নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১
আমি চিকিৎসক। অর্থপেডিক বিশেষজ্ঞ। মানে হাড় হাড্ডি ভাঙ্গাভাঙ্গি নিয়ে কাজ। কোথাও কোন অ্যাকসিডেন্ট হওয়া মানেই আমার ঘরে লক্ষ্মীর আগমন। খুব বিজি না হলেও যশ খারাপ না। কমবেশি প্রতিদিনই তিনচারটা ওটি থাকে। এছাড়াও প্লাস্টার ফ্লাশটার তো আছেই। এই ফিল্ডে যেসব নতুন ধরনের অপারেশারন শুরু হয়েছে সেসবের ওপর কিছু ট্রেনিং নেয়া আছে। সো যারা জানে আমি এসব কাজ পারি, তাঁরা প্রায়ই রুগী পাঠান।
সেদিন বিকেল পাঁচটার দিকে নিজস্ব চেম্বারে ছিলাম এমন সময় ফোনটা আসল। এসময় সাধারনতঃ ফোন ধরি না। রুগীরাও যেমন ডিস্টার্ব হয়, আমার নিজেরও বিরক্ত লাগে। এছাড়াও আরেকটা সমস্যা ইদানীং শুরু হয়েছে। চাঁদা। কয়েকবার চাঁদার জন্য ফোন পাওয়ার পর থেকে অপরিচিত নম্বর থেকে আসা ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছি। এই ফোনটাও ধরতাম না, কয়েকবার উপর্যুপরি ফোন আসবার পরে কেন যেন ফোনটা ধরলাম।
— ডাঃ আশরাফ বলছেন?
বেশ রাশভারী কণ্ঠস্বর, তবে ভদ্রস্থ আওয়াজ। চাঁদা পার্টি মনে হচ্ছে না। মনে হল দ্বায়িত্বশীল কেউ। রুগীর সিরিয়াল নেয়ার জন্য মাঝে মাঝে অনেকে আমাকেই ফোন করে। এদের এই জ্ঞান নাই যে ডাক্তার সাহেব নিজের সিরিয়াল নিজে নেন না। তবে এই ফোনটা সে টাইপ মনে হল না। যদিও নিজস্ব নম্বর কোন রুগীকেই কখনো দিই না, তারপরেও কেমন করে যেন জোগাড় করে ফেলে। মাজাহে মাঝেই অদ্ভুত সব অনুরোধ, 'পায়খানা হচ্ছে না, কি খাব?’
যাইহোক, এই ফোনটার উত্তর দেয়া দরকার। বললাম
—বলছি। আপনি?
— আমি গাজীপুর থানার ওসি বলছি।
সেরেছে। ভুল চিকিৎসা মার্কা কেস নাকি? এই এক নতুন সমস্যা হয়েছে। কোথাও কোন রুগী মরল, আর কেউ উস্কানি দিল, চিকিৎসা ঠিক হয়নি, অমনি সাংবাদিক ডেকে টেকে বিচ্ছিরি অবস্থা করে ফেলবে। কিন্তু গাজীপুর থেকে কেন? ওদিকে তো আমি যাই না। এক সময় যেতাম, তা ও গাজীপুর ছেড়ে আরও কিছুদূর গিয়ে মাওনা নামের একটা জায়গায়। সেটাও তো ছেড়েছি আজ বছর পাঁচেক হল। দূর, এতো স্পেকুলেশান কেন করছি।
— বলুন।
— মৌসুমি নামে কাউকে চেনেন?
চিনব না মানে, আমার একমাত্র স্ত্রী। বাট মৌসুমির ব্যাপারে পুলিশ কেন ফোন করবে? কিছু করেছে নাকি? গাড়ি আমাদের একটা, সেটা আমার কাছেই থাকে। ওকে সকালে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আসি। ফেরাটা নিজে ফেরে। রিক্সায়। স্কুলে, মানে একটা কিন্ডার গার্ডেনে টিচার। কিন্তু কি করেছে?
আচ্ছা, অন্য কোন মৌসুমি না তো? কিন্তু তার জন্য আমাকে তো ফোন করার কথা না। মৌসুমিই হবে। সন্দেহটা একটু দূর করা দরকার। জিজ্ঞেস করলাম
— মৌসুমি? কোন মৌসুমি একটু পরিষ্কার করে বলবেন?
