নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

দুঃসাহসী স্বপ্ন দেখা তরুণ

সাইফুল ইসলাম জুয়েল

দুঃসাহসী স্বপ্ন দেখা তরুণ। জন্ম \'সাগরকন্যা\' পটুয়াখালী জেলায়। স্বপ্নচারী। ভ্রমণপ্রেমী। অলস। ভীষণ ঘুমকাতুরে। ভালো লাগে গল্পের বই পড়তে। সবথেকে বেশি পছন্দ করি রহস্য-রোমাঞ্চ-থ্রিলার ও রম্য লেখা।

সাইফুল ইসলাম জুয়েল › বিস্তারিত পোস্টঃ

পদক (গল্প)

৩০ শে মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:০৩

ঢাকায় ফিরছি। অনেক দিন পর বাড়িতে এসে ঢাকায় ফেরার সময় মনটা সত্যিই খুব খারাপ হয়ে যায়। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকছি অনেক বছর, কিন্তু দেশের বাড়ির প্রতি একটা আলাদা টান সব সময়ই অনুভব করি। তাই দেশের বাড়িতে এলে ঢাকায় যাওয়ার শিডিউল কখনোই ঠিক রাখতে পারি না। দু চারদিন পিছাবেই। অথচ এবার হয়েছে তার উল্টোটা। নির্দিষ্ট দিনেই যাচ্ছি, উপরন্তু মেজাজটাও ফুরফুরে। দারুণ একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়। আর সে কারণে ঢাকার পথে থাকা সত্তে¡ও ঢাকায় ফেরার তাড়াটা অনেক বেশি ছিল আমার। ফেরিতে নদী পাড় হচ্ছিলাম। ওপাড়ে গিয়ে সেখান থেকে জেলা সদরে গিয়ে ঢাকার বাস ধরবো। পায়রা নদী। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে এটা অনেক বড় একটা নদী। এই নদীর ইলিশ অনেক সু¯^াদু। নদীর বুকে ট্রলারে বসে দু’পাশের নয়নাভিরাম দৃশ উপভোগ করছিলাম। আসলে এমন পরিবেশের কাছাকাছি হলেই আমার লেখক সত্তাটা প্রবলভাবে জেগে ওঠে। অনেকদিন ধরে লিখছি। এবার নতুন করে কিছু করতে হবে। কী করা যায়, তাই ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করেই আইডিয়াটা এলো। খুশি খুশি মন নিয়ে ট্রলারে বসে বিস্তারিত ভাবছিলাম।
হঠাৎ আমার পাশে বসা একটা বাচ্চা ছেলের কথা শুনে চিন্তায় ছেদ ঘটলো।
‘দাদু, আমাকে একটা ফাইভের গাইড কিন্যা দাও না। ক্লাশের সবাই সেই জানুয়ারি থেকেই প্রাইভেট পড়ছে, ওদের সবার গাইড বই পড়াও শ্যাষ। কিন্তু আমি এই কয়ডা দিন পইড়াও ঠিক ঠিক ওদের থাইক্যা ভাল রেজাল্ট করতে পারমু। এ প্লাসও পামু, তুমি দেইখখো।’
বাচ্চা ছেলেটির কথা শুনে মুখ বাঁকিয়ে হাসলাম। এখন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। নভেম্বরে পিএসসি পরীক্ষা। আমার ছেলেও এবার পিএসসি পরীক্ষা দেবে। জানুয়ারি নয়, সেই গত বছর ডিসেম্বরেই ওদের ক্লাস ফোরের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ওকে ক্লাস ফাইভের প্রত্যেক সাবজেক্টের জন্য টিউটর ঠিক করে দিয়েছি। সেই সাথে প্রত্যেক পাবলিকেশন্সের একটা করে গাইড বই তো রয়েছেই। অথচ এই ছেলেটা, যার কিনা এখনো একটা গাইড বইÑই কেনা হয়নি, সেও বলছে এ প্লাস পাবে! এ প্লাস আজকাল গাছে ধরে নাকি!
