নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সজীব

সজীব › বিস্তারিত পোস্টঃ

জ্বিন ভূত প্রেত : বিশ্বাস, কল্প-কাহিণী ও বাস্তবতা :|| :|| :|

১৬ ই অক্টোবর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৩০


জ্বিন ভূত প্রেতের অস্তিত্বে অনেকে বিশ্বাসই করেনা। বিশেষতঃ পশ্চিমা জগতের উন্নত দেশগুলোতে জ্বিন ভূত প্রেতের কথাকে অনস্তিত্বের কল্প-কাহিণী মনে করা হয়। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে অবশ্য জ্বিনের কথা উল্লেখ আছে। তাই ধার্মিক লোকেরা হয়তো বিশ্বাস করতে বাধ্য। যারা কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয় তারাও যে সবাই অবিশ্বাস করে এমনটিও না। বড়োরা বিশ্বাস করুক আর নাই করুক দুনিয়ার সব বাচ্চারাই হয়তো জ্বিন ভূত প্রেতের অস্তিত্বকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। পরী নিয়ে কল্পকাহিণী বা fairy tale নামে দেশ বিদেশে অনেক মজার মজার শিশুতোষ গল্পের বই লিখিত হয়েছে যুগে যুগে। বইগুলো সবদেশের বাচ্চাদের কাছে অতি জনপ্রিয়। জন্মের পর থেকে একটা সময় পর্যন্ত বাচ্চাদের সারাদিনের কাজ হলো একটানা ঘুম আর তার ফাঁকে ফাঁকে কিছুক্ষণ জেগে থেকে কান্নার ভাষায় বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস বা দাবী আদায় করা। পেটে খিদে লাগলে, পায়খানা-পেশাবের পর পরিষ্কার করার প্রয়োজন হলে, ঘুম ঘুম ভাব কিন্তু ঘুমের সুযোগ বা পরিবেশ নেই এমন পরিস্থিতিতে বাচ্চারা কেঁদে কেঁদে নোটিশ জারি করে। কান্নার প্রেক্ষিতে যারা বাচ্চাদের কখন কি দরকার তা বুঝতে না পারে তারা যেমন বিপাকে পড়ে, বাচ্চারাও তাদের কাছ থেকে সঠিক সেবা যত্ন পায়না। যতোক্ষণ বাচ্চারা জেগে থাকে ততোক্ষণে যদি তাদের কোনো জিনিসের প্রয়োজন না থাকে তাহোলে তারা এসময়টুকু পরিচিত মানুষের চোখের চাহনী, ভাব-বিনময় ও খেলার তালে স্বর্গীয় হাসি হেসে হাত-পা নেড়ে আশে পাশের সবাইকে আনন্দে উদ্বেলিত করে রাখে। বাচ্চাদের জীবনের এই অধ্যায়টা পার হওয়ার সাথে সাথে যখন তাদের মুখে কিছুটা কথা ফোটে, ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ ও বাক্যে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, প্রশ্ন করতে শেখে, তখন তাদের ঔৎসুক্য ও প্রাণচাঞ্চল্য এতোই বেড়ে যায় যে তাদের ঘুম লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পেতে থাকে। বয়সের এই