নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সপ্ন

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী

কিছুই না

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঈশ্বর হ্যাকড

২৭ শে জুন, ২০১৭ ভোর ৬:৫২


আরিফ প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন থিওরি হাজির করে। কিছুদিন আগে হাজির করেছিল, ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পেসিস’ এক্সটেনশান। থিওরিটা ভালোই লেগেছিল। থিওরির বক্তব্য হচ্ছে, ইভোলিউশানের বর্তমান অবস্থা। ডারউইনের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, তবে সেই প্রক্রিয়া এখনও চলছে। আর সে কারণেই আমরা এখন অন্য কোন প্রজাতি হওয়ার মাঝ রাস্তায় আছি। কথাটায় যুক্তি আছে। যদি আমরা বানর থেকে মানুষ হয়ে থাকি, তবে তো মানুষ থেকে এতোদিনে অন্য কিছু হয়ে যাওয়ার কথা। কিংবা হওয়ার কোন না কোন ছোটখাট লক্ষণ দৃশ্যমান হওয়ার কথা। বাস্তবে ব্যাপারটা হয়তো তাই। অন্য কোন প্রজাতি হওয়ার পথে আছি আমরা। কথাটায় যদিও যুক্তি আছে, তবে এই মুহূর্তে ওর হাতে কোন প্রমাণ নেই। আর ওর যা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা তাতে সম্ভবও না এনিয়ে রিসার্চ করার। তাই ওর বেশিরভাগ চিন্তাই একটা হাসির খোরাক হয়েই থেকে যায়। আমাদেরকেও যে কেন এসব শোনায়, জানি না। হয়তো ভাবে, ওর আইডিয়া শুনে, এ বিষয়ে ওকে রিসার্চ করতে সাহায্য করব। কিংবা হয়তো, আমাদের বলেই ও মজা পায়।
ইদানীং অবশ্য আস্তিকতা আর নাস্তিকতা মিলিয়ে একটা কম্বিনেশান লাইনে চিন্তা করছে। ঈশ্বর আছে কি নেই তা নিয়ে ওর সিদ্ধান্ত হচ্ছে ‘ঈশ্বর আছেন।‘ এবং এই মহাবিশ্বকে যে তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন তার পেছনে রয়েছে কোন না কোন ধরনের কমিউনিকেশান ব্যাবস্থা। কোন না কোনভাবে ঈশ্বর কিছু না কিছু সিগন্যাল পাঠিয়ে এই বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করছেন। সিগন্যালটা ট্রেস করবার কোন ব্যাবস্থা এখনও মানুষ আবিস্কার করতে পারেনি ঠিকই, তবে সিগন্যাল অবশ্যই কিছু একটা আছে। এখন ওর মাথায় সারাক্ষণ ঘুরছে, কিভাবে সেই সিগন্যাল ট্রেস করা যায়। একবার ট্রেস করা গেলে, যে মেশিন ব্যাবহার করে ঈশ্বর এই সিগন্যাল পাঠাচ্ছেন, সেটাকেও ট্রেস করা সম্ভব। আর সেই মেশিনকে ট্রেস করা গেলে, সেটাকে হ্যাকও করা সম্ভব। অর্থাৎ ঈশ্বর ক্যান বি হ্যাকড।
নতুন থিওরিটা ও আজকে আমাদের সামনে উপস্থাপন করল। এই মুহূর্তে, যথারীতি আমরা আমাদের করণীয় করছি। অর্থাৎ, আপাততঃ আমরা হাসছি। ব্যাপারটা নতুন কিছু না। ওর প্রায় সব থিওরি শুনেই আমরা হাসি। ওকে যে আমরা সিরিয়াসলি নিই না, এটা হয় ও বোঝে না আর নয়তো ও জানে কিন্তু তারপরও বলে। আসলে, মাথায় কোন আইডিয়া আসলে, ওর প্রথম কাজ হচ্ছে, সবার আগে এসে আমাদেরকে সেটা জানানো। মাঝে মাঝে মায়া লাগে, এতো শখ করে বন্ধুদেরকে নিজের নতুন নতুন সব আইডিয়া শোনায়, আর আমরা কি না এসব হেসে উড়িয়ে দিই। উৎসাহ দেয়া তো দূরের কথা, অনেক সময় ওর কথাই শুনি না।
ছয় সদস্যের আমাদের একটা ছোটখাট গ্রুপ আছে। বেশিরভাগই স্কুলফ্রেন্ড। বেশিরভাগ কেন বলছি, তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি। আসলে এই গ্রুপটা শুরুতে ছিল আমাদের চার ক্লাসফ্রেন্ডদের নিয়েই। চাকরীর খাতিরে যারা ঢাকার বাইরে থাকে, তারা ছাড়া আমাদের স্কুলজীবনের বন্ধুদের মধ্যে যারা সন্ধাটা আড্ডায় আসতে পারে, মুলতঃ তাঁদের নিয়েই এই গ্রুপ। সন্ধার পরে রেগুলার আমাদের আড্ডা বসে। ঢাকার বাইরে থাকা বন্ধুরা ছুটি ছাটায় ঢাকায় আসলে আড্ডায় যোগ দেয়। ধীরে ধীরে গ্রুপের দুজনের প্রেম হল। প্রেমিকা সহই আসা শুরু হল আড্ডায়। এভাবে আড্ডাটা ‘কেবল ক্লাসমেটদের’ থেকে ‘প্রায় সবাই ক্লাসমেট’দের আড্ডা হয়ে গেল।
যে দুজনের ইতিমধ্যে অ্যাফেয়ার হয়েছে তার মধ্যে আমি একজন। ওদের নাম দিয়েছি ‘ফ্রেন্ডনি’। আমার ‘ফ্রেন্ডনি’ বা প্রেমিকার নাম মিলি। অপর জন ঈশিতা। আরিফের ‘ফ্রেন্ডনি’। আমাদের সাথে আমাদের প্রেমিকারাও অনেক সময় একসাথে আড্ডা দিতে আসে। কখনও সবাই মিলে একসাথে আড্ডা হয়। কখনও দেখা যায়, আমরা বন্ধুরা একসাথে গল্প করছি, আর প্রেমিকাদের গ্রুপ আলাদা। তবে কেন যেন, আরিফকে এই প্রেমিকাদ্বয় বেশ পছন্দ করে। আরিফের প্রেমিকা পছন্দ করে ব্যাপারটা নাহয় বোধগম্য, কিন্তু আমারটা কেন করে, বুঝি না। এতো বোকা বোকা কথা কেউ বিশ্বাস করে? আমরা যারা ওকে আগে থেকেই চিনি, তারা ওর গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনি এবং এরপরে যথারীতি হাসাহাসি করি। কেবল এই ফ্রেন্ডনিদ্বয় এখনও ওর থিওরিগুলো বিহ্বল হয়ে শোনে।
আজকের ওর ‘ঈশ্বর হ্যাক’ থিওরি শুনে যথারীতি আমরা বন্ধুরা হাসছি আর ‘ফ্রেন্ডনি’ গ্রুপ দারুণ এক্সাইটেড। ‘দারুণ হবে, তাই না?’ আরিফ প্রতিবারের মত এবারও সিরিয়াস। এবার একটু বেশিই সিরিয়াস। কারণ এক মোবাইল কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে, সিগন্যাল সম্পর্কে কিছু আইডিয়া ওর আছে। ইনফ্যাক্ট কোম্পানি বাতিল বলে যেসব ইন্সট্রুমেন্ট ফেলে দেয় বা নিলামে দেয়, সেখান থেকে কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট সে জোগাড়ও করেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন ফ্রিকোয়েন্সির সিগন্যাল ট্রেস করার চেষ্টা করছে। গত প্রায় একবছর ধরে চলছে ওর সিগন্যাল ট্রেসের প্রচেষ্টা। কোন একটা নতুন সিগন্যাল পেলেই লাফিয়ে ওঠে, ‘এটাই বুঝি ঈশ্বরের সিগন্যাল’। সেই প্রচেষ্টায় আজকে নতুন যুক্ত হল, হ্যাকিং আইডিয়া, ঈশ্বর হ্যাকিং।