— দেখুন কোন মৌসুমি তা তো বলতে পারব না, বাট উনার পুরো নাম বলতে পারব, মৌসুমি হায়দার। আর উনার ব্যাগে আপনার ভিজিটিং কার্ড ছিল যেখান থেকে আপনার নম্বরটা পেয়ে ফোনটা করলাম।
— দেখুন, আমার স্ত্রীর নাম মৌসুমি হায়দার। বাট ওর হ্যান্ডব্যাগ গাজীপুরে গেল কি করে? ও তো সকালেই ওর বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিল, খিলগাঁয়। আপনাদের কি কোথাও ভুল হচ্ছে?
— মে বি পরে উনারা এদিকে কোথাও এসেছিলেন।
— হতে পারে, বাট… এনিওয়ে কি হয়েছ, ছিনতাই টাইপ কিছু?
— জ্বি না। ব্যাগটা উনার সাথেই ছিল। আসলে গাজীপুরের কাছে একটা বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। একজন ভদ্রমহিলা সেই বাসে ছিলেন। উনার ভ্যানিটি ব্যাগে উনার একটা আইডি কার্ড পাওয়া গেছে। এক সানফ্লাওয়ার কিন্ডার গার্ডেনের। টিচারের আইডি সম্ভবতঃ। সেখান থেকে জানতে পারি উনার নাম মৌসুমি হায়দার।
— আই ডি কার্ডের ছবির সাথে চেহারা মিলছে? আই মিন, এমনও তো হতে পারে ব্যাগটা কেউ ছিনতাই করে।
— যদিও বেশ ইনজিওরড, বাট চেহারা চেনা যাচ্ছে অ্যান্ড আই থিংক আই ডি কার্ডে যার ছবি, ইনিই সেই মহিলা।
এবার বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। সকালে বেরোবার সময় বলল বান্ধবীর বাসায় সারাদিন থাকবে। পুরনো বান্ধবী অনেকদিন পরে দেশে ফিরেছেন। আজ সেজন্য স্কুল ছুটি নিয়েছে। একসঙ্গে হয়তো ঘুরতে বেরিয়েছিল। হঠাৎ মনে সবচেয়ে বাজে চিন্তাটা আসল
— ইজ শী অ্যালাইভ? মানে…
— জ্বি, অ্যালাইভ। ডাক্তার বলছেন ইনজুরি সম্ভবতঃ খুব গুরুতর না, তবে সিটি স্ক্যান না করে সিওর করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
নিজের অজান্তেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল।
— ওর সাথে কথা হতে পারে?
— উনি আনকনসাস।
মাই গড। তাহলে আর গুরুতর না বলে কি করে? কোথায় আছে? ডিউটি ডক্টরের সাথে একটু কথা বলতে পারলে ভাল হত।
— আই সি। আচ্ছা একটা রিকুয়েস্ট। ভিজিটিং কার্ড দেখে তো বুঝতেই পারছেন, আমি ডাক্তার। আমি কি ডিউটি ডক্টরের সাথে একটু কথা বলতে পারি?
— উনি মনে হয় না এখন কথা বলতে পারবেন। দুটো গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ, বেশ অনেক ইনজিওরড। হাসপাতালের অবস্থা বেশ ভয়াবহ। এখনও আহত লোক আসছেই। আপনি কি একটু আসতে পারবেন?
— অবশ্যই। আমি এক্ষুনি আসছি। গাজীপুর জেনারেল হাসপাতাল, তাই তো?
