![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘হে নূতন/দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ/…/চিরনূতনেরে দিল ডাক/পঁচিশে বৈশাখ’- বাঙালি জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান পুরুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জম্মদিন আজ। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (১৮৬১ সালের ৭ মে) কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জম্মগ্রহণ করেন তিনি। বাঙালির মনন, সংস্কৃতি আর চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশীদার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৩ তম জন্মজয়ন্তী সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা আয়োজনে বরণ করে নেওয়া হবে।
তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ এ সাহিত্যিককে ডাকা হয় গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবিসহ নানা অভিধায়। তার লেখালেখির মধ্যে রয়েছে ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস এবং ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন। তার লেখা ছোটগল্পের সংখ্যা ৯৫টি ও গান ১৯১৫টি। এঁকেছিলেন প্রায় দুই হাজার ছবি। এখনও নিয়মিত বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করছে তার রচনাসমগ্র। এ থেকে বুঝা যায় তিনি কতটা জনপ্রিয় ও বাঙালির মননের কাছাকাছি।
১৯১৩ সালের ১০ নভেম্বর সুইডিশ একাডেমি তাকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রদান করে। যার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্ব দরবারে পরিচিতি ও গুরুত্ব লাভ করে। বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলায় সাহিত্যচর্চার যে প্রধান ধারা, সেখানে তাকেই অনুসরণ করা হয়। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লেখালেখি ছাড়াও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে ভাষার ব্যবহারে।
সাহিত্যের ভাষা হিসেবে চলিত ভাষার ব্যবহারকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সূত্রে বলা যায়, ভাষার ক্ষেত্রে বর্তমানে যে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চোখে পড়ে তার প্রধান অনুপ্রেরণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি বাংলা গদ্যের সনাতনী ও আধুনিক ধারার মধ্যে যুগসন্ধি। সে দিক থেকে তার গুরুত্ব উত্তরোত্তর বাড়ছে।
বাঙালির আবেগ অনুভূতিতে জড়িয়ে আছে রবীন্দ্রসংগীত। প্রেম-বিরহ, ঋতু উদযাপন, পূজা-পার্বন কোথায় নেই তার গান। তার গান এ দেশের মাটি থেকে উৎসরিত। যেখানে উপনিষদ্, হিন্দু পুরাণ, সংস্কৃত কাব্যনাটক, বৈষ্ণব ও বাউল দর্শন একসূত্রে মিলেছে। সুরের দিক থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত, বাংলা লোকসংগীত, কীর্তন ও রামপ্রসাদী এবং পাশ্চাত্য ধ্রুপদি ও লোকসংগীতের অসামান্য সম্বন্বয় ঘটেছে রবীন্দ্রসংগীতে। তার কবিতা ও গানে রয়েছে মুগ্ধকর বিমূর্ততা। তা যেন দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে ধ্রুপদী উপলব্ধি দেয়। সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের অসামান্য প্রতিভূ তার কবিতা ও গান। তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। এ গানটি সুরারোপিত হয়েছে কুষ্টিয়ার গননহরকরার একটি গানের সুরে। সে সূত্রে বলা যায়, আধুনিকতা ও লোকায়ত সুরকে আমরা চমৎকারভাবে এ গানে পায়। এ ছাড়া সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ গানটি গেয়ে ২০১৪ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়েছে।
বাঙালির শোষণবিরোধী ও অসম্প্রদায়িক রাজনীতিতে রয়েছে তার অবদান। তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের একনিষ্ট সমর্থক। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত মানসী কাব্যগ্রন্থে তার প্রথম জীবনের রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইটহুড বর্জন করেন। বাংলাকে বিভক্তকারী ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আইনের প্রধান বিরোধীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এর জন্য কবিতা-গান নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। প্রতিবাদে যুক্ত করেন স্বদেশী রীতি। বঙ্গভঙ্গের আনুষ্ঠানিক ফরমান জারির দিনটিকে 'অরন্ধন দিবস' হিসেবে ঘোষণা করেন।
সম্প্রদায়গত বিভাজন এড়াতে 'রাখীবন্ধন' উৎসবের নবায়ন ঘটান। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার ভাইফোঁটা দেওয়ার রীতিকেও সামাজিক রূপ দিতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি এসেছেন অনুপ্রেরণা হয়ে। এর আগে ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকার বেতার-টেলিভিশনে তার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু বাঙালিরা তা মেনে নেয় নি। প্রতিবাদের ঝড় উঠে দিকে দিকে। ১৯৬১ সালে তার জম্ম শতবার্ষিকী পালনের সূত্রে আবির্ভাব ঘটে ছায়ানটের মতো প্রতিষ্ঠানের। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি রমনা বটমূলে প্রথমবারের মতো আয়োজন করে বাংলা নববর্ষ পালন। এখন তো রমনা বটমূলে ছাযানটের বর্ষবরণ ও ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি ছাড়া বাংলা নববর্ষকে কল্পনায় করা যায় না। এভাবে তিনি আমাদের মনন ও চেতনায় ছড়িয়ে আছেন দিবস-রজনী।
তার রাজনৈতিক চিন্তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষা দর্শন। তিনি প্রাচীন ভারতের গুরুমুখী শিক্ষায় প্রধান দিকটি সামনে তুলে নিয়ে আসেন। তাই শান্তিনিকেতন আশ্রমের মাধ্যমে দেশ ও ভূগোলের ছড়িয়ে ভারত ও বিশ্বকে একসূত্রে বাধতে চেয়েছেন। বিশ্বভারতীর মাধ্যমে সনাতন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ব্রহ্মচর্য ও গুরুপ্রথার পুনর্প্রবর্তন করেন। বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি ও দর্শনচর্চায় এ দুই প্রতিষ্ঠান এখনও অনুপ্রেরণা।
এভাবে প্রতিদিন তিনি আমাদের কল্পনা ও কর্মে নতুন নতুন ভাবে হাজির হন। তার কর্ম আমাদের উৎসাহিত করে নতুন পথের যাত্রায়। সে অভিযাত্রায় তার প্রতি শ্রদ্ধা।
©somewhere in net ltd.