সময়টায় বাচ্চারা পরিচিত হয় জ্বিন ভূত প্রেতের সাথে। যেসব বাচ্চারা ঘুমের সময় বিছানায় শুয়ে ঘুম এড়ানোর জন্য পট পট করে একথা সেকথা বলতে থাকে তাদের কথা বন্ধ করে দ্রুত ঘুম পাড়ানোর জন্য সবচেয়ে ফলদায়ক ওষুধ হলো জ্বিন ভূত প্রেতের গল্প। এমন কোনো বাচ্চা পাওয়া যাবেনা যাকে ভূত আসছে বললেও কথা থামিয়ে নিশ্চুপ বনে যাবেনা। শহরের ঘরে ঘরে রোমাঞ্চকর কল্পকাহিণী সম্বলিত অসংখ্য ভূতুড়ে গল্পের বই শোভা পায়। বাচ্চাদেরকে ওগুলো ঘুমের আগে শোনানো হয়। ভয়ংকর এসব গল্প বাচ্চারা সরল মনে বিশ্বাস করে, জ্বিন ভূত প্রেতের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের মনে কোনো প্রকার সন্দেহ থাকেনা, তাদের মন একধরনের ভয়-ভীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। পল্লীতে জ্বিন ভূত প্রেতের উপর এতো বইয়ের ছড়াছড়ি নেই তবে সেখানে আছে মানুষের মুখে মুখে অদ্ভূত সব কল্প-কাহিণীর সমাহার যা আবার উপস্থাপিত হয়ে থাকে বাস্তব অভিজ্ঞতার আদলে। ভুতুড়ে এসব গল্প এমনভাবে বলা হয় যেনো পরিচিত কোনো ব্যক্তির জীবনে ঘটেছে। বাচ্চাদের মনে জ্বিন ভূত প্রেতের অস্তিত্ব ও তাদের ভয়ংকর কর্মকান্ডের সত্যতা ভালোভাবে গেঁথে দেয়ার জন্য অনেক সময় অন্য একটা ঘটনাকে জ্বিন ভূত প্রেতের ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। গ্রাম্য বাড়ীগুলো যেহেতু গাছ পালায় ঘেরা এবং যেহেতু ধরে নেয়া হয় জ্বিন ভূত প্রেতরা গাছে বাস করে, শহরের তুলনায় গ্রামের বাচ্চাদের কাছে এভাবে বিভিন্ন ঘটনাকে জ্বিন ভুত প্রেতের বাস্তব কর্মকান্ড হিসেবে বিশ্বাস করানো খুবই সহজ। যেমন ধরুন বাচ্চাকে বলা হলো - কথা বলোনা, চুপ করে ঘুমাও, নইলে ভূত আসবে। বাচ্চাটা হয়তো তখন ভূতের কল্পনা ও ভূতের ভয়ে বিভোর থাকবে। এমনই এক মূহুর্তে জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা অন্ধকারে বাতাসে গাছের পাতা নড়তে দেখা গেলো, পাতা নড়ার শব্দ ভেসে এলো বাচ্চার কানে। তাকে বলা হলো - ঐ দেখো গাছ থেকে ভূত এসে ঘরের চালে বসেছে, এর পর না ঘুমালে সে এখনই চাল থেকে নেমে বিছানায় চলে আসবে। বাচ্চা যেনো বাস্তবে ভূতই দেখলো, ভূত চলার শব্দই শুনলো, বিশ্বাস না করে উপায় কী! তার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া!! সে পাশে শোয়া মা-বাবা অথবা বড়ো কারো বুক শক্তকরে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে যেতে বাধ্য হয়।



