![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...
প্রতিদিন একই বাস। একই বাস স্ট্যান্ড। একই সময়, সকাল ৮ টা।
এবং সেই একই যাত্রী, যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন, একই।
আকিবের ঘুম ভাঙে ৭ টা পঁচিশ কিংবা তিরিশে। সে যখন বাসা থেকে বের হয়, তার ডান হাতে থাকে অফিসের ব্যাগ, বা হাতে ব্রাশ। মুখের ভেতর। সে দৌড়ায়। বুয়া রোজ রাতে রান্নার সময় ব্যাগের ভেতর পানির বোতল গুঁজে দেয়। আকিব বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে কুলি করে। মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। তারপর বোকা বোকা চোখে এদিক সেদিক তাকায়। যাত্রী লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। দৃশ্যটা চেনা। রোজকার। আজকাল কেউ আর পাত্তা দেয় না। বাঁশির মতন লম্বা নাকের মেয়েটাও না। সে দীর্ঘ লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রোজ যেমন থাকে। আজও।
আকিবও মেয়েটার দিকে তাকায় না। তার তাকানোর মানুষ আছে। ওই যে অইখানে। মাথা উঁচু করলেই দেখা যায়। সে মাথা খানিক উঁচু করে তাকায়। বিলবোর্ডে চোখ পরতেই রোজকার মতোই সে মুগ্ধ গলায় অস্ফুট বলে 'আহা, যেন ডানাকাঁটা পরী'।
-'ওই চেহারারে আফনের পরী মনে অয়? আফনের রুচিতো দেহি মেলা খারাপ ভাই!'
আকিব পেছন ফেরে। কানে দুল পড়া ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। গলা ভর্তি চেইন। বা হাতের কবজি জুড়ে ব্রেসলেট। কখন পিছে এসে দাঁড়িয়েছে! আকিব ফ্যা ফ্যা করে হাসে। তাহলে শব্দ করেই বলে ফেলেছিল সে! কি আর করা! তার রুচি না হয় খারাপই! তারপরও সে বিলবোর্ডের মেয়েটার দিকে তাকিয়েই থাকে। তাকিয়েই থাকবে। প্রয়োজন হলে সারাদিন তাকিয়ে থাকবে।
বাস আসলে সে গুটিগুটি পায়ে উঠে পড়ে। ডান পাশে মুখ ঘুড়িয়ে সাবধানে বাসে ওঠে। তারপর সোজা পেছনের সিটে। জানালার পাশে। জানালায় ঘাড় ঘুড়িয়ে সে বিলবোর্ড দেখে, যতক্ষণ দেখা যায়। সে কখনও ডান পাশে তাকায় না। ডান পাশের দ্বিতীয় সারিতে তো নয়ই। ওখানে বাঁশির মতন লম্বা নাকের মেয়েটা বসে। রোজ বসে। তার পাশের সিটটা ফাঁকাই থাকে। কারণ, একাই দু খানা টিকেট কেটে বসে সে।
সমস্যা হচ্ছে বাস চলতে শুরু করলেই ধীরে ধীরে বিলবোর্ডটা পেছনে চলে যায়, আর আকিবের মনে পড়ে যায় প্রথম দিনের কথা। অফিসের সেই প্রথম দিন। ১ তারিখে অফিসের জয়েনিং ডেট ছিল। কিন্তু ৩১ তারিখ রাত অবধি সে গ্রামের বাড়ি। তার আগের রাতে সারারাত জার্নি করে সে জরুরী কাজে বাড়ি গিয়েছিলো। আর পরের সারা রাত নির্ঘুম বাস যাত্রা শেষে যখন ঢাকায় ফিরল, তখন ভোরের আলো ফুটেছে। আকিব মেসে পৌঁছে শুধু কাপড়টা বদলে নিয়ে আবার ছুটল।
এই একই বাস স্ট্যান্ড, একই বাস, একই সময়ের সেই শুরু।
সে ঢুলুঢুলু চোখে বাসে এসে ধপ করে বসে পড়লো। তারপর মাথা এলিয়ে দিল পাশের মানুষটার কাঁধে। প্রথমে আলতো হাতের ধাক্কা, তারপর আরও খানিক জোরে, তারপর আরও। আকিব প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে অর্ধেক চোখ মেলে বলল, 'কি সমস্যা আপনার? ৫ মিনিট ঘুমাতে দেন, তারপর সটান বসে যাব'।
মেয়েটা হতভম্ব হয়ে আকিবের দিকে তাকিয়ে থাকল, 'এটা কি ধরণের কথা!'
