নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সালমা রুহী

সালমা রুহী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার গর্ভে জন্ম নিও....

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০০


শৈশব স্মৃতি বললেই আমাদের মনে পড়ে যায়, পুতুল খেলা, স্কুল পালানো, বান্ধবীদের নিয়ে আড্ডা দেয়া, মজা করা ইত্যাদি।
কিন্তু আজ আমার শৈশবের যে স্মৃতি বার বার মনে পড়ছে, তা আমার ছোটভাইয়ের জন্ম।

আজকাল সন্তান জন্মানোটা প্রযুক্তি কত সহজ করে দিয়েছে।
কিন্তু আমি যখন ছোট তখন সন্তান জন্মানো ছিল খুবই লজ্জার ব্যাপার, মায়ের পেটে বাচ্চা আসলে, অন্য সন্তানদের জানানো হতো না।
অনেক গোপনীয়তা রক্ষা করা হতো।

আমার বয়স ছয় কি সাত হবে, বাবা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। মা আবার কনসিভ করেছেন, আমি এখনকার যুগের বাচ্চা হলে ঠিকই বুঝতাম মার পেটে বাবু। কিন্তু সেই যুগে এই ব্যাপারটা গোপনীয় হওয়াতে কিছুই বুঝি নি। মায়ের পেট দিন দিন দেখি বড় হয়ে যাচ্ছে।

একদিন মাকে জিজ্ঞাস করলাম, "আচ্ছা মা তোমার পেট এত বড় হয়ে যাচ্ছে কেনো? মা মনে হয় লজ্জা পেয়ে গেলেন, অপ্রস্তুত ভাবেই বললেন,"আমি এখন ভাত বেশি খাই তো, তাই পেট বড় হয়ে গেছে"। আমি আবার পন্ডিতের মত বললাম "মা তোমার পেটে মনে হয় কৃমি হয়েছে, মর্জিনার পেটটা দেখনা কত বড়! তুমি না সেদিন মর্জিনার মাকে বলছিলে, মর্জিনার পেট বড় হয়ে গেছে। কৃমির ঔষধ খাওয়াতে।"

কাজের বুয়ার পাঁচ বছরের মেয়ের বিশাল পেট দেখে
সেদিন মা আমার সামনে একথা বলছিলেন।
তবুও বুঝি না আমার মায়ের পেটে আমার ছোটভাই।
পাশের বাসার টুম্পা আমার সাথে পড়ে। রোজ তাদের বাসায় বিকেলে খেলতে যাই, সন্ধায় মা ডেকে নিয়ে আসেন।
আজ মা ডাকছে না, নিজেই বাসায় গেলাম।
বাসায় গিয়ে শুনি মায়ের রুম থেকে মায়ের গোঙ্গানির শব্দ, বাবা অস্থির ভাবে এ ঘর ও ঘর পায়চারি করছেন। বাবা আমাকে মায়ের রুমে যেতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু কেনো?
বাবাকে জিজ্ঞাস করলে বাবা বললেন, "তোমার মায়ের পেটে ব্যথা, তুমি গেলে বিরক্ত হবে।"

আমার ছোট্ট মনে প্রশ্ন, "আমাদের কিছু হলে বাবা ডাক্তার কাকার কাছে নিয়ে যায়, আজ কেনো মাকে ডাক্তার কাকার কাছে নিয়ে যাচ্ছেনা?"
"মায়ের কাছে যাবো", কান্না করতে লাগলাম। বাবা আমাকে মায়ের দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে আমাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিলেন, বাবা ভিতরে গেলেন না।