বিদেশ বিভূঁইয়ে শহুরে জীবনে বাচ্চাদেরকে যখন সম্পূর্ণ বানানো fairy tale (পরীর গল্প) পড়তে দেখি বা নিজে পড়ে শুনাই, তখন সেই ছোট্টবেলায় গ্রাম বাংলায় খোলামেলা মেটো ঘরে বসে শোনা অনেক বিস্ময়কর গল্প ও বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনা মনে ভেসে আসে। জ্বিন ভূত প্রেত বলতে সবই হয়তো এক। কিন্তু এ তিনটা পৃথক নাম আমাদের বাল্য মনে একই শ্রেণীভূক্ত তিনটা ভিন্ন ভিন্ন ভয়ংকর সৃষ্টির ছবি এঁকে দিয়েছিলো। ছোটোবেলায় খুব ঘন ঘন শুনেছি, দেখেছি অমুকের উপর জ্বিনে আছর করেছে, অমুকের ঘাড়ে ভূত চেঁপেছে, গ্রামের হাঁট থেকে বাড়ী ফেরার সময় অমুকের মাথায় রাতের অন্ধকারে বাঁশঝাড়ের উপর থেকে পেত্নী পেশাব করে দিয়েছে, একটা বাঁশ হঠাৎ করে নীচে নেমে এসে তার পথ আগলে ধরেছে, ইত্যাদি। সেসময়ে আমার শিশুমনে প্রোথিত ধারণা অনুযায়ী জ্বিন বলতে এমন এক বিশেষ অদৃশ্য অশরীরি সৃষ্টিকে বোঝানো হয় যারা আগুনের তৈরী এবং তারা শুধুমাত্র মেয়েমানুষের, বিশেষতঃ প্রাপ্তবয়স্কা মহিলাদের, পেছনে লাগে। জ্বিনেরা দুই ধরনের। এক শ্রেণীর জ্বিন অত্যন্ত খারাপ চরিত্রের যারা মেয়েদের পেছনে লাগে তাদের ক্ষতি সাধনের জন্য। কোনো মেয়েকে যদি তাদের অপছন্দ হয় অথবা তার দ্বারা অজান্তেই তাদের কোনোরকম অসুবিধা হয় তাহোলে তারা ওই মেয়ের পেছনে আদাজল খেয়ে লাগে, তার ঘাড়ে চেঁপে বিভিন্নভাবে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করে। আরেক শ্রেণীর জ্বিন আছে যারা খুব সৎ, কারো কোনো ক্ষতি তারা করেনা। খোদার সৃষ্টি হিসেবে এদের মধ্যেও প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা আছে। কোনো মেয়েমানুষের রূপ সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে এরা অনেক সময় ওই মেয়ের ঘাড়ে চাপে। তার সাথে একধরণের সখ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এই শ্রেণীর মধ্যে আবার অনেকে আছে যারা কোনো এক মেয়ে মানুষকে বিপদের ভিতর দেখলে, বিশেষতঃ কোনো খারাপ জ্বিন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে দেখলে, সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে, মেয়েটির পিছে লেগে থেকে তার বিপদ-আপদ ও ক্ষতি প্রতিরোধ করে। অন্যদিকে ভূত হলো যারা শুধু পুরুষ মানুষের পেছনে লাগে। এরা খুব দুষ্টু প্রকৃতির এবং অসুরের মতো শক্তিধর। এরা কখনো কোনো কারণে কোনো পুরুষ দ্বারা কোনো কাজে অথবা গতিপথে বাঁধাগ্রস্থ হলে অথবা যে কারণেই হোক তার প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তাকে বিভিন্নভাবে প্রথমে দূর থেকে ভয় দেখায় এবং পরে ঘাড়ে চেঁপে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায় এবং ক্ষতি সাধন করে। জ্বিন ভূতের সমজাতীয় আরেক সৃষ্টি হলো প্রেত। প্রেতরা মহিলা প্রজাতির এবং এদের মধ্যে দুইটা ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণী আছে – পরী ও পেত্নী। পরীরা খুবই সুন্দরী হয় এবং ওরা কখনো কোনো সুদর্শন মানব-পুরুষের দেহাবয়ব ও রূপ সৌন্দর্যে মাতাল হলে ওই পুরুষের প্রেমে পড়ে তার ঘাড়ে চাপে, তার সাথে ভালোবাসার রকমারি ছলনা করে, তাকে মুগ্ধ করতে চায়। পেত্নীরা হলো আরেক প্রজাতির অশরীরি জীব যারা কিম্ভুত-কিমাকার কালো মহিলা চেহারা ও এলোমেলো চুল নিয়ে আবির্ভূত হয় মানুষের সামনে।



