![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...
মাসুদ চলে যাওয়ার আগে আমার হাত ধরল। হাত ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, 'দোস্ত যাইগা, সামনের শুক্কুরবার উত্তরকান্দির লগে খেলনের সময় আমার কথা মনে করিস। আগেরবার কিন্তু আমিই জিতাইছি। মনে নাই, খেলা শেষ হওনের আগের মিনিটে গোল দিছিলাম!'
আমি মাসুদকে বললাম, 'তুই যাস ক্যান? ওই ইশকুলে গিয়া কি করবি?'
মাসুদ বলল, 'আমিতো যাইতে চাইই না, আব্বায় না জোর কইরা লইয়া যায়, আব্বার চাকরীর পুস্টিং উইখানে। যাইতেই হইব'।
- ধুর, অইখানে গিয়া দেখবি তর মন খারাপ হইয়া থাকবো। অইখানে ইশকুলের লগে এমুন গাঙ আছে? কিস্নচূড়া গাছ আছে? তরেতো ফুটবল খেলতেও লইব না'।
মাসুদ ফসফস করে বার দুয়েক বুক ভরে শ্বাস নিল। তারপর হাতের মাসল ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, 'যেইটায় খেলতে না নিব, সেইটারই কাইনসার নিচে চটাং চটাং দুইখান দিমু, বাপ বাপ কইয়া নিব। মাসুদরে চেনে নাই। হুহ!'
আমার মন খারাপ। আমাদের মন খারাপ। রকিব, সুজন, আমি , আমাদের সবার। কিন্তু আমরা সবাই ফিক করে হেসে দেই। সমস্যা হচ্ছে মাসুদ চলে গেলে উত্তরকান্দির সাথে সামনের শুক্রবারের ফুটবল ম্যাচে আমরা জিততে পারবো না। কাদা মাঠে ফুটবল খেলার চেয়ে বেশি হয় ল্যাং মারা আর গা জোয়ারি কসরত। তাতে মাসুদের চেয়ে দক্ষ খেলোয়াড় আর কেউ নেই। সে থাকা মানে নিশ্চিত জয়। তার গায়ে ষাঁড়ের মতন শক্তি!
কিন্তু মাসুদ চলে যাচ্ছে।
মাসুদ চলে গেল।
আমরা শুক্রবারের ম্যাচে হেরে গেলাম। হেরে গেলাম মানে খেলা শেষ হওয়ার আগেই মোটামুটি হেরে গেছি। হাফ টাইমের মধ্যেই দুই গোল খেয়ে ভুস। এর মধ্যে একজনের পা মচকে গেছে। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ ছেড়েছে। শামুকে পা কেটে আরেকজনের রক্তারক্তি অবস্থা। আমাদের চিন্তা ভাবনা তখন এমন যে বাকি অর্ধেক টাইম খেলা না হলেই বাঁচি। ২-০ মোটামুটি সম্মানজনক হার। মান সম্মান কিছু থাকতে পুরোপুরি হারানোর দরকারটা কি?
