নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সপ্ন

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী

কিছুই না

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সব চরিত্র কাল্পনিক

১২ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:২২


খবরটা যতটা দ্রুত ছড়াবার কথা, ঠিক ততটা দ্রুতই ছড়াল। দেখতে দেখতে কক্সবাজার শহরের হোটেল প্যারাডাইসের লবিতে ভিড় বাড়তে শুরু করল। পুলিশ এখনও আসেনি, তাই উৎসাহীর জনতা উঁকিঝুঁকি দেয়া এখনও চলছে। যার ঝুলিতে যে গল্প আছে তা নিয়েই চলছে কাহিনী বানাবার প্রক্রিয়া। হোটেলের ম্যানেজার সাহেব আপ্রাণ চেষ্টা করছেন জনতাকে রুম থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখবার। চারতলার বোর্ডার ছাড়া আর কাউকে চার তলায় উঠতে দেয়া হচ্ছে না। লিফটেও একজনকে সার্বক্ষণিক রাখা হয়েছে ব্যাপারটা তদারক করার জন্য।
কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও জনতার সংখ্যা গুটিকয় ছিল। সাংবাদিক বাহিনী খবরটা পাওয়ার পরে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে শুরু করেছে। দুএকটা টিভি চ্যানেল ইতিমধ্যে স্ক্রলে ব্যাপারটা প্রচার শুরু করে দিয়েছে। ওদিকে হোটেলের সামনের রাস্তাতেও ভিড় জমে রাস্তা বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। ব্যাপারটার দ্রুত একটা মীমাংসা না হলে এই ট্যুরিস্ট সিজনে বড়সড় লোকসানের মুখ্যে পড়তে হবে। ম্যানেজার ইদ্রিস আলী তাই ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন। সাতটা ত্রিশ।
আধ ঘণ্টা আগেই পুলিশকে ফোন করা হয়েছে। ঘটনাটা জানতে পারার পরে ইদ্রিস সাহেব আর এক মুহূর্ত দেরি করেননি। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে যে ব্যক্তিটি ফোনটা তুলেছিলেন, তিনি পুরো ব্যাপারটা শুনেছেন কি না, তা নিয়েই এখন সন্দেহ জাগছে ইদ্রিস আলীর মনে। থানা থেকে প্যারাডাইস হোটেল বড়জোর পাঁচ মিনিটের পথ। সময়টা নেহাত এসপি সাহেবকে ফোন করবার মত না, তা নাহলে অনেক আগেই তিনি এসপি সাহেবকে ফোনে ব্যাপারটা জানিয়ে দিতেন। যেভাবে উৎসুক জনতার ভিড় বাড়ছে, মনে হচ্ছে এসপি সাহেবকে ফোন করা ছাড়া পরিস্থিতি সামাল দেয়ার আর কোন উপায় নেই।
এদিক ওদিক থেকে ছুটকো ছাটকা মন্তব্য কানে আসছে। কেউ বলছেন ‘সুইসাইড' কেউ বলছেন ‘মার্ডার' তাঁর নিজের অবশ্য অন্য একটা সন্দেহ হচ্ছে। ব্যাপারটা তিনি এস পি সাহেবকে জানাবেন ঠিক করে রেখেছেন।
রাতে যখন উনি নিজে তাঁকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, 'সকালে সাড়ে সাতটায় উনার ফ্লাইট, আর সাড়ে ছটায় রিপোর্টিং। সো অবশ্যই যেন তাঁকে পাঁচটার দিকে ডেকে দেয়া হয়।’ তখন তাঁকে পুরোপুরি স্বাভাবিকই লেগেছিল। রাতে রুমে ঢোকার পরে আর কেউ কি এসেছিল? সিসি ক্যামেরা এখনও বসানো হয়নি। ফলে জানবার উপায় নেই। বয়দের কাছে খবর নেয়ার সুযোগ এখনও পাননি। তবে একই ফ্লোরে যেহেতু উনিও আছেন, তাই হলফ করে বলা সম্ভব না যে উনি রাতে তাঁর রুমে যাননি।
রিসেপশানিস্ট জোর দিয়েই বলছে, বাইরের কেউ আসেনি। ছেলেটা নতুন, তাই চোখ এখনও তৈরি হয়নি। হোটেলের বোর্ডার আর বাইরের কাউকে এক নজরে আলাদা করতে পারার কথা না। তারপরও লাশের চেহারা দেখে তাঁর মনে হয়েছে, কিছু একটা ঘাপলা আছে। বিষ খাওয়ানোর সম্ভাবনাটাই ঘুরে ফিরে মাথায় আসছে। আর আসছে উনার নাম। মেঝেতে পড়ে ছিল, চোখ দুটো বিস্ফোরিত।