মিলির সঙ্গে আমার প্রেম খুব বেশিদিনের না। মাস দুয়েক হবে। প্রথম দেখা একটা হাসপাতালে। সরকারী হাসপাতালে, রুগী দেখানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল। এমন অপরুপা একটা মেয়ের এভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাপারটা কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ আকর্ষণীয় একটা ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। খটকার জায়গা আরও ছিল। তার বেশভূষা বলে দিচ্ছে সে বেশ পশ ফ্যামিলির মেয়ে। আর এমন একজন মেয়ের সাথে লাইনে দাঁড়ানো ব্যাপারটা ঠিক মানাচ্ছিল না। তাই দেখা গেল, আশেপাশের লাইনের অনেকেই ওর দিকে নির্নিমেষ নয়েনে তাকিয়ে আছে। শুধু যে তাকিয়ে আছে তা না, অনেকে আবার ওকে দেখার জন্য নিজেকে সিরিয়ালে পিছিয়ে নিচ্ছে। পেছনের লোককে আগে যেতে দিচ্ছে। মোটামুটি দেখার মত এক পরিস্থিতি।
বিপদে পড়া একজন সুন্দরীকে সাহায্য করতে লোকের অভাব কখনই হয় না। এখানেও তা ই হল। দুই একজন অতি উৎসাহিত হয়ে সাহায্যও করতে এগিয়ে আসল। এরমধ্যে কিছু আবার রুগী ধরা দালালও আছে। ‘সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা হয় নাকি? আমার পরিচিত একজন ডাক্তার আছে...’ কেউ কেউ আবার এসেছিল, ‘যাকে দেখাবেন, উনি আমার পরিচিত।‘ এরপরের বক্তব্য হচ্ছে, উনি চাইলেই সিরিয়াল এগিয়ে দিতে পারবেন ইত্যাদি। মিলির দেখলাম কারো দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। হাতের মোবাইল ফোনটায় একমনে গেম খেলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে মিলির সিরিয়াল চলে আসল।
এবার বলি আমি কেন গিয়েছিলাম। আমার কোন অসুখ করেনি। অফিস কামাই দিয়েছিলাম। সেই পাপ স্খলন করতে একটা মেডিকেল সার্টিফিকেট চাই। সেটা জোগাড় করার রাস্তা দুটো। পরিচিত কেউ অথবা উৎকোচের বিনিময়ে। আমি প্রথম গোত্রের। আমাদের বন্ধু গ্রুপের একজন সদস্য ডাক্তার। তার কাছেই এসেছি। সার্টিফিকেট নিতে। এতক্ষণে নিয়ে চলেও যেতাম। কিন্তু ঘটনাটা ঘটেনি, সেই অপরুপার জন্য।
মিলি যাকে দেখাবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল, আমিও যাব তার কাছে।ওর দরজায় যে ছেলেটা দ্বায়িত্বে আছে, সে আমাকে চেনে। আমি এগিয়ে গেলেই, সিরিয়াল ভেঙ্গে আগে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে দেবে, আমি জানি। রুগীরা কিছু চিৎকার চেঁচামেচি করবে, তবে আবার থেমেও যায়। যদিও আগে ঢুকতে পারতাম, তারপরও কেন ঢুকিনি, তা তো বললাম। এদিক ওদিক ঘুরে সময় কাটাচ্ছিলাম। আসল ইচ্ছে ছিল, মিলি যখন ঢুকবে, তার একটু পরেই ঢুকব। ঢুকে একটু অভিনয় করব, বুঝতে পারিনি যে মেয়ে রুগী আছে। এরপরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হব। এটাও জানি, তখন আমার ডাক্তার বন্ধু অবধারিতভাবেই আমাকে বলবে, ‘বস। এই রুগী শেষ করেই তোকে দেখছি।
সরকারী হাসপাতাল। ফলে প্রাইভেসি ব্যাপারটা খুব বড় কোন ইস্যু না। দেখা যাবে সেই মহিলা রুগীর সমস্যা শুনতে শুনতেই আমার জন্য চা বলবে। আমিও বসে কিছুক্ষণ সেই খুব কাছে থেকে সেই অপরুপাকে দেখবার সুযোগ পাব।
প্ল্যান মতোই কাজ করলাম। গিয়ে দেখি মিলি রুমে একা। ঘরে আমার বন্ধুটি নেই। রুমে নেই মানে, রুমের সঙ্গে লাগানো অ্যাটাচ বাথে আছে হয়তো। আমার জন্য সুবিধাই হল। মিলির পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পড়লাম। বাড়াবাড়ি হয়ে গেল কি না, সেটা চিন্তা করে, নিজে থেকেই বললাম, ‘আমার ফ্রেন্ড। একেবারে স্কুলজীবনের’।
--জানি। আপনার নামও জানি। অপু।

