নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সপ্ন

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী

কিছুই না

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইরিন

২৬ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:১৯

জীবনের যেকোনো 'প্রথমে'রই বোধহয় আলাদা একটা মূল্য আছে। সমস্যা হচ্ছে, খুব কম প্রথমই মনে থাকে। তবে জ্ঞান হওয়ার পরে যেসব 'প্রথমে'র সৃষ্টি, সেগুলো বোধহয় মনে থাকে। প্রথম পড়া দস্যু বনহুর কিংবা মাসুদ রানা। প্রথম স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া কিংবা প্রথম সিগারেট। 'প্রথম' নিয়ে যদিও আমার খানিকটা আদিখ্যেতা আছে তবে প্রথম প্রেমের ক্ষেত্রে বোধহয় ব্যাপারটা কেবল আদিখ্যেতা না। বলা যেতে পারে, অনন্যোপায়। আউট অফ মাই কন্ট্রোল। বলাই বাহুল্য, প্রেমটা সফল হয়নি, তবে ভুলতেও পারিনি। কেন? সেটা আজও রহস্য।

যাইহোক, আমার ছোটবেলা কেটেছিল রাজশাহীতে। সেখানে বাবার তরফের আত্মীয় বলতে ছিলেন আমার এক চাচা আর দুই ফুপু। ঘটনাটা যে সময়ের, সেই সময়, আমার বড় ফুপুর বড় মেয়ে অর্থাৎ আমার ফুপাতো বোনের কেবল বিয়ে হয়েছে। ফুপু যে পাড়ায় থাকতেন, সেখানে আশে পাশের বাড়িগুলো ছিল ফুপার আত্মীয়দের। কিছু সরাসরি, কিছু লতায়পাতায়। যাইহোক, সেই সময়টায় চলছিল বোন আর দুলাভাইকে নিয়ে বিভিন্ন দূরত্বের আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি যাত্রা। বিয়ের আমেজ তখনও চলছিল, আর সেই সুবাদে সেদিন আমিও ফুপুর বাসায় গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পরে শুরু হল নতুন জামাই নিয়ে প্রতিবেশী আত্মীয়দের বাড়ি ভ্রমণ। অন্যদিনগুলোর ভ্রমণে আমি না থাকলেও, সেদিনের ভ্রমণে সঙ্গে ছিলাম আমি। সেই ভ্রমণের এক পর্বে, যাওয়া হল নির্দিষ্ট একটি বাসায়। লতায় পাতায় আত্মীয়। ড্রইং রুমে সবাই বসলাম।
বাসায় পিচ্চি এবং ছটফটে কিসিমের কোন সদস্য থাকলে যা হয়। মেহমানদের সামনে তিড়িং বিরিং করে ঘুরে বেড়ায়। সেই বাসায় তেমনই এক সদস্য ছিল। ফ্রক পড়া, পুতুলের মত দেখতে রোগা পাতলা সুন্দরী মেয়েটি আমাদের সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করছিল। আর আমি অবাক বিস্ময়ে আমি মেয়েটিকে দেখছিলাম। একবার চোখাচোখিও হল। মনে হল, হার্ট একটা বিট মিস করল। এবং… টুপ করে প্রেমে পড়ে গেলাম। স্মৃতি হাতড়ে যতোটা মনে পড়ে, ওটাই ছিল জীবনের প্রথম প্রেম!