রাতের অন্ধকারে বাঁশঝাড়ের আগায়, গাছের পাতায় কিংবা ডালে তাদেরকে হঠাৎ হঠাৎ করে দেখতে পাওয়া যায়। বিদ্ঘুটে কালো চেহারা ও অদ্ভুত অবিন্যস্ত চুলের ফাঁক দিয়ে তাদের লাল টকটকে ভয়ংকর চোখ ঠিক্রে পড়ে রাতে চলাচলকারী মানুষের উপরে। অনেকটা হনুমানের মতো এদের আচরণ। গাছের আগায় বসে বসে লম্বা হাত দিয়ে মাথার চুল বাছতে থাকে সারাক্ষণ। এরা নাকি কিছু কিছু মৃত মানুষের প্রেতাত্মা। যেসব মানুষ বড়ো ধরণের পাপী বা অপরাধী তারা মরার পর তাদের অশান্ত আত্মা পেত্নীর রূপ নিয়ে আবার দুনিয়ায় এসে আজীবন শাস্তি ভোগ করতে থাকে। পাপের শাস্তি হিসেবে ওরা সর্বদা পিপাসার্ত থাকে এবং একটু শান্তির অন্বেষায় বারবার এক গাছ থেকে অন্য গাছে স্থানান্তর হতে থাকে। বাঁশঝাড়ের ও গাছের আগা ছাড়া কোথাও ওদের আশ্রয় মিলেনা। মাঝে মাঝে ওরা “পানি খাবো, পানি দাও” বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেয়। ওরা যখন রাতের অন্ধকারে লম্বা বাঁশের আগা অথবা গাছের ডালসহ ঝপ্ করে রাস্তায় চলন্ত মানুষের উপর নেমে আসে তখন তা স্বেচ্ছায় বা ভয় দেখানোর জন্য করেনা। পিপাসার্ত বুকে এক ফোঁটা পানির জন্য অশান্ত অস্থির মনে একটু শান্তির জন্য তারা আকূল আকূতি নিয়ে মনের অজান্তেই গাছের আগা বেয়ে মানুষের সান্নিধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষ তাতে ভয় পায়, প্রাণে বাঁচার জন্য দৌঁড়িয়ে পালায়। কিন্তু পিপাসায় কাতর অভাগা পেত্নীদের পোড়া কপালে কখনোই শান্তি মিলেনা, মিলেনা একফোঁটা পানি। জ্বিন ভূত প্রেত ছাড়াও এদের সমগোষ্ঠি আরেকটি অশরীরি জীব আছে যাদের চলাফেরা ও বসবাস পানি কেন্দ্রিক। দেশের আনাচে কানাচে অসংখ্য খাল-বিল, নদ-নদী ও জলাশয়ের পানির পাশে এরা লুকিয়ে থাকে, মাছ খেয়ে জীবন ধারন করে। গ্রাম্য ভাষায় এরা “শক্শো” নামে পরিচিত। এরা পানিতে মাছ ও ডাঙ্গায় পাখির রূপ ধারণ করতে পারে। রাতে মাছ ধরার নেশা যাদের বেশী, তারাই শক্শোর মুখোমুখী হয়। গ্রামদেশে মাছ ধরার বাতিকগ্রস্থ লোকের অভাব নেই, এদের মধ্যে আবার অনেক মাছুড়ে আছে যারা রাতে নিরিবিলি পরিবেশে মাছ ধরতে পছন্দ করে। কিন্তু রাতে মাছ ধরার বিপদ একটাই – শক্শো। রাতে মাছ ধরার একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এটাকে বলা হয় আলোকাটায় মাছ ধরা। এক হাতে একটা আলো এবং বাঁশের কঞ্চি চিরে চিকন বেত দিয়ে তৈরী এক ধরনের মাছ রাখার পাত্র বা খেলোই রাখতে হয়, অপর হাতে গ্রাম্য ভাষায় পরিচিত চাবক নামের লম্বা একটা লগি দিয়ে মাছ ধরার কাজ করতে হয়। চাবকের মাথায় সুচের মতো ধারালো চিকন অনেক গুলো শিক থাকে যা সজোরে মাছের পিঠে বসিয়ে দিয়ে হেঁচকা টান দিয়ে মাছ তুলে আনা হয় ডাঙ্গায়। হাতে আলো রাখলে নাকি মাছ গুলো দূর দূরান্ত থেকে মাতাল হয়ে আলোর দিকে ছুটে আসে। সবার হাতে মাছ সমান ধরা পড়েনা। যারা অনেক নামকরা মাছুড়ে, শক্শো গুলো তাদের পেছনে লাগে বেশী। মাছ মেরে খেলোই ভরে ফেলাচ্ছে অথচ পরে দেখে খেলোইয়ে মাছ নেই অথবা খুবই কম। এমন অবস্থা হলে, ধরেই নিতে হবে শক্শো ব্যাটা সব মাছ খেয়ে নিয়েছে। তাতেও ভয় পাবার কিছু নেই। ভয় জাগে তখন যখন চাবক মেরে মাছ ডাঙ্গায় তোলার পর সে মাছ মৃত পাখীর রূপ ধারণ করে। শক্শো অবশ্য সব পাখীর রূপ ধারন করেনা, দৃশ্যতঃ শুধুমাত্র মরা কালো কাকের আকৃতি নিয়ে পড়ে থাকে।