— দৈনিক সচিত্র সময়ের সম্পাদক ইনাম খানকে নাকি আপনার হোটেলের একটি রুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে?
দেখা গেল জনৈক মহিলা টিভি সাংবাদিক মাইক হাতে তাঁর কাছে পৌঁছে গেছেন। এই চ্যানেলে সম্ভবতঃ লাইভ দেখানো শুরু করে দিয়েছে। আটকাতে হয়তো পারবেন না, জাস্ট একটু দেরি করানো গেলে, অন্ততঃ পুলিশ ঘটনাস্থলের দ্বায়িত্ব নিয়ে ফেললে তিনি আর টেনশান করতেন না।
পরিস্থিতি সম্ভবতঃ আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না। নিচে হই হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে। ইদ্রিস সাহেব সব দ্বিধা ঝেড়ে এসপি সাহেবকে ফোন করলেন। তিনবার রিং বাজবার পরেই উনি ধরলেন। কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বললেন
— খবর পেয়েছি।
— কখন আসবেন স্যার?
— আই অ্যাম অন দ্যা ওয়ে। স্পটে যেন কেউ না যেতে পারে।
— জ্বি স্যার। রুম লক রেখেছি। বাট মিডিয়া আর উৎসাহী জনতা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি।
— ফোর্স কম ছিল, অন্য থানা থেকে ডাকতে হয়েছে, তাই একটু দেরি হচ্ছে। রওয়ানা হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের ভেতরই পৌঁছে যাবে।
টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার মেয়েটি তখনও উত্তরের আশায় তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন। ইদ্রিস সাহেব অভিজ্ঞ লোক। এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে মাথা ঠাণ্ডা রাখা আর খুব হিসেব করে, সাবধানী শব্দ চয়নে কথা বলা। অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলে করজোড় করে যতটা সম্ভব অমায়িক গলায় জানালেন
— একটু অপেক্ষা করুন। হোটেলের তরফ থেকে একটা প্রেস কনফারেন্স করা হবে। অ্যান্ড প্লিজ, এখনই লাইফ টেলিকাস্ট করবেন না। পুলিশ আসছে, তদন্তে অসুবিধা হতে পারে।
অনুরোধ এবং অমায়িক ব্যাবহার দুটোই বুমেরাং করল। সাংবাদিক মহিলা বুঝে গেলেন, তাঁর লাইভ টেলিকাস্ট কাজে দিয়েছে। ম্যানেজার সাহেব চ্যানেলকে মনে রেখেছেন। ব্রেকিং নিউজ হিসেবে তাঁর চ্যানেলেই প্রথম স্ক্রল যায়। ঘটনাটা যে লাইভ দেখাবার মত, এটা বুঝে সে ইতিমধ্যে লাইভ টেলিকাস্ট সুরুক ওরে দিয়েছে।
এই মুহূর্তে উনি আরও একটি হট টপিকের সন্ধান করছেন। একটা উড়ো খবর পেয়েছেন। সেটা যদি সত্যি হয়, তবে আগামী কয়েকদিনের জন্য ঘটনাটা লিড নিউজ হতে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে পাওয়া খবরটার সত্যতা তাঁরা নিশ্চিত করতে পারেনি। খবরটার অথেনটিসিটি যেমন জানা দরকার, তেমনি আবার জরুরী খবরটা লুকিয়ে রাখাও। অন্ততঃ একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নেয়ার আগে খবরটা জানাজানি হলে খবরটা ব্রেক করার দারুণ একটা অপারচুনিটি মিস হয়ে যাবে। সাংবাদিক মহিলাটি মাইক হাতে ইদ্রিস সাহেবের পিছু নিলেন।
— স্যার, আর একটা শুধু প্রশ্ন। ইনাম খানের প্রথম স্ত্রী, বিতর্কিত লেখিকা, রেহানা ইয়াসমিনও নাকি এই মুহূর্তে নাকি আপনার হোটেলে অবস্থান করছেন?