আমার তখনকার অবস্থা বোঝানোর জন্য যথার্থ শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। ‘স্তম্ভিত’ আর ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ এর একটা কক্টেল অবস্থা বলা যায়। কোন রকমে মুখ দিয়ে বেরোল
--আমাকে চেনেন?
--আপনাদের চার বন্ধুদেরকেই চিনি। ফ্রেন্ডনিকেও
--কিভাবে?
--ঈশিতা, আবিরের ‘ফ্রেন্ডনি’।
আমার অবাক ভাব তখনও কাটেনি। কোনরকমে বললাম,
--আপনি ঈশিতার পরিচিত?
--হ্যা। আমি ওর স্কুলফ্রেন্ড। পেশায় জার্নালিস্ট।
--কোথায় আছেন?
--ঠিক কোন পারটিকুলার পেপারের সাথে অ্যাটাচ না। ফ্রিল্যান্স বলতে পারেন।
--আই সি।
--প্রেমে পড়েছেন?
প্রশ্নটার মানে বুঝলাম না। ‘কোনদিন কারো প্রেমে পড়েছি কি না?’ না ‘উনার প্রেমে পড়েছি কি না?’ তার চেয়েও বড় কথা এধরনের কথা বলার মত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক এখনও আমাদের হয়নি। তাছাড়াও কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ এই কথা কেন?
--মানে?
--মানে আপনি কি আমার প্রেমে পড়েছেন?
--কেন একথা মনে হল?
--আপনার চোখে বেশ স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে, আমার প্রেমে পড়ে বসে আছেন। একটা ছেলের চোখের ভাষা পড়তে পারা একটা মেয়ের জন্য তেমন কোন ব্যাপার না। কিন্তু সেটা এমন ক্যাজুয়ালি বলা, একটু অবাক করা ব্যাপার তো অবশ্যই। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, ‘নো ভদ্রতা। মনে যা আছে, অকপটে স্বীকার’।
--ঠিক ধরেছেন। প্রথম দৃষ্টিতেই প্রেম বলতে পারেন।
--দেন? হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর?

