![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। প্রকৃত ইতিহাস সন্ধানী।
রাজপথে গাড়ি-ঘোড়া আর পথচারীর বদলে শক্তি পরীক্ষা ও রাজনৈতিক সমাবেশের আধিক্য আমাদের রাজপথ কেন্দ্রিক রাজনীতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। কোন প্রতিবাদ করতে হবে, কোন চিন্তা নাই রাজপথ আছে তো! রাজনৈতিক প্রতিবাদের কিছু বিশেষ রূপ যেমন- মানব বন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, অনশন ধর্মঘট, সবই এখন রাজপথ কেন্দ্রিক। এ ধরনের রাজপথ কেন্দ্রিক কর্মসূচীর জ্বালায় বেচারা পথিক ভুলতেই বসেছে যে আজকাল রাস্তা দিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটে হেটে বেড়ানো যায়। অবশ্য রাজনীতিকদের দোষ দিয়েই বা কি লাভ হবে, তারা যে কজটি করছেন তাতে জনগনের তার পিছনে সাধারন জনগনের ব্যাপক সমর্থন আছে বৈকি। ঐতিহ্যবাহী মোরগ লড়াইয়ের কথা সবারই জানা আছে, দূটি মোরগ ঠোকাঠুকি করে আর মোরগের মালিকসহ অন্যান্য দর্শকরা তালিয়া বাজায়। রাজনীতির অবস্থা কি এর চেয়ে ব্যাতিক্রম? এখানে শুধু ব্যাতিক্রম হল মোরগ নিজেদের মাঝে ঠোকাঠুকি করে তখন সে ৩য় কারো ঠ্যাং কামড়ে দেয়না। কিন্তু রাজনীতির মোরগ লড়াইয়ে ঐ ৩য় জন রেহাই পায়না।
কোন রোগ যেমন তার গোড়ার কারন উদঘাটন ছাড়া প্রতিকার সম্ভব হয়না, ঠিক তেমনই হয়েছে এক্ষাত্রেও। চোখ ফেরানো যাক বঙ্গভঙ্গ থেকে চলে আসা ঘটনাপ্রবাহের দিকে।
পূর্ববঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত কৃষিনির্ভর সমাজকে ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়নের আওতায় আনতে ও বৃটিশ প্রশাসনে হিন্দু মহাজনদের ব্যাপক প্রভাব কমাতে বাংলা অঞ্চলকে ভাগ করে আসাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলকে নিয়ে পূর্ব বাংলা গঠন করা হল এবং ঢাকাকে প্রাদেশিক রাজধানী করা হল। ভারতে মোসলমান শাসকদের পতনের শুরুর অঞ্চল বিজেতাদের অধীনে কোন ব্যাপক বিত্তিক উন্নয়নের ভাগীদার কখনোই হতে পারেনি। ফলে এ সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশী আনন্দিত হয়েছিল এই ঢাকার বা অধুনা বাংলাদেশের জনসাধারন। কায়েমী স্বার্থবাদী কলকাতার বেনিয়ারা তাদের একচেটিয়া আধিপত্যে আঘাত লাগার আশঙ্কায় হল নাখোশ। ভারতে বৃটিশ শাসনের সবচেয়ে বেশী সুবিধা ভোগ করেছিল হিন্দু মহাজন সমাজ। এমনিতেই দু-চারজন পূর্ববঙ্গীয় বাঙ্গালীর ট্যালেন্ট দেখে আতঙ্কিত মহাজনেরা বৃটিশদের এই সিদ্ধান্তে যার পরনাই নাখোশ হলেন, করলেন বিদ্রোহ। দুশ বছরের একান্ত অনুগত প্রজা কি আর প্রভুর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিতে পারে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সে সময়কার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিত্ব। ভুলে গেলে চলবেনা, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই হিন্দু বেনিয়া মহাজনদেরই একজন, রচনা করলেন “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...”। বড়ই পরিতাপের বিষয় সেই সঙ্গীত আজ বাংলাদেশেরই জাতীয় সঙ্গীত! গঠন করলেন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মঞ্চ, প্রচলন করেছিলেন রাখী বন্ধন উৎসবের, যা ভারতে আজও প্রচলিত। রাখী বন্ধন উৎসব হল, ভাইয়ের প্রতি ভালবাসার চিহ্ন! তাদের পূর্ববঙ্গের মানুষদের প্রতি এমনই টান ছিল যে দুইশ বছরের নির্যাতনের অন্ধকারের মাঝে যেইনা পুব আকাশ থেকে একটু আলোকচ্ছটা দেখা দিল অমনি সেই আলোটুকুও তারা নিভিয়ে দিলেন!