— আমরা কি উনার জন্য চলে যাচ্ছি?
স্যুটকেস গুছাতে গুছাতে উত্তর দিলেন রেহানা
— অনেকটা
ঈশিতার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। প্রায় পঁচিশ বছর প্রবাসে নির্বাসিত থাকবার পরে, অতি সম্প্রীতি রেহানা ইয়াসমিন আর তাঁর মেয়ে ঈশিতা ইয়াসমিন দেশে ফেরার অনুমুতি পেয়েছেন। মেয়েকে বাংলাদেশ ঘুরাতেই কক্সবাজারে আসা। মিডিয়া যেভাবে পেছনে লেগেছিল, তাতে লুকিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। রেহানা নিজে মিডিয়া পছন্দ করলেও, মেয়েটাকে এর বাইরেই রাখতে চান। পতর পত্রিকায় তাঁর যত ছবি তার বেশিরভাগই পুরনো। সেখানে তাঁর ছিপছিপে ফিগার, লম্বা কালো চুল। ফলে সাম্প্রতিক হেয়ারস্টাইল পাল্টানোতে অনেকেই তাঁকে প্রথম দেখায় চিনতে পারছেন না। ব্যাপারটা বেশ কাজে দিয়েছে। আসোবার সময় প্লেনে তাঁকে কেউই চেনেনই। বোরখা বা তেমন কিছু না পড়েই কক্সবাজারে ঘুরে বেড়াতে সমস্যা হচ্ছে না।
প্রথম দুদিন ভালোই কাটল। ঈশিতার ভেতর এই মুহূর্তে অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস কাজ করছে। যা দেখছে, তা ই ‘দারুণ' বলে উচ্ছ্বসিত হচ্ছে। প্রথমবারের মত দেশে ফেরা কিংবা প্রথমবারের মত দেশকে দেখতে পারাটাই হয়তো কারণ। মেয়ের এই উচ্ছ্বাস দেখে খানিকটা বিরক্ত লাগলেও, বারণ করছেন না। গতকাল ইনানি বিচে মা মেয়ে অনেকক্ষণ হেঁটেছেন। স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। কবে প্রথমবারের মত কক্সবাজার এসেছিলেন। মেডিকেল কলেজের সেই স্টাডি ট্যুরের স্মৃতি।
হঠাৎ করেই যেন সব এলোমেলো হয়ে গেল। আজ সকালে খবরটা জানবার পর প্রথমটায় তিনি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যান। সকালের দিকে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ফিরে আসোবার সময় দেখেন উৎসুক জনতার ভিড়। দুএকজনের গলায় ঝোলানো মিডিয়ার আইডি কার্ড দেখে বুঝতে বাকি ছিল না, ঘটনা গুরুতর।
এক মুহূর্তের জন্য ভেবেছিলেন, বোধহয় তাঁর জন্য এসেছে। কিছুক্ষণের ভেতরেই বুঝতে পারলেন, ঘটনা অন্য কিছু। হোটেল রুমে এক ভদ্রলোককে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। মার্ডার, সুইসাইড, না স্বাভাবিক মৃত্যু, এনিয়েই সবাই চিন্তিত। নিশ্চয়ই নামীদামী কেউ, নইলে এই ঘটনা এতোটা মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার কথা না। বিস্তারিত জানবার আকাঙ্ক্ষা থেকে উনি ভিড়ের ভেতরে কিছুক্ষণ মিশে থাকলেন। আলাপ আলোচনা যা কানে আসল, তা থেকে কিছুক্ষণের ভেতরেই বুঝে গেলেন পুরো ব্যাপারটা। মৃত ব্যক্তিটি আর কেউ নন, তাঁর দ্বিতীয় স্বামী, ইনাম খান।
— তুমি কি পালাতে চাইছ?
— ঠিক পালাতে না, এড়াতে চাইছি।
— কি?
— এখন যা ঘটবে সেসব।
— অন্য কোন হোটেলে যেতে পারি না?
রেহানা বুঝলেন, ব্যাপারটাকে ঈশিতা পুরনো ঘটনার সাথে মেশাচ্ছে। ঈশিতাকে ঠিক দোষ দেয়া যায় না। নিজের স্মৃতিকথাতে তিনি তাঁর প্রাক্তন স্বামীদের যে চিত্র এঁকেছেন, তাতে এমন ধারণা করাটাই স্বাভাবিক। ও হয়তো ভাবছে স্বামীগুলোকে তিনি প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। ভাবছে, ইনামের কাছ থেকে দূরে সরে যেতেই রেহানা কক্সবাজার ছাড়ছে।
তিনি আসলে এমন কিছুই চাইছেন না। তিনি ভাল করেই জানেন মিডিয়া তাঁর পিছু ছাড়বে না। তিনি শুধু চাইছেন, ঈশিতাকে এসবের বাইরে রাখতে। এখানে সেটা সম্ভব না। ঢাকায় একবার পৌঁছে গেলে, মিডিয়ার পুরো অ্যাট্রাকশানটা থাকবে তাঁর দিকে। তাই এখানে তিনি মিডিয়ার মুখোমুখি হতে চাইছেন না।