২
ভয়াবহ বলতে যা বোঝায়, পরিস্থিতি তার চেয়েও বেশি ভয়াবহ। জনা পঞ্চাশেক আহত। মৃত নিয়ে রিউমার চলছে, কারো মতে বিশ কারো মতে বেশি। হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা রুগীতে সয়লাব। সাথে তো আত্মীয়স্বজন রয়েছেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে মিডিয়া। টিভি দেখি না, তাই জানতে পারিনি। বেশ কয়েকটা চ্যানেল রীতিমত ঘণ্টায় ঘণ্টায় রিপোর্ট দিচ্ছে। হাসপাতালে ক্রন্দনরত আত্মীয়স্বজনের ছবি প্রায় সব চ্যানেলেই দেখা যাচ্ছে।
আসলে মিডিয়া ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। রুগীর যন্ত্রণা লাইভ দেখাবে, না হাসপাতালের ভেতরে বিচ্ছিরি অবস্থা দেখাবে। যেখানেই ডাক্তার দেখছে, হামলে পড়ছে, ‘কতজন আহত?’ কিংবা হতাহতের কোন সঠিক সংখ্যা?' ডাক্তার, নার্স তেমন কিছু বলছে না দেখে তাঁরা এখন হাসপাতালের দুর্দশার চিত্র দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনেক কষ্টে পৌছালাম। এরকম পরিস্থিতিতে সবচেয়ে সমস্যা করে উৎসাহী জনতা। আমি যখন পৌছালাম ততোক্ষণে এলাকায় বেশ অনেক পুলিশ অবস্থান করছে। উৎসাহী জনতা বেশ অনেকটাই সরিয়ে দিতে পেরেছে পুলিশ। এখন যারা আছেন তাঁরা আহত কিংবা নিহতদের আত্মীয়স্বজন। প্রায় সবারই রিলেটিভ সম্ভবতঃ এসে পড়েছে। একটা দুটো ছাড়া প্রায় সব আহতের পাশেই কেউ না কেউ আছে। আহতদের সবাইকেও সম্ভবতঃ নিয়ে আসা হয়ে গেছে। অকুস্থলে এখন আর কেউ নেই। সবাই এখানে না। প্রথম দিকে সবাইকেই এখানে আনা শুরু হয়। পরে যখন দেখা গেল স্থান সংকুলান হবে না, তখন জেলার সিভিল সার্জন ঊর্ধ্বতন মহলের সাথে কথা বলে। এরপরে সরকারের তরফ থেকে নির্দেশনা আসায় বেশ কয়েকজনকে কাছের এক বেসরকারি ক্লিনিকে নেয়া হয়েছে।
গাজীপুরের সিভিল সার্জন সাহেব বেশ দ্রুতই পদক্ষেপ নিয়েছেন। পর্যাপ্ত ওষুধের ব্যবস্থা করেছেন। আশেপাশের হেলথ কমপ্লেক্স থেকে ডাক্তার ডেকে পাঠিয়েছেন। সব অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালে রেখেছেন। গুরুতর আহতদের কয়েকজনকে ইতিমধ্যে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। অ্যাকসিডেন্টে পরে একটা হাসপাতালের পরিস্থিতি কেমন হয়, ডাক্তার হিসেবে আমার তা জানা আছে। তাই মাথায় একটা চিন্তাই কাজ করছে, দ্রুত মৌসুমিকে এখান থেকে সরাতে হবে।
গাজীপুরে পরিচিত যে কজন আছে, প্রায় সবাইকেই ফোন করে হাসপাতালে আসতে বলেছি। সিভিল সার্জনকে কাউকে দিয়ে ফোন করাবার কথা একবার মাথায় এসেছিল, পরে তা বাদ দিলাম। গাড়ি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে দ্রুত একটা এসি এ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে গাজীপুরে রওয়ানা দিই। জ্যাম আর পুলিশ ব্যারিকেড পার হয়ে কিছুক্ষণ আগে এসে পৌছালাম। বন্ধুবান্ধবদের সাথে নিয়ে অনেক কষ্টে ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। মহিলা ওয়ার্ডের অবস্থা বেজায় করুণ। পা ফেলার জায়গা নাই। সব আহতের আত্মীয় স্বজনরা সম্ভবতঃ পৌঁছে গেছেন। আমিই শেষে এসেছি। দ্রুত চোখে মৌসুমিকে খুঁজছি।
