![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সৃজনশীল লেখালেখি, গবেষণা ও সম্পাদনা
এক
শ্রাবণ মাস। গতকাল রাত থেকে শুরু হয়ে আজ সারাদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে। একটু আগে থেমেছে বটে, তবে এখনো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বৃষ্টির ঘ্রাণ। সন্ধ্যা নেমেছে ধীরে ধীরে। আকাশ এখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে যায়নি, কিন্তু ভারি মেঘে ঢেকে আছে দিগন্ত। জানালার ফাঁক দিয়ে চোখ চলে যায় ছুটে চলা মেঘের পেছনে। মেঘেরা যেন ক্লান্ত অথচ নিরলস। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার পুরো গ্রামটাকে গিলে ফেলবে।
ঘরের কোণে বসে সুলতান প্যাদা চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে। সারাদিন বৃষ্টির কারণে বাইরে বের হওয়া হয়নি। আজও কোনো কাজ জোটেনি। এমন না যে কাজের অভাব, কিন্তু বৃষ্টির এই মৌসুমে মাঠে যাওয়া মানেই কাদা-মাখা নরক। তার ওপর বর্ষাকালে গ্রাম থেকে বাজারমুখী পথটা হাঁটুসমান পানিতে তলিয়ে যায়। চাইলে দোকান থেকে কেরোসিন আনা যেত, কিন্তু তা বলার মতো সহজ নয়। যাওয়া-আসা মিলিয়ে অন্তত পঁচিশ মিনিটের রাস্তা। যদিও সেটা খুব একটা বেশি সময় নয়, সমস্যা হচ্ছে পায়ের নিচে জমে থাকা কাদা আর জলমগ্ন পথ।
ঘরে কুপি জ্বালানোর মতো কেরোসিন নেই। সুলতানের হাতে আছে মাত্র সাতানব্বই টাকা। এই টাকায় আগামী সপ্তাহের চাল-ডাল কেনা না হলে পুরো পরিবার না খেয়ে থাকবে। সাতানব্বই টাকায় গোনা গোনা করে হিসেব করে, পাঁচ কেজি চাল, দুই কেজি আলু আর সামান্য মশুর ডাল হয়ে যাবে। এর এক টাকাও অন্য কোনো খাতে খরচ করার সাহস সে পায় না।
বৃষ্টির জলে ভিজে, রোদে পুড়ে, জমির কাজ করে যে মানুষটা সারা বছর কাটায়, তার জীবনের হিসেবটাও এমনই মাটি মাখা। শারীরিক কষ্টে অভ্যস্ত হলেও অর্থকষ্ট তাকে বারবার ভেতর থেকে ক্ষয়ে ফেলে। গত তিন দিন টানা বৃষ্টিতে একটাও দিনমজুরির কাজ জোটেনি।
সে ঠিক করে আজ আর কোথাও যাবে না। একদিন কুপি না জ্বালালে খুব বেশি ক্ষতি হবে না। দ্রুত কিছু খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়বে।
এমন সময় পেছন থেকে ফাতেমা ডাক দেয়, কণ্ঠে একটা উদ্বেগের সুর—
এই শুনছো, একটু আইসো তো।
ফাতেমার কোলে দেড় বছরের মেয়ে পপি, আর হাতে ধরে চার বছরের ছেলে সবুজকে।
সবুজ কাঁদছে। সুলতান জানালার ফাঁক থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে, কি হইছে? কান্দে কেন?
