নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সপ্ন

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী

কিছুই না

আহমাদ যায়নুদ্দিন সানী › বিস্তারিত পোস্টঃ

হোমো এলিয়েন্স

১৯ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১২:০৭



‘তারপর’ রোগটা সম্ভবতঃ আবিরের মজ্জাগত। সবসময়েই এসব নিয়ে ভাবতো। মৃত্যুর পরে তো না হয় স্বর্গ কিংবা নরক। তারপর? কিংবা আজ হোক কাল হোক মঙ্গল গ্রহে তো নাহয় পৌছব। তারপর? এইমুহূর্তে ও যে রিসার্চ করছে তার পেছনেও আছে ওর এই ‘তারপর’ রোগ। ছাত্র খুব খারাপ ছিল না। তবে অতিরিক্ত প্রশ্নের অত্যাচারে সব শিক্ষকই তাকে বেশ এড়িয়ে চলত। ‘ক্লাসের পড়ায় মনোযোগ দাও’ টাইপ কিছু একটা বলে পাশ কাটাত। শিক্ষক সাহেব হয়তো বেঁচে যেতেন, কিন্তু আবির বাঁচত না। তার মাথায় সারাক্ষণ ঘুরত একটাই প্রশ্ন, ‘তারপর?’
এখন ও আছে ‘বাংলাদেশ জিন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’। বাংলাদেশের আর দশটা ইন্সটিটিউটের মতোই নাম কা ওয়াস্তে একটা ইন্সটিটিউট এটা। ইন্সটিটিউটে রিসার্চ করার তেমন কোন সাধন নেই। সরকারী টেন্ডারবাজীর বদৌলতে যা ইন্সট্রুমেন্ট আছে, তাও বেশির ভাগ অকেজো। রিসার্চ অফিসারের পোস্টও যেমন আছে তেমনি সেসব পদে রিসার্চ অফিসার হিসেবেও তেমনি অনেকেই কর্মরত আছে। বেশিরভাগ সময় আড্ডা আর মাঝে মাঝে কিছু আর্টিকেল লেখা ছাড়া বাকীরা তেমন কোন কাজ করে না।
এদের মাঝে আবির একটু আলাদা। রাজ্যের আর্টিকেল পড়ে পড়ে নিজে কিছু তাত্ত্বিক কাজ করে যাচ্ছে। বায়কেমিস্ট্রি থেকে পাশ করে জেনেটিক্সে পিএইচডি সেরে ফেলেছে। এখন সেই বিষয়ে কিছু রিসার্চ করার চেষ্টা করছে। বলা যায়, পুরো ইন্সটিটিউটে, কাজের মধ্যে আছে কেবল একজনই, আবির। আর ওর রিসার্চের বিষয়টাও হচ্ছে ‘তারপর’। ভূতটা ছোটবেলাতেই ঢুকেছে। সম্ভবতঃ এসএসসি কিংবা এইচএসসিতে। ডারউইনের হাইপোথিসিস পড়াবার সময়েই তার মনে প্রশ্ন জাগে, ইভোলিউশান কি শেষ? না চলছে? যদি চলে, তবে এর পরের ধাপে কি?