পূর্বা বাংলার মানুষদের বঞ্চনার সেই শুরু। তীব্র অসন্তোষ, অল্প স্বল্প প্রতিবাদ, আর লেখালেখির মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল সব প্রতিবাদ। তখন তো আর এ অঞ্চলে তেমন আলোকিত নাগরিক সমাজ ছিলনা যে তারা এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে মানুষদের সচেতন করবেন। কোন বিদ্রোহও হয়নি, কোন আন্দোলনও নয়। কিন্তু ক্ষত রয়ে গিয়েছিল, যে ক্ষতে ছিল বিশ্বাসঘাতকতার চিহ্ন, যার প্রভাব দেখা দিয়েছিল সাতচল্লিশের দেশবিভাগে। বস্তুত এ অঞ্চলের মানুষ তার প্রতিবেশী হিন্দু মহাজন সমাজকে এতোই অবিশ্বাস করত যে হাজার মেইল দুরের একটা অঞ্চলের সাথে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নিল কিন্তু প্রতিবেশী অঞ্চলের সাথে জোট বাধার কোন চেষ্টাই করলনা। সেখানেও এই পূর্ব বঙ্গের মানুষদের ছিল আন্দোলনই ভরসা। পাকিস্তান হল কিন্তু স্বপ্ন পূরন হলনা। ন্যায্য অধিকার তো পেলইনা, বরং বিদেশ থেকে আস ত্রান সামগ্রীও ৬০ শতাংশের বেশী হাইজ্যাক করে পশ্চিম বঙ্গে পাচার করার মত কাজ করল। মাতৃভাষা নিয়ে গাধার জলঘোলা, উন্নয়নে বৈষম্য, দেশ পরিচালনায় বৈষম্য, প্রশাসনে বৈষম্য,সামরিক বাহিনীতে, পুলিসেসহ দেশরক্ষায় বৈষম্য, নিজেদের মুসলমানিত্ব নিয়ে প্রশ্ন, ২য় শ্রেনীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিতকরন আরেকবার অতিষ্ঠ করল এ অঞ্চলের মানুষদের। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের কবল থেকে গনতন্ত্রে উত্তরনের যাত্রা শুরুর প্রাক্কালে আঞ্চলিক নেতা শেখ মুজিব জনগনের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে পাকিস্তান শাসনের বৈধতা পেলেও পাঞ্জাবী ও সিন্ধী মহাজনেরা আরেকবার গলা টিপে দিতে চাইল বাঙ্গালীদের। কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আসল বাংলাদেশ। কিন্তু আবারো হতাশ হল জাতি। পর্বত প্রমান জনপ্রিয় শেখ মুজিবের মাত্র দুবছরেই সবচেয়ে অজনপ্রিয় নেতায় রুপান্তর, যে গনতন্ত্রের জন্যে বাংলাদেশের জন্ম, সেই গনতন্ত্রের নির্মম হত্যা, ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ড, ৭ নভেম্বরের পটপরিবর্তন, কর্নেল তাহেরের হত্যা, জিয়ার আকাশচুম্বী জনপ্রয় শাসন পরিচালনা, জিয়ার হত্যা, এরশাদের স্বৈরশাসন, ঘটনাবহুল ৯০ এর দশক, স্বৈরতন্ত্রের পতন, সবমিলিয়ে বলা যায় স্বাধীনতার ২১ বছর পরেও স্থিতীশীল হতে পারেনি বাংলাদেশ। অবশেষে আবার এল সেই কাঙ্খিত গনতন্ত্র। কিন্তু আবার সেই পুরনো কৌশল, ভোট জালিয়াতি, অবৈধ ভাবে ক্ষমতায় থাকার কৌশল, মার খেল এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীর সামনে। সারাদেশে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, চোরাচালান, জঙ্গিবাদ, ক্রসফায়ার এ নিয়েই উত্তপ্ত ছিল ৯৫ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত পত্রিকার শিরোনাম।
২০০৬ এ কতিপয় সাবেক আমলা, সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় শুরু হল শুদ্ধি অভিযান। তারপরে আসল গনতন্ত্র। কিন্তু হল না পরিবর্তন, মানুষ রয়ে গেল সেই তিমিরেই। মোট কথা এ অঞ্চলের মানুষ কখনোই নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারেনি। সবসময়ই তাকে সিধেল চোরের ভয়ে রাতজেগে বাড়ি পাহারা দিতে হয়েছে। কখনো স্থিতিশীল হয়নি রাজনীতির মাঠ, কখনো সন্ত্রাস, কখনো জঙ্গিবাদ, কখনো রাজনৈতিক সহিংসতা কেড়ে নিয়েছে দেশের মানুষের ঘুম। ফলে রাতের ঘুমটা যেমন হয়নি, তেমনই দিনের আলো ভাল করে কাজে লাগিয়ে হয়ে ওঠেনি তেমন কোন সুকুমার বৃত্তির চর্চাও। মনস্তাত্ত্বিক ধারনা মতে রাতের ঘুম হল দিনের কাজের রসায়ন। রাতের ঘুম না হলে মস্তিষ্ক তেমন কোন ফলাফল দিতে পারেনা, ঠিক তাই হয়েছে এদেশের মানুষের সাথে। মোটকথা শাসকগন কখনোই জনগনের চাহিদা বুঝতে সক্ষম হয়নি বা জনগন তার শাসককে কখনই বুঝতে সক্ষম হয়নি। কেউ রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আশায় কিন্তু ফল হয়েছিল পুরাই উল্টো, অভ্যুত্থান পাল্টা-অভ্যুত্থান হয়েছিল এদেশের মানুষের চোখেরই সামনে। কেউই দেয়নি মানুষের চাহিদার দাম। তাই আজ যেই একটু আশ্রয় দেয় তার হয়েই রাজপথ কাঁপায় এ অঞ্চলের সাধারন মানুষ। প্রয়োজনে মারে আবার নিজেও মরে। কিন্তু সেই ক্ষত শুকায়না। আজ আর কেউ ক্ষমতায় থাকেনা জনসমর্থনের ভিত্তিতে এখন ক্ষমতায় আরোহন করে মানুষ শক্তিমত্তার পরীক্ষায় পাস করে। কার কত লাশ ফালানোর অভিজ্ঞতা, কার কত লাশ ফালানোর সামর্থ, তাই নির্ধারন করে কাল কে মসনদে থাকবে আর কে নামবে। হতাশার অতল গহ্বরে গিয়ে কেউ এখন আর জনসমর্থন খোজেনা, সবাই এখন শক্তির পূজারী। তাই আজ রাজপথ আর পথচারীর জন্যে নয় আজ রাজপথ রক্তরাঙ্গা কৃপাণের।
©somewhere in net ltd.