সমস্যা আরও আছে। গোলকীপার সুজন পায়ে ব্যথা পেয়ে মাঠের পাশের উঁচু মাটির ঢিবির উপর বসে কোকাচ্ছে। সে আর মাঠে নামবে না। কিছুতেই না। আমি গিয়ে তার পা ধরলাম, 'তোরে একটা ডাইক্লফেনাক কিনে দেই, খাইয়া খালি পোস্টের নিচে দাড়াই থাকবি, বলও ঠেকান লাগব না। ভাই আমার'।
সুজন ঘোঁত করে উঠে বলে, 'তুই যাইয়া খাড়া, তুই গিয়া গুলকি হ। আমি খেলুম না, আমি পারুম না, পারুমই না...'। সুজন কথা শেষ করতে পারল না। ঢিবির উপর থেকে ছিটকে পড়লো মাঠে। লাথিটা খুব জোরে লাগে নি কিন্তু তাতেই সে ছিটকে পড়েছে। লাথিটা লেগেছে তার পাছার নরম মাংসে। তেমন ব্যাথা পাবার কথা না। কিন্তু ছিটকে পড়া সুজন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কে মারল লাথিটা? আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। মাসুদ! মাসুদ দাঁড়িয়ে আছে রেইনট্রি গাছে হেলান দিয়ে। তার পড়নে লুঙ্গী, সেই লুঙ্গী মালকোঁচা মেরে পালোয়ানদের মত দাঁড়িয়ে আছে সে। তার চোখ শান্ত। কিন্তু চোখ ভর্তি দুষ্টুমি। সে চোখের ঈশারায় সুজনকে উঠতে বলল। সুজন বিনাবাক্যব্যায়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর গোলপোস্টের নিচে গিয়ে দাঁড়ালো। মাসুদ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, 'সকাল বেলায় টরকীর লঞ্চ আহে মধুপুর থেইক্যা। হেই লঞ্চে চইর্যা আইয়া পড়লাম। আব্বারে কইছিলাম ফজরে নামাজ পড়তে মসজিদে যাই। আব্বা তার ধোয়া লুঙ্গী দিল। সেই লুঙ্গী ফিন্দা আন্ধার থাকতে থাকতে লঞ্চে উইঠা পড়ছি'।
আমি কোন কথা বলি না। মাসুদের দিকে তাকিয়েও থাকি না। খেলতে মাঠে নামি। হাফ টাইম শেষে খেলা আবার শুরু হচ্ছে। মাসুদ ফসফস করে বার দুয়েক বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারপর হাতের মাসল ফুলিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলে, 'চাইরদিন হইলো মধুপুর গেছি। এরমইধ্যে তিনজনরে কেলাইছি। চিন্তা কইরা গেছিলাম প্রত্যেকদিন একটা কইরা কেলামু, পারলাম না। ভাগে একটা কম পইর্যা গ্যাছে। আইজ এই শালাগো দিয়া উসুল করমু।' বলে ফে ফে করে হাসল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলল, 'হাফ টাইমের মইধ্যে কয় গোল খাইছস?'
কয় গোল খেয়েছি সেই হিসেব আমি দেই না। আমার আর হিসেবের দরকারও নাই। হিসেব যা নেওয়ার তা মাসুদ নিজ দায়িত্বেই নিবে। মাসুদ মালকোঁচাটা আরও শক্তভাবে বেঁধে রেডি হয়। খেলা শুরু হচ্ছে।
খেলা শুরু হোল, খেলা শেষও হোল। মাসুদ মাঠের মাঝখানে হা করে শুয়ে হো হো করে হাসছে, 'কি রে, ক্যামন দেখলি? তিনডার ঠ্যাংতো তিনমাসের জন্য ঝুলাই দিলাম!
আমি বরাবরই খানিক নরম প্রকৃতির। মিনমিন করে বললাম, 'অমনে না মারলেও পারতি'।
মাসুদ রক্তচক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকায়, তারপর বাঁকা গলায় বলে, 'তুমি তো আর চান্দু ল্যাঙ মারা খাও নাই, খাইছে সুজন আর রকিব, অগোরে জিগাও কেমন লাগতেছে! আর অমনে মারছি দেইখাই বল নিয়া যাওনের সময় আমার সামনে আর কেউ আসনের সাহস পায় নাই। দুই গোলের জইন্য ছোঁয় গোল। হা হা হা। দেড় হালি। হা হা হা। হাফ ডজন। হা হা হা।
হাসতে হাসতে মাসুদের চোখে পানি চলে আসছে। ওর না ঘুমানো চোখ লাল। আমি সেই হাসি মাখা লাল চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মাসুদের সাথে দেখা দীর্ঘ কুড়ি বছর পর।
হটাত করেই দেখা। শুকনো হাড় জিরজিরে চেহারার ছেলেটা মাসুদ আমার বিশ্বাস হয় না। ছেলেটা দাঁড়িয়েছিল ছবির হাঁটের ভেতর। মুখভরতি না কামানো দাড়ি। সে আমাকে দূর থেকে ডাকল। এবং হাত ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, 'দোস্ত চিনছস আমারে? আমি মাসুদ। গুন্ডা মাসুদ। ওই যে ল্যাঙ মারায় ওস্তাদ প্লেয়ার মাসুদ'।
আমি মাসুদকে চিনলাম। মাসুদ আমার কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, 'এখন কি করস দোস্ত?'
