নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সালমা রুহী

সালমা রুহী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ও আমার দেশের মাটি

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:২৫


প্রতিদিনের মতো সোহাগ মিয়া তার রিক্সা নিয়ে রাজপথে বেরিয়েছে। রিক্সার পেসেঞ্জার তার ৭-৮ বছরে ছেলেকে নিয়ে স্কুলের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন।
রিক্সার তিন চাকা ঘুরছে, রিক্সার হাতলে লাগানো ছোট্ট বাংলাদেশের পতাকাটা পতপত করে উড়ছে। আজ স্বাধীনতা দিবস, চারদিকে একটা উৎসব মুখর আমেজ। মানুষ লাল সবুজ কাপড় পরে হাতে ফুল নিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছে। স্কুলে স্কুলে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান চলছে।
সোহাগ মিয়ার বয়স এখন প্রায় ৫০ কি ৫৫ হবে। একাত্তরের যুদ্ধের সময় তিনি ৮ কি ১০ বছরের ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের কথা তার আজো মনে আছে.....

সোহাগ মিয়ার বাবা কবির মিয়া ঢাকা শহরে একটা কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। সোহাগ মিয়া তখন ক্লাশ টু'তে পড়ে। প্রতিদিন রাতের খাবারের পর বাবার সাথে রেডিওতে খবর শুনে, চারদিকে পরিস্থিতি গরম।
আজ বাবার সাথে রেডিও খবরে শুনেছে, পাকিস্তান জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন, "২৩ তারিখ তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন।"
আসলে এটা ছিলো একটা মিথ্যা প্রচারনা মাত্র। বাঙ্গালীদের ধোকা দেয়া হয়েছিলো।

২৩ তারিখ চলে যাওয়ার কথা বলে তিনি ঢাকাতেই অবস্থান করেন এবং 'অপারেশন সার্চলাইটের' প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
আসলে ২৫শে মার্চ রাতে টিক্কা খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। সেই রাতেই বাঙ্গালীদের উপর চালানো হয় এক নির্মম হত্যাকান্ড। যা ছিলো 'অপারেশন সার্চলাইট'....!!!
২৫ মার্চ কালো রাতে ১১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ৩১ জন সহকর্মী সহ মিথ্যা 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার' দায়ে গ্রেফতার করা হয়।
সেদিন রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষনা করেন,
"হয়ত এটাই আমার শেষ বার্তা, কিন্তু আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন......।"

২৫শে মার্চের সেই নির্মম কালো রাতের কথা সোহাগ মিয়ার এখনো স্পষ্ট মনে আছে...........

খাবারের পর বাবার সাথে শুয়েছিলো, পাশের রুমে মা কাঁদছেন। বাবাকে জিজ্ঞাস করলে বাবা বললেন, তোমার মায়ের শরীরটা একটু খারাপ। তখন দাদী এসে বাবাকে বললেন, " বাবারে, দাই সব রকম চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাসায় সম্ভব হচ্ছে না, সোহাগের মাকে হাসপাতালে নিতে হবে।"
বাবা শার্ট গায়ে দিচ্ছেন, মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।

হঠাৎ চারিদিকে গুলির শব্দ, চিৎকার।
"দারওয়াজা খোল, দারওয়াজা খোল"। দরজায় মিলিটারির লাথির শব্দ। বাবা দরজা খুলতে গেলে, দাদী না করছে, "খুলিস না বাবা, খুলিসনা।"
মিলিটারিরা দরজায় লাথি দিয়েই যাচ্ছে.....
একপর্যায়ে বাবা দরজা খুলে দিলেন। তারা ঘরে ঢুকেই বাবাকে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো, দাদী এসে চিৎকার করে বলছেন, "বাবারা দোহাই তোমাদের, আমার ছেলেকে ছাইড়া দাও। আমার ছেলে তো কিছু করেনি, সে তো নির্দোষ.... "
তখন একজন মিলিটারী বললো, "বুড়িয়াকো বাহার ফেকো।"
সাথে-সাথেই একজন এসে দাদীকে এমন ধাক্কা দিলেন, দাদী পড়ে গিয়ে তার মাথা ফেটে রক্তে ঘরের মেঝে ভেসে যাচ্ছে.......

তারা মায়ের রুমের দিকে যাচ্ছে আর বলছে, "তেরা বিবি বেটি কাহা হে??"
বাবা বলছেন, "আমার কোনো বেটি নাই। আমার বিবি অসুস্থ, তার ব্যাথা উঠেছে। আমাকে যেতে দিন, আমার যে ওকে হাসপাতালে নিতে হবে।"
বাবার কথা তাদের বিশ্বাস হলো না, মায়ের রুমে ঢুকে মাকে দেখে তাদের মাথায় যেনো রক্ত উঠে গেলো। মায়ের চিৎকারে সোহাগের কলিজা শুকিয়ে গেলো...... তারা নির্মমভাবে বেয়োনেট দিয়ে মায়ের পেট ফেঁড়ে দিয়েছে......
এক মিলিটারি এসে বাবাকে বললো, "তেরি বিবিকো হাসপাতাল নাহি লেনা পারেগা, হাম তেরি খুবসুরাত বিবিকা ডেলিভারি কারা দিয়েহে।"
আরেকজন মিলিটারি বললো, "চালো। আব ইস ঘারমে হামলোগ কা কাম কা কুছ নাহি রাহা....।"