— শোন, যদি ব্যাপারটা লিক হয় যে আমরাও এই হোটেলে আছি, তাহলে ব্যাপারটার একটা অন্য মিনিং দাঁড়াবে।
— তো? একটা রিউমারের ভয়ে আমরা পালাব?
— আমরা পালাচ্ছি না, আমি শুধু চাইছি, এসব ব্যাপারে তুমি যেন না জড়াও।
— জড়িয়ে তো গেছিই।
— তা গেছ, বাট কিছুটা সময় পার হলে ব্যাপারটা থেকে তুমি বেরিয়েও যাবে। মিডিয়া তখন আমাকে নিয়ে পড়বে। আমি শুধু সেই সময়টা চাইছি।
এমন সময় দরজায় নক হল। রেহানা আর ঈশিতা পরস্পরের দিকে তাকালেন। রেহানার চোখে কিছুটা ভীতি। ভাবছেন, বোধহয় দেরি করে ফেললেন। ইশারায় ঈশিতাকে শান্ত থাকতে বলে উনি ধীর ধীরে উঠলেন। দরজা খুলে বেশ বড় রকমের একটা হোঁচট খেলেন। অপরিচিত এক ভদ্রলোক দরজায় দাঁড়িয়ে। পেছনে আরেকজন ভদ্রলোক। দরজা খুলতে সামনের জন নিজের পরিচয় দিলেন
— আমি ইশতিয়াক আহমেদ, এসপি, কক্সবাজার।
পুলিশের সম্মুখীন এর আগেও হয়েছে রেহানা, তবে সেসবের কারণ তাঁর জানা ছিল। এবারের কারণ ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না। একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল, আর তা হচ্ছে, তাঁর অবস্থান সম্পর্কে পুলিশ অবগত। যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকবার চেষ্টা করে রেহানা উত্তর দিলেন
— বলুন।
— খবরটা তো শুনেছেন।
— জ্বি
— এই ব্যাপারে আমাদের কিছু প্রশ্ন ছিল।
এবার রেহানা অবাক হল। ইনামের কক্সবাজার আসা সম্পর্কে তিনি তেমন কিছুই জানেন না। তাঁকে কেন ইন্টারোগেট করা হচ্ছে? প্রাক্তন স্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানা যেতে পারে, তবে সেটা তো মিডিয়ার কাজ। হতভম্ব ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলেন। পিছিয়ে এসে তাঁদের ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দিলেন
— আসুন।
— থ্যাংকস। জাস্ট দুএকটা কথা জানবার ছিল।
— বলুন
— আপনার সাথে ইনাম সাহেবের শেষ কখন কথা হয়েছে?
— ঢাকায়। ইনফ্যাক্ট আমি আজকেই জানলাম ও, মানে উনি এই হোটেলেই উঠেছিলেন।
— আই সি। আপনি যে এখানে এসেছেন, ব্যাপারটা কি উনি জানতেন?
— হ্যাঁ।
— বলতে চাইছেন, উনি এখানে এসছেন অথচ আপনার সাথে দেখা করেননি?
— ইয়েস। আমরা, মানে আমি আর আমার মেয়ে গতকাল বাইরে বাইরেই ছিলাম। রাতে বাইরে খেয়েছি। রুমে ফিরে এতোটাই টায়ার্ড ছিলাম টিভি দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টেরই পাইনি।
— আই সি।
এসপি ইমতিয়াজ সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে রুমের চারদিকে একবার নজর বোলালেন। স্যুটকেস যে প্যাক করা হয়ে গেছে, ব্যাপারটা তাঁর নজরে এড়াল না। স্যুটকেসের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি জানতে চাইলেন
— আপনি কি চেক আউট করার কথা ভাবছেন?
— হ্যাঁ। এনি প্রবলেম?
— ঠিক প্রবলেম না, আই মিন বুঝতেই তো পারছেন ব্যাপারটা তো বেশ সেনসেটিভ। কোন ফাউল প্লের পসিবিলিটি এখনও আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না।
— মানে?
— মানে উনি খুন হয়েছেন না জাস্ট ন্যাচারাল ডেথ এটা সিওর না হওয়া পর্যন্ত…
— আমাদের এরেস্ট করছেন?
— না না এরেস্টের প্রশ্ন আসছে না। জাস্ট বলছি, আপনি আর কটা দিন এখানে থাকুন।
— কটা দিন মানে?
— জাস্ট আজকে আর কালকে। কমও হতে পারে। আসলে ওপরে জানিয়েছি, যা নির্দেশ আসে।
বেশ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাপারটায় সম্মতি জানায় রেহানা। এরপরে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে একটা ফ্যাকাসে হাসি দেয়। বলতে চায়, ‘সরি, তোমাকে এসবের বাইরে রাখতে পারলাম না।’



