![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি হাজার বছর বাঁচিতে চাই মানুষের মাঝে কি সকাল কি দুপুর কি বিকেল কি তমিস্রার সাঁঝে।
ছেলে আরমান মা"কে চিঠি লিখেছে-
মা, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার পর থেকেই আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে,সংসারজীবনে যে কি অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে তার হিসেব মেলা ভার।
মাগো, আজ বুঝতে পেরছি- তোমার আশীর্বাদ, তোমার দোয়া আমার জীবনের সকল প্রতিষ্ঠার একমাত্র হাতিয়ার ছিলো। জানো মা, আজ আমি মুক্ত পাখির মত স্বাধীন। আমাকে আর কেউ কোনোদিন প্ররোচিত করে বলবেনা, তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসো। কেউ বলবেনা, তোমার মাকে আমার সহ্য হয়না। আর কোনদিন কেউ বলবেনা তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে না রাখলে আমার সংসার ভাঙ্গবে।ছেলেকে গলা টিপে মারবে।
মা"গো- এত সব কিছুর চাপে আমি যেন একসময় নিরুপায় হয়ে পড়ি আমি যেন হয়ে উঠি নির্বোধও।আমি কেবলি আমার স্ত্রী সন্তান এদের সুখের কথাই ভাবতে থাকি। ভাবিনি ভেবে দেখিনি যে,তুমি আমার সুখের একমাত্র হাতিয়ার।তুমি আমার সকল আশীর্বাদ। তুমি আমার পৃথিবীর সেরা সুখ, তুমি যে স্বর্গ। আমি তোমার একমাত্র সন্তান। আমি ছাড়া তোমার আপন বলতে এ ধরায় দ্বিতীয়টি আর কেউ নেই জেনআমি তোমার কথা সেদিন ভাবিন মা। তোমার সাথে চরম অন্যায় করেছি। মাগো, আমায় তুমি ক্ষমা করো। চিঠি পড়া শেষ করতে পারেনি "মা" রেবেকা ছেলের এহেন চিঠি, এতোটা বছর পর, মা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। আমার আদরের আরমান সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে। আমার মানিক, খোকা, বাবা আরমান আয় আমার বোকে আয়। সেই কতটা বছর তোর মুখে মা ডাক শুনিনারে। হৃদয়টা আজ আমার বড়ই ক্লান্ত।
খোকা,
তোর বাবার মৃত্যুর কালে আমার হাত দুটি ধরে বলেছিলো, রেবেকা-আমার অনেক আশা ছিলো আরমানকে ডাক্তার বানাবো।কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস,আমার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে গেলো। আমার আশা পূরণ হলোনা। আমি অশ্রুসিক্ত নয়নে সেদিন বলেছিলাম- ওগো স্বামী, তোমার অপূর্ণ বাসনা আমি জীবন দিয়ে হলেও পূর্ণ করবো।