'প্রথম প্রেম’ কথাটা বলা যত সোজা, আসলে কি ততোটা সহজ? স্মৃতি হাতড়ে দেখুন না, কত পুরনো ঘটনা মনে পড়ে। নয় দশ বছরের আগের কোন ঘটনা মনে করতে পারবেন? তখন প্রেমে পড়ে থাকলে? কাজটা কঠিন জেনেও ‘প্রথম প্রেম’ আবিষ্কার করতে আজকে স্মৃতি হাতড়াতে বসলাম। গ্যারান্টি দিচ্ছি না, এর আগেও প্রেমে পড়ে থাকতে পারি। তবে তেমনটা হলেও, মনে নেই। যাইহোক, যে ঘটনাটা বললাম, সেটা আমার বালক জীবনের ঘটনা। তখন বেশ ছোট। ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ি। প্রেম ব্যাপারটা হয়তো তখনও বুঝিনি, হয়তো ভালো লাগা, কিংবা হয়তো, ‘একে আমি বিয়ে করব’ টাইপ কিছু ছিল। না, এরপরে আর তেমন কিছু হয়নি। আমার জীবনের বেশিরভাগ প্রেমের মত, সেই প্রেমও ওখানেই শুরু এবং…।
এরপরে? এরপরে স্কুল জীবন এগিয়ে যেতে লাগল। বয়েজ স্কুল, সো, নারী সঙ্গের কোন সম্ভাবনা নেই। পাড়ায় ছিল। বেশ কিছু সুন্দরী মেয়েই ছিল, তবে প্রতিযোগিতাও ছিল। এবং যথারীতি সম্ভাবনাও ছিল ক্ষীণ। দুএকজন, আমের আঁটি দিয়ে দেয়ালে ‘আই লাভ ইউ’ লিখে জানান দিয়েছিল। শত্রুরা আবার যোগ চিহ্ন দিয়ে দুজনের নাম লিখে তাঁদের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করত। আমার দৌড় ছিল, মনে মনে রূপকথার রাজ্যে বিচরণ, সেটাই চালিয়ে গেলাম।
আসলে, জীবনে নারী বলতে যতটুকু ছিল, তা ছিল ঐ রোড সাইড রোমিও হিসেবে। পাড়ার সুন্দরী মেয়েদের আড়চোখে দেখা আর নয়তো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রিক্সা করে যাওয়া মেয়েদের দেখা। যেটাকে এখন 'ইভ টিজিং’ ডাকা হয়, অনেকটা সেই ধাঁচের। টিপ্পনী কাটা, ‘ঐ সুন্দরী কৈ যাও’ টাইপ। এরপরে যথারীতি স্কুলে গিয়ে ভদ্র বালকের মত অধ্যয়ন। ওরকম ‘ইভ টিজিং’য়ের পরে সাধারনতঃ সিনেমায় প্রেম হয়, বাস্তবে না। আমারও হয়নি। এবং এভাবেই একদিন স্কুলের গণ্ডি পেরোলাম।
শুরু হল কলেজ জীবন। এস এস সি’র রেজাল্টের বদৌলতে সুযোগ পেলাম রাজশাহী কলেজে। জীবনে প্রথম কো এডুকেশান। অপূর্ব সুন্দরী বেশ কিছু মেয়ে এবার সহপাঠী। দুমদাম প্রেমে পড়া শুরু করলাম। অনেকগুলো প্রেমে পড়ার একটা কারণ হতে পারে, চান্স না নেয়া। একই সঙ্গে অনেকের সঙ্গেই চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। চেষ্টা আবার কি? ঢেঁকি আর কোন কাজ শিখেছে? দৌড় তো ঐ রাস্তার পাশে রোমিও সেজে থাকা। বলাই বাহুল্য, এবারও কেউ ফিরে তাকালো না। সহপাঠীদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের প্রেম হলেও, আমার ব্যর্থতা অব্যাহত থাকল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এমনটা হলেও, একটা ক্ষেত্রে কলেজে উঠে মৃদু সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।