বাচ্চাটি যাকে দাদু বলে সম্বোধন করলো, সেই বৃদ্ধ লোকটি এবার মুখ খুললো, ‘দেখ দাদু ভাই, জিনিসপাতির দাম অনেক বাইড়া গ্যাছে, অহন সংসার চালাইতেই বড় কষ্ট। কী করে যে তোকে...’, হঠাৎ থেমে গেলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘যা, আগামী এক হপ্তা’র মধ্যেই তোকে কিন্না দিমু।’
ছেলেটির চোখ-মুখ খুশিতে চকচক করতে লাগলো। দাদুর হাত দু’টি ধরে বলল, ‘তুমি দেইখখো দাদু, আমি একদিন ডাক্তার হমু। তোমার ¯^প্ন ঠিকই পূরণ করমু।’
আমার পাশের অপরিচিত এক যাত্রীর সাথে ফাঁউ আলাপ জমিয়ে মনের ক্ষোভটা শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করেই ফেললাম, ‘এই সব ভিখিরিদের পালা-পদ্য দেখলে হাসি পায়। দু বেলা খেতে পারে না। কত্ত কত্ত ¯^প্ন দেখে এরা।’
আমার কথা শুনে বৃদ্ধ ভিক্ষুক লোকটা একবার মুখ তুলে তাকালো। ইতোপূর্বে আমার কাছে ‘দুইডা ট্যাহা ভিক্ষা’ চেয়েছিল সে, কিন্তু এই সকল ভিখিরিদের ভিক্ষা দিলেই লাই পেয়ে মাথায় উঠে যায়, তাই দিইনি। এখন মনে মনে ভাবলাম, না দিয়ে ভালোই করেছি। শেষে আবার নাতির গাইড বই কিনে দেবার জন্যও আমাকে চেপে ধরতো!
ট্রলারের কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চাইতেই মেজাজ দেখিয়ে বললাম, ‘ভাড়া হয়েছে, যাও তো। বারবার খালি ভাড়া ভাড়া করে।’
কন্ডাক্টর অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, ‘ভাড়া আবার কহন চাইলাম ভাই, একবারেই তো হক্কলের ভাড়া কাইট্যা ফালাই।’
জ্বিভ কেটে তাড়াতাড়ি ভাল মানুষ হয়ে বললাম, ‘স্যরি স্যরি, আসলে একটু ভাবনার মধ্যে ছিলাম তো। কিন্তু আমার কাছে তো এক হাজার টাকার নোট। ভাংতি হবে?’
আসলে ঢাকার শহরে চলতে গিয়ে যেমনটা করি, এখানেও তেমনটাই করতে চাইলাম। ভাড়া না দিয়ে বলি, ভাড়া হয়েছে। কয়বার চাইবা! কখনো কখনো এক হাজার টাকার নোটের কথা বলি। ওরা ভাংতি দিতে পারে না। আমারও ভাড়া দিতে হয় না। এই গ্রামে তো ওরা এক হাজার টাকার নোট চোখেই দেখেনি। ভাংতি দেবে কীভাবে! কিন্তু ট্রলারের কন্ডাক্টর আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘এক হাজার টাকার নোট? আইচ্ছা দেন, ভাঙ্গাইয়া দিতাছি!’
আমি জানি, আমার পকেটে কোন হাজার টাকার নোট নেই। এখন কী করি! শেষে একটা দশ টাকার নোটা বের করে বললাম, ‘তোমাকে আর কষ্ট করে টাকা ভাঙাতে হবে না। একটা দশ টাকার নোট যে ছিল, সে কথা খেয়ালই ছিল না। নাও, এটাই রাখ।’
‘কিন্তু ভাইজান, ওইডা আমারে দিলে পরের রাস্তায় ভাড়া দিতেও তো সমস্যা অইবে। দ্যান আমিই ভাঙ্গাইয়া দিই।’
পেটের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। ট্রলারের অনেকের দৃষ্টিই এখন আমার দিকে। হাজার টাকার নোটের কথা বলে কেনা-কাটার ক্ষেত্রেও অনেক সময় পাঁচ টাকা দশ টাকা কম দেওয়া যায়। কিন্তু এখন যে গ্যাড়াকলে পড়ে গেলাম। শেষে বললাম, ‘ধন্যবাদ ভাই, ও নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ফ্লেক্সি করতে হবে। সেখান থেকেই ভাঙিয়ে নেব।’ ট্রলালের কন্ডাক্টর কী মনে করলো কে জানে। পাশের জনের কাছে ভাড়া কাটতে চলে গেল। বৃদ্ধ ভিক্ষুকটাকে দেখলাম, আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছেন!