এখানে পৌঁছেই সেই ওসি সাহেবকে ফোন করেছিলাম। উনি বাসায় চলে গেছেন। অন্যজন এখন ডিউটিতে। বেড নম্বর কিংবা কোন বেডের পাশের ফ্লোরে আছে, সেসব কিছু বলতে পারলেন না। তবে একটা আন্দাজ দিলেন, বাম দিকে তিনটা বেড পরে, ফ্লোরে আছে। সেখানে পেলাম না। সম্ভবতঃ সিফট করেছে। আমার পরিচয় পাওয়ার পরে হয়তো কর্তৃপক্ষ অন কোথাও শিফট করেছে। ওয়ার্ডের দ্বায়িত্বে থাকা নার্সের টেবিলের কাছে বিশাল জটলা। উনিও মনে হয় না কিছু বলার মত অবস্থায় আছেন, তারপরও ট্রাই করতে এগলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে যদি কোন লাভ হয়। কোন আটেন্ডেন্ট নেই, এমন রুগীগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে এগোচ্ছিলাম। প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। আর মাত্র দু তিনটে সারি। এমন সময় চোখে পড়ল। ঐ তো মৌসুমি। বিছানায় দেয়া হয়েছে।
চোখ মুখ ফুলে থাকলেও চেহারা বোঝা যাচ্ছে। দ্রুত মৌসুমির কাছে পৌছালাম। স্বভাবের কারণেই হোক আর ভীতির কারণেই হোক, প্রথমেই পালস দেখলাম। ঠিক আছে। নিঃশ্বাসও খারাপ চলছে না। মাথায় হাত বুলিয়ে একটা আন্দাজ করে নিলাম, ফ্র্যাকচার নেই। ডান হাতের শেপ দেখে মনে হচ্ছে ফ্র্যাকচার হয়েছে। সমস্যা নেই, ওটার ব্যাবস্থা করা যাবে। এবার সাহায্যের জন্য জন্য নার্সের কাছে গেলাম। ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে টেবিলে পৌঁছে নিজের পরিচয় দিলাম
— সিস্টার, আমি ডাঃ আশরাফ হায়দার।
৩
বেশ অনেক ঝক্কি ঝামেলা পেরিয়ে অবশেষে মৌসুমিকে ওখানে থেকে উদ্ধার করলাম। অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা দিলাম। পথে মৌসুমির জ্ঞান ফিরল। ব্যাথায় কাতরাচ্ছিল দেখে ব্যাথার ইঞ্জেকশান দিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে রিল্যাক্স করতে বললাম। একবার আমার দিকে তাকাল। দৃষ্টিটা খারাপ লাগল না। মনে হচ্ছে বুঝতে পারছে। চিনতে পারছে আমাকে। প্রাথমিকভাবে ব্রেন ইনজুরি হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। তারপরও রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না। ক্লিনিকে পৌঁছেই পুরো চেকাআপ করে ফেলতে হবে।
মনে হল কিছু বলতে চায়। কান মুখের কাছে নিয়ে জানতে চাইলাম
— কিছু বলবে?
ফিসফিস করে কিছু একটা বলল, কিছুই বুঝলাম না।
আন্দাজেই ধরে নিলাম হয়তো জানতে চাইছে ও এখন কোথায়? উত্তর দিলাম
— কোন চিন্তা কর না। আমরা এখন ঢাকায় যাচ্ছি, আর কিছুক্ষণের ভেতরেই ঢাকায় পৌঁছে যাব
মাথা নেড়ে অসন্তুষ্টি জানাল। অন্য কিছু বলতে চায়। মনে হল নিজের ব্যাগের কথা হয়তো বলছে। আশ্বস্ত করলাম
— তোমার ব্যাগ নিয়ে এসেছি। আমার কাছেই আছে।
এবারও মনে হল হালকা মাথা নাড়ল। অন্য কিছু বলতে চাইছে। বাচ্চাদের কথা? হবে হয়তো। কিন্তু এখন ওকে রিলাক্স করা দরকার। বাট হেড ইনজুরি সিওর না হয়ে সিডেটিভ দিতে সাহস পাচ্ছি না। রাস্তায় জ্যাম নেহাত কম না। মনে হচ্ছে ঘণ্টা দুয়েক আরও লাগবে। এসি অ্যাম্বুলেন্স বলে রক্ষা। আমার ডাক্তারি চোখ তখন কেবল ভাইটাল সাইন দেখছে। নিঃশ্বাস ঠিক আছে কি না, পালস কেমন।