অবিশ্বাস্য শোনালেও, এটাই আমার প্রেম কাহিনী। মিলি যে একটা ধোঁয়াটে চরিত্র, ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ নেই। পড়ে ঈশিতার কাছে যখন জানতে চাইলাম, মিলি তোর কেমন ফ্রেন্ড। ঈশিতাও খুব ভালো উত্তর দিতে পারল না। বলল
--আমার নিজেরও ঠিক মনে নেই রে। বলছে একই স্কুলে পড়ত। কিছু স্যারের নামও ঠিকঠাক বলল। স্কুলজীবনের বেশ কিছু ঘটনার কথাও বলল। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না, ও কে?
তবে এতে আমার তেমন কোন আপত্তি নেই। এমন অপূর্ব সুন্দরী একজনের সাথে প্রেম হয়েছে, এতেই আমার আনন্দে বাগ বাগ অবস্থা। বন্ধুরা যখন ট্যারা চোখে মিলিকে দেখে কিংবা আমাদের জুটিকে দেখে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে, মজাই লাগে। মাঝে মাঝে নিজেই ইচ্ছে করে এদিক ওদিক সরে যাই। তখন দেখা যায়, বন্ধুদের উৎসাহ। কে কি বলে মিলিকে আনন্দ দিবে, তা নিয়ে তখন চলে তুমুল প্রতিযোগিতা। শুধু একজন তার নিজের মত থাকে, আরিফ। আর সেকারণেই বোধহয় মিলি একটু বেশী বেশিই আরিফের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানতে চায়, ওর এক্সপেরিমেন্ট কতদূর এগোল। ঈর্ষা যে একেবারে হয় না, তা বলব না, তবে সন্দেহ করি না। আরিফ এক কথার ছেলে। ঈশিতাকে ছেড়ে অন্য কারো দিকে ও নজর দিবে না।
আরিফকে নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ার আরও একটা কারণ অবশ্য আছে। আসলে ওর নিজের জগত নিয়ে ও এতোটাই মগ্ন থাকে যে, আর কোন কিছুই সে লক্ষ্য করে না। সবার ভেতরে থেকেও ও একেবারে আলাদাই থাকে। হয়তো আমরা গল্প করছি কোন ফিল্ম নিয়ে, ও হঠাৎ বলে বসল, ‘জানিস কালকে একটা সিগন্যাল দেখে মনে হয়েছিল, এটাই বুঝি ঈশ্বরের।‘ রাজনীতি নিয়ে চলা তুমুল বিতর্কের মাঝে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসে, ‘আচ্ছা, ঈশ্বরের ল্যাংগুয়েজ কোনটা? মানে উনি যদি পাসওয়ার্ড সেট করেন, কোন ভাষায় করবেন?’
পড়াশোনায় এমন কিছু ছিল না। ভর্তি পরীক্ষার সময় আবিরের, মানে আমাদের ডাক্তার ফ্রেন্ডটার পাশে বসে। ওর দেখে দেখে লিখেই, ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পায়। ভালো সাবজেক্ট অবশ্য পায়নি। হিস্ট্রি। চাকরির বাজারে তেমন ডিমান্ড নেই। তারপরও চাকরি জোগাড় করে দেয়া হয়। ওর পাগলামি টাইপ কথাবার্তা শুনে হাসলেও, ওকে সবাই আমরা বেশ পছন্দ করি। চাকরি না থাকলে, সবাই একযোগে চেষ্টা শুরু করি, কিছু একটা জোগাড় করে দেয়ার। এখন যে চাকরীটা ও করে, সেটাও এক বন্ধুর জোগাড় করে দেয়া। এভাবেই চলছে।
আড্ডায় আসে ঠিকই, কিন্তু ওর মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। বেশিরভাগ দিনই আসে ঈশিতার পিড়াপীড়িতে। এই এক জায়গা ছাড়া আর কোথাও আরিফকে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারে না ঈশিতা। না পার্ক, না ফাস্ট ফুড। ওদের প্রেমের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে, এই আড্ডায়। প্রায় তিন বছর হতে চলল। এখনও ওদের প্রেম ব্যাপারটা, ‘প্রেমে’ই আটকে আছে। বিয়ে পর্যন্ত এগুচ্ছে না। ঈশিতার বাবা মা চাইছেন, বিয়েটা দিয়ে দিতে। আরিফের একটা ভালো চাকরি হলেই হয়তো বিয়েটা দিত।
আরিফের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। এখন মেতেছে, ঈশ্বরকে হ্যাক করতে। এবার ও বেশ সিরিয়াস। সিরিয়াস অবশ্য সবসময়েই, তবে এর আগের থিওরিগুলোর ক্ষেত্রে এগোনোর তেমন কোন সুযোগ ছিল না। এবার আছে। তেমন কোন অ্যাকাডেমিক ডিগ্রী না থাকলেও মেশিনপত্র খুব ভালো বোঝে। নিজের শখ থেকেই শিখেছে। তার ওপর যোগ হয়েছে, ফ্রিতে পাওয়া কিছু নষ্ট কিংবা আধা নষ্ট যন্ত্রপাতি। প্রায় সারাদিনই বসে বসে সিগন্যাল খোঁজে। যত রকম ফ্রিকোয়েন্সি আছে, সবগুলোতেই ট্রাই করছে। ঈশ্বর কখন কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে সিগন্যাল পাঠান!