জ্বিন ভূত প্রেত সংক্রান্ত ওইসব শৈশব ধারণা, ঘটনা ও কাহিণী সম্পর্কে এখন আমার মনে নানারকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্ন জন্মালেও তখনকার দিনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। ছোটবেলায় যেসব ধারণা হৃদয়ে অংকন করে দেয়া হয়েছে, যেসব কাহিণী শুনেছি এবং যে ঘটনাবলী দেখেছি সেসম্পর্কে এখন আমার ভিতর তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। এক, কিছু ঘটনা ও কাহিণী আজ অসত্য ও পাতানো মনে হয়, কিছুতেই মন বিশ্বাস করতে চায়না। দুই, কিছু কাহিণী ও ঘটনাকে আমি কোনোভাবেই অবিশ্বাস করতে পারিনা, যা দেখেছি আর যা অকাট্যভাবে শুনেছি তা মিথ্যা প্রমাণ করার মতো কোনো যুক্তি প্রমাণ আমার কাছে নেই। তিন, কিছু কিছু ঘটনা ও কাহিণী এখনো রহস্যে আবৃত, না পারি বিশ্বাস করতে আর না পারি ঠেলে ফেলে দিতে। আমি পারিনা কোনোভাবেই ওগুলোর সত্য মিথ্যার ব্যাখ্যা মিলাতে। বিশেষতঃ জ্বিন সম্প্রদায় সম্পর্কে যেহেতু পবিত্র কুরআন শরীফে অনেক আলোচনা এসেছে, তাদের অস্তিত্ব ও জীবনধারা সম্পর্কে আমি অন্যান্য সব বিশ্বাসীদের মতোই কুরআন পাকের বিবরণ অনুযায়ী হুবহু বিশ্বাস করি। কিন্তু শৈশবে শোনা অনেক বর্ণনা ও ঘটনা আজ যখন যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করি তখন অনেক ক্ষেত্রে হোঁচট খাই, ওগুলোকে অলীক মনে হয়। জ্বিন ভুত প্রেতের ঐসব ঘটনা হয়তো দেশে এখনো চলছে, আজকের বাচ্চারা হয়তো এমনই বিশ্বাস করছে যেমন আমি তাদের বয়সে করেছি। কিন্তু বড়ো হয়ে দেশের বাইরে বিশেষ করে পশ্চিমা জগতে উন্নত দেশে যখন ঐ জাতীয় ঘটনা দেখিনা, কাহিণী শুনিনা তখন স্বভাবতই মনে খটকা জাগে যে ওদের ওইসব আজব কাহিণী ও ঘটনা কেনো শুধু আমাদের দেশেই ঘটবে? জীবনের এপর্যায়ে এসে আজকে আমার বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেনো সেই শৈশবে শোনা, দেখা ও বাস্তব অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কিছু কাহিণী, কিছু ঘটনা আজ আমার মনকে ব্যাকুল করে পিছে টানছে। বড়ো জানতে ইচ্ছে করছে অন্যরা এগুলোকে কীভাবে দেখবেন, বিশ্লেষণ করবেন এবং গ্রহন বা বর্জন করবেন।