যত সময় যাচ্ছে মৌসুমির অস্থিরতা বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। আর আমি সেটা বুঝতে পারছি না বলে আরও অস্থির হচ্ছে। ঠিক করলাম আওয়াজ না শুনে ওর ঠোঁট পড়ার চেষ্টা করব। কান ওর ঠোঁটের কাছে না নিয়ে ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
এবার অনেক স্পষ্টভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে। প্রাণপণ শক্তিতে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। পারছে না। আর না পারাতে আরও অস্থির হচ্ছে। কার কথা জানতে চাইছে? ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম
— বাচ্চারা ভাল আছে।
চোখ বন্ধ করে ফেলল। আবার শক্তি জোগাড়ের চেষ্টা করছে। যা বলতে চাইছে না বলা পর্যন্ত ও স্থির হবে না। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম
— জোর দিয়ে কথা বলার দরকার নেই। কেবল ঠোঁট নাড়াও। আমি বুঝে নিব।
মৌসুমি সেটাই করল। প্রথমবার কিছু বুঝলাম না। বললাম আবার বল। এবার মনে হল শেষ শব্দটা বুঝতে পারছি। শেষে বলছে ‘কোথায়।' সেটাকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম
— কে কোথায়? বাচ্চারা?
মনে হল মাথা নেড়ে না বলছে। হঠাৎ ব্যাপারটা মাথায় আসল। সাথে কি আর কেউ ছিল? জিজ্ঞেস করলাম
— আর কেউ ছিল তোমার সাথে?
মনে হল মাথা নেড়ে সম্মতি জানাচ্ছে। তাই তো, ব্যাপারটা আমার আগে মাথায় আসা উচিত ছিল। খিলগাঁয়ে বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিল। এরপরে গাজীপুরে। ওখানে তো একা যাওয়ার কথা না। সাথে নিশ্চয়ই কেউ ছিল। সেই বান্ধবী? নামও তো জানি না। ওর কথাই কি জিজ্ঞেস করছে? জিজ্ঞেস করলাম
— তোমার সেই বান্ধবী?
বললাম বটে, বাট এখন আর ফিরে গিয়ে ওর খবর নেয়া সম্ভব না। গাজীপুরের আশেপাশে পরিচিত যে বন্ধুরা এসেছিল, তাদেরকেই ফোন করে বলতে হবে। বাট কার কোথা বলব? কাকে খুঁজবে? নামটা জানা দরকার। এবার ওর মুখের কাছে আবার কান নিয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম
— কে কোথায়? কে ছিল তোমার সাথে।
যতটা সম্ভব শক্তি জড় করে কোনরকমে মৌসুমি বলল
— ফরহাদ ভাই কোথায়?
৪
মৌসুমির শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি অল্পের ওপর দিয়েই গেছে। ডান হাতটাই শুধু ফ্র্যাকচার হয়েছে। ব্রেনের সিটি স্ক্যান দেখে ডাক্তার অনেকটাই নিশ্চিত যে ব্রেন ইনজুরি হয়নি। শরীরের বাকী ইনজুরি সারতে সময় লাগলেও খুব ভয়ের কিছু নেই। আপাততঃ দিন পনের হয়তো হাসপাতালে থাকতে হবে। শরীরের ছড়ে যাওয়া অংশগুলো রিপেয়ার হতে শুরু করেছে। হাতে আপাততঃ প্লাস্টার করা হয়েছে। ভাল মত সেট হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। না হলে পরে হয়তো অপারেশান লাগবে। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে মেডিকেল দিক থেকে অনেকটাই নিশ্চিন্ত।