সেই থেকে জীবন যুদ্ধে আমি সংগ্রামী নারী হই। সুদীর্ঘ জীবনে কত ঘাত প্রতিঘাত, কত জয় পরাজয়ের মাঝেও হাল ছাড়িনী। আজ আমি তা পেরেছি। কিন্তু নিয়তির কাছে হেরেছিও। হয়তো সেদিন নিয়তি দেখেছিলো আমার যুদ্ধাহত জীবনের পরিসমাপ্তিটা হবে বড়ই নির্মম, বড়ই নির্লজ্জ, বড়ই কষ্টের। জানালার শিক ধরে-হুইল চেয়ারে বসে মা রেবেকা অঝোরে চোখের জ্বল ঝরায়। ভাবে জীবনের অতীত। স্মৃতি যেন ফ্লিমের ক্যানভাসে জীবন্ত হয়। কি নির্মম কষ্টের দিন! সেদিন-আজও তার পরিসমাপ্তি হলোনা।তবে কি জীবনে আমি এতোটাই ভুল করেছিলাম নাকি এ আমার অদৃষ্টের লেখা। ভাবতে ভাবতে রেবেকা অনুভব করে তার কোমরের ডান পাশটাতে তীব্র ব্যথা, উহঃ করে উঠে। হাতটা দিয়ে কোমরটা চেপে ধরে। একদিকে হৃদয়ের ব্যথা আরেক দিকে সমস্ত শরীর জুড়ে কি অমানষিক যন্ত্রণা। ডাক্তার যতটা জানে তার শারীরিক অবস্থা কি সংকটময় রেবেকা ততটা জানেনা। জানার কথাও নয়। যে মরন যন্ত্রনায় এমনিতেই মর্মাহত তার উপর যদি জানে বেশি দিন বাচবেনা সে তাহলে কষ্টটা যে বেশি বেড়ে যাবে।
অনেক বছর হলো রেবেকার দুইটি কিডনীই ডেমেজের পথে। ডায়বেটিস এর রোগী। একটি চোখে পাথর পড়ানো সে অনেক দিন আগের কথা। বৃদ্ধাশ্রমে আসার পূর্বে থেকেই এমন। আগে কিছুটা দেখতে পেতো এখন একটি চোখ পুরোপুরিই অন্ধ। অন্যটার অবস্থাও শোচনীয়।
রেবেকা কাঁদে। চোখে হাত বুলিয়ে অঝোরে কাঁদে। এই চোখ বিক্রি করেই আরমানকে একদিন ডাক্তার বানিয়েছে। আরমান তাও জানে। সকল কথাই রেবেকার মনঃকোঠায় নাড়া দিয়ে বসে। আরমান তখন সবে মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে। সব কিছুই সে বুঝে। অনুভব করে মায়ের সারাটা জীবনের ত্যাগের কথা। মায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম আর দোয়ায় আজ সে মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছে। মায়ের অমানসিক কষ্ট আরমানের মনে ভীষণ নাড়া দেয়।
মাকে বলে, মা, আমার মেডিক্যালে পড়া থাক। এতো টাকা তুমি কোথায় পাবে। আমি না হয়, কোন রকম একটা কলেজ থেকে ডিগ্রী নিয়ে চাকুরী করি। তুমি আর এভাবে নিজেকে কত শেষ করবে। কথাটা একদিকে মায়ের মন তৃপ্ত হলেও অন্যদিকে যেন বিষের চুরির মত বিধে। স্বামীকে কথা দিয়েছে রেবেকা ছেলেকে ডাক্তার বানাবে।
রেবেকা যেন ভীষণ মন খারাপ করে। আরমান বুঝতে পারে। মা'কে বলে, আচ্ছা মা তোমার অবাধ্য আমি হবো না। মা রেবেকা যেন দেহেতে প্রাণ ফিরে পায়। সকল কষ্ট যেন মোমের মত গলে যায়। দুজনে শত কষ্টের মাঝেও একটু সুখের হাসি হাসে।
এত টাকা! সত্যিইতো অনেক টাকা! কিভাবে জোগাড় করবে রেবেকা। মনে মনে ভীষণ হিমশিম খেতে থাকে। ছেলে আরমানকে তা বুঝতে দেয়না। রেবেকার দুঃসম্পর্কের এক ফুফাতো ভাই প্রাইমারী স্কুলে একই সাথে পড়তো। নাম তার জিয়া। ঢাকায় থাকে। খবর নিয়ে জেনেছে রেবেকা জিয়াে ছুটিতে বাড়ী এসেছে। পরদিন ভোর বেলায় রেবেকা একাকী জিয়ার কাছে যায়। গিয়ে সকল কিছু শেয়ার করে। জিয়াও সল্প আয়ের মানুষ। যা পায় তাতে কোন রকম টেনে হেচড়ে সংসার চলে। নিজে থেকে কোন উপকার করতে পারবেনা তা প্রকাশ্যেই রেবেকাকে জানিয়ে দেয়। পাশাপাশি পরামর্শ দেয়-