শক্শোর অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। কারণ এটা যেহেতু মাছুড়েদের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং গ্রাম দেশে সবাই যে হাত যশা মাছুড়ে এমনও নয়, তাই শক্শোর ঘটনা সচরাচর তেমন একটা চোখে পড়েনা। যাদের আশে পাশে বড়ো ধরণের মাছুড়ে লোকের বসবাস শুধু তারাই হয়তো শক্শোর কান্ড কারবারের কাহিণী শুনতে পারে বা বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা অবলোকন করতে পারে। আমার এক চাচা ছিলেন অত্যন্ত নেশাগ্রস্থ মাছুড়ে। আমার মাছুড়ে দাদার স্বভাব একমাত্র ঐ চাচাই পেয়েছেন। মাছ ধরার নেশায় কখনো তাকে বাড়ী পাওয়া যেতোনা, কি দিনে কি রাতে। মাঝে মাঝে কয়েক দিনের জন্য বেরিয়ে যেতেন জাল, চাবক, আলো ও মাছ ধরার অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ খাবার দাবার নিয়ে। অনেক দূরে দূরে যেতেন মাছ ধরতে। বিল খালের পাশেই রাত কাটাতেন বছরের বিশেষ বিশেষ মাছ ধরার সময়গুলোতে। তার কাছে শুনেছি শক্শো নিয়ে অনেক মজার মজার ঘটনা। আমরা সবাই জানি যে কোনোখানে একাধিক মাছুড়ে একসাথে মাছ ধরতে গেলে অন্য কেউ একটা মাছ না পেলেও আমার চাচার খেলোই কিছুক্ষনের মধ্যে ভরে যাবে মাছে। সেই চাচাকেই মাঝে মাঝে দেখতাম সারারাত আলো কাটায় মাছ ধরা শেষে সকালে খালী হাতে অথবা অতি অল্প মাছ নিয়ে বাড়ী ফিরেছেন, এ এক অবাক কান্ড। চাচার মন খুবই খারাপ। চাচা খিদে, রাগে ও ক্ষোভে অনর্গল শক্শোকে গালিগালাজ করে যাচ্ছেন। কী ব্যাপার? চাচা বলবেন, আমি একেকবার ঝাকে ঝাকে মাছ ধরে খেলোইয়ে রাখছি আর পরক্ষণে আবার যখন নতুন করে ধরা মাছ রাখতে যাচ্ছি তখন দেখি আগের মাছ গুলো আর নেই। সব ঐ শক্শো হারামজাদা খেয়ে ফেলেছে। তা একবার খেলে হয়, আমি যতোবার মাছ রেখেছি ততোবারই সে খেয়ে ফেলেছে। এমন হাতযশা মাছুড়ে যখন খালী হাতে বাড়ী ফিরে এমন কথা বলে তখন বিশ্বাস না করে আর উপায় কি? অনেক রাতে আলোকাটায় মাছ ধরতে গিয়ে এমন হয়েছে যে উনি মাছের ঝাকে চাবক মারছেন, চাবকের সুচালো শিকের মাথায় আটকে থাকা মাছ ডাঙ্গায় তুলছেন, তারপর সে মাছ চাবক থেকে ছুড়িয়ে নিয়ে মাটিতে রাখার সাথে সাথে মৃত পাখী হয়ে যাচ্ছে। সব সময় আমরা এটা বিশ্বাস করতামনা, পাতানো গল্প মনে করতাম। কিন্তু কোনো সময় যদি এমন ঘটনা ধারে কাছে, বিশেষ করে গ্রামের বিলে, ঘটতো তাহোলে সকালবেলা আমাদেরকে সেখানে নিয়ে গিয়ে মরা পাখী দেখিয়ে দিতেন। এখন মনে হয় গ্রাম দেশে বিল খালের পাশে যেখানে শত শত পাখীর বাস সেখানে দুয়েকটা পাখী মরে পড়ে থাকতেই পারে। উনি হয়তো আমাদেরকে এমন এক জায়গায়ই নিয়ে যেতেন যেখানে আগে থেকেই উনি মরা পাখী পড়ে থাকতে দেখেছেন।