আজকে একটা বিশেষ দিন। মানে, আমার জন্য বিশেষ দিন। মিলির সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে আজকে। সকালে দশটার ভেতরেই সবার আসবার কথা। সবাই প্রায় চলেও এসেছে। শুধু আরিফ বাকী। আরিফের দেরীর কারণও আছে। ওর দ্বায়িত্ব হচ্ছে কাজী সাহেবকে নিয়ে আসা। কাজী সাহেবের বাসা ওর বাসার কাছেই। সেকারণেই ওকে এই দ্বায়িত্ব দেয়া। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে সিদ্ধান্ত হল আরিফের কোন ভরসা নেই। হয়তো দেখা যাবে ঈশ্বর হ্যাক করছে আর নয়তো কোন সিগন্যাল কোথা থেকে আসছে তা নিয়ে রিসার্চ করছে। সিদ্ধান্ত হল, আবির যাবে। এমন সময় আরিফ এসে হাজির। সঙ্গে একটা ল্যাপটপ। কাজী সাহেবের কোন পাত্তা নেই। কেবল মুখ জোড়া বিজয়ীর হাসি
--আই ডিড ইট।
ঈশিতাও আমাদের মাঝে ছিল। সে সবার আগে ধরতে পারল, আরিফ কি বলতে চাইছে।
--ও সম্ভবতঃ ঈশ্বরের সিগন্যাল ট্রেস করে ফেলেছে।
পরিস্থিতি হঠাৎ করেই পাল্টে গেল। কাজী না আনবার জন্য সবাই মোটামুটি গালি দেয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, থেমে গেল। আমার বিয়েও মনে হয় ভন্ডুল হতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে সবাই বেশ এক্সাইটেড। আরিফ আর যাই করুক, ওর নিজের কাজ নিয়ে কখনও মিথ্যে বলে না। ফলে ও যখন বলেছে, ও ঈশ্বরের সিগন্যাল ট্রেস করতে পেরেছে, তার মানে ও পেরেছে। মিথ্যে বলব না, প্রথমে বিরক্ত লাগলেও, এখন আমিও বেশ উৎসুক হয়ে উঠছি। একমাত্র নিস্প্রভ আমার হবু স্ত্রী মিলি। আরিফকে সবসময় উৎসাহ দেয়া মিলির কাছে এটা আশা করিনি। বিয়ে তো আর ভেঙ্গে যায়নি, বড়োজোর একদিন পেছাল এই যা। আজ হয়নি, আগামীকাল হবে। এতে এতো মন খারাপ করার কি আছে?
সব দৃষ্টি এখন আরিফের দিকে।
--নট অনলি দ্যাট, আই হ্যাকড হিম।
--মানে?