এখন বুঝি, "ওই ঘরতো ছিল তখন অশুচ ঘর, আঁতুড় ঘর, বাবাদের যাওয়ার নিষিদ্ধ ঘর...."
মা শুয়ে আছে, ঘামে মায়ের শরীর ভিজে জব জব হয়ে আছে।
সারা ঘরে ডেটলের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। দরজা-জানালা সব বন্ধ, দম বন্ধ পরিবেশ। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "দুষ্টামি করবে না, বাবাকে বিরক্ত করবে না, সময় মতো স্কুলে যাবে, সময় মত খাবে। মা শুয়ে-শুয়ে কথাগুলো বলছেন আর তার দু'চোখ গড়িয়ে চোখের পানিতে বালিশ ভিজছে......
মা হয়তো ভাবছেন, "যদি মারা যান"।
আমার ছোট্ট হাতে মায়ের চোখ মুছে দিচ্ছি আর বলছি, "মা তোমাকে বলেছিলাম না তোমার পেটে কৃমি হয়েছে ঔষধ খাও, দেখনা মর্জিনা কয়দিন পর পর পেটের ব্যথায় কাঁদে।"

হঠাৎ মায়ের পায়ের কাছে কালো নোংরা শাড়ী পড়া একজন বয়ষ্ক মহিলাকে বসে থাকতে দেখে বললাম, "মা এই পচা মহিলা কে?" মা বললেন, "এভাবে বলে না, উনি তোমার একটা নানু। আমার পেট ব্যথায় উনি তেল দিয়ে দিলে ভাল হয়ে যাবে।"
বাবা আমাকে ডাক দিয়ে নিয়ে আসলেন।
মায়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে বাবার গলা জড়িয়ে কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম......

সকালে ঘুম ভাঙ্গলো মায়ের রুম থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দে, দৌড়ে মায়ের রুমে গেলাম......
মায়ের পাশে কাথায় মুড়ানো ছোট্ট একটা 'দেবশিশু' পিট পিট করে তাকাচ্ছে।
আমি অবাক হয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছি।
মায়ের পেটে ব্যথা সেরে গেছে, কিন্তু চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। যেনো মায়ের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে, তারপরও মায়ের ঠোঁটে হাসির ঝিলিক।

মা বললেন, "তুমি না বলতে তোমার সাথে খেলার কেউ নেই, প্রতিদিন টুম্পাদের বাসায় যেতে হয় খেলতে।
আল্লাহর কাছে বলেছিলাম, কাল তুমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে আল্লাহ তোমার খেলার সাথীকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।"
আমার খুশি কে দেখে, যেনো স্বর্গ আমার হাতের মুঠোয়....!!
নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে সারাদিন ভাইয়ার কাছে বসে থাকি।

আমার শৈশবের এই স্মৃতি মনে পড়লে আজও চোখের কোণ ভিজে উঠে......আনন্দ আর বেদনায়।
আনন্দে চোখ ভিজে আমার 'দেবশিশুর' মত ভাইটার জন্মের কথা মনে হলে।
বেদনায় ভিজে উঠে মায়ের কথা মনে পড়লে, যে আজ না ফেরার দেশে......!

সেদিনের ছোট্ট মনে প্রশ্নের উত্তরগুলো আজ খুঁজে পাই, "বাচ্চা ডেলিভারির ব্যাপারটা ছিলো খুবই গোপনীয়, মফস্বলে ডাক্তার নার্স দিয়ে প্রসব করানো হতো না। এটা যেন একটা খুবই স্বাভাবিক গোপন ব্যাপার।

সারা গ্রাম জুড়ে অভিজ্ঞ একজন দাই থাকতেন, নোংরা, অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর.....!!
তখন তারাই ছিল আমাদের মায়েদের একমাত্র ভরসা, তারাই তাদের নোংরা হাতে প্রসব করাতো।
কোথায় গ্লাভস, কোথায় এন্টিসেপ্টিক, ডেটল-স্যাভলন, কোথায় বেবি ডেলিভারি কিডস....??
বাবা সচেতন হওয়ায় ডেটল আর নাড়ী কাটার নতুন ব্লেড এনে রেখেছিলেন।