শহরে গিয়ে যদি গার্মেন্টস এ চাকুরী করো তবে বেশ টাকা মিলবে। তাতে করে নিজের চলাটাও চলবে ছেলেটারও পড়ার খরচ যোগাতে পারবে। মনে মনে রাবেয়া গার্মেন্টস এ চাকুরীর চিন্তাটাই মাথায় রাখে।
সে অনেক ইতিহাস। অনেক ইতিকথা। নদী ভাঙনের মত শতবার রেবেকার হৃদয় ভেঙেছে। তবু সে এতটুকু থেমে থাকেনি। কত ঝড় হিমালয়ের মত মাথার উপর দন্ডায়মান হয়েছে রেবেকা মোকাবেলা করেছে। মহান প্রভু তার সহায় থেকেছে। ছেলের পড়ার টাকা যোগাতে রেবেকার বাপের বাডিতে কিছু সম্পত ছিল তা বিক্রি করেছে। স্বামীর দেওয়া কিছু অলংকার ছিল তা বিক্রি করেছে। পরিশেষে ছেলের যখন ফাইনাল ইয়ারে তখন অনেক টাকা চাই। রেবেকা দিশেহারা হয়ে পড়ে। খবর পায় চৌধুরী সাহেবের স্ত্রীর চোখই নষ্ট হয়ে গেছে তাহার জন্য চোখের প্রয়োজন। যত টাকাই লাগোক চৌধুরী চোখ চাই। খবরটা রেবেকার কানে আসে রেবেকা শুনে যেন খুশি হয়।ছোটে যায় চৌধুরী সাহেবের কাছে। সব কিছু খুলে বলে রেবেকা। অবশেষে চৌধুরী সাহেব অনেক টাকার বিনিময়ে রেবেকার একটি চোখ কিনে নেয়।
আজ রেবেকার সেই চোখ চির দিনের জন্য মোক হয়ে গেছে।সাক্ষ্য হয়ে আছে শুধু অতীতের হাজারো স্মৃতি আর স্মৃতিময় যন্ত্রণা গুলো। মনে মনে ভেবে রেখেছিলো রেবেকা, ছেলে তার ডাক্তার হলে কত শত চোখ পাওয়া যাবে। সেদিন এক চোখেও অনেক স্বপ্ন দেখেছে রেবেকা। আজ অন্তিমকালে স্বপ্নরা বডই কষ্ট দিয়ে যায়। কি চেয়েছিলো রেবেকা আর কি পেলো এ জীবনে।
শুধু রেবেকা নয় এই বিশ্ব নাট্যশালায় লাখো রেবেকার জীবনের পরিণতি এমনি করুণ যা দেখলে হৃদয় ভেংগে যায়। রেবেকা নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। দীর্ঘদিন যন্ত্রণার সাথে যুদ্ধ করে করে নিজেকে কিছুটা হলেও শক্ত করতে শিখেছে রেবেকা। কিন্তু আজ কি হলো যে দু চোখের পাতায় অশ্রু যেন বৃষ্টির মত ঝর ঝর করে ঝরেই যাচ্ছে। অশ্রুসিক্ত নয়নেই-ছেলের অসমাপ্ত চিঠি পড়ার জন্য ফের নিজেকে তৈরী করে। অনেক আগ্রহ ভরে চিঠিটার ভাজ ফের খোলে।অশ্রু ভেজা চশমাটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নেয়। দু'হাতে চিঠিটা মেলে ধরে। চোখ বুলায়। ছেলের অসমাপ্ত লিখা-
মাগো, আমি এক হতভাগা। প্রায়শ্চিত্তের পথ আমাকে ডাকছে। এ জীবনে তোমার নিঃস্বার্থ অবদান অস্বীকার করার নির্মিতে যে পাপ আমি করেছি তার প্রায়শ্চিত্ত আমার শুরু হয়ে গেছে। তোমার একমাত্র আদরের নাতি সে অনেক বড় হয়েছিলো। মাঝেমধ্যেই তোমার স্মৃতি চারণ করত, তোমার শুন্যতা বেশ অনুভব করতো।