মৌসুমির মানসিক অবস্থা ঠিক বুঝতে পারছি না। কথাবার্তা বিশেষ বলছে না। প্রথমদিন অনেক কষ্ট করে সেই ফরহাদ ভাইয়ের খোঁজ করেছিল। এরপরে আর তেমন কথা বলেনি। বলেনি ঠিক না, বলতে পারেনি। ব্যাথার জন্য প্রায়ই পেইনকিলার দিতে হয়েছে। সাথে ঘুমের ওষুধও। দুতিনদিন স্যালাইনের ওপর রাখা হয়েছিল, এরপরে মুখে খেতে দিয়েছে। খাওয়া বাসা থেকেই আসছে।
খবর শুনে মৌসুমির মা রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন। ঢাকায় আমার তেমন কোন আত্মীয় স্বজন নেই। ফলে আমার শাশুড়িই সংসার দেখছেন। হাসপাতালে মৌসুমিকে আটেন্ড করবার মত কেউ নেই, ফলে আমাকেই বেশিরভাগ সময় থাকতে হচ্ছে। মৌসুমির মা ও হেল্প করছেন। দুজনে পালা করে ডিউটি দিচ্ছি। অফিস থেকে আপাততঃ ছুটি নিয়েছি। চেম্বারও বন্ধ। এভাবেই আরও দিন পাঁচেক চালাতে হবে মনে হচ্ছে। বাচ্চাদের বেশি আসতে দিচ্ছি না।
কিছুক্ষণ আগে আমি এসেছি। শাশুড়ি ফিরে গেলেন। মৌসুমি ঘুমাচ্ছিল। কাজ নেই দেখে টেলিভিশন দেখছিলাম। মৌসুমির আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরে পেলাম। ঘুম থেকে উঠেছে। কিছু একটা বলেছিল, লক্ষ্য করতে পারিনি। তাই সোফা থেকে উঠে ওর কাছে গেলাম
— কিছু বলছ?
— ফরহাদ ভাইয়ের আর কোন খোঁজ পেলে?
আজ অ্যাকসিডেন্টের দশম দিন। এই কদিন ফরহাদ ভাই সম্পর্কে জানতে চায়নি মৌসুমি। হয়তো আশা করেছিল, আগের অনুরোধের কারণেই আমি খোঁজ নিব আর নিজে থেকেই তথ্যটা জানাব। ভদ্রলোক কে তা পুরোপুরি জানি না। আসলে জানতে চাইনি। হয়তো স্কুলের কলিগ হবে কিংবা পরিচিত কেউ। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাসে ছিল কি না। উত্তরে মৌসুমি বলেছে হ্যাঁ। কি সম্পর্ক, কেন, কোথায় যাচ্ছিল এসব যদিও জানতে ইচ্ছে করছে কিন্তু প্রশ্নগুলো করিনি। অপেক্ষা করে আছি একটু সুস্থ হলে, মৌসুমি হয়তো নিজেই বলবে।
ইতিমধ্যে সেই ফরহাদ ভাইকে খোঁজার চেষ্টা একেবারে করিনি, তা না। পরিচিত এক বন্ধুকে সেদিনই অনুরোধ করি হাসপাতালে গিয়ে খবর নিতে। সে ওখানে গিয়ে খোঁজ নেয়। ঐ নামে কাউকে পায়নি। মৃতদের সবার নাম জানা যায়নি। আহতদের অনেককেই ভর্তি রাখা হয়েছিল নাম ছাড়া। তাঁদের অনেকেরই তখনও জ্ঞান ফেরেনি। রিসেন্টলি অবশ্য আর খোঁজ নেয়া হয়নি।
ফরহাদ ভাইয়ের যে কোন খোঁজ পাইনি, তথ্যটা মৌসুমিকে পরের দিনই জানিয়েছিলাম। এর মধ্যে মৌসুমিও আর জিজ্ঞেস করেনি। হয়তো জানবার আর ইচ্ছে ছিল না,কিংবা হয়তো ভেবেছিল আমি নিজে থেকেই বলব। আরেকবার কি খোঁজ নিব? আমার নেয়া উচিত ছিল, বাট এতো দৌড় ঝাঁপের ভেতরে ঠিক মনে ছিল না। আজকে মৌসুমির মুখে আবার নামটা শুনে মনে খটকা লাগল। ফরহাদ লোকটা কে, এই প্রশ্ন এবার ঘুরপাক খাওয়ার চেষ্টা শুরু করছে। পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করছি। পরিচিত কেউ হবে ভেবেই মন থেকে সরাবার চেষ্টা করছি। একটু সুস্থ হলে সব জিজ্ঞেস করা যাবে।
— খোঁজ নেয়ার কোন উপায় নেই?