আজ আমি লেবার পেইন নিয়ে লেবার রুমে ভর্তি হয়েছি।
এসি রুম সব কিছু হাইজেনিক একটু পর পর গাইনী ডাক্তার আসছে, নার্স আসছে। কত ধরনের ইন্সটুমেন্ট, প্রসব সহজ করার জন্য।
নরমাল ডেলিভারিতে পেথিড্রিন ইঞ্জেকশন দিলে ব্যাথার তীব্রতা কমে যায়। আমাকে পেথিড্রিন ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরেও কোরবানির পশুর মত গোঙ্গাচ্ছি, চিৎকার করছি..........
অথচ আমাদের মায়েদের প্রসব ব্যাথার তীব্রতা কমানোর কোনো চিকিৎসাই ছিলো না, তারপরও চিৎকার করা নিষেধ ছিলো।
বাইরে আওয়াজ গেলে বা মানুষ শুনে নিলে যে মহাপাপ হয়ে যাবে!!!

প্রসব ব্যাথায় ছটফট করছি আর মনে মনে মাকে উদ্দেশ্য করে বলছি, "মাগো বদ্ধ আঁতুড় ঘরের কোণে পড়ে থেকে এতো কষ্ট করে আমাদের জন্ম দিলে আর আমরা
প্রযুক্তির সহায়তায় তোমাদের চেয়ে কম কষ্টে,
কত যত্নে সন্তান জন্ম দিচ্ছি।
তবুও সন্তান জন্ম এতো কষ্টের....!!!

"মাগো, তুমি আমার গর্ভে আমার মেয়ে হয়েই জন্ম নিও।
আমাকে এতো কষ্ট করে জন্ম দেওয়ার কষ্টগুলো যেন সুখে বদলে দিতে পারি.........!!!!!

মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০৭

রাজীব নুর বলেছেন: অসাধারন একটি লেখা। ভালোবাসা আর মায়া মমতায় ভরপুর।
শৈশব বড় আনন্দময়।

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৫৭

সালমা রুহী বলেছেন: ধন্যবাদ

২| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৫৬

তারেক ফাহিম বলেছেন: মায়ের প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য উধাহরণ দিয়ে গেলেন +

শৈশবে যা করেছে তা এখন মনে পড়লে নিজে নিজেই হাসি। :D

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৫৭

সালমা রুহী বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:২৮

চাঁদগাজী বলেছেন:


তখনকার মায়েদের কষ্টের কথায় চোখে পানি এলো; সভ্যতা মা'দের পক্ষে কাজ করছে।

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৫:২৮

সালমা রুহী বলেছেন: সহমত

৪| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫৭

কাওসার চৌধুরী বলেছেন: সকল মা সুখে থাকুন। সব মায়ের সন্তানরা ভাল থাকুক।

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৫:২৯

সালমা রুহী বলেছেন: আমিন ।

৫| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৪০

সনেট কবি বলেছেন: অসাধারন একটি লেখা।

২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৫৮

সালমা রুহী বলেছেন: ধন্যবাদ

৬| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৫৯

Ashfi Tuhin বলেছেন: অসাধারণ।।

মুখ বন্ধ

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৫:২৭

সালমা রুহী বলেছেন: ধন্যবাদ ।

৭| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:০৯

আহমেদ জী এস বলেছেন: সালমা রুহী ,




একটা সময়ের কথা কী স্পষ্ট করে বলে গেলেন । বলে গেলেন , সেদিনের মা'য়েদের তুমুল প্রসব বেদনার পরেও মুখে হাসির ঝিলিকের কথা । বলে গেলেন নিজের অনুভবের কথাও ।

জীবনের সুন্দর একটা ছবি এঁকে ফেলেছেন ।

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৫:২৫

সালমা রুহী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ । উওরে দেরি হওয়াতে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ।

৮| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৯:৩৯

কাতিআশা বলেছেন: খুব ভালো লাগলো লেখাটা!,,,জগতের সব মায়েরা ভলো থাকুন!

৯| ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:০৪

শামচুল হক বলেছেন: অসাধারান লেখা। ধন্যবাদ

৩০ শে এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৫:২৬

সালমা রুহী বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ ।

১০| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ৮:৫১

নতুন নকিব বলেছেন:



খুব সুন্দর একটি লেখা। পড়েছিলাম অাগেই। মন্তব্যে আসা হয়নি।

শুভকামনা আপনার জন্য।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.