আমাকে বলতো বাবা, আমার নানুজান, নানাজান সবাই আছে আমার দাদাজান, দাদীজান নেই কেন? আমি নীরবেই চোখের জ্বল ঝরাতাম। বলত সে কথা তোমার মা"কে জিজ্ঞেস করো। সে অনেক কথা মা। আসলে নিয়তির উপরে বুঝি কারো হাত নেই? তবে কেন এমন হয়? কেন তোমার মত এমন নিঃস্বার্থ জননীর জীবনে কান্নার ঢল? কেন আমার মত একজন ডাক্তার সন্তান থেকেও তুমি বৃদ্ধাশ্রমে? এর জন্য আমিই দায়ী "মা"।
আর তাইতো- গত মাসের বিশ তারিখে রোড এক্সিডেন্টে তোমার একমাত্র "নাতি" দুনিয়ার মায়া ছেড়ে
পাড়ি জমায় পরপারে। তোমার বউ মা'র অত্যাচারের মাত্রা কিছুটা হলেও তুমি জানো। তার অত্যাচার মাত্রাটা এখন এতোটাই প্রখর সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই তাকে আমি নিজ হাতে গলা টিপে মেরেছি। পুলিশ আমাকে হণ্যে হয়ে খোজছে। জানি এর পরিণতি কতটা মারাত্মক।
তবু সারাটা জীবন সে আমাকে যে নীরব কষ্টটা দিয়েছে, তোমাকে বঞ্চিত করে রেখেছে তোমার অধিকার থেকে। তার কিছুটা হলেও বদলা আমি নিতে পেরেছি মা। আমি তাতেই ধন্য।
মাগো, তুমি যদি ক্ষমা না করো আমি মরেও যে শান্তি পাবোনা। তিল তিল করে সমস্ত সুখকে জলাঞ্জলি দিয়ে যে তুমি আমাকে মানুষ করতে চেয়েছিলে আর আমি হয়েছিলাম কিনা অমানুষ। একজন মানুষ রুপী শয়তান।এবারও চিঠিটা পড়া শেষ হলোনা...
"মা" রেবেকার হাত থেকে কখন জানি চিঠিটা পড়ে গেছে...চোখের চশমা্টাও লোটিয়ে পড়েছে হুইল চেয়ারের নীচে...মাথাটা থুবড়ে পড়েছে দু হাটুর উপরে। মুখ থেকে ফেনা বের হয়েছিল আন্দাজ করা যায়...তবে নাক দিয়ে যথেষ্ট পরিমান রক্ত ক্ষরণ হয়েছে...চোখ দুটো যেন এখনও ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছে...এদিকে অনেক ক্ষণ বিছানায় রেবেকাকে না পেয়ে শরমিলা ঠাকুর তাকে খোঁজছে বের হয়। বারান্দায় হুইল চেয়ার দেখেই শরমিলা ঠাকুর বুঝতে পারে আর কেউ নয় রেবেকাই হবে।
বুড়ো বয়সী হলে কি হবে। মন তো কখনও বুড়ো হয়না। দুষ্টমির ছলে শরমিলা ঠাকুর পেছন থেকে রেবেকার চেয়ারটাকে একটু জোরে থাক্কা দেয়। অচেতন রেবেকা মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ফ্লোরে।
শরমিলা ঠাকুর চীৎকার দিয়ে উঠে...তার চীৎকারে মিনিটের মধ্যেই বহু লোক সমবেত হয়। ডাক্তারও আসে, চেকাপের পর, ডাক্তার রেবেকাকে,মৃত বলে ঘোষণা করে।
২| ০১ লা জুন, ২০২০ বিকাল ৫:১৫
ডাকঘর সাহিত্য পত্রিকা বলেছেন: অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো আপনার জন্। ধন্যবাদ শ্রদ্ধাভাজন।
©somewhere in net ltd.
১|
০১ লা জুন, ২০২০ দুপুর ২:১০
রাজীব নুর বলেছেন: আহ বড় মর্মান্তিক।