যতটা সমস্যা হবে ভাবা হয়েছিল, কাহিনী তার চেয়েও বেশি ঘোলাটে হওয়ার লক্ষণ দেখা দিল। সম্প্রতি সম্পাদক সাহেব তার পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বিরোধী দলের একজন পলাতক শীর্ষ নেতার সাথে সখ্যের খবরও শোনা যাচ্ছিল। ফলে এটা হত্যা না স্বাভাবিক মৃত্যু, তা নিয়ে বেশ দ্রুতই মিডিয়া ইনভেস্টিগেশান শুরু হয়ে গেল। কখন তাঁকে শেষ দেখা গেছে, কার সাথে দেখা গেছে এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে পুলিশের বেশ বিপর্যস্থ অবস্থা।
ওদিকে তাঁর প্রাক্তন স্ত্রীকে একই হোটেলে পাওয়া যাওয়াতে কাহিনীতে খানিকটা আদি রসাত্মক মোড় চলে আসে। স্ক্যান্ডালের একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়ায় মিডিয়াও ব্যাপারটায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সম্পাদক সাহেবের বর্তমান স্ত্রী তাঁর দুই পুত্রসহ বর্তমানে পাকাপাকিভাবেই কানাডায় অবস্থান করছেন। তাঁদের দুই পুত্রও সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বেশ কিছুদিন যাবত সম্পাদক সাহেব একাকী থাকতেন। মাঝে মাঝে কানাডা গিয়ে দেখা করে আসতেন। ফলে নিঃসঙ্গ সম্পাদকের সঙ্গে প্রাক্তন স্ত্রীর প্রণয়ের একটা গল্প পাকিয়ে ওঠার একটা সমূহ সম্ভাবনা সবাই দেখতে পাচ্ছেন।
রেহানা ইয়াসমিনকে পুলিশ আপাততঃ শহর ছাড়তে দেয়নি। লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পোস্ট মরটেম এখানে করবে, না ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হবে, তা নিয়ে শলা পরামর্শ চলছে। এমন হাই প্রোফাইল কেসের ময়না তদন্ত করতে কর্তব্যরত ডাক্তার সাহেব কিছুটা গড়িমসি করছেন। একে তো তাঁর ফরেনসিকের ওপর ডিগ্রি নাই, তার ওপরে রয়েছে দক্ষ ডোমের সমস্যা। ভিসেরা ঠিকমত প্রিজার্ভ করা না গেলে পরে সমস্যা হতে পারে।
বিরোধী দল ইতিমধ্যে সরকারের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করে ফেলেছে। সরকারও বেশ সতর্ক। কোন সন্দেহের অবকাশ রাখতে চাইছে না। প্রতিটা পদক্ষেপ বেশ চিন্তা ভাবনা করেই ফেলা হচ্ছে।
ইদ্রিস সাহেবের আপাততঃ দ্বায়িত্ব হচ্ছে রেহানা এবং তার কন্যাকে চোখে চোখে রাখা। রুমের বাইরে একজন কনস্টেবল বসানো হয়েছে। মিডিয়াকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া হচ্ছে না। এর সঙ্গে নিজ উদ্যোগে তিনি আরেকটা কাজ করছেন। তা হচ্ছে বয় মারফত তাঁদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। খাবার দিতে যাওয়ার সময় তাঁরা তীক্ষ্ণ নজর রাখছে ঘরের প্রতিটি জিনিসের ওপর। তাঁদের কাছে ফোন আসছে কি না, আসলে কার কাছ থেকে, এসব কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইছেন ইদ্রিস সাহেব।
পুলিশও অনুসন্ধানে লেগে পড়েছে। কোথায় কোথায় গিয়েছেন তার লিস্ট তাঁরা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন। এখন তার সত্যতা যাচাই চলছে। কোন সাক্ষী আছে কি না, যারা তাঁদের সেখানে দেখেছেন। মোবাইল ফোন চেক করা হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরির ছবি পাওয়া গেছে। কললিস্টেও তেমন কোন সন্দেহজনক ফোনের লক্ষণ মেলেনি। সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে উনার ফোনে শেষ কোথা হয় তিনদিন আগে। সেসময়ে তিনি ঢাকায় ছিলেন।
সব মিলিয়ে মৃত্যুর সাথে রেহানার তেমন কোন সংশ্রব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মৃত্যুটা স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। কিন্তু মিডিয়া চাইছে অন্য কিছু হোক। মার্ডার না হলেও অন্ততঃ একটা স্ক্যান্ডাল হলেও তাঁদের চলবে। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই চেষ্টা হচ্ছে, উনাদের একসাথে দেখা গেছে এমন কোন উইটনেসের দেখা পাওয়া যায় কি না। প্রথমে হোটেলের অ্যাটেন্ডেন্টগুলো যার যতটুকু মনে ছিল, বেশ উৎসাহ নিয়েই বলেছে। কিন্তু কাহিনী যে এতো বিরক্তিকর বাঁক নেবে তা কেউই বুঝতে পারেনি। ইন্টারভিউ দিতে দিতে সকল আটেন্ডেন্ট আর রেসেপশানিশটের অবস্থা এখন 'ছেড়ে দে মা' টাইপ।
আজকে যেকোন সময়েই পোস্ট মরটেমের প্রাথমিক রিপোর্ট চলে আসবে। সেখানে খুনের কোন আলামত না পাওয়া গেলে সম্ভবতঃ রেহানাকে আর আটকে রাখা হবে না।