আমি বললাম, 'চাকরি করি'
- কিসে চাকরী করস?
- করি একটা বিদেশী ফার্মে।
- বিদেশী ফার্ম? মাশাল্লাহ। বেতন টেতনতো মেলা দেয় না?'
আমি খানিক বিব্রত হই এবং বিব্রত গলায় বলি, 'এই দেয়, চলে যায় মোটামুটি ভালোই'।
- দোস্ত হাজার পাঁচেক টাকা দিতে পারবি? তোগো জানাইতে পারি নাই, বিয়া কইরা ফালাইছিলাম বছর দুই আগে। গতমাসে আল্লায় একটা পোলাও দিছে, আর কপালডাই এমন, চাকরিডাও গেল। এখন পোলাডার দুধের পয়সাও নাই রে দোস্ত। খুব লজ্জার কথা কিন্তু তোর কাছে লজ্জা কি, একসাথে কত ল্যাংটা হইয়া গাঙ্গের মইধ্যে ডুবাইছি, মনে আছে না দোস্ত?'
আমার সব মনে আছে।
মাসুদ যে একটা মেয়েকে দেড় হালি বছর ধরে, হাফডজন বছর ধরে পাগলের মতন ভালোবাসতো তাও মনে আছে। শিখা নামের মেয়েটার কথাও মনে আছে। লম্বা মুখের ফর্সা মেয়েটা। খুব হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলত। বিয়ে করবে বলে মাসুদ গ্রামের ধানী জমিটা বেঁচে দিয়েছিল, তাও মনে আছে আমার। মোহাম্মদপুরে দুইরুমের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিল সে। টুকটুক করে কিছু ফার্নিচারও কিনে ফেলেছিল। কাঁচের প্লেট, গ্লাস, কাপ পর্যন্ত। কিন্তু শিখা চলে গিয়েছিল। হুট করেই চলে গিয়েছিল। মামাতো ভাই রাফি'র সাথে। আমেরিকা! সাত হাজার মাইল দূরে। স্ট্যাচু অফ লিবার্টির দেশ। শিখা পেয়ে গেল সীমাহীন লিবার্টি কিন্তু মাসুদ হয়ে গেলো স্ট্যাচু। সেই স্ট্যাচু তারপর ডুবে গেলো অন্ধকারে। গভীর অন্ধকারে। আমার সাথে ওর দেখা হয় নি। কিন্তু ওর খবর শুনেছি এর ওর কাছে। গত বছর দুই আগে মাসুদকে সেই অন্ধকার থেকে ফেরাতে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে। গত মাসে একটা বাচ্চাও হয়েছে তাহলে!