সে ধাক্কা দিয়ে কাঁধ থেকে আকিবের মাথা সরিয়ে দিল। আকিবের ঘুমের ঘোর তাও কাটল না। আকিব ঘুম জড়ানো গলায় এলোমেলো ভঙ্গীতে হাতের ৫ আঙুল তুলে বলল, '৫ মিনিট, মাত্র ৫ মিনিট, তারপর উঠে যাব, ডিস্টার্ব করেন না, প্লিজ!'
মেয়েটা কিছু বলল না। জানালার পাশের সিট ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ালো। বাসে আর কোন সিট ফাঁকা নেই। সে দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে বলল, 'যান এইপাশে বসেন, এইগুলা যে কোত্থেকে আসে! যত্তসব!'
আকিব শুনল কি না বোঝা গেলো না, চোখ বন্ধ করে সে তখনও ঢুলছে। কিন্তু ঘুমের মধ্যেই সে হাচরে পাঁচরে জানালার পাশের সিটে গিয়ে বসলো। এবং জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে গেল। তার মুখ হয়ে আছে হা। ভাগ্য ভালো যে বাসের লাস্ট স্টপে সে নামবে। বাস থামার আধা ঘণ্টা পরে বাসের কন্ডাক্টর তাকে ডেকে তুলল। আকিব লম্বা হাই তুলে বলল, 'চলে আসছি তাহলে?'
আকিবের ঘুম যেন তখনও ভাঙে নি। ঘুম ভাঙল অফিসে ঢুকে। বাসে আধবোজা চোখে সে যে মেয়েটিকে দেখেছিল, অফিসের করিডোরে সেই মেয়েটিকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে গেল আকিব! মেয়েটি তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আকিবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। পুরোপুরি ঘুম ভেঙ্গে গেলো কাজ বুঝে নিতে গিয়ে। মেয়েটি আর তার বসার জায়গা পাশাপাশি। সেও আজই জয়েন করেছে। আকিবের ডান পাশেই মেয়েটার ডেস্ক। আকিব ডান পাশে তাকানো পুরোপুরি বন্ধ করে দিল! কেউ জিজ্ঞেস করলেই আকিব করুণ মুখ করে বলে, 'আহ, ঘাড়ে ব্যথা! ঘাড়ে ব্যথা!'
আকিবের ব্যথাও আর সারে না। তার ডান দিকে তাকানোও আর হয় না। কিন্তু কাজ হয়। নিঃশব্দ কাজ। আকিবের ফাইল গুলো আকিব পাশের টেবিলে নিজে গিয়ে দিয়ে আসে না, পিওন মান্নানকে ডাকে। মান্নান মুখ টিপে হাসে। শুধু মান্নান না, আরও অনেকেই হাসে। কিন্তু আকিব ডান দিকে তাকায় না। এবং কেউ একজন বা দিকেও না।
কিন্তু রোজ সেই একই বাস, একই সময়, একই দীর্ঘ লাইন, একই অফিস, একই ডেস্ক!
আকিব আজও অফিসে ঢুকল।
বড় স্যার হঠাৎ ডাকলেন, 'আকিব, এখন থেকে লীনা'র প্রজেক্টটাও তোমাকে দেখতে হবে, যতদিন না ওর জায়গায় অন্য কাউকে আমরা রিক্রুট করছি'।
এই সময়টায় আকিবের চোখে ঘুম লেগে থাকে, ঘুম কাটতে সময় লাগে। কিন্তু বড় স্যারের কথায় তার ঘুম কেটে গেল, সে যেন ঝট করে জেগে উঠলো, 'ক্যানো স্যার?'
-'ওহ! তুমি এখনও জানো না? লীনাতো কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে গেছে! ও অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে, সবাইতো জানে! কি সমস্যা তোমাদের! এতদিন ধরে একসাথে কাজ করছ! অথচ...'।
আকিব বড় স্যারের কথা শেষ করতে দেয় না, 'উনি কবে যাচ্ছেন স্যার?'