প্রায় সমস্বরে চিৎকার বলা যায়। পরিবেশ মুহূর্তেই আরেক ধাপ চড়ে গেল। আরিফ শুধু ইশ্বরের পাঠানো সিগন্যাল ট্রেসই করেনি, সিগন্যাল পাঠাবার মেশিনও হ্যাক করে ফেলেছে? গ্রেট। তার মানে এখন ও চাইলে ঈশ্বরের মেশিন ব্যাবহার করে নিজেই সিগন্যাল পাঠাতে পারবে? তারমানে তো...
ভাবলে তো অনেক কিছুই ভাবা যায়। কিন্তু এই মুহূর্তে সবার চিন্তা অন্য। ঈশ্বর কি করছেন? তাঁর সৃষ্ট একজন মানুষ, তাঁরই সিগন্যাল জেনারেটিং মেশিন হ্যাক করে ফেলল, আর উনি তা বসে বসে দেখছেন? উনি কি টের পাননি? না আটকাবার কোন চেষ্টা করেননি? নাকি তিনি নিজেই চাইছেন, হ্যাক হউক।
চিৎকার চেঁচামেচির মাঝে আরিফ যথারীতি তাঁর ল্যাপটপ অন করে ফেলেছে। ল্যাপটপের সাথে যোগ করেছে ছোট্ট একটা মেশিন। সেই মেশিনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোগ্রাম অন করল। এরপরে বিজয়ীর হাসি নিয়ে আমাদের সবার দিকে তাকাল।
--বলতে পারিস, এখন ইতিহাস সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। আমার এই যুগান্তকারী আবিস্কার সম্পর্কে পৃথিবীর যে কয়জন সৌভাগ্যবান মানুষ সর্বপ্রথমে জানতে পারছে, তোরা হচ্ছিস সেই কজন।
আমরা তাকিয়ে আছি আরিফের ল্যাপটপের দিকে।
--ঈশ্বর প্রতিটি মানুষ, ইনফ্যাক্ট প্রতিটি জীবের জন্য আলাদা আলাদা কোড সেট করে রেখেছেন। আর সেই কোড অনুযায়ীই উনি সিগন্যাল পাঠাচ্ছেন। সেভাবেই কাজ হচ্ছে। আমি জানি ব্যাপারটা প্র্যাকটিক্যালি না দেখালে তোরা কেউ বিশ্বাস করবি না। সো, হেয়ার কামস দ্যা ডেমন্সট্রেশান।
সবাই বেশ উৎসুক বোধ করছে। কিন্তু আরিফ ঠিক কি করতে যাচ্ছে, কেউই বুঝতে পারছি না। আবির জানতে চাইল।
--আমাদের কি করতে হবে?
--তোরা কে কে তোদের ভবিষ্যৎ জানতে চাস? বা বলতে পারিস আগামী কিছুদিন তোদের কার জন্য কি সিগন্যাল ওয়েট করছে, সেটা আমি এখন বলে দিতে পারি।
সবাই সমস্বরে ‘আমি’ বলে উঠল। আরিফ সবার দিকে তাকিয়ে কেন যেন আমাকে চয়েস করল।
--আই থিঙ্ক দ্যা ব্রাইডগ্রুম সুড গেট দ্যা চান্স ফার্স্ট।
সমস্বরে করতালি দিল সবাই। আপত্তির তেমন কোন কারণও নেই। একে একে সবাই তো সুযোগ পাচ্ছে। শুধু ফার্স্ট হওয়ার জন্য ঝগড়া করার বয়সের এখন আমরা নই।
--কি জানতে চাস?
--আমার বিয়েটা কবে হচ্ছে?
--ওকে। তার আগে বলে নিই। ঈশ্বর আসলে সবাইকেই ক্যাটাগরিতে ভাগ করে রেখেছেন। সেই ক্যাটাগরিটা বুঝতে পারলে ইন্ডিভিজুয়ালকে ট্রেস করা কোন ব্যাপার না। সেই ক্যাটাগরি নিয়ে পরে এক সময় কথা বলব। আপাততঃ এটুকু জেনে রাখ, আমাদের, মানে মানুষদের জন্য আইডির একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন আছে। সেটা ফলো করে আমাদের, মানে আমাদের এই ফ্রেন্ড গ্রুপের প্রায় সবার আইডি আমি পেয়ে গেছি। আমরা এখন অপুর আইডিতে ঢুকব। সেখানে ঢুকলেই আমরা পেয়ে যাব, অপুর জীবনে এখন থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কি কি ঘটবে, তার ডিটেলস। সো, লেটস স্টার্ট।
--ঈশ্বর আমাদের সবাইকে আইডি নম্বর দিয়ে রিকগনাইজ করেন?
--ইয়েস। অ্যান্ড ফর ইওর ইনফরমেশান, একজন ছাড়া আমি বাকি সবারই আইডি ট্রেস করে ফেলেছি।