বিপাশার সাথে আবিরের প্রেমটা বেশ অনেক দিনের। টিপিক্যাল প্রেমিকের মত হাত ধরাধরি করে পার্কে বা বাগানে হাঁটাহাঁটি খুব একটা হয় না। বেশিরভাগ দিনই দেখা যায়, আবির এসে পৌঁছেনি। পাঁচটায় আসবার কথা, অথচ দেখা যাবে সাতটার সময়ও ওর পাত্তা নেই। ফোন করলে হয়তো দেখা যাবে, ফোন সাইলেন্ট মোডে কিংবা সুইচড অফ। ঝগড়া যে হয়নি, তেমনটা বলা যাবে না। তবে এনিয়ে বিপাশার সঙ্গে প্রেমে চিড় ধরেনি। অগাধ ধৈর্য নিয়ে বিপাশা এখনও প্রেমটা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন বরং সময়মত আসলেই বিপাশা অবাক হয়
--কোন সমস্যা?
--কেন?
--এইযে, সময়মত হাজির।
আবির হাসে। সত্যিই আজকে সময়মত হাজির হওয়ার একটা কারণ আছে। কাজে মন বসাতে পারছে না। আর কিছু জিন অ্যানালাইসিস বাকী। সেখানেও কিছু না পাওয়া গেলে এতোদিনের রিসার্চ মাটি। খুব আশা করেছিল আবির। কিছু একটা পাওয়া যাবেই। কিন্তু এখনও কোন সাফল্যের দেখা পায়নি।
--মন খারাপ?
বিপাশার এই ব্যাপারটা আবির খুব এঞ্জয় করে। খুব ভালো মন পড়ে ফেলে। ওর চেহারা দেখেই বুঝে ফেলে, ওর মনে কি চলছে। রিসার্চ যে আবিরের প্রাণ একথাও জানে বিপাশা। তাই রিসার্চের কারণে কখনও অভিমান করতে দেখা যায় না ওকে। অনেকদিন এমনও হয়েছে, দুঘণ্টা অপেক্ষা করে বিপাশা ফিরে গেছে। কিংবা যাওয়ার পথে আবিরের বাসায় গিয়ে দেখে বাসায় ফিরে আবির কম্পিউটারে বসে গেছে। প্রথম প্রথম রাগ করলেও এখন বিপাশা বুঝে গেছে, লাভ নেই। আবিরকে মেনে নিতে হলে ওকে ওর এই পাগলামি সহই মেনে নিতে হবে।
আবির যে ওর রিসার্চ নিয়ে চিন্তিত সেটা বিপাশাকে বলে দিতে হয় না। কি কারণে চিন্তিত, সেটা জানতে চেয়েও কোন লাভ নেই। সাইন্সের ছাত্রী হলেও জেনেটিক্স খুব ভাল বোঝে না। আর রিসার্চ লেভেলের কথা বার্তাও খুব ভালো বুঝবে না ভেবে, তেমন কিছু জানতে চায় না। তারপরও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে ফেলে
--রিসার্চে কিছু পেলে?
আবিরের ম্লান হাসি বলে দেয়, এখনও কিছু পায়নি। আজকে আর তেমন কোন প্রেমালাপ হবে না। আবির গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকবে আর বিপাশা পাশে বসে আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকবে। এক সময় আবিরের মনে হবে, বিপাশার সাথে কথা বলা উচিৎ। তখন জানতে চাইবে
--তারপর? তোমার কাজ কেমন চলছে?
--চলে যাচ্ছে।
--বাসায়?
--ঐ একই। এই পাগল ছেলের কোন ভবিষ্যৎ নেই।
--তুমি কি বলছো?
বিপাশা খানিকক্ষণ আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই নকল আবিরকে ওর ভালো লাগে না। নিজের রিসার্চ নিয়ে মগ্ন আবিরকেই ও ভালোবাসে।
--চলো ফেরা যাক।
--কেন? এখনই তো আসলাম।
--তোমার বাসায় চলো।
--কেন?
--তোমাকে এক কাপ চা করে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে।
 ৩
মিস্টার সরকার বেশ উত্তেজিত। আজকে মিস্টার ম্যালকম ফোন করেছিলেন। প্রথম দিকে বেশ মোলায়েম স্বরে কথা বললেও ইদানীং উনার আওয়াজ বেশ চড়ছে। সম্ভবতঃ বেশ অধৈর্য্য ফিল করতে শুরু করেছেন। আগেও তাগাদা দিতেন, তবে আজকে একেবারে অবাক করে দিয়েছেন। রীতিমত গালিগালাজ করেছেন। ‘অকর্মার ধাড়ি’ টাইপ। তিনি একেবারেই বুঝতে চাইছেন না যে মিস্টার সরকার তাঁর সাধ্যমত করছেন।
ঘটনার শুরু প্রায় বছর খানেক আগে। একটা ফোন আসল। একটা অ্যাসাইনমেন্ট। ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে। একজন সাইন্টিস্টের ল্যাপটপ থেকে কিছু ডাটা চুরি করতে হবে। চোর ছ্যাঁচড়ে ভরা এই দেশে তাঁর মত জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রাক্তন ছাত্রকে এমন একটা কাজের জন্য কেন পছন্দ করার অন্যতম কারণ বোধহয় ‘জিন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ অনেকের সাথে তাঁর পরিচয়। প্রথমে ব্যাপারটা তাঁর পছন্দ হয়নি। কাজটা করতে অস্বীকারও করেছিলেন মিস্টার সরকার। এরপর যখন টাকার অংকটা শুনলেন তখন আর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি।