সেদিকে আর না খেয়াল করে আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। লেখালেখি করি অনেক বছর হয়ে গেল। এখনো তেমনভাবে লাইম লাইটে আসতে পারিনি। কোন পদক-টদক পাওয়া তো দূরের কথা। তবে এক কাজ করলে কেমন হয়Ñনিজেই নিজেকে পদক দিই! যেটাকে সেলফ অ্যারেঞ্জড পদকও বলা যেত পারে। আমাদের দেশেও তো জাতীয় পর্যায়ে এমন কাজ হয়। অনেক তারকা-সুপারস্টার কোন সংগঠনকে টাকা দিয়ে পদক নিয়ে থাকেন। আবার কয়েকজন মিলে একটা সংগঠন বানিয়ে তারপর ফি বছর নিজেরাই পদক ভাগাভাগি করে নেন। পত্রিকায় সম্পর্কের জোরে আলোচনায়ও চলে আসেন। তাদের মতো আমিও নেব। জাতীয় পর্যায় অনেকদিন লেখালেখি করি। নিজের ঢোল নিজে না পেটাতে পারলে এবারে আর চলছেই না!
সব কিছুর গোছগাছ করতে কয়েক মাস লেগে গেল। একটা সংস্থা থেকে আমাকে পুরষ্কার দেওয়া হবে! আঞ্চলিক পুরষ্কার; যারা আমাদের অঞ্চলের, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে অবদান রেখেছেন কিংবা রেখে আসছেন। আর এই পুরষ্কারটাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য এলাকার এক মুক্তিযোদ্ধাকেও একটা পদক দেওয়ার প্রস্তাব পেলাম জনৈক শুভাকাক্সক্ষীর কাছ থেকে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি, মুক্তিযুদ্ধে সেই মুক্তিযোদ্ধা আর সাংস্কৃতিক ব্যক্তি হিসেবে আমার মতোই একজন! কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে ভাল অংকের ডোনেশন পেলাম। কিছু বিজ্ঞাপন পার্টনারও জুটে গেল। আসলে এ বিষয়টা যে এতটা লাভজনক সেটা ভাবতেও পারিনি। পদক দেওয়ার এই বিষয়টাকে নিয়মিত করলে বোধ হয় খারাপ হবে নাÑমনে মনে ভাবলাম আমি।
আমার সেই শুভাকাক্সক্ষী বড় ভাইটি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি যার নাম প্রস্তাব করলেন তাকে আমি চিনি না। আমাদের এলাকার একমাত্র ‘আসল মুক্তিযোদ্ধা’ না কি তিনিই। তবে তার কোন মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেই। তিনি কথা, মুক্তিযুদ্ধ করেছি দেশের জন্য, সার্টিফিকেট নিয়ে সেটাকে বিনিময়যোগ্য কেন করবো?
একদিন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাকেসহ আরো কয়েকজনকে তার কাছে পাঠানো হল। তাকে পুরষ্কার দেওয়ার সুসংবাদটা জানিয়ে নির্দিষ্ট দিন উপস্থিত থাকার কথা বলে আসতে হবে।