এদিক ওদিক থেকে প্রশ্ন আসতে লাগল। ‘কার?’ ‘হু ইজ হি?’ ‘ভালো করে দেখ’। আরিফ কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপচাপ থেমে থাকল। উত্তর না পেয়ে একসময় প্রশ্নও থেমে গেল। এমন সময় একটা শব্দ সবার কানে যেন তীরের মত বিধল
--আমার।
সবার চোখ একসাথে ঘুরে গেল। কথাটা এসেছে মিলির মুখ থেকে। হতভম্ব হওয়ার আরও অনেক বাকী ছিল। মিলি বলে যেতে লাগল
--আরিফ আমার আইডি পায়নি, কারণ আমি মানুষ না।
ঘরে তখন পুরোপুরি পিন পতন নীরবতা। মিলি মানুষ না হলে তাহলে কে বা কি এই প্রশ্ন করার মত অবস্থায় তখন আমরা কেউ নেই। মিলি বলে যেতে লাগল।
--আরিফ যে পথে এগোচ্ছিল, সেই পথে যে সাফল্য আসবে, তা ঈশ্বর জানতেন। তিনি নিজেও দেখতে চাইছিলেন, আরিফ কতোটা এগোতে পারে। চাইলেই তিনি থামাতে পারতেন, আরিফকে মেরে ফেলতেও পারতেন, সিগন্যালের হেরফের করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি আসলে দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি তাকে ট্রেস করার কতোটা কাছাকাছি পোঁছবার ক্ষমতা রাখে। তাই তিনি আরিফকে পুরোপুরি ছাড় দিয়েছিলেন। এমনকি এই কয়দিন আরিফের আইডিতে ঈশ্বরের কাছ থেকে কোন সিগন্যালও আসেনি। এই কয়দিন আরিফ নিজেই ছিল নিজের ঈশ্বর। বুঝতেই পারছো, আমাকে ঈশ্বরই পাঠিয়েছেন। আর আরিফের ওপর নজর রাখতেই পাঠিয়েছেন।
আমার তখন গলা শুকিয়ে কাঠ। এতদিন তাহলে কার সাথে প্রেম করেছি। ঈশ্বরের পাঠানো চরের সঙ্গে? ব্যাপারটা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। এখন বুঝতে পারছি, কেন ঈশিতা মিলিকে মনে করতে পারেনি। আর আমার সাথেই বা এক মুহূর্তের পরিচয়ে প্রেম করতে আগ্রহী হল কেন? ও চাইছিল আমাদের গ্রুপে এন্ট্রি। আরিফের ওপর নজর রাখতে। অনেক কষ্টে বললাম
--কি বলছো এসব।
আরিফ এসময় বলে উঠল, ‘ও ঠিকই বলছে। গতকাল আমার নিজের আইডিতে ঢুকে আমি কোন সিগন্যাল পাইনি। অথচ আবিরের আইডিতে দিব্বি আগামী কিছুদিনের করণীয় লেখা আছে।
এমন সময় মিলি আবার বলতে শুরু করল।
--ঈশ্বর চাইছিলেন, সিগন্যাল ট্রেস করার মেশিনটা আবিস্কার হোক। আর এক মুহূর্তের জন্য হলেও, সেটা টেস্ট হোক। যেটা আরিফ গতকাল রাতে করেছে। তবে তিনি চাননা, ভবিষ্যৎ জানবার ফর্মুলা বেঁচে থাকুক। তিনি চান না কেউ তোমরা নিজেদের ভবিষ্যৎ জানতে পার।
--মানে?
মিলি এবার সবার দিকে একে একে তাকাল। সাপের মত শীতল চোখে স্পষ্ট করে উচ্চারন করল
--টুডে ইজ ইওর, ডুমস ডে। এঘর থেকে তোমরা আর কেউ বেঁচে ফিরবে না।
--শেষ