ফাতেমা সন্তানের কপালে হাত রেখে বলে, জ্বর আইছে মনে হইতেছে।
সুলতান ধীর পায়ে চৌকি থেকে নেমে আসে। সবুজের কপালে হাত রাখে। শরীর গরম কি না বোঝার চেষ্টা করে। ঠোঁট কামড়ে একটু ডাক্তারসুলভ গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে, হঁ, গরম লাগতেছে।
কিন্তু একটু পরেই চুপ করে যায়। বেশি কিছু বললে ফাতেমা ভয় পেয়ে যাবে সেই চিন্তায় সান্ত্বনার সুরে বলে, আরে, কিচ্ছু হইবো না। কাল সকালে দেখবা ঠিক অইয়া গেছে।
সুলতান যতই শক্ত হতে চায়, ছেলের প্রতি দুর্বলতা চেপে রাখতে পারে না। নিজে একেবারে বিছানায় না পড়লে ডাক্তারের কাছে যায় না, কিন্তু সবুজকে নিয়ে সে সেই ঝুঁকি নেয় না। ফাতেমা দুশ্চিন্তায় চোখে পানি চলে আসে। মুখ নিচু করে বলে, আপনের মনে নাই, গত মাসেও এরম জ্বর আইছিল! পাঁচদিন ভুগলো, শেষে স্যাকমো ভাইয়ের ট্যাবলেট খাইয়া ঠিক হইল।
সুলতান কিছু বলে না। চুপচাপ সবুজকে কোলে তুলে নেয়। জানালার পাশে চৌকিতে বসে মাথায় হাত বুলায়। ফাতেমা জানে, তার স্বামী এখন কী ভাবছে- কীভাবে কাল সকালে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবে, টাকাপয়সা জোটাবে।
এই গ্রামের নাম ব্রাহ্মণ পাড়া। নাম শুনে যতটা ঐতিহ্যপূর্ণ মনে হয়, বাস্তবে তার ছিটেফোঁটাও নেই। পুরো গ্রামে এখন একজন ব্রাহ্মণ তো দূরের কথা, কোনো হিন্দু পরিবারই নেই। অথচ একসময় এই গ্রামেই থাকতেন ধীরেনন্দ্র নাথ মণ্ডলের পরিবারসহ কয়েকটি সনাতন ধর্মালম্বী পরিবার। সময় বদলেছে, মানুষ সরে গেছে। একেকজন করে চলে গেছে শহরের দিকে, কেউবা চলে গেছে দেশ ছেড়ে। সবশেষ ছিল— ধীরেনন্দ্র নাথ, সেও চলে গেলো। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ পাড়া নামের যর্থার্থতা মুছে গেলো। তার মৃত্যুর পর আর কোনো হিন্দু পরিবার ফিরেও তাকায়নি এই গ্রামে। তবু নামটা রয়ে গেছে, ব্রাহ্মণ পাড়া। নামটা যেন একটা স্মৃতির মতো, যার শরীরে এখন ধুলোমাখা বাস্তবতা।
ফাতেমা আবার বলে, কাল সকালে ওরে হাসপাতালে নিয়া যাইতে হইবে। স্যাকমো ভাইরে চিনোই তো—ভালো মানুষ। ওষুধ দিয়া দিবে।
সুলতান মাথা নাড়ে। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার সপ্তাহে একদিন আসে। বাকি সময় ক্লিনিকে বসে থাকে একজন আয়া আর একজন স্যাকমো। লোকজন স্যাকমোকেই ডাক্তার বলে ডাকে। মেনেও নেয় তার সাজেশন। আর দীর্ঘদিন ডাক্তারের সাথে থাকতে থাকেতে ছোটখাট অসুখের ব্যাপারে সাজেশন দেওয়ার সাহসও তার হয়ে গেছে। যে কোনো অসুখে প্রয়োজন অনুযায়ী সে সরকারি বরাদ্দের ওষুধ দিয়ে দেয়। সন্তানদের ছোটখাটো অসুখে তার কাছেই যায় গ্রামের বেশিরভাগ পরিবার।
আয়াকে নিয়েও মহিলারা আড়ালে হাসাহাসি করে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরামর্শ দেয় সে, অথচ তার নিজেরই পাঁচ সন্তান। এইসব সামাজিক বৈপরীত্য গ্রামজীবনের অংশ হয়ে গেছে।
সুলতান কপালে হাত দিয়ে ভাবতে থাকে, পরদিন সবুজকে নিয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু তারপর? সাতানব্বই টাকা নিয়ে কতদূর চলা যায়?
ঘরের কোণ থেকে পপির কাঁপা কাঁপা শব্দ আসে। ক্ষুধায় চিৎকার করে উঠেছে। ফাতেমা তাকে বুকে তুলে নেয়। ছোট্ট পপির মুখ ঘসে শাড়ির আঁচলে। দুধ চায়, অথচ ফাতেমার শরীরেও সেই আগের মতো দুধ ওঠে না। অভাব আর চিন্তায় শরীরটাও শুকিয়ে গেছে।
এই যে তার প্রতিদিনের ছোট ছোট যন্ত্রণাগুলো তা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। এরা ঢেউয়ের মতো আসে। কখনো পায়ের তলায়, কখনো চোখের কোণে। সুলতান জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টিভেজা গাছপালায় অন্ধকার নেমে এসেছে। চোখের সামনে যেন একটা ভবিষ্যৎহীন ছবি আঁকা। কুয়াশায় ঢাকা পথ, যার শেষ নেই। তবুও সুলতান উঠে দাঁড়ায়। ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি চিন্তা কইরো না। কাল সকালে যামু। সব ঠিক অইয়া যাইবে।
তার কণ্ঠে দৃঢ়তা নেই, তবু সেই কণ্ঠেই ভরসা খোঁজে ফাতেমা। জীবনে এমন অনেক সময় আসে, যখন শব্দের থেকেও নীরবতাই বড় আশ্বাস হয়ে দাঁড়ায়।
চলবে...
©somewhere in net ltd.