— উনার মোবাইল নম্বর আছে?
— আমার মোবাইলে সেফ করা ছিল।
— তোমার মোবাইল তো খুঁজে পাওয়া যায়নি। নতুন সেট কিনেছি, আর আজকে নতুন সিমও তুলেছি।
এই বলে মোবাইলটা বিছানার ওপরে রাখলাম। মৌসুমি মোবাইলটা দেখল, কিছু বলল না। এরপরে আবার চোখ বন্ধ করল। আমার নিজেরও কিছুটা অস্বস্তি লাগছিল। কেবিনের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে সেই পরিচিত বন্ধুটিকে আবার ফোন করলাম। আরেকবার ওখানে যাওয়ার অনুরোধ করলাম। লোকটার কোন ছবি আছে কি না জানতে চাইল। জানালাম নেই। বয়স কিংবা পুরো নামও বলতে পারলাম না। জানল, সে আবার হাসপাতালে গিয়ে খবর নেবে।
কথা শেষ করে আবার কেবিন রুমে প্রবেশ করলাম। জানালাম একজনকে খবর নিতে বলেছি। আরও বললাম, পুরো নাম আর ছবি পেলে সুবিধা হত। মৌসুমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠল। আমি ধরব কি না ভাবছি এমন সময় ও নিজেই ফোনটা ধরল।
৫
কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না। যদিও এই প্রসঙ্গে আরও পরে কথা বলব ভেবেছিলাম, বাট ফোনটা এসে সব এলোমেলো করে দিল। একটু আগে যে ফোনটা এসেছিল, ওটা ছিল ফরহাদ ভাইয়ের। তাঁর সাথে হওয়া দীর্ঘ কথোপকথন থেকে জানা গেল অ্যাকসিডেন্টে উনি তেমন একটা ইনজিওরড হননি। এদিক ওদিক একটু ছড়ে গিয়েছিল এই যা। একটু সুস্থ হতেই তিনি মৌসুমির খোঁজ করেছিলেন। তখন জানতে পারেন আমি মৌসুমিকে নিয়ে চলে এসেছি। এরপরে উনি মৌসুমিকে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ফোন বন্ধ পান। অবশেষে আজকে মৌসুমিকে রিচ করতে পারেন।
এবার মৌসুমি বিস্তারিত বলতে শুরু করল ফরহাদ ভাইটা কে? সোজা বাংলায় ফরহাদ ভাই আমার স্ত্রীর বর্তমান প্রেমিক। ঠিক বর্তমান বললে ভুল বলা হবে, প্রাক্তন এবং বর্তমান। একসময় প্রেম ছিল। এরপরে ভদ্রলোক বিদেশ চলে যান। স্কলারশিপ পেয়ে। যোগাযোগ রাখেননি। এই অবস্থায় মৌসুমির সাথে আমার পরিচয় এবং প্রেম হয়। সেই প্রেমের পরিণতি হিসেবে বিয়ে এবং দুই সন্তান। অতি সম্প্রতি সেই ফরহাদ ভাই ফিরে এসেছেন। ক্ষমা টমা চেয়ে মৌসুমির মনও গলিয়ে ফেলেছেন। আমার ব্যস্ত জীবনের কারণে একাকী হয়ে যাওয়া মৌসুমি জীবনে পুনরায় ফিরে আসে ফরহাদ ভাই।
মৌসুমির শারীরিক অবস্থার কারণেই হোক আর নিজে সবকিছু স্বীকার করার কারণেই হোক, যতোটা রেগে যাওয়া আমার উচিত ছিল, ততোটা রাগতে পারলাম না। মনের একটা অংশ বলছে, ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু সমাধানের একটা চেষ্টা করা উচিত। ও যেহেতু সবকিছু নিজে থেকই জানিয়েছে, এর মানে হচ্ছে ও হয়তো অনুতপ্ত। আর বল এখন আমার কোর্টে। আমি ক্ষমা করলেই হয়তো কাহিনীর ইতি ঘটবে। সব কিছু আমাকে বলে, এখন ও আমার কাছ থেকে একটা সমাধান চাইছে।
পুরো সমস্যায় যেহেতু আমার বেশ খানিকটা দোষ ছিল, নিজের পেশার ব্যাবসায়িক দিকের কারণে আমি যেহেতু ওকে সেভাবে সময় দিইনি, তাই ঠিক করলাম পুরনো সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করব। কাহিনীর এই পর্যন্ত মেনে নিতে আপত্তি করব না ঠিক করলাম। বরং নিজের কিছু ভুল শুধরে নিয়ে আরেকবার নতুন করে শুরু করার কথা ভাবলাম। ঠিক করলাম, সংসারের দিকে এখন থেকে আরও কিছুটা বেশি সময় দিব। নিজস্ব রুটিনের কিছু এদিক ওদিক করলে হয়তো পেরেও যাব।