সেই গল্পটাই বরং বলি। স্কুল জীবনের সময়ে যেসব মেয়ের জন্য রাস্তায় রোমিও সেজে দাঁড়াতাম তাঁদের বেশ কয়েকজন ভর্তি হয়েছিল রাজশাহী কলেজে। যথারীতি অপূর্ব সুন্দরী এবং প্রেমে পড়ার মত। এদের নাম যেহেতু জরুরী না, তাই আপাততঃ এদের নাম দিচ্ছি ‘এ’ ‘বি’ ‘সি' ‘ডি’ ইত্যাদি। এদের সবার জন্যই রোমিও সাজা অব্যাহত ছিল। পথে ঘাটে যেখানেই দেখা হত, আড় চোখে দেখা, বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলা, আর একে তাকে দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব পাঠানো। প্রায় সবাই প্রত্যাখ্যান সেরে ফেলেছিল। তবে এক জায়গায়, একটা আশার প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছিল। তাঁর নাম ছিল ইরিন। অন্য মেয়েদের সাথে এই মেয়েটির একটি পার্থক্য হচ্ছে, এই মেয়েকে রাস্তায় টোন করা, অতোটা সহজসাধ্য ছিল না। ওর বাবা রাজশাহীর বেশ স্বনামধন্য এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তি হওয়ায়, রোড সাইড রোমিওরা একটু সমঝে চলত। অন্ততঃ আমাদের মত ভীতু গ্রুপটা। সো, মনে প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকলেও, আমাদের দৌড় ছিল, কেবল আড় চোখে তাকিয়ে দেখা পর্যন্ত। তাহলে আশাটা কোথায়? বলছি।
স্কুলের আমাদের বন্ধু গ্রুপটা কেন যেন, বেশ নারী বিদ্বেষী ছিল। হতে পারে, নিজের ক্যারেক্টার নিয়ে খুব একটা ভরসা ছিল না (সেটা হয়ে থাকলে, ঠিকই আছে)। হতে পারে এমনিতেই। আবার হতে পারে রাজশাহীর অন্য যে সরকারী স্কুল, সেই স্কুলের গ্রুপের উল্টোটা আমাদের হতে হবে, এই জেদ থেকে। সরকারী গার্লস স্কুলও ছিল। ইংরেজি প্রাইভেট পড়তে গিয়ে, ওরা স্কুল জীবন থেকেই সেই গার্লস স্কুলের মেয়েদের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে। যুক্ত হয় ওদেরকে ঈর্ষা করবার আর নারী বিদ্বেষী হওয়ার নতুন কারণ। তাই আমাদের কাজ ছিল, এই মেয়েদের সাথে কোনভাবেই বন্ধুত্ব করা যাবে না। কেবল উত্যক্ত করা যাবে। যাই হোক, বাকিদের কথা জানি না, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই আমি প্রেমে পড়ে যেতাম। এবং হার্টে ফ্র্যাকচার বাধাতাম। বুঝতেই পারছেন, হার্টের অবস্থা তখন আমার বেশ ভাঙ্গাচোরা। তারপরও ইরিনের প্রেমে পড়ে নতুন আরেকটা ফ্র্যাকচারের রিস্ক নিয়েছিলাম। কারণটা বুঝতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে।
আসলে ইরিনের নাম প্রথম শুনি স্কুলে। ঐ একই পাড়ায় বাসা হওয়ায় আমাদের এক বন্ধুকে রাগানো হত, ইরিনের প্রেমিক বলে। সে ও আপ্রাণ বোঝাতে চেষ্টা করত, ‘আই অ্যাম নট ইন দ্যা কিউ।’ কে শোনে কার কথা। নিজেকে ডিফেন্ড করতে সে তখন গোপন একটা খবর জানালো, ‘সজল নামের এক ছেলের সাথে ওর প্রেম আছে।’ একই পাড়ায় থাকবার বদৌলতে, সে এই তথ্য জানে, এবং তথ্যটা অথেনটিক। কেউ বিশ্বাস করল, কেউ করল না। আসলে ইরিন প্রেম করলেই কি, আর না করলেই কি? সেটা মূল ইস্যু ছিল না। স্কুলে যেমনটা হয়, কেউ কোন কথা শুনে রাগছে, এমনটা হলে সবাই মিলে তাকে রাগায়। ব্যাপারটা ঐ অবস্থা পর্যন্তই ছিল।