-'নেক্সট উইকে, তুমি ওর থেকে কাজগুলো বুঝে নিও'।
আকিব কাজগুলো বুঝে নেয়। কথা হয়, আবার হয়ও না। কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। দুপুরে লাঞ্চ শেষে ডেস্কে ফিরে আকিব হঠাৎ ডান পাশটায় তাকায়। ডেস্কটা ফাঁকা। লীনার লাঞ্চ তাহলে শেষ হয় নি এখনও? কিন্তু সারা দিনই ডেস্কটা ফাঁকা পড়ে থাকে। শুন্য। আকিব কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করে না। কি দরকার?
পরদিন কাকভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় আকিবের। সে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়ায়। ৭ টার বাস শেষে ৮ টার বাসের লাইন দীর্ঘ হয়, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। কিন্তু লাইনের সামনের সেই একই মানুষটা আর নেই।
সেই একই বাস, সেই একই লাইন, সেই একই সময়।
কিন্তু সেই লম্বা বাঁশির মতন নাকের মেয়েটাই শুধু নেই। অথচ আকিবের হঠাৎ সব অচেনা লাগে। ভীষণ অচেনা। তার একবারও মাথা তুলে তাকাতে ইচ্ছে করে না, বিলবোর্ডের ডানা কাঁটা পরীটার কথা সে ভুলে যায়। সে গুটিগুটি পায়ে বাসে ওঠে। সে ডান দিকের দ্বিতীয় সারির সিটের দিকে তাকায়। একটা বুড়ো লোক বসে আছে, তার পাশে ছোট্ট এক মেয়ে। আকিব চুপচাপ পেছনের সিটে গিয়ে বসে। তারপর তাকিয়ে থাকে। তাকিয়েই থাকে। নিঃশব্দ জানালায়।
তিন দিন। আকিব আজকাল আর বা দিকে তাকায় না। সে সারাদিন ডান পাশেই তাকিয়ে থাকে। কিন্তু গত তিন দিন ধরেই ডান পাশের ডেস্কটা ফাঁকা। আকিব কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করে না। করবেও না। সে পারে না। কিন্তু সেদিন দুপুরে খাবার টেবিলে হঠাৎ মান্নান এসে উদয় হয়, 'স্যার, লীনা ম্যাডাম বিদাশ যাইবতো, হেই জন্য আগে থেইকাই ছুটি নিছে, কেনাকাটা করন লাগব, আরও অনেক গুছগাছের কাম আছে। হে খালি আর একদিন অফিসে আইব, যাওনের আগের দিন, সবাইর কাছে বিদায় নিতে'।
আকিব ম্লান হাসে, 'ও আচ্ছা।'
মান্নান পকেট থেকে কার্ড বের করে আকিবের হাতে দেয়, 'লীনা ম্যাডাম কইছে, প্রোজেক্টের কাজে কিছু জানতে যদি দরকার হয় তাইলে হের এই কাডের নাম্বারে ফোন দিতে...'
আকিব কার্ডটা পকেটে রেখে দেয়।
গভীর রাতে ঘুম ভাঙে আকিবের। সে আঁতিপাঁতি করে কার্ডটা খোঁজে। তারপর লীনার নাম্বারে অদ্ভুত একটা টেক্সট লেখে, 'আমার আর বাসের লাইনে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না, লাইনের সামনে কাউকে দেখতে ইচ্ছে করে না, বাসে উঠতে ইচ্ছে করে না, বাসের সামনের সিট দুটোতে অন্য কাউকে দেখতে ইচ্ছে করে না, অফিসে যেতে ইচ্ছে করে না, একটা ডেস্ক ফাঁকা দেখতে ইচ্ছে করে না... এতো কষ্ট হয়! এতো...!'