তখন তিনি কারণটা বুঝতে পারেননি। তবে এখন সম্ভবতঃ খানিকটা বুঝতে পারছেন। সাইন্টিস্ট আবির এমন কিছু একটা আবিস্কার করতে চলেছেন, যা হবে যুগান্তকারী। নোবেল প্রাইজ তো পাবেননি, হয়তো সেই আবিস্কারের প্যাটেন্ট দিয়ে, চাইলে পৃথিবীটাও কিনে ফেলতে পারবেন। মিস্টার ম্যালকমের কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালা দেখে তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছেন, মিস্টার আবিরের আবিস্কার হাতে পেতে, হেন হীন কাজ নাই যা মিস্টার ম্যালকম করবেন না।
কাজটা পাওয়ার পরেই মিস্টার সরকার বেশ ভালভাবেই কাজ করছিলেন। প্ল্যান তৈরি করে ‘বাংলাদেশ জিন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ নিজের গোয়েন্দা সেট করে ফেলেন। আবির কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, কি পছন্দ করে সব তথ্য এখন তাঁর নখদর্পণে। আবির যে ফ্ল্যাটে থাকে সেখানে তিনটি রুম। গোয়েন্দা লাগিয়ে তার দুটো রুমে মিস্টার সরকার সিসি ক্যামেরা লাগাতে পেরেছেন। শুধু পারেননি একটি রুমে। সেটা আবিরের রিসার্চ রুম। আর সেটার দরজায় রয়েছে ফিঙ্গার প্রিন্ট লক। অফিসের নিজের রুমেও একই সিস্টেম।
ফলে গতকাল রাতে আবির কি খেয়েছে, সেটা মিস্টার সরকার জানলেও একটা জিনিস তিনি এখনও জানতে পারেননি, আর সেটা হচ্ছে আবিরের ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড। আবিরের ল্যাপটপটা চুরি করা তাঁর জন্য এমন কোন সমস্যা না, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পাসওয়ার্ড ছাড়া সেই ল্যাপটপ অকেজো। আবির এমন মেকানিজম করে রেখেছে যে তিনবারের বেশি কেউ ভুল পাসওয়ার্ড দিলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে হার্ডডিস্কের পুরো ডাটা ডিলিট হয়ে যাবে। আর তাই পাসওয়ার্ড পাওয়ার আগে চাইলেও মিস্টার সরকার ল্যাপটপ চুরি করতে পারছেন না। এখানেই তাঁর কাজ আঁটকে আছে। মিস্টার ম্যালকমকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেওছিল। কিন্তু অ্যাজ তিনি কোন কথাই শুনতে চাইলেন না। তাঁর এক কথা, আগামী এক সপ্তাহের ভেতরেই ল্যাপটপ আর পাসওয়ার্ড তাঁর চাই। ফোনটা আসবার পর থেকেই তিনি তাঁর সারাটা সময় একই কাজ করে যাচ্ছেন, পাসওয়ার্ড যোগাড়ের নতুন প্ল্যান তৈরি।
অ্যাসাইনমেন্ট শুরুর সময় যে কয়জনকে বিশ্বস্ত লোক নিয়ে তিনি টিম করেছিলেন, আজকে তাঁদের সবাইকেই ডেকেছেন। তাঁর হাতে সময় বিশেষ নেই। মিস্টার ম্যালকম, তাঁকে ছাড়াও আরও কিছু গোয়েন্দাকেও অ্যাপয়েন্ট করেছিলেন। আর সেখান থেকেই তিনি খবর পেয়েছেন, আবির হয় রিসার্চ শেষ করে ফেলেছে আর নয়তো শেষ পর্যায়ে আছে। আর সে তাঁর রিসার্চ, নোবেল কমিটির কাছে পাঠিয়ে দিলে, সব শেষ। তখন আর ল্যাপটপ চুরি করেও লাভ হবে না। আর সেক্ষেত্রে তাঁকে এবং তাঁর পুরো টিমকে এর খেসারত দিতে হবে। হয়তো জীবন দিয়ে। যে লোক একটি ল্যাপটপ চুরির জন্য কোটি কোটি টাকা ঢালতে পারেন, তাঁর পক্ষে তাঁর মত চুনোপুঁটিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া যে নস্যি, তা দুধের শিশুও বুঝবে।
সবাই এসে পড়েছে। মিস্টার ম্যালকমের দেয়া আজকের ডেডলাইন সবাইকে জানাতেই এই মিটিং। যাদের নিয়ে কাজ করছেন, সবাই এই কাজের গুরুত্ব জানেন। ফলে ভেঙ্গে বলার কিছু নেই। তিনি ঠিক করেছেন আজকের মিটিঙয়ে শুধু একটা কথাই বলবেন।
--নাও ওর নেভার।