প্রেম না হলেও, রাজশাহী কলেজে ওঠার পরে, ইরিনকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে দেখবার সুযোগ পেলাম। অপূর্ব সুন্দরী। বেশ পাতলা শাতলা ছিল। ভদ্রভাবে বললে বলা উচিৎ স্লিম ফিগারের। তবে ও বোধহয় তার চেয়েও স্লিম ছিল। কলেজে সম্ভবতঃ নামকরণ হয়েছিল ‘হাড্ডি খটাশ’। এনিওয়ে, মুখশ্রী আসল, আর সেখানে থেকে চোখ ফেরানো কষ্টকর ছিল বলে, যথারীতি বেশ অনেকেই প্রেমে পড়ল। আমার নামটা আলাদা করে বললাম না। যদিও এধরনের মেয়েদের প্রেমে পড়ার ঘটনা খুব বেশি ঘটে না। এধরনের বলতে বোঝাচ্ছি, যে মেয়ের সাথে ইতিমধ্যেই কারো প্রেম আছে (আমরা ততদিনে সিওর হয়ে গেছি)। তারপরও ঘটল।
কারণটা হতে পারে ওর সৌন্দর্য, হতে পারে ওর প্রেমিক। সজল দেখতে রাজপুত্রের মত হলেও, পড়াশোনায় তেমন কিছু ছিল না। তার ওপর শুরু করে নেশা। সো, আমাদের মত ‘নিশ্চিত পরাজিত’ প্রেমিক গ্রুপ নতুন আশায় বুক বাঁধতে শুরু করে। সজলের সাথে প্রেমে ফাটলের সম্ভাবনা দেখা দেয়ায়, এই র‍্যাট রেসে আমিও নাম লেখাই। ভালো কোন ক্যান্ডিডেট না থাকলে, হয়তো আমার সম্ভাবনা থাকতো, তবে এতো ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মাইনি। দেখা গেল এই র‍্যাট রেসে অচিরেই আমি পিছিয়ে পড়লাম। সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যায় আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী স্কুলের একজন। ওর নাম দিলাম ‘এক্স'। ওরা প্রায়ই একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতো। যদিও প্রেম করছে, এমনটা দুজনের কেউই স্বীকার করত না। বলত, ‘আরে না, জাস্ট ফ্রেন্ড’। সো, কলেজ লাইফে, অবস্থাটা ছিল অনেকটা এরকম, সজলের সাথে প্রেম ভেঙ্গে ফেলার ব্যাপারে ইরিন দ্বিধায় আছে। তবে তেমনটা হলে, ‘এক্স’ সুযোগ পাবে। ‘এক্স’ও যেহেতু বেশ হ্যান্ডসাম, সুদর্শন, তাই মোটামুটি সবাই সন্দেহ করতে থাকে, ইরিন অচিরেই মত পালটাবে, সজলের সাথে প্রেম ভাঙল বলে। যত দিন গড়িয়ে যেতে লাগল, রটনা বেশ জোরালো আকার নিতে থাকল, 'সজল আউট হতে যাচ্ছে আর সেখানে সেই ‘এক্স' ইন হবে'।
‘এক্স' মহাশয় একসময় বেশ কনফিডেন্ট ফিল করতে শুরু করেন। একে তাকে বলে বেড়াতেও শুরু করেন। বন্ধুদের জন্য নির্দেশনা জারী হয়, ইরিনকে ভাবী ডাকার। আসলে, কোন কনফার্মেশান ইরিনের তরফ থেকে পেয়েছিল কি না জানি না, তবে সেই ছেলেটি মোটামুটি সিওর ছিল, ‘হি হ্যাস হিট দ্যা জ্যাকপট।’ আমরা ব্যর্থ প্রেমিকরা হিংসায় জ্বলতে লাগলাম। একে তো ইরিনকে পেলাম না, সঙ্গে যুক্ত হল শত্রু স্কুলের ছেলের সঙ্গে প্রেম। ভরসা একটাই, ইরিন এখনও প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়নি, কিংবা ওর বান্ধবীরাও কেউ জানায়নি, যে সজলের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে কিংবা এখন ‘দে আর কাপল’। সো, পরাজয় জেনেও, হাল ছাড়িনি।