সিদ্ধান্তটা বা সহজ করে বললে আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন কেমন হবে তা বলবার জন্য কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। এমন সময় মৌসুমি কথা বলে উঠল
— আই লাভ হিম
এবার সত্যি সত্যিই ধাক্কা খেলাম। মানে ব্যাপারটায় ও অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আর আমার কাছে সবকিছু স্বীকার করা মানে আমাকে সবকিছু জানানো? নিজের কানকে তখনও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বললাম
— কি বলছ এসব
এতক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল। এবার সরাসরি আমার দিকে তাকাল।
— সত্যি কথাটা বলছি।
— মানে? ডিভোর্স চাইছো?
— জানি না
— জানি না বললে তো হবে না, একটা সিদ্ধান্ত তো নিতে হবে
— পারছি না।
— পারছি না মানে? তোমার দুটো বাচ্চা আছে, স্বামী সংসার আছে এসব তোমার কাছে কিছু না?
— কিছু বলেই তো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না।
— মানে?
— ফরহাদ ভাইকেও ভুলতে পারছি না, নিজের সংসারকেও না।
— কি বলছ এসব? এভাবে হয় নাকি?
মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করলাম।
— দেখ, যা হয়েছে, হয়েছে। আমারও দোষ ছিল, তোমাকে যতোটা সময় আমার দেয়া উচিত ছিল, দিইনি। বাট এখন থেকে চেষ্টা করব। নিজের লাইফ স্টাইলে কিছুটা চেঞ্জ আনলেই পেরে যাব আই থিংক।
— তুমি ব্যাপারটা বুঝছ না।
— মানে?
— মানে আমার পক্ষে আর ফরহাদ ভাইকে ভোলা সম্ভব না।
এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না।
— ওকে। উনার কাছেই যাও। লিভ আস।
— সেটাও পারব না।
— মানে? এভাবে তো চলতে পারে না। আমার সাথে সংসার করবা আর আরেকজনের সাথে প্রেম।
মৌসুমি ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। ওর সেই দৃষ্টিতে কি যেন একটা ছিল। রাগ নেমে গেল। বরং ওর সরল স্বীকারোক্তির কারণে ওর ওপর কেমন মমতা জাগল। মনে হল ও আমার হেল্প চাইছে। এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। নিজেকে শান্ত করে ওকে বললাম
— দেখো, তোমাকে আমি জোর করছি না বাট এভাবে তো হয় না। ইউ হ্যাভ টু চুজ। টেক আ ডিসিশান। যদি মনে কর উনার কাছে ফিরে গেলেই তুমি সুখী হবে, দেন…
— সেটা মনে করলে তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলতাম
— তাহলে?
— জানিনা। কোন ডিসিশান নিতে পারছি না।
— কেন পারছ না?
— বিকজ আই লাভ বোথ অফ ইউ। ইকুয়ালি।
--শেষ
১৭ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১২:০৭
আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ
২| ১৭ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:৫৪
রানা আমান বলেছেন: অসাধারন।
১৭ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১২:০৮
আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী বলেছেন: ধন্যবাদ
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ৮:৩৭
মো: হাসানূর রহমান রিজভী বলেছেন: আপনাদের লেখা পড়লে নিজের লেখাকে ছাইপাঁশ মনে হয়।অসাধারন।