--স্যার চা।
আবির বেশ মগ্ন হয়েই ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়েছিল। তাই লক্ষ্য করেনি কখন অরণী এসে তাঁর টেবিলের পাশে দাঁড়িয়েছে। ওর আওয়াজে ঘোর ভাঙল। আবির কিছুটা বিরক্তও হল। এভাবে নক না করে তাঁর ঘরে কেউ ঢুকুক, ব্যাপারটা তাঁর পছন্দ না। কিন্তু রূঢ় কথা বলা তাঁর স্বভাব না। তারপরও আজকে তাঁকে বলতে হবে। কি বলবে মনে মনে তা গুছাচ্ছিল এমন সময় অরণীই বলল
--অনেক বার ‘মে আই কাম ইন’ বলেছিলাম স্যার। আপনি কোন উত্তর দেননি। আর চাও ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, তাই...।
যুক্তিটা আবির মেনে নিল। হতেই পারে। আসলে রিসার্চ শেষ হতে আর হয়তো বেশীদিন বাকি নেই। ফলাফল কি হবে তা জানে না, তবে খুব রোমাঞ্চ ফিল করছে। আর সেকারণেই হয়তো খুব বেশি মগ্ন হয়ে থাকছে কাজে। ব্যাপারটা বিপাশাও লক্ষ্য করেছিল। স্বাভাবিক থাকবার হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও গতদিন নালিশ করছিল, ‘তুমি আজকাল খুবই আনমনা হয়ে থাকছো।‘
স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল। আসলে তাঁর রিসার্চ এখন এমন এক পর্যায়ে যে সে চাইলেও তাঁর মনোযোগ তাঁর অধীনে রাখতে পারবে না। এক বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল সে যেকোনো মুহূর্তে পেয়ে যাবে। ফলে সে চাইলেও অন্য কিছুর দিকে মন দিতে পারছে না। সারাটা ক্ষণ মাথার ভেতর ঘুরছে শুধু একটাই কথা, আর মাত্র শ’খানেক জিন বাকী।
--চা ঠিক আছে স্যার?
অরণী মেয়েটাকে সে আসলে বেশ পছন্দ করে। বেশ সপ্রতিভ। এতোটা বুদ্ধিমান সেক্রেটারি সচরাচর দেখা যায় না। কবে একদিন ‘এক কাপ চা খাওয়াতে পারবে?’ বলেছিল, সেটা আজও মনে রেখেছে। প্রতিদিন রুটিন করে দু’ঘন্টা পরপর চা নিয়ে এসে হাজির হয়। বোধহয় নিজেই বানায়। এক ধরনের আলাদা স্বাদ আছে ওর চা’য়ে। এছাড়াও আরও অনেক কারণ আছে ওকে পছন্দ করার। ছোট খাট কোন কাজ দিলে একদম ঠিকঠাক করে দেয়। ইন্টারনেট থেকে কিছু ডাউনলোড কিংবা কাউকে মেইল করা, একেবারে নির্ভুলভাবে করে দেয়। এখন তাই এসব কাজ অরণীর ওপরই সে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিয়েছে।
শুধু বিরক্তিকর লাগে ওর এই ঘুরঘুর করার স্বভাব। হয়তো তাঁর স্যারের জন্য অতিরিক্ত কিছু করতে চায়। হয়তো স্যারকে খুশী করে প্রমোশান বাগানোর ইচ্ছেও মনে থাকতে পারে। হয়তো... আরে এটা তো ভেবে দেখেনি। তাঁর রিসার্চ নিয়ে কি ওর কোন ইন্টেরেস্ট আছে? না, তা কি করে হয়। আবার ভাবে, কেনই বা হবে না। টাকা যেকোনো মানুষকে অন্যায় পথে নিয়ে যেতে পারে। যাক, এখন থেকে সতর্ক  হতে হবে। সিদ্ধান্ত নেয়, এখনও কিছু বলবে না। গম্ভীর হয়ে আবির জানতে চায়
--তোমাকে কিছু পেপার ডাউনলোড করতে দিয়েছিলাম।
--এই যে স্যার।
আবির অবাক হয়ে দেখে ল্যাপটপের ঠিক পাশেই কাগজগুলো রাখা আছে। সে নিজে এতোটাই মগ্ন হয়ে কাজ করছিল যে লক্ষ্যই করেনি কখন অরণী এসে টেবিলের ওপর কাগজগুলো রেখেছে। চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রেখে কাগজগুলো হাতে নিল। হলুদ মার্কার দিয়ে সুন্দর করে বিভিন্ন জায়গায় দাগ দেয়া। সেদিকে তাকিয়ে আবিরের ভ্রু কুঁচকে উঠল। এরপরে অবাক হয়ে অরণীর দিকে তাকাল। অরণী তখন দরজার কাছে চলে গিয়েছে।
--এগুলো কে মার্ক করেছে?
অরণী ঘুরে তাকাল। আবিরের হাতে কাগজগুলো দেখে বুঝতে পারল, আবির কি বলতে চাইছে। ধীরে ধীরে অরণী টেবিলের কাছে এগিয়ে আসে। মাথা নিচু করে কিছুটা ভীত স্বরে বলে
--আমি স্যার
আবির বুঝতে পারে, তাঁর কথায় অরণী নিজেকে অপরাধী ভাবছে। ব্যাপারটা ইজি করতে বলল
--আমি কমপ্লেইন করছি না, জানতে চাইছি শুধু।
--আমি ভাবলাম, আপনার জন্য হেল্পফুল হবে।
কাগজগুলোর দিকে আবার তাকিয়ে বেশ সম্মতি সুচক মাথা নেড়ে আবির বলল
--গুড জব।
--থ্যাংকস স্যার।
হঠাৎ প্রশ্নটা আবিরের মাথায় আসল। তাই তো? বেশ কিছুদিন ধরে তাঁকে ফলো করা হচ্ছে, সেটা সে বুঝতে পেরেছে। কে করছে বুঝতে না পারলেও কেন করছে, সেটা অনুমান করেছে। তাঁর রিসার্চের ফলাফল তাঁদের চাই। তবে আবির শুধু ভেবেছিল, তাঁকে কেবল বাইরের লোকেরাই ফলো করছে। একেবারও মাথায় আসেনি, ভেতরের কেউও তাঁকে ফলো করতে পারে।
অরণী কি ওদের কেউ হতে পারে? হয়তো না। তারপরও প্রশ্ন তো মনে জাগতেই পারে। কেবল ইন্টারমিডিয়েট পাশ একজন ছাত্রীর পক্ষে কি জেনেটিক্সের এসব কঠিন ব্যাপার বোঝা কি সম্ভব? যেভাবে মার্কিং করেছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সে বুঝেই মার্কিং করেছে। অরণী তখন আবার ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। তখন আবির জানতে চাইল
--তোমার পড়াশোনা কতদূর?