কলেজ লাইফে ফয়সালা হল না। এই দোলাচালের ভেতর দিয়েই কলেজ জীবন শেষ হল। এরপরে ভাগ্যক্রমে সুযোগ মেয়ে গেলাম রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। ইরিনিও পেল। শুরু হল মেডিকেল জীবন। তবে, ইরিনের বাকী সব প্রেমিকের মনে বিশাল আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিয়ে, সেই ‘আশাবাদী প্রেমিক’ বা ‘এক্স' মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা চান্স পেতে ব্যর্থ হল। আমি আশায় যে বুক বাঁধব, সে গুড়েও বালি। ‘এক্স' হয়তো প্রতিযোগিতা থেকে আউট, কিন্তু আরও অনেক প্রতিযোগী ‘পি' ‘কিউ' ‘আর' ‘এস’ এসে হাজির। সো, অচিরেই বুঝে গেলাম এবারও আমার কপালে শিকে ছিড়বার তেমন কোন সম্ভাবনা নাই। ‘এক্স’ বিদায় হলেও আমার অবস্থা তথৈবচ, রেসে পেছন দিক থেকে প্রথম। মেডিকেল কলেজে আমার চেয়ে অনেক যোগ্য, আর অনেক কাঙ্ক্ষিত প্রার্থী তখন গিজগিজ করছে।
যেহেতু সজলের সাথে এখনও প্রেম চলছে, তাই নতুন প্রেমিকগুলোকে আসলে বলা উচিৎ একতরফা টাইপের প্রেমিক কিংবা প্রতীক্ষারত প্রেমিক। আমি যদিও এখনও চেষ্টায় আছি, প্রেমের বয়সের দিক দিয়ে ওদের চেয়ে পুরনো, তারপরও খুব আশাবাদী না। ফেলিওর হবে এব্যাপারে নিশ্চিত হলেও, ময়দান ছেড়ে পালাইনি। তেলাপোকার মত টিকে থাকা, আর কি। আসলে সব কিছুই তো নির্ভর করছে, সজলের সাথে ব্রেক আপের উপর।
সো, অবস্থা এখনও কলেজ জীবনের মতোই। ইরিনের প্রেম জীবন নিয়ে সেই পুরনো অবস্থা তখনও বিরাজ করছে। সজল কি আউট হচ্ছে? ভেতরের খবর হচ্ছে, নেশা এখন আগের চেয়ে বেড়েছে। ছাড়বার কোন নামগন্ধ নাই। আশাবাদী প্রেমিকরা ভাবছে, এমন ছেলেকে ছেড়ে দেয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সো, কমবেশি সব প্রেমিকেরই তখন ‘ফিঙ্গার ক্রসড’। অনেক প্রেমিক থাকলেও, এখানেও রেসে অনেকটা এগিয়ে যায় আমাদের আরেক বন্ধু। সুদর্শন এবং বেশ হ্যান্ডসাম এই বন্ধুটির নাম রাখলাম ‘ওয়াই’। এবার অবশ্য একসঙ্গে ঘোরাঘুরি না, প্রায়ই ইরিনের বাসায় যেত। ইরিনের বাবা মা ও ওকে বেশ পছন্দ করত। ‘ওয়াই’ তখন বেশ হওয়ায় ভাসছে। প্রায়ই রটনা শোনা যেত সজলের সাথে ইরিনের সম্পর্ক বেশ খারাপ যাচ্ছে। ‘ওয়াই’ যেহেতু বেশ লুকিয়ে চুরিয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল, তাই আমরা বন্ধুরা ছাড়া, ব্যাপারটা কেউ জানতো না। এভাবে বেশ অনেকদিন চলল। ঠিক কোন ইয়ার পর্যন্ত এমন অবস্থা চলেছিল, মনে নেই। ‘ওয়াই’ যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, ‘সজল আউট হচ্ছে আর তখন তার সুযোগ অবধারিত’, তখন হঠাৎ একদিন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। ‘ওয়াই' সহ সব প্রেমিকের হার্টে মাল্টিপল ফ্র্যাকচার করে, ইরিন সজলকে বিয়ে করল।