শৈশবে কখনোই এমন ভাবিনি, মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছি। ছোটোবেলায় অনেককে বড়শী পেতে মাছ ধরতে দেখেছি। সাধারণতঃ রাতের প্রথমভাগে বড়শী পেতে রাখা হয় এবং ভোরে তা তুলে আনা হয়। সব বড়শীতে মাছ না বাঁধলেও একশোটার মধ্যে অন্ততঃ পঞ্চাশটায় মাছ বাঁধে। মাছ ধরায় যার যতো হাতযশ তার ততো মাছ বাঁধে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অল্প বয়সীরাই বড়শী দিয়ে মাছ ধরে। রাতে যাতে ভীতিকর কোনো পরিস্থিতির শিকার না হতে হয় সেজন্য কয়েকজনে দল বেঁধে বড়শী পাত্তে যায় আবার দল বেঁধে ভোররাতে বড়শী তুলে আনে। আমার পোড়া কপালে যদিও মাছ বাঁধতো সবার চেয়ে কম, আমিও শৈশবে দল বেঁধে বড়শী পেতে মাছ ধরেছি। সাধারণতঃ শীতকালেই বড়শী দিয়ে মাছ ধরা জমে বেশী। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মাছ হতো আমারই সমবয়সী শুকুর চাচার হাতে। তার পেছনে শক্শো লেগেই থাকতো। প্রতি রাতে সকাল হওয়ার অনেক আগে কে যেনো তাকে ডেকে ডেকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো। বলতো এই শুকুর ওঠ, সকাল হয়ে গেলো, ফজরেরে আজান হয়ে গিয়েছে, চল তাড়াতাড়ি চল বড়শী তুলতে হবে। শুকুর চাচার কাছে কণ্ঠটা আমাদের মধ্য থেকেই কোনো একজনের মনে হতো। সে ঝটপট লেপ কাঁথা ফেলে ঘুম থেকে উঠে ঝুড়ি মাথায় নিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে দৌড়াতো বুড়িগাঙের দিকে। ঘুমের ঘোরে কিছুদূর পথ এগিয়ে দেখতো তখনো অনেক অন্ধকার, যেনো রাত তখনো বেশ বাকী। কিন্তু ঠিকই সে তার সামনে অন্যান্য সাথীদেরকে দেখতে পেতো। অন্ধকারে তো আর চেহারা দেখা যায়না, ছায়ামূর্তির মতো তাদেরকে দেখতে পেতো। শুকুর চাচা থম্কে দাঁড়িয়ে বলতো, কি রে তোরা এতো রাতে কোথায় যাচ্ছিস? এখনো অনেক রাত। দ্যাখ, এখনো অন্ধকার রয়েছে, আমি পরে যাবো তোরা এখন যাবি তো যা। অমনি তারা হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যেতো। শুকুর চাচা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে আবার লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। সকালে ঠিকই আমরা যথাসময়ে একসাথে দল বেঁধে বড়শী তুলতে যেতাম। সে সময় শুকুর চাচা আগে যার কণ্ঠ শুনে গভীর রাতে বেরিয়েছিলো তাকে জেরা করতো, গালিগালাজ করতো তার ভোগান্তির জন্য। আমরা যেহেতু কেউই এটা করিনি, তার কথার আগা মাথা আমরা কেউ বুঝতামনা। বুঝবোই বা কি করে, ওই শক্শো ব্যাটাই তো ওটা করেছে। কি জানি শুকুর চাচাকে ভালিয়ে ভুলিয়ে যদি আর একটুখানী দূরে নিয়ে নদীর পানিতে ফেলতে পারতো তাহোলে হয়তো তাকে ঘাড় মটকিয়ে পানিতে ডুবিয়ে মারতো। এমনই ছিলো তখন আমাদের ধারণা, এখন যদিও এমন কিছু বিশ্বাস করতে মন চায়না।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১:১৬

অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: আপনি নিজেইতো একজন ভৌতিক ব্লগার :-& :-&

মজা করলাম ।

ভালো থাকবেন :)

২| ১৭ ই অক্টোবর, ২০১৪ দুপুর ১:৪৭

সজীব বলেছেন: :D :D :D

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.