--তোমার কি হয়েছে?
--কি আবার হবে?
কথাটা বলেই আবির বুঝল, এধরনের হালকা উত্তরে হবে না। তাঁর আনমনা ভাব নিয়ে বিপাশা সাধারণতঃ নালিশ করে না। তবে আজকে বোধহয় ওর চেহারায় অন্য কিছু আছে। আবির তাই কিছুক্ষণ বিপাশার দিকে তাকিয়ে থাকল। বোঝার চেষ্টা করল, কি হয়েছে বা বিপাশা কি বলতে চাইছে। পুরোটা না বুঝলেও এটা বুঝল, বিপাশা বেশ সিরিয়াস। তাঁর আচরণে কিছু একটা সে পেয়েছে। তা না হলে কথা নেই বার্তা নেই দুম করে অফিসে এসে হাজির হত না। ইনফ্যাক্ট বিপাশা এর আগে কখনই অফিসে আসেনি। আজকেই প্রথম আসা, আর এসেই শুরু করল হুলস্থুল।
--একি অবস্থা করেছো ঘরের? এতো গুমোট কেন?
এরপরে এগিয়ে গিয়ে স্লাইডিং জানালার এক পাট খুলে দিল। এরপরে বাইরে মাথাটা বাড়িয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিল।
--কোনদিন এই জানালা খুলে দেখেছো?
আবির বিপাশাকে চেনে। রোম্যান্টিক মুডের চরমে আছে এখন ও। না থামালে হয়তো দেখা যাবে টেবিলে রাখা আবিরের কাগজপত্র নিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে বলছে, ‘এঞ্জয় দ্যা লাইফ’। আবির জানে, এই মুহূর্তে ওকে শান্ত করার একমাত্র উপায় ওকে নিয়ে কোথাও বেরোতে যাওয়া।
--কয়েকদিন ধরেই দেখছি, তুমি স্বাভাবিক না। আমার কোন কথা শুনছো না, আমার দিকে তাকাচ্ছ না।
আবিরের অফিসের সামনের ফাস্ট ফুডের দোকানে বসতে বসতে নালিশ করল বিপাশা।
--তাকাচ্ছি না কোথায়?
আবিরও শেষ একটা চেষ্টা করল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার।
--এই শাড়িটা তোমার কিনে দেয়া। আজকেই প্রথম পড়েছি। অথচ তোমার কোন রিয়াকশানই নেই। মনে হয় বুঝতেও পারনি যে এটা আজকেই প্রথম পড়লাম।
আবির হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বিপাশার গম্ভীর মুখ দেখে থেমে গেল। এবার সে নিজেও খানিকটা গম্ভীর হয়ে বলল
-- অনেস্টলি ইয়েস। আমি সত্যিই বেশ সমস্যায় আছি।
--কি সেটা?
--তুমি বুঝবে না।
--মাথায় ঘিলু নাই বলতে চাইছো?
--ঠিক তা না। আসলে প্রবলেম দু’টা। আমার রিসার্চের রেজাল্টের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি আমি। বলতে পারো একেবারে শেষ প্রান্তে। যেকোনো দিন হয়তো রেজাল্ট পেয়ে যাব। বাট...
--আর দ্বিতীয়টা?
--দ্বিতীয়টা আমার ধারণা আমাকে কেউ ফলো করছে। বাট, আমি ঠিক সিওর না।
--ফলো করছে?
--হ্যা। এটা আমার ইন্টিউশানও হতে, ভুলও হতে পারে।
-- দেন, তুমি পুলিশ প্রটেকশান চাইছ না কেন?
-- কি বলব পুলিশের কাছে?
-- যা সত্য তাই বলবে। তোমকে ফলো করা হচ্ছে।
আবিরের অফিসের সামনের যে ফাস্টফুডের দোকানে বসে বসে ওরা কথা বলছিল ঠিক তাঁর সামনেই রাস্তার ওপাশে একটা লোক ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পেপার পড়ছিল।
--আচ্ছা বল, ঐ লোকটা কেন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছে?
--আমি কিভাবে বলব?
--এডজ্যাক্টলি সেটাই। নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব না। হতে পারে সে আমাকে ফলো করেছে? অপেক্ষা করে আছে কখন আমরা বের হই। আবার হতে পারে সে আমাদের ফলো করছে না। সো, ফলো যে করছে, তার প্রমাণ কৈ?
--আই সি। তাহলে?
আবির এবার চিন্তিত হয়ে যায়। নতুন আরেকটা সম্ভাবনা তাঁর মাথায় আসে। ল্যাপটপে পাসওয়ার্ড থাকায়, ওরা হয়তো তাঁর ল্যাপটপের ডাটা চুরি করতে পারবে না, কিন্তু যদি...। সেটাই হবে। ওরা হয়তো এখন ওর উইক পয়েন্ট খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রিয়জন কাউকে কিডন্যাপ করে তাঁকে ব্ল্যাকমেইল করা। হতে পারে। হতে পারে না, এটাই ওদের প্ল্যান। বিপাশাকে কিডন্যাপ করা। আবির অস্থির হয়ে উঠল।
--গা ঢাকা দিতে হবে।
--মানে?
--মানে... হঠাৎ করে গায়েব হয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সে আমার এক বন্ধু আছে... ভাবছি ওকে সব বলব। ও বলেছিল, কখনও কোন সমস্যা হলে ওর সাথে দেখা করতে। ও নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাবস্থা করে দিতে পারবে।
--তাহলে তোমার সাথে দেখা করব কি করে?
--আপাততঃ দেখা হবে না।
--দেখা হবে না? মানে?
--আমার সাথে সম্পর্ক রাখা মানেই, তোমার লাইফ এন্ডেঞ্জার করা।
--আমি কিন্তু কিছুই বুঝছি না।
আবির বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে নেয়।
-- ডারউইনের নাম শুনেছো?
বিপাশা অবাক হয়ে আবিরের দিকে তাকায়।
--চার্লস ডারউইন?
--হ্যা।
-- শুনেছি। তোমার জন্য জিনের ওপর কিছু কিছু বই পড়েছি। উনিই তো অরিজিন অফ স্পেসিস লিখেছিলেন, তাই না?
--ইয়েস।
--সেই ডারউইন তোমার পিছে গোয়েন্দা লাগিয়েছে?