বাকী সব প্রেমিকের মত আমার অবস্থা হলেও, দ্রুতই সামলে উঠলাম। কারণ সম্ভবতঃ ‘আমার হয়নি তো কি হয়েছে ওদেরও তো হয়নি।’ যাইহোক, যে দুর্বল পয়েন্টের কারণে সবাই ভেবেছিল, সুযোগ আছে, সেই দুর্বল পয়েন্ট এখন বিজয়ীর হাসি হাসছে। ‘প্রেম’ মানে 'ব্রেক আপের চান্স আছে' হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে এমনটা ভাববার সুযোগ নেই। ফলে ইরিনকে নিয়ে তাঁর কোন প্রেমিকই আর ইন্টারেস্টেড না। আমিও না। একেবারে না বলাটা হয়তো অন্যায় হবে। আসলে কিছুটা খবর রাখতাম। ওর জীবন অসুখী হচ্ছে কি না। কারণ তেমন কোন খবর পেলে একটা পুলকিত ভাব বোধ করতাম। ‘এ হচ্ছে আমাকে প্রত্যাখ্যান করার সাজা।'
যদিও কেউ খুব একটা খবর রাখেনি, তারপরেও কাহিনী এগিয়ে গিয়েছিল। কাহিনীটা বেশ করুণ এবং লম্বা। সারাংশ হচ্ছে, ইরিন আপ্রাণ চেষ্টা করল, সজলের নেশা ছাড়াবার। অনেকের ধারণা, নেশা ছাড়াতেই বিয়ে করেছিল ইরিন। যেন সংসার ব্যাপারটা সজলকে ফিরিয়ে আনে। পারেনি। কাহিনী, সুখকর পরিণতির দিকে এগোয়নি। পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে, সংসারেও ভাঙ্গন ধরে। ডিভোর্স হয়। আমাদের মত ব্যর্থ প্রেমিকরা যে অভিশাপ দিয়েছিলাম, ‘এই মেয়ে জীবনে সুখী হবে না’ তা প্রায় ফলতে শুরু করে।
তবে শেষটা সুখকর হয়। কিছুদিন একাকী জীবন যাপনের পরে, ইরিনের জীবনে আবার প্রেম আসে। এবং অবশেষে পুনরায় আরেকজন জীবনসঙ্গী বেছে নেয়। আমাদের সেই অভিশাপ, ফলতে ফলতেও ফলেনি। এখন যতদূর জানা যায়, স্বামী সংসার নিয়ে সে বেশ সুখী। ঢাকায় থাকে। আমি অন্য জেলায় থাকায় দেখা সাক্ষাতের সম্ভাবনাও শূন্য। না, ভুল বললাম। আমার বাবা মা ও থাকেন রাজশাহীতে। ওর মা ও থাকেন রাজশাহীতে। এবং তিনি অসুস্থ। সো… ‘পিকচার আভি বাকী হ্যায় মেরে দোস্ত।’
আসলে এমন প্রেম প্রায় সব পুরুষের জীবনেই দুএকটা আছে। মনে মনে পছন্দ, কোনদিন বলতে না পারা এবং চোখের সামনে অন্যের হয়ে যাওয়া। এই ধরনের প্রেমগুলো পরবর্তী জীবনে এমন কোন প্রভাবও হয়তো ফেলে না। ইরিনের সাথে আমার প্রেম ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই। যথারীতি একতরফা এবং মনে মনেই। এধরনের প্রেমের আরও একটা ব্যাপার বোধহয় অবধারিত, বেশিরভাগ অংশই পরে আর বিশেষ মনে থাকে না। আজ যখন পুরনো স্মৃতি ঘাঁটতে বসলাম, দেখলাম স্কুল জীবনে ওকে নিয়ে খুব বেশি কোন স্মৃতি নেই। রাজশাহী কলেজ লাইফে কিছু। মেডিকেল কলেজে সম্ভবতঃ আরও কম। যা স্মৃতি সব ‘এক্স' আর ‘ওয়াই’কে নিয়ে। সেই ‘ঈর্ষা মিশ্রিত ক্রোধ’। রাজশাহী কলেজ থেকে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত সহপাঠী থাকলেও, মজার ব্যাপার হচ্ছে এই মেয়েটির সাথে জীবনে কখনো সামনাসামনি কথা হয়নি। আরও অনেক সহপাঠিনীর সঙ্গেও হয়নি, আমার ধারণা। কেন হয়নি, তার একটা কারণ হতে পারে, প্রয়োজন হয়নি। অন্য একটি কারণ হতে পারে, আমাদের নারী বিদ্বেষী বন্ধু গ্রুপ, ‘মেয়েদের সাথে মিশলে ক্যারেক্টার খারাপ হয়ে যাবে’। আর ইরিনের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলা মানে নির্ঘাত প্রেমে পড়া, সো, ‘নিরপাদ দূরত্বে থাকুন’ ফর্মুলায় পেরিয়ে যায় কলেজ আর মেডিকেল জীবন।