রেহানা ইয়াসমিনের জন্য না হলেও তাঁর মেয়েটার জন্য খারপ লাগছে ইদ্রিস সাহেবের। নিজের যৌবনে বেশ অনেক স্ক্যান্ডালের জন্ম দিয়েছিলেন রেহানা। কবি এবং কলামিস্ট হিসেবে বেশ নাম হয়েছিল। তবে বেশি আলোচনায় ছিলেন তাঁর উৎশৃঙ্খল জীবন যাপনের জন্য। একই সঙ্গে কয়েকজন পুরুষের সাথে সম্পর্ক, অবশেষে জনৈক বিখ্যাত কবির সাথে প্রেম এবং বিয়ে, সেই সময়ে বেশ আলোচিত হয়েছিল। ছয়মাসের বেশি সে বিয়ে টিকেনি। এরপরে বিয়ে হয় সম্পাদক ইনাম খানের সাথে। এই সম্পর্কও চলে বছর খানেক।
নারীবাদী লেখালেখি করে জনপ্রিয়তাও যেমন পেয়েছিলেন, তেমনি বিতর্কিতও হয়েছিলেন। আসলে যে সময় তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন, তখন এতো কড়া ভাষায় লেখালেখির চল ছিল না। ধর্মকে সরাসরি আক্রমণের সাহস তেমন খুব একটা দেখা যেত না। দুএকজন পুরুষ নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা দিয়ে বক্তব্য দিলেও নারীদের ভেতর তেমন কাউকে এতোটা সাহসিকতা দেখাতে দেখা যায়নি। তাঁর লেখালেখির শুরুটা কবিতা দিয়ে হলেও, দ্রুতই তিনি কলামিস্ট হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আর তাঁকে জনপ্রিয় করতে মুখ্য ভূমিকা রাখে সাপ্তাহিক সচিত্র সময় এবং সম্পাদক ইনাম খান।
এরপরে একসময় মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকির মুখে তিনি দেশ ছাড়েন। প্রায় পঁচিশ বছর প্রবাসে নির্বাসিত থাকবার পরে, সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে আসেন। তাঁর ওপর ঘোষিত হুমকি যদিও এখনও অব্যাহত আছে, তারপরও তিনি ফিরেছেন কিংবা ফেরার সাহস দেখিয়েছেন। ধারণা করা হয়, মৌলবাদী গোষ্ঠীর সাথে একটা আপস রফা হয়েছে। তিনি আপাততঃ বিতর্কিত তেমন কিছু লিখবেন না, বিনিময়ে তাঁর কোন ক্ষতি মৌলবাদীরা করবে না।
সম্পাদক সাহেবের মৃত্যুর পরে, সম্পাদক সাহেবের সাথে সাথে তাঁর পুরনো জীবনও স্ক্যানারের নিচে চলে আসে। তাঁকে নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলো পত্রিকার পাতায় পুনরায় আসতে শুরু করেছে। যদিও এসব গল্পের অনেক কিছুই রেহানা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তারপরও গল্পগুলো নতুনভাবে উত্থাপিত হতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে সহানুভূতি যেহেতু ইনাম সাহেবের দিকে, তাই আত্মজীবনীতে দেয়া রেহানার নেগেটিভ বয়ানকে কমবেশি সবাই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
আত্মজীবনীতে ছিল রেহানার নিজস্ব বয়ান। জীবিত থাকতে ইনাম সাহেব এর প্রতিবাদও যেমন করেননি, তেমনি স্বীকারও করেননি। ফলে সত্য কিম তা নিয়ে সবারই একটা নিজস্ব মতামত তৈরি হয়ে আছে। কেউ রেহানার পক্ষে, কেউ আবার বিপক্ষে। কেউ মনে করে, রেহানা যা বলেছে তা সম্পূর্ণ সত্য আর কারো মতে বই বিক্রির জন্য কাহিনী ফেঁদেছে।
ব্যাপারটা নিয়ে বিতর্ক প্রায় থেমেই গিয়েছিলে, তবে সাম্প্রতিক মৃত্যু ঘটনায় নতুন মোড় এনে দেয়। আত্মজীবনীতে তিনি তাঁর জীবনে আসা সকল পুরুষকেই কমবেশি খল চরিত্র হিসেবে চিত্রায়িত করেছিলেন। বেশ কিছু স্পর্শকাতর বিষয়কে সর্বসম্মুখে এনেছিলেন। এতে সেই চরিত্রগুলো সামাজিকভাবে অসম্মানিত হলেও তাঁর বইগুলোর কাটতি বেড়ে গিয়েছিল। এবার আসতে শুরু করল সেসব ঘটনা সম্পর্কে ইনাম সাহেব এবং রেহানার পরিচিতজনদের জবানী। কিন্তু এবার উল্টোটা ঘটতে থাকল। বিভিন্ন ঘটনার যেসব অংশ তিনি সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছিলেন সেসব বের হয়ে আসতে লাগল।
রেহানা যদিও মিডিয়া কিংবা স্ক্যান্ডাল অপছন্দ করেন না, তারপরও বেশ কিছু ব্যাপার সম্ভবত তিনি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তার একটি ছিল তাঁর মেয়ের পিতৃত্বের ব্যাপারটার পুনরুত্থান। কে তাঁর মেয়ের পিতা, এনিয়ে যে ইনাম সাহেব সন্দেহ করেছিলেন, তা তাঁর আত্মজীবনীতে আছে। তবে সত্যি সত্যিই কে তাঁর পিতা তা নিয়ে কখনই তিনি মুখ্য খোলেননি। তাঁর আত্মজীবনী অনুসারে তিনি যখন অন্তঃসত্ত্বা, তখন এই সন্তানের পিতৃত্ব নিয়েই সম্পাদক সাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি নয়। সম্পাদক ইনাম সাহেব চেয়েছিলেন বাচ্চাটিকে নষ্ট করে দিতে। রেহানা ব্যাপারটায় রাজি হননি। বরং তিনি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসেন। বইটি প্রকাশের পরে, বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শী জানায়, সম্পাদক সাহেবের সাথে সংসার করা কালীন তিনি নাকি তাঁর প্রথম স্বামীর সাথেও সম্পর্ক রেখেছিলেন। তাঁদের একসঙ্গে ঘুরতেও দেখা গেছে।

