নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রতিবাদের ভাষা

০৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:০৩

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘটনা।

হলের ক্যান্টিনে খেতে গিয়েছি। প্রচণ্ড ভিড়। পিচ্চি পিচ্চি ক্যান্টিন বয়গুলো খাবার দিতে হিমশিম খাচ্ছে। আমি প্লেটে অর্ধেক খাবার আর এঁটো হাত নিয়ে বসে আছি ১৫ মিনিট ধরে। বাকী খাবারের খবর নেই। শুধু যে আমি একা বসে আছি, তা না। আমার মতো আরও অনেকেই বসে আছে। এই মুহূর্তে তিনি সদলবলে ঢুকলেন। তিনি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা। তিনি সিংহের মতন ঢুকলেন। মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো টেবিলটা ফাঁকা হয়ে গেলো। আর সব কাজ বাদ দিয়ে পিচ্চি দুজন ক্যান্টিন বয় হাওয়ার বেগে ছুটে এলো। ধুয়ে মুছে ঝকঝকে করে দিল বিশাল টেবিলখানা। টেবিলের চারপাশে দলবল নিয়ে হাত পা ছড়িয়ে বসলেন তিনি। ক্যান্টিন মালিক মতি ভাই দৌড়ে ক্যাশ ছেড়ে ছুটে এলেন, 'ভাই, কি কি খাইবেন? ভালো পাবদা মাছ আছে, খাশির মগজ আছে, আর গরুর মাংস। লগে চ্যাপা শুটকীর ভর্তা'।



তিনি নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে কেশে গলা পরিষ্কার করলেন, তারপর টেনে টেনে বললেন, 'মো-ও-ও-ও-তি-ই ভাই, আপনে জানেন না, আমি শুঁটকি খাই না?'



মতি ভাই তার এহেন স্মৃতিভ্রষ্টতায় যারপরনাই বিব্রত, ভীত এবং বিগলিত। তিনি বিনয়ে মাটির সাথে মিশে যেতে যেতে বললেন, 'ভুল হইয়া গ্যাছে ভাই, আপনেতো টাকি আর চিংড়ি ভর্তা খান। আইজ বাজারে টাকি মাছ পাই নাই, তয় চিংড়ি ভর্তাটা ইশপেশাল আপনের জন্যই করা হইছে, ওই চিংড়ি ভর্তা দে, আর লগে পাবদা মাছের ভুনা, আর খাশির মগজ'।



ক্যান্টিনের গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল রাজু। ক্যান্টিনের সবচেয়ে ছোট্ট ক্যান্টিন বয়। কেবল মাস খানেক হয় কাজে এসেছে। রাজুর চোখের কোণায় চিকচিক করছে পানি। আমি বললাম, 'কি রে রাজু, খাবার আর দিবি না? কান্দস ক্যান?'



রাজু গুটি গুটি পায়ে আমার কাছে আসলো, তারপর বলল, 'ইট্টু আগে (আরেক নেতা) ভাই আইছিল, খাওন দিতে দেরি হইছে দেইক্ষ্যা দুইডা থাবড় দিছে গালের মইধ্যে, আর দ্যাহেন, গরম ভাতের প্লেট ধইর‍্যা ছুইর‍্যা মারছে... আমাগো কি দোষ কন? খালি খালিই মারে, আমরা কি ইচ্ছা কইর‍্যা দেরি করি? তাও...'



রাজু কথা শেষ করতে পারল না, পেছন থেকে এই মাত্র আগত নেতা চিৎকার দিয়ে ডাকলেন, 'ওই পিচ্চি, পানি লইয়ায়, ঠাণ্ডা পানি'।



রাজু আর কথা বলল না, দৌড়ে পানি আনতে ছুটল। আমি বুঝলাম, আজ আর বাকী খাবারের অপেক্ষা করে লাভ নেই। এঁটো হাতে বসে থাকারও মানে হয় না। আমি খাবারের প্লেটটা সামনে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এই সময়ে শব্দটা শুনলাম। প্রথমে বিকট শব্দে থাপ্পরের শব্দ হল, রাজু তার পিচ্চি শরীর নিয়ে ছিটকে পড়েছে মেঝেতে। সাথে তার হাতের কাঁচের গ্লাসটাও। মেঝের পানির ভেতর থেকে রাজু উঠে দাঁড়ালো। ততক্ষণে নেতার মুখে গালির তুবড়ি, 'হারামজাদা, গ্লাস দেওয়ার আগে দেখন যায় না গ্লাস ধোয়া না আধোয়া? গ্লাসে ময়লা ক্যান? ওই হারামজাদা, ওই? যা, গ্লাস মাইজ্জা চকচক কইর‍্যা পানি নিয়ায়, যা...'



রাজু কোন কথা বলে না। সে চুপচাপ হেঁটে ক্যান্টিনের পেছনে বাসন মাজার কলের কাছে যায়। আমিও ওর সাথে সাথে যাই, 'এতো মাইর খাস, তাও হয় না? একটু ভালো কইরা ধুইয়া দেওন যায় না?'



রাজু কাঁদে না, ঠাণ্ডা গলায় বলে, 'ধুইয়াই দিছি মামা, ময়লা আছিল না, ওইডা গ্লাসে দাগ আছিল, হ্যারা আইলেতো আমরা মাইরের ডরে সবচেয়ে ভালোডাই দেই। মাইর খাইতে কেডা চায়? তাও হ্যারা মারে'।



আমি আর কোন কথা বলি না, রাজুর দিকে তাকাই। নির্লিপ্ত চোখ সাপের মতন ঠাণ্ডা। রাজু কে বাসন মাজার কলের কাছে রেখে ফিরে আসি। তারপর হঠাৎ মনে হলো, যাই, ওকে ১০ টা টাকা দিয়ে আসি। বেচারা আজ যা মারগুলাই না খেল! ঘুরে তাকিয়ে দেখি, ঝকঝক করে মাজা কাঁচের গ্লাস ভর্তি পানি, সেই পানির কাছে মুখ নিল রাজু, তারপর থুক করে এক দলা থুথু ফেললো গ্লাসের পানিতে। তারপর হনহন করে হেঁটে গেল খানিক আগের সেই সিংহ মানব নেতার কাছে। ঝকঝকে মাজা গ্লাসের পরিষ্কার স্বচ্ছ পানি তিনি তৃপ্তি নিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেললেন, তারপর ফোঁস করে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, 'তোগো মাইরের উপর না রাখলে কোন কামই হয় না ব্যাটা। মাইর দিছি তো সব ঠিক। যারে যা দিতে হয়'।



আমি জানালার বাইরে থেকে মানুষটার তৃপ্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকিয়ে রইলাম রাজুর চোখের দিকেও। সেই চোখ জোড়া নির্লিপ্ত। সেই চোখে অজস্র ভাষা। এই ভাষা আমার পড়তে পারার কথা ছিল। কিন্তু আফসোস, প্রতিবাদের সব ভাষা আমাদের জানা নেই।



আর জানা নেই বলেই, আমরা শাসক শ্রেণী নিজেদের সবসময়ই বিজয়ী ভাবি, ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। একবারও ভাবি না, মমতা ভালোবাসা যেমন মমতা আর ভালবাসাই ফিরিয়ে দেয়, তেমনি উল্টোটা ঘটে, উল্টো এবং ভয়ংকর পথে...

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৩

ঢাকাবাসী বলেছেন: রাজুদের সংখ্যা নেই বললেই চলে!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.