ইতিমধ্যে আমিও ডাক্তার হয়েছি। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান করে, একটি বিষয় বিশেষজ্ঞও হয়েছি। পোস্টিং অন্য জেলায় হওয়ায়, রাজশাহী ছাড়তে হয়েছে। নিজের সংসার হয়েছে এবং যথারীতি ইরিন এখন একটি স্মৃতি। নিজের ব্যর্থতা নিয়ে কষ্ট লাগলে, ‘এক্স' আর ‘ওয়াই’য়ের কথা ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিই। ‘ওদের মত হ্যান্ডসাম ছেলেরাই পাত্তা পেল না, তো আমি কোথাকার কি?’ যাইহোক, ডাক্তারদের জীবনে যেমনটা হয়, বন্ধু, কিংবা বন্ধুর বন্ধু প্রায়ই ফোন করে। ‘আর বলিস না, তোর ভাবির এই সমস্যা, কাকে দেখালে ভাল হয়?’ কিংবা ‘অমুক ডাক্তারের সাথে তো তোর ভাল পরিচয়, একটু বলে দে না, আগে আগে দেখে দেবে?’ ‘একটু বলে দে, যেন ভাল ভাবে দেখে’ আর নয়তো, ‘আমার ছেলেটার দুদিন থেকে কাশি, কি খাওয়াব বল তো?’। হয় ডাক্তারি করে দিতে হয়, আর নয়তো কোন বন্ধু ডাক্তারের কাছে রিকোয়েস্ট ফরোয়ার্ড করতে হয়।
বেশ কিছুদিন আগের কথা, আমি তখন রাজশাহীতে। ছুটিতে গেছি। এমন সময় মোবাইলে একটা ফোন আসল। অজানা নম্বর থেকে। আত্মীয় স্বজন ছাড়া ছাড়া আমাকে ফোন করেই দুধরনের লোক, রুগী আর নয়তো বন্ধুরা। বন্ধুদের নম্বর সেভ করা থাকলেও, নতুন মোবাইলে এখনও কপি করা হয়নি। তাই কিছুদিন যাবত অজানা নম্বর হলেও, ফোন ধরছি। এটাও ধরলাম। এরপরে বেশ কিছু ঘটনা ঘটল। জীবনে দ্বিতীয়বারের মত হার্ট তার বিট মিস করল। চোখের সামনে ভেসে উঠল ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। পুতুলের মত সুন্দর রোগা পাতলা ফ্রক পড়া একটা মেয়ে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে পড়ল সেই চোখাচোখি। সেই প্রথম প্রেমে পড়া। প্রথমবারের মত সেই হার্টের বিট মিস করা। এরপরে? এরপরে শুরু হল, আমার প্রথম প্রেমের সাথে জীবনে প্রথমবারের মত আলাপচারিতা, ‘হ্যালো, আমি ইরিন।’
শেষ

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুন, ২০১৭ রাত ৯:৪৬

বিষাদ সময় বলেছেন: ভাল লাগলো আপনার কাহিনী এবং সাবলিল উাপস্থাপন শৈলী। তবে শেষের পরেই তো আসলে কাহিনী শুরু তাই এই শুরুর শেষটাও সুন্দর হলে সব দিক থেকে ভাল হয়।

ঈদ মুবারাক।

১২ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:২৩

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: পড়ার জন্য ধন্যবাদ

২| ১১ ই জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৯

রায়হান চৌঃ বলেছেন: অসাধারণ লিখেন আপনি.............
তবে আপনার নাম টা , কেন জানি খুব পরিচিত মনে হচ্ছে কিন্তু পনে করতে পারছি না :(, ভালো থাকবেন :)

১২ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:২৪

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: উৎসাহ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.