ঠিক একই সময় তাঁর ওপর মৌলবাদী হুমকি আসায় তিনি দেশ ছাড়েন। রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অনেক দেশই রাজি ছিল। বিভিন্ন দেশে ঘুরে অবশেষে তিনি ইউরোপে স্থায়ী হন। মাঝে মাঝে ভারতে আসলেও বাংলাদেশে আসোবার চেষ্টা তিনি করেননি। অন্য সব ব্যপারে কড়া জবাব দিলেও মেয়ের পিতৃত্ব নিয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি। ফলে ব্যাপারটা নিয়ে ঔৎসুক্য থাকলেও তথ্যের অভাবে গল্পটা আর জমে ওঠেনি। এই মৃত্যু সেই পুরনো গল্পকে নতুন করে দিল। মিডিয়া আবার জানতে উৎসাহী হয়ে উঠেছে, কে ঈশিতার পিতা।
এই মুহূর্তে ইদ্রিস সাহেবের প্রথম কাজ রেহানা ইয়াসমিনের ওপর নজর রাখা হলেও মুখ্য আরকটি কাজ হচ্ছে মিডিয়াকে তাঁর কাছে যেতে না দেয়া। কাজটায় তাঁকে বিশেষ বেগ পেটে হয়নি, কারণ গতকাল থেকে তিনি রুমের বাইরে বেরোননি। খাবারও রুমে আনিয়ে নিয়েছেন। সম্ভবতঃ অপেক্ষায় আছেন, কখন তাঁকে ঢাকা যাওয়ার অনুমুতি দেয়া হবে।


