![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...
আসিফ ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকাল, বিকাল ৫ টা!
ছ'টায় অফিস থেকে বের হওয়া অসম্ভব। সে টেবিলে স্তুপ করে রাখা ফাইলগুলো দেখল, একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে গিয়েও শেষ অবধি ছাড়ল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লাভ নেই। এই কাজ সে আজ কেন, কালও শেষ করতে পারবে না। ছ'টা কেন, রাত ২টা হলেও না। তারচেয়ে বরং এখুনি অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়া ভালো। থাকুক কাজ। জীবন মানেই দিন ভর অফিসের ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি না। সে ঢকঢক করে দু গ্লাস পানি খেয়ে ফেললো। এই নিয়ে কয় জগ খেলো, কে জানে! তেষ্টায় গলা মরুভূমি হয়ে আছে। বৃষ্টি দরকার!
আসিফ হাসি হাসি মুখে বড় স্যার আশফাক সাহেবের রুমের দরজায় উঁকি দিল। বড় স্যার চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালেন, 'কি আসিফ? ফাইলগুলো শেষ হয়েছে? খুব জরুরী। আমি ওই ফাইলের জন্যই অপেক্ষা করছি।'
আসিফ হাসল। তারপর বড় স্যারের রুমে ঢুকে চেয়ার টেনে বসলো। টেবিলে রাখা কাঁচের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে শান্ত গলায় বলল, 'আমি আজ ফাইলগুলো শেষ করতে পারবো না স্যার'।
বড় স্যার যেন কানে শুনতে পাননি, তিনি অবাক চোখে তাকালেন, 'কি?'
- 'আমি আজ ফাইলগুলো শেষ করতে পারবো না স্যার, আমার প্রচণ্ড তেষ্টা পেয়েছে, গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তেষ্টা যাচ্ছে না'।
- 'তো তেষ্টা না যাওয়ার সাথে ফাইল শেষ করার কি সম্পর্ক?'
-'সম্পর্ক আছে স্যার। গত সাত দিন থেকে এই তেষ্টা। সারাদিন বুক খা খা করে। গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়ে যাচ্ছি, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। তেষ্টা যাচ্ছে না। বরং বাড়ছে'।
বড় স্যার রেগে যাচ্ছেন কি না বোঝা যাচ্ছে না। তবে প্রবল হতভম্ব ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছেন, 'কি সমস্যা আসিফ?'
-'সমস্যা ধরতে পেরেছি স্যার। গত এক সপ্তাহ ধরে রিমি'র সাথে দেখা হচ্ছে না। এই দেখা না হওয়ার কারণেই তেষ্টা পাচ্ছে, দেখা হলে সেরে যাবে, এক বসায় সব ফাইল শেষ করে ফেলতে পারবো ইন শা আল্লাহ্'।
বড় স্যার মুখ হা হয়ে আছে, তিনি হা করা মুখেই বললেন, 'রিমি কে?'
-'আমার গার্লফ্রেন্ড স্যার। তার ধারণা, আমি তাকে তেমন ভালোবাসি না। কিন্তু তার এই ধারণা যে কি মস্ত বড় ভুল তা সে জানে না। অবশ্য জানার দরকারও নাই। ভালোবাসার পরিমাণ জানা ঠিক না। কি বলেন স্যার?'
এতক্ষণে আশফাক সাহেবের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করে উঠলেন, 'দিস ইজ নট অ্যা ক্লাব, দিস ইজ অ্যান অফিস'।
আসিফ নির্লিপ্ত গলায় বলল, 'জানি স্যার, কিন্তু উপায় নেই, রিমির সাথে দেখা না হলে আমি জলতেষ্টায়... না, মানে... রিমিতেষ্টায় মারা যাবো'।
আশফাক সাহেব এবার ধাক্কা দিয়ে টেবিল সরালেন, তারপর দু পা সামনে এগিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, 'গেট লস্ট, জাস্ট গেট লস্ট। আমার চোখের সামনে থেকে বের হও। এই মুহূর্তে বের হও'।
আসিফ হাসি হাসি মুখে উঠে দাঁড়ালো। আশফাক সাহেব সাপের মতো হিসহিস শব্দে বললেন, 'কাল থেকে তোমার আর অফিসে আসার দরকার নেই, ইউ আর স্যাকড! গো অ্যান্ড আউট'।
- 'থ্যাংক ইউ স্যার।'
আসিফ দরজা ঠেলে বেড়িয়ে এলো, বেড়িয়ে আসার আগে আরও এক গ্লাস পানি খেল। আশফাক সাহেব দরদর করে ঘামছেন। তার ৩৬ বছরে চাকুরি জীবনে এমন ঘটনা আর ঘটে নি।
২