আকিব ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, সারারাত। কিন্তু একবারও শব্দ করে না ফোন। একটা মেসজেও আসে না।
আকিব উঠে গোসল সাড়ে। ব্রেকফাস্ট করে। বাসা থেকে বেরুনোর ঠিক আগ মুহূর্তে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা হঠাৎ ছলকে ওঠে, লীনার মেসেজ! সে মেসেজটা খোলে। সেখানে জ্বলজ্বল করছে একটা লাইন, 'আই টোল্ড ইউ টু নক মি অনলি এবাউট অফিসিয়াল ম্যাটারস, নাথিং এলস'।
আকিব দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতরটা কেমন দম বন্ধ হয়ে যায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। সে চুপচাপ হেঁটে বাস স্ট্যান্ডে যায়। লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। লাইনের মাথায় মাঝবয়সি এক মহিলা দাঁড়িয়ে। আকিবের চোখটা হঠাৎ জ্বালা করে ওঠে। কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। কান্না লুকাতে কি না, কে জানে, আকিব মাথা তুলে আকাশে তাকায়। সেখানে সেই বিলবোর্ডটা। কিন্তু ঝাপসা চোখে আকিব কিছু দেখতে পায় না। কিছুই না।
- 'একটা বিলবোর্ডের ভাড়া কত?'
আকিব পেছন ফিরে তাকায়। বাঁশির মতন লম্বা নাকের মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, লীনা! লীনা খুব স্বাভাবিক গলায় বলে, 'আচ্ছা একটা বিলবোর্ডের ভাড়া কত? ভাবছি এই বিলবোর্ডটা ভাড়া নেব?'
আকিব অবাক গলায় বলে, 'ক্যানো?'
- 'নিজের ছবি টানিয়ে রাখার জন্য'।
আকিব কিছু বুঝতে পারে না, সে বিভ্রান্তের মতন বলে, 'ক্যানো? বিলবোর্ড ক্যানো?'
লীনা প্রবল নির্লিপ্ততায় বলে, 'কারণ, কেউ একজন চায়, কেউ একজন শুধু তাকেই দেখুক, তাকিয়ে থাকুক, কিন্তু সে কেউ একজন সারাদিন তাকিয়ে থাকে এই বিলবোর্ডে। সেই জন্য...'
আকিবের মাথায় কিছু ঢোকে না। সে বুঝতে পারে না কি বলবে! লীনা আবার বলল, 'কই ভাড়ার কথাতো বললেন না?'
আকিব হড়বড় করে বলল, 'ছাব্বিশ টাকা ভাড়া... না, মানে একজনের,...ওহ! না মানে দুইজনের বায়ান্ন টাকা'।
লীনা হাসল, তার হাতে দুটো টিকেট, 'বাসের ভাড়া!' সে ঠোঁট টিপে হাসল, 'আমি টিকেট আগেই কেটে রাখি, দুটো।'
আকিব কি বলবে ভেবে পায় না। সে বরাবরই বাসে উঠে তারপর টিকেট কাটে। আকিব লীনার সামনে বাসের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকল। বাস আসতেই রোজকার মত গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বাসে উঠলো সে। তারপর সোজা হেঁটে... যাচ্ছিল... সোজা বাসের পেছন দিকটায়... কিন্তু তার পেছন থেকে বাঁশির মতন লম্বা নাকের মেয়েটা শক্ত হাতে তার হাত ধরল। তারপর সামনের সেই দুই সিটের একটাতে বসে পড়লো। লীনা জানালার দিকে সরে বসতেই আকিব চুপচাপ তার পাশে এসে বসলো। জড়সড়। আকিবের হঠাৎ রাজ্যের ঘুম পেতে থাকল। কিন্তু তার পাশে বসা সেই... সেই... আগুন চোখের মেয়েটা আলতো হাতে তার মাথা টা টেনে নিল কাঁধে। তারপর কাঁধ ছুঁয়ে চেপে রাখল। তারপর ফিসফিস করে বলল, 'কই? বিলবোর্ডের ভাড়ার কথাতো জানা হোল না?'
আকিব কোন কথা বলল না। কি দরকার?
ওই বিলবোর্ড কেন, প্রয়োজনে আর চোখ মেলে তাকাবেই না সে। অজস্র বৃষ্টিপাত শুনতে শুনতে এই কাঁধে মাথা রেখেই বাকীটা জীবন কাটিয়ে দিবে সে...
---------------------------------------------------------------------------
বিলবোর্ড/ সাদাত হোসাইন
১২.০৪.২০১৪
©somewhere in net ltd.