সবচেয়ে বিরক্তিকর সময় কাটছে ঈশিতার। যদিও তার বের হওয়ার ক্ষেত্রে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই, তারপরও সে বের হচ্ছে না। মা কে সঙ্গ দেয়া কিংবা একাকী বের না হওয়ার ইচ্ছা, যে কারণেই হোক, সে ও রুমে নিজেকে অন্তরীন রেখেছে। টেলিভিশানের দৌরাত্ম্যে রেহানা আর ইনাম খানের প্রণয় এবং বিয়ের যাবতীয় তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ সে গতকাল সারাটা দিন ধরে দেখেছে। মা ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেও কিছু বলেননি। কবে, কোথায় রেহানা আর ইনাম খানের প্রথম দেখা, কিভাবে ইনাম খানের অনুরোধে কলাম লেখার শুরু, এসব তথ্যের প্রায় পুরোটাই রেহানার আত্মজীবনীতে রয়েছে। আর তাই এসবের কোন কিছুই ঈশিতার অজানা না। টিভি দেখতে দেখতে ঈশিতা আবিষ্কার করল, তাঁর এই জানাটা ছিল একতরফা। যা জেনেছিল তার বেশিরভাগটাই সে বিশ্বাস করেছিল। হয়তো এখনও করে, তবে গল্পের অন্য পক্ষের বক্তব্যটাও মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছে না।
ইনাম সাহেবের মৃত্যুর রেশ ধরে চলে আসছে মায়ের প্রথম স্বামী কবি ইলিয়াসের প্রসঙ্গ। কবি ইলিয়াসের সাথে মায়ের প্রেম কিংবা বিয়ে নিয়েও বেশ গল্প চলছে। চলছে সাক্ষাতকার। কবির বন্ধুদের বেশিরভাগই মাকে দায়ী করছেন কবি ইলিয়াসেরর অকালমৃত্যুর জন্য। ভদ্রলোক যদিও হার্ট অ্যাটাকে মারা যান, তার পরেও কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়নকে। সম্ভাবনা জানানো হচ্ছে, মায়ের সাথে বিচ্ছেদটা না হলে হয়তো তিনি আরও অনেক দিন বাঁচতেন।
কবিতা, কলামের পাশাপাশি রেহানা একটা উপন্যাসও লেখেন। ঈশিতাকে গর্ভে ধারণ এবং তার পিতৃত্ব নিয়ে ইনাম সাহেবের মনে জাগা সংশয় ছিল উপন্যাসের উপজীব্য। ইনাম সাহেবের মৃত্যুতে সেই উপন্যাস নিয়ে বিভিন্নভাবে আলোচনা শুরু হয়েছে। নারীবাদীরা রেহানার পক্ষ নিয়েছেন। পিতৃত্ব প্রশ্নে স্বামীদের অহেতুক সন্দেহ নিয়ে চলছে বেশ তিক্ত বিতর্ক। সন্দেহ দেখা দিলে প্যাটার্নিটি টেস্ট করা কতোটা যৌক্তিক তা নিয়ে শুরু হয়ে গেছে বচসা।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে এসব দেখছিল ঈশিতা আর রেহানা। ইনাম সাহেব কেন কক্সবাজারে এসেছিলেন, এই প্রশ্নে দেখা গেল বেশ কিছু মিডিয়া সরগরম। আকারে ইঙ্গিতে তাঁরা বলতে চাইছেন, কে ঈশিতার বাবা, তা জানতেই ইনাম সাহেব কক্সবাজারে এসেছিলেন। গোপনে হয়তো তাঁদের সাক্ষাতও হয়েছে। হয়তো তিনি এমন কিছু বলেছেন যার ধকল সামলাতে না পেরে, ইনাম সাহেব হার্ট অ্যাটাক করেন। কমবেশি সব চ্যানেলেই এখন একটা প্রশ্ন উঠছে, কে ঈশিতার বাবা? আর কেনই বা এই তথ্য রেহানা প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ঈশিতা আর টিভি ছাড়েনি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখছিল। একসময় অনুভব করল মা পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিছু কি বলতে চান মা? নাকি কেবল সঙ্গ দিতে এসেছেন। ধীরে ধীরে মায়ের দিকে তাকাল ঈশিতা। তেমন কোন ভাবলেশ নেই। মনের ভেতরে কি চলছে বোঝা যাচ্ছে না। ঈশিতা যতদূর জানে, ইনাম সাহেবের সাথে তাঁর যোগাযোগ বরাবরই ছিল। ডিভোর্সের পরে কিছুদিন কথা বন্ধ থাকলেও একসময় ইনাম সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পারেন। ক্ষমা চান। ফিরে যেতে অনুরোধ করেন মাকে। কিন্তু মা রাজী হননি। তখন অবশ্য মোস্তফা চলে এসেছেন মায়ের জীবনে। উনার সাথে কিংবা পরের দুজন স্বামীর সাথেও তাঁর সম্পর্ক খুব বেশিদিন সম্পর্ক টেকেনি। তবে ইনাম সাহেবের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে এরপরে আর ফাটল ধরেনি।
— কিছু কি বলবি?
মা কি তাঁর মনের কথা ধরতে পারছেন? কাল সারাদিন ধরে তাঁর নিজের পিতৃত্ব নিয়ে এতো কথা, এতোভাবে শুনেছে যে একবারের জন্য ভেবেছিল, মা কে জিজ্ঞেস করে, কে আমার বাবা? জানাটা খুব জরুরী না, জাস্ট মিলিয়ে দেখা, ওর গেসটা ঠিক হয়েছে কি না। কিংবা উল্টোভাবেও বলা যায় গেস করতে আর ইচ্ছে করছে না। মা তাঁকে যেভাবে মানুষ করেছেন, তাতে সন্তান উৎপাদন নিয়ে তাঁর ভেতরেও সো কলড নৈতিকতা ব্যাপারটা কাজ করে না। একে তো বিদেশে থেকে মানুষ হয়েছে, তার ওপর মায়ের শিক্ষার কারণে, তার কাছে সন্তান হওয়া একটা জৈবিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছু না।
এসব নিয়ে মাকে কিছু না বলার সিদ্ধান্ত নিল। মায়ের প্রশ্নের উত্তরে ঈশিতা শুধু বলল
— কবে যেতে দেবে কিছু বলেছে?
— যা জানতে ইচ্ছে করছে, সেটা বলছিস না কেন?
ঈশিতা বুঝতে পারে, মা তাঁকে লক্ষ্য করেছেন। কোন কোন চ্যানেলে, কি কি অনুষ্ঠান দেখেছে, তা বেশ ভালভাবেই লক্ষ্য করেছেন মা। তার মনে যে প্রশ্ন জেগেছে, ব্যাপারটা মা ভালোই ধরতে পেরেছেন। নিজের অনুমানটা যে মাকে বলতে সংকোচ বোধ করছে, এই ব্যাপারটা আঁচ করতে সমস্যা হওয়ার কথা না। একবার ভাবল, সত্যটা বলেই ফেলে। জিজ্ঞেস করে মনটাকে হালকা করে। কিন্তু পারছে না। মা কি ভাববে এই প্রশ্নের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে নিজের হিপোক্র্যাসি। মুখ্যে নারী স্বাধীনতার বড় বড় কথা বললেও নিজের পিতৃ পরিচয় জানতে কেন মন আকুল হচ্ছে। কেবল মায়ের পরিচয়ে কেন নিজেকে পরিচিত রাখতে পারছে না।
— আচ্ছা মা, ইনাম সাহেবের সাথে তোমার সম্পর্কটা কেমন ছিল?
— স্মৃতি কথা পড়ে তোর কি মনে হয়েছে?
— মনে হয়েছে প্রেম ছিল, বাট অসম। উনি তোমাকে যতটা ভালবাসতেন, তুমি তার চেয়ে অনেক কম বাসতে।
— তা ঠিক। সম্পর্কটা যতটা না প্রেমের ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল কৃতজ্ঞতার। কিংবা বলা যায় প্রেমের চেষ্টা করার।
এমন সময় দরজায় নক হল।
(চলবে)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:০৯

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: কল্পনা খালি মিলা মিলা যায় ;) :P

হা হা হা

চলুক

১২ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৫৪

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: শেষটাও দিলাম

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.