অনেক দিন পরে আবারো এলাকায় আসলাম। এলাকার খুব অল্প লোকই আমাকে চেনে। আর যে আমি লেখালেখি করে, সে কথা তাদের অনেকেই জানে না। একটা আঞ্চলিক পত্রিকা হাতে তুলে নিয়ে আনমনে চোখ বোলাতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম, কয়দিন পরে যখন মহা ধুমধামে পদকটা পাব, তখন সবাই-আমাকে ধন্য ধন্য করবে। কত মানুষ অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য লাইন দিবে! মনটা খুশিতে ভরে গেল। তবে এর পাশাপাশি অন্য একটা বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। ছেলের পিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। কে জানে কী রেজাল্ট আসে। কাকতালীয় ভাবে তখনই ঢাকা থেকে স্ত্রীর ফোন, ‘এই শুনছো, আমাদের বাবু না এ প্লাস পেয়েছে। ওদের স্কুল থেকে মাত্র বাইশটা ছেলে-মেয়ে এ প্লাস পেয়েছে এবার, তার মধ্যে আমাদের বাবুটাও আছে।’ গর্বে বুকটা ফুলে গেল আমার। এই না হলে আমার সন্তান। বাইশ জনের একজন! যেতে যেতে দেখলাম, পত্রিকায় একটা ছেলের ছবি ছেপেছে। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সে সারাদেশের মধ্যে প্রথম হয়েছে। ভাবলাম, মাত্রই রেজাল্ট দিলো। আর পত্রিকাওয়ালারা এর খবর পেল কোথায়? পরে বুঝলাম, যারা প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হয়, তাদের কথা বোর্ড আগেই বলে দেয়। সংবাদ দাতারা সাথে সাথেই ছেলেটির ছবি সংগ্রহ করেছে। পত্রিকায় ছাপা হওয়া ছবিটি দেখে ছেলেটিকে চিনতে পারলাম, ফেরিতে এই ছেলেটিকেই দেখেছিলাম, একটা ভিক্ষুকের সাথে। হঠাৎ যেন গাছ থেকে মাটিতে পতন ঘটলো আমার...।
মুক্তিযোদ্ধার বাড়িটা গ্রামের অনেকটা ভিতরে। ঠিকানামতো পৌঁছতেও অনেক কষ্ট হলো। কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তাতে পুরোপুরি হতাশ হতে হলো আমাকে। কোন রকমে জোড়া-তালি দেওয়া একটা খুপড়ি ঘর। আর সেখানে যাকে দেখলাম, তাকে দেখে তো আমার একেবারে আকাশ থেকেই মাটিতে পড়ার মতোন অবস্থা হল। কয়েক মাস আগে ফেরিতে দেখা হওয়া সেই ভিক্ষুক। যাকে আমি অপমান করে কথা বলছিলাম। আমার মুখে তাকে পুরষ্কার দেওয়ার কথা শুনে তিনি হাসতে লাগলেন। তারপর বললেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা। ভিক্ষা করে খেলেও কখনো কারো কাছে নিজের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান বিকিয়ে দিইনি। আগামীতেও দেব না। যে লোকের মন অতটা সংকীর্ণ, তার দেওয়া পুরষ্কার আমি নেবই বা কেন?’
আমার সাথের একজনের কাছ শুনলাম, এই লোকটার দুটো ছেলে ছিল। দুজনই মারা গেছে। একজন ২০০৭ সালের প্রলয়ংকারী সিডরে, আরেকজন ক্যান্সারে। একটা নাতি আছে, বিবাহিত ছেলের বউ আরেক জায়গায় বিয়ে করেছে। আর আছে বৃদ্ধ স্ত্রী। ক্যান্সারে আক্রান্ত ছেলেটিকে বাঁচাতে নিজের সমস্ত জায়গা জমি বিক্রি করে দেন। কিন্তু তাতেও লাভ হলো না। এখন বাধ্য হয়ে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
একটা ভিক্ষুকের (আসলে যিনি একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক) কাছে চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম আমি। পেণ্ডুলামের মতো মনটাও দুলছেÑআমি কি পদকটা নেব, নাকি নেব না? নাকি আমার পদকটা ইতোমধ্যে পাওয়া হয়ে গেছে!
[email protected]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.