রাতের তিনটা হবে। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। আবিরের অফিস আজকে বন্ধ। মূল দরজার বাইরে কেবল একজন ওয়াচম্যান আছে। ইন্সটিটিউটের একটা ব্যাপার বেশ উন্নত। সিকিউরিটি। রিসার্চ অফিসারদের প্রত্যেকের রুমেই রয়েছে ফিঙ্গার প্রিন্ট লক। এছাড়া সিকিউরিটি অ্যালার্ম তো আছেই। দরজা দিয়ে কেউ ঢুকতে চাইলেই, অ্যালার্ম বেজে উঠবে। অফিসে আবিরের রুমে আছে দুটো জানালা। রুমে এসি থাকার কারণে দুটোই সবসময় বন্ধ থাকে। দুটো জানালাতেই থাই লাগানো স্লাইডিং ডোর।মেঝে থেকে তিন ফুট উচুতে বেশ চওড়া জানালা। খুব ধীরে কেউ একজন আবিরের সেই বন্ধ অফিসের জানালার স্লাইডিং ডোর ফাঁক করল। ছোট্ট একটা পিনহোল ক্যামেরা জানালার পর্দার সাথে লাগিয়ে দিল। এরপরে আবার স্লাইডিং ডোর টেনে জানালাটা লাগিয়ে দিল। জানালায় কোন অ্যালার্ম না থাকায় কোন অ্যালার্ম বাজলো না।