আসিফ ছ'টার আগেই লাল বাজারের কাছে ক্যাফেটাতে পৌঁছে গেল। কিন্তু তার এখন ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। ভয়াবহ দুশ্চিন্তা! চাকুরীটা চলে গেলে সে বিপদেই পড়ে যাবে। ভালোরকম বিপদ! এমন না করলেও সে পারত। বড় স্যারের সাথে ওই আচরণটা না করলেও পারত। রিমির সাথে একটা দিন পড়ে দেখা করলেও হত! সে ঝিম মেরে বসে রইল ক্যাফের বাইরের ফুটপাতে। ছটা বাজতে ৫ মিনিট বাকী। কিন্তু রিমির সাথে আরও একদিন দেখা না করে সে থাকতে পারত না। পারতই না। অসম্ভব! এই সমস্যা তার হয়। সে জানে না এই সমস্যার কারণ কি? কিন্তু সমস্যাটা তার হয়। প্রবলভাবে হয়।
রিমি ফোন ধরছে না। গত তিন দিন সে দেখা করবে করবে বলেও শেষ পর্যন্ত আসতে পারে নি। কাজ পড়ে গেছে। রিমির অফিসে ইয়ার ক্লোজিং। অফিস থেকে বের হবার ঠিক ঠিকানা নেই। আসিফ সারাদিন প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করেছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে রিমি এক লাইনের ছোট্ট মেসেজ পাঠিয়েছে, 'সরি, আই এম স্টাক অ্যাট অফিস, কান্ট ম্যানেজ টুডে'।
আসিফ কিছু বলে নি। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসেছে। কিন্তু কাল আর পারে নি। ইচ্ছা মত চেঁচিয়েছে। রিমি কিছু বলে নি, ফোন কেটে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছিল, 'আই উইল ম্যানেজ ইট টুমরো, অ্যাট এনি কস্ট'।
আসিফ হয়তো এই জন্যই অত বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল আজ। আজ আর সে কোনভাবেই মিস করতে চায় নি। কিন্তু, রিমি ফোন ধরছে না কেন?
১৯ বারের বার রিমি ফোন ধরল, আসিফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফিসফিসে গলায় বলল, 'তুমি অফিস থেকে বের হয়ো না। কাজ শেষ করে বাসা চলে যাও, আই এম ইন অ্যান ইম্পরট্যান্ট মিটিং'।
রিমি ফোন কেটে দিয়েছে। আসিফের সারা শরীর বেয়ে ঘাম নামছে। তার মনে হচ্ছে সে ফোনটা আছড়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলে। মুঠি মুঠি চুল নিয়ে ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। সে রিমির নাম্বারে আবারও ফোন করলো। আবারও ফোন করলো, আবারও ...। রিমি এবার ফোন কেটে দিয়ে মেসেজ পাঠাল, 'সরি, আই কান্ট ম্যানেজ টুডে'। আসিফ আবারও ফোন দিল। রিমির ফোন অফ!! আসিফের সারা শরীর যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। প্রবল শক্তিতে রাস্তার মাঝখানে আছড়ে ফেললো সে তার হাতের মোবাইল ফোন।
তারপর হেঁটে চলল।
৩
রাত এগারোটা।
তুমুল বৃষ্টি নেমেছে। প্রচণ্ড ঝড়ে বাজ পড়ছে কোথাও। আসিফ ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তার মাথা কাজ করছে না। তার ধারণা সে পাগল হয়ে যাচ্ছে। গত একঘণ্টা ধরে বৃষ্টিতে ভিজছে সে। বাসার সামনের রাস্তায় হাঁটু পানি জমে আছে। কিন্তু তার তেষ্টা একফোঁটাও কমে নি। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির জলে ডুবে যাচ্ছে বুকের ভেতর, কিন্তু তেষ্টারা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে যেন! গোটা শহরে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয়ংকর রাত। সেই ভয়ংকর রাতে রিকশাটা এসে থামল গেটের বাইরে। বিদ্যুৎ চমকাল দিনের আলোর মত। রিমি যখন রিকশা থেকে নামলো, ভেজা শাড়িটা চুপচুপে হয়ে সেঁটে আছে তার শরীরে। আসিফ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রিমির দিকে, রিমি তাকে দেখতে পায় নি। কিন্তু সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। এতো রাতে এই বাসায় ঢুকতে পারবে না সে। তার হাতে একগাদা অফিসের ফাইল, কাঁধে ব্যাগ। সে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
আসিফ অন্ধকারে তাকিয়ে রইল রিমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। সে রিমিকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু বৃষ্টি ভেজা ওই জমাট অন্ধকারটুকুতে কি আছে কে জানে! আসিফের বুকের ভেতরটা হঠাৎ শীতল হতে থাকল।
ভিজে যেতে থাকল বৃষ্টির জলে।
অদ্ভুত জলে।
----------------------------------------------------
তৃষ্ণা/ সাদাত হোসাইন
©somewhere in net ltd.