানুষটা আমার মায়ের সাথে কথা বলছেন। আমার মনে হয় আমার চোখের সামনের দরজাটা ধীরে ধীরে আবছা হয়ে যাচ্ছে। আমি মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছি। আমার খুব ইচ্ছে হয় চিৎকার করে মানুষটাকে ডাকতে। কিন্তু কেন জানি পারি না।



এখনও পাড়ি না। মানুষটার সাথে দেখা হলে খুব স্বাভাবিক গলায় কথা বলি। একটা দুটা কথা। তারপর মানুষটাও আর কিছু বলার খুঁজে পান না, আমিও না। আমরা উঠে যাই। আমার খুব ইচ্ছে হয় মানুষটার গা ঘেঁষে বসি, বসে জিজ্ঞেস করি, 'আপনি কি আমাকে আর আগের মতো ভালবাসেন না?' আমার জিজ্ঞেস করা হয় না। মানুষের অনেক ভাবনা ভাবনা অবধিই থেকে যায়, বলা হয়ে ওঠে না। এই ভাবনাটাও এমন।



তবে আমি প্রায়ই একা একা ফিস ফিস করে বলি, 'মামা, আপনি কি জানেন, শুধু আপনার জন্যই এই 'মামা' শব্দটার ভেতর দু দু'জন মা মিশে আছেন। দুই দুইজন মা। জানেন মা মা?' মামা জানেন কি না আমি জানি না। তবে আমি জানি। পৃথিবীতে অদ্ভুত গভীর কিছু সত্য আছে, যে সত্যগুলো সবাই জানে না। কেউ কেউ জানে।



আমি সেই কেউ কেউ'র একজন।

--------------------------------------

মা+মা=মামা/ সাদাত হোসাইন

০৩.০৩.২০১৪

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.