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুন, ২০১৭ সকাল ৮:৩৩

নাদিম আহসান তুহিন বলেছেন: অসাধারণ ভাই,,,,সত্যিই সুন্দর,,, ঈশ্বরের চরের সংগে প্রেম করতে পারাটাও তো ভাগ্যের ব্যাপার,,,তাই না???

৩০ শে জুন, ২০১৭ ভোর ৪:০০

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: ধন্যবাদ

২| ২৭ শে জুন, ২০১৭ সকাল ৯:১৪

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: হা হা হা

দারুন!!!!!!

ঈদ মোবারক :)
++++++++

০১ লা জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:০৬

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ২৭ শে জুন, ২০১৭ সকাল ১০:৪৭

আরিফুর রহমান রিপন বলেছেন: অসাধারন লাগলো + +++++

০৯ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:২৬

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: ধন্যবাদ

৪| ২৭ শে জুন, ২০১৭ সকাল ১০:৫২

Muhammad dulal hussain বলেছেন: muTa muTi gaja kuei cinta

৫| ২৭ শে জুন, ২০১৭ সকাল ১১:৩১

বিজন রয় বলেছেন: ভালই তো লিখেছেন।
আপনি এত কম লেখেন কেন?

ঈদ মোবারক।

০৯ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:২৭

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: চেষ্টা করছি বেশি লেখার। ধন্যবাদ

৬| ২৭ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৪:২০

কানিজ রিনা বলেছেন: বেশ ভাল লাগল। আমার এক ভাই অত্যন্ত
ধর্ম ভীরু আর জোগস মানুষ। মসকরা করতে
পারদর্শী। একদিন আমি এমন অসুস্হ হলাম
প্রান যাই যাই। এবার ভাইকে বললাম ভাই
আল্লাহ কোনও কিছু করার আগে বলেন হও
আর হয়ে যায়। তাহলে আমার প্রান নিতে
আজরাইল না জম আসবে কেন? ভাই বলল
আল্লাহ ওই শালা নিজেই আসে নাম দেয়
আজরাইলের।
তুই ভয় পাসনে তোর প্রান আরও অনেকদিন
থাকবে আর আল্লাহ বলবে ওমুকের প্রান চলে
আস তাই চলে যাবে আল্লাহর কাছে। ধন্যবাদ
গল্পটা বেশ সুন্দর।

০৯ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:২৭

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.