তারা চলে যাচ্ছিলো....... হঠাৎ একজন ঘুরে বাবাকে ব্রাশফায়ার করলো....
একের পর এক ঘটনা সোহাগের চোখের সামনে ঘটে গেলো, সে যেন খাটের নিচে পাথর হয়েই লুকিয়ে রইলো,
তার আর কিছু মনে নেই, কখন যেনো কে এসে তাকে খাটের নিচ থেকে টেনে বের করলো!!!!!
সোহাগ মিয়া তার দূর সম্পর্কের এক চাচার কাছে বড় হয়েছে। আব্বা-আম্মা বেঁচে থাকলে তার জীবনটা হয়তো আজ অন্য রকম হতো। পড়াশুনা করে হয়ত ভালো কিছু করতে পারতো......
রিক্সা চালালেও সোহাগ মিয়ার দেশের জন্য গভীর মায়া....... এই দেশ স্বাধীন করতে তার মা-বাবা, দাদী ও তার মায়ের গর্ভের অনাগত সন্তানও জীবন দিয়েছে।
কয়জন মনে রেখেছে তাদের এই বলিদান???
সেইদিন সোহাগ মিয়ার ছোট্ট মনে প্রশ্ন জেগেছিলো, "সেদিন তারা তার অসুস্থ মাকে কেনো মারলো?"
আজ বুঝতে পারছে সেদিন তার অন্তসত্তা মা তাদের যৌনক্ষুধা মিটানোর অবস্থায় ছিলো না। সেই জন্য তার সুন্দরী মাকে দেখে জানোয়ারদের মাথায় রক্ত উঠেছিলো......মায়ের অনাগত বাচ্চাটাকেও দুনিয়াতে আসতে দিলো না!!!
সোহাগ মিয়া তার মা-বাবাকে যেমন ভালবাসতো, তেমনি ভালবাসে এই স্বাধীন বাংলাদেশকে....এই দেশের মাটিতে মিশে আছে তার মা বাবা আর দাদীর রক্ত.......

"এই রিক্সা থামাও" পেসেঞ্জারের ডাকে সোহাগ মিয়ার সম্বিৎ ফিরে এলো।
রিক্সার তিন চাকা স্কুলের গেটের সামনে থেমে গেলো। স্কুলের অনুষ্ঠান থেকে ভেসে আসছে,

"ও আমার দেশের মাটি,
তোমার পরে ঠেকাই মাথা,
তোমাতে বিশ্বময়ী,
তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।
ও আমার দেশের মাটি........

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৩৪

মনিরুল ইসলাম বাবু বলেছেন: নির্মম সেই দিনগুলো উঠে এসেছে আপনার লেখায়।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৩২

সালমা রুহী বলেছেন: ধন্যবাদ

২| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৪২

হাফিজ বিন শামসী বলেছেন:

সব হারানো সোহাগ মিয়াদের মনঃকষ্ট দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ধন্যবাদ।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৩৪

সালমা রুহী বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:১৫

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: ধন্যবাদ , সুন্দর করে তুলে ধরেছেন সেই কাল রাতের নিষ্ঠুর নির্মতাকে ।
স্বাধিন বাংলাদেশের পতাকা যখন নির্ভয়ে মর্যাদার সহিত বাংলার আকাশে বাতাসে উড়ে
চারিদিকে ভয়হীনভাবে যখন বাজে গানের কলি ও আমার দেশের মাটি.. তখন
ভুলে যাই সে দিনের দু:খ কষ্টের কথা ,তবে মনে বাজে হারানো প্রিয়জনদের কথা
যারা আমাদের জন্য একটি স্বাধিন দেশ লভিভার তরে জীবন দিয়ে গেল আকাতরে,
তাদের প্রতি রইল ভালবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধা ।

শুভেচ্ছা রইল

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৪২

সালমা রুহী বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ

৪| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৫৪

আহমেদ জী এস বলেছেন: সালমা রুহী ,




গল্পের ছলে হলেও লেখাটি লিখে, মুক্তিযুদ্ধ যে আমাদের উপলব্ধির কতো গভীরে প্রোথিত তা-ই প্রমান করলেন ।
সোহাগ মিয়াদের মতো লাখো সোহাগ মিয়া ঐ সময়ে একটি সংজ্ঞবদ্ধ চেতনার, আবেগের, বিদ্রোহের কালই দেখেছেন , রয়েছেন তার নিরব স্বাক্ষী হয়ে ।

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৪৩

সালমা রুহী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ

৫| ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১১:০৯

নূর-ই-হাফসা বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন ।
ঐ সময়ের কিছু মুহূর্ত কি সুন্দর করে তুলে ধরলেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.