আবির আর বিপাশা পার্কে বসে আছে। সময়টা আবিরই ঠিক করেছে। সেই ডেকে পাঠিয়েছে বিপাশাকে। পার্কটা আবিরের বাসার কাছেই। বিকেল বেলা মোটামুটি ভালোই ভিড় হয়। বেশ অনেক জোড়া কপোত কপোতী এদিক ওদিক বসে আছে। বিপাশাও আজকে বেশ রোম্যান্টিক মুডে আছে। শুধু আবির বেশ গম্ভীর হয়ে আছে।
--কি ব্যাপার? জরুরী তলব?
--আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে তোমার বাবা মা র তো মত নেই, তাই না?
বিপাশা মিষ্টি করে হাসে।
--আই ডোন্ট কেয়ার।
--বাট আই ডু। আমার জন্য তোমার লাইফ রিস্ক আমি করতে পারব না।
--মানে?
-- মানে, তোমার বাবা মা কিন্তু একেবারে ভুল বলছেন না। বরং কম বলছেন। তুমি পানিতে পড়ছো না, আগুনে পড়ছো। আমাদের আলাদা হয়ে যেতে হবে।
এবার বিপাশা বেশ রেগে ওঠে।
-- এসব কি কথা?
কিন্তু আবিরের মুখ দেখে বিপাশা কেমন থমকে যায়। আবিরের মুখ এখন বেশ গম্ভীর। বিপাশা বুঝতে পারে, ঘটনা অন্য কিছু
--ওরা যদি বুঝতে পারে, তুমি আমার উইক পয়েন্ট, দেন তোমাকে কিডন্যাপ করে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবে।
বিপাশা ভয়ে শক্ত হয়ে যায়।
--তুমি যদি এই কাজ ছেড়ে দাও?
আবির স্মিত হাসে।
--এখন আর ছেড়ে দিয়েও লাভ নাই। টু লেইট।


-- চলবে

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১২:২৮

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: লেখাটা একটু বড় হয়ে গেল।

২| ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:১১

আশফাক সফল বলেছেন: "বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স" !!!! কে আসবে? মাসুদ রানা?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.