আমি পকেট থেকে টাকা বের করি। ৫ টা এক হাজার টাকার নোট। টাকাগুলো মাসুদের হাতে দেই। মাসুদ হাত বাড়ায়। হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো ধরে। সেই টাকা ধরা হাত কাঁপে। সেইদিনের মতন। সেই যে মাসুদ চলে যাওয়ার দিনের মতন। আজও মাসুদ চলে যাওয়ার আগে আমার হাত ধরল। হাত ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, 'দোস্ত যাইগা, পোলাডার জন্য দুধ কিনতে হইব'।
আমি মাসুদের হাতের দিকে তাকাই। হাতভর্তি অজস্র কাঁটাছেড়ার দাগ। ধারালো ব্লেডে হিজিবিজি অসংখ্য ক্ষত। আমি সেই ক্ষত থেকে চোখ সরিয়ে মাসুদের চোখের দিকে তাকাই। মাসুদের চোখ এখনও লাল। মাসুদ সেই লাল চোখে একবার আমার চোখের দিকে তাকায়, একবার তার হাতের ক্ষতগুলোর দিকে। তারপর হটাত হো হো করে হাসে, হাসতে হাসতে বলে, 'তুই ভাবছস আমি অখনও নেশা করি? নেশা? হা হা হা! হা হা হা! নেশাতো কবেই ছাইড়া দিছি। অখন আমি পোলার বাপ। পোলার বাপের নেশা করণ ঠিক না। ঠিক না। এই টাকা দিয়া পোলার দুধ কিনতে হইব। দুধ। হা হা হা...'।
আমি কিছু বলি না। হাসতে হাসতে মাসুদের চোখে পানি চলে আসছে। ওর না ঘুমানো নেশাশক্ত প্রবল ঘোরের চোখ। একজোড়া লাল চোখ। আমি সেই হাসি মাখা লাল চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মাসুদ হাসছে! কোন মাসুদ?
---------------------------------------------------------
অন্য মানুষ/ সাদাত হোসাইন
১০.০৩.২০১৪
১০ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:২২
সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ ভাইয়া
২| ১০ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:৪৩
উদাস কিশোর বলেছেন: ভাল লাগলো
১০ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:২২
সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ
৩| ১০ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:৪৯
অন্ধকারে একজন বলেছেন: ভীষণ আবেগী গল্প। ছোটবেলার বন্ধুদের কথা মনে করিয়ে দেয়। আজও পথে ঘাটে দেখা হলে আমি বা তারা ঝাপিয়ে পড়ি একে অন্যের উপর। সে যে কি ভীষণ ভালো লাগা প্রকাশ করা যায় না।
লাইক বাটন খালি ঘুরে আর ঘুরে। সামু'র মডুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এর সমাধান করুন আপনাদের প্লিজ লাগে।
১০ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:২৩
সাদাত হোসাইন বলেছেন: আজও পথে ঘাটে দেখা হলে আমি বা তারা ঝাপিয়ে পড়ি একে অন্যের উপর। সে যে কি ভীষণ ভালো লাগা প্রকাশ করা যায় না
আসলেই তাই.।
৪| ১০ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:৪৫
সালমা শারমিন বলেছেন: darun likhesen. sriti cuye jay muhurte.
১০ ই মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১:৫৫
সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ
৫| ১০ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১১:৪৯
পরের তরে বলেছেন: আপনার লেখার হাত অনেক ভাল। ভাল লাগল।
১০ ই মার্চ, ২০১৪ দুপুর ১:৫৫
সাদাত হোসাইন বলেছেন: ধন্যবাদ
৬| ১০ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ৮:০৩
উদাস কিশোর বলেছেন: দারুন লিখেছেন ।
অসাধারন
৭| ১০ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ৮:০৪
উদাস কিশোর বলেছেন: আবারও পড়লাম তাই আবারো মন্তব্য জানিয়ে গেলাম
৮| ১০ ই মার্চ, ২০১৪ রাত ১০:২৩
স্বপ্নচারী গ্রানমা বলেছেন:
মাসুদ সেই লাল চোখে একবার আমার চোখের দিকে তাকায়,
একবার তার হাতের ক্ষতগুলোর দিকে।
অনেক ভালো লাগলো গল্প !
ভালো থাকুন ।
৯| ১২ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:০০
নষ্ট অবতার বলেছেন: অনেক ভালো লাগলো... ++
©somewhere in net ltd.
১|
১০ ই মার্চ, ২০১৪ সকাল ১০:৩৭
শরৎ চৌধুরী বলেছেন: বেশ। +।