নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্যভুবন

তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়

সাপিয়েন্স

আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি ... ফাগুন প্রাতের উতলা গো চৈত্র রাতের উদাসী

সাপিয়েন্স › বিস্তারিত পোস্টঃ

পোলোনিয়াম ২১০

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১৪

একদিন নেমন্তন্ন এলো স্টেট অফিস থেকে। বিল রিচার্ডসের সাথে আগে এক পার্টিতে দেখা হয়েছিল। কিছু কথা হয়েছিল। বাংলাদেশ ডেস্কের দেখাশোনা করে। সেই সূত্রে মাঝে মাঝে টেলিফোনও করত। বেশ ইন্টেলিজেন্ট মনে হয়েছিল। সামনাসামনি দেখে আরো চতুর মনে হলো। নাম দেখে আজকাল চেনা যায় না। কিন্তু আমারও টেকনিক আছে। বুঝে গিয়েছিলাম – ইহুদী, কট্টর যিওনিস্ট। তাতে আমার অসুবিধে নেই। আমি গোঁড়া মুসলিম না, নামসর্বস্ব বলা চলে। এবং সেও যে এ ব্যাপারটা লাঞ্চের সময় গভীরভাবে খেয়াল করছে, তা-ও বুঝতে পারলাম। দুজন দুজনকে মাপছি। এ অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। আমার পেশাতে অপরিহার্‍্য।



বিল অনেক কিছু অফার করল সেই দামী রেস্তরাঁয়, যেখানে অনেক রাষ্ট্রপ্রধানরা আপ্যায়িত হন। তার খুব ভালো জ্ঞান আছে, পৌনঃপুনিকতায় পাওয়া। আমার পেট নরম। ডাল পর্যন্ত সহ্য হয় না। সারাজীবন মোটামুটি ভাজি আর মুরগির ঠ্যাং দিয়ে চালিয়েছি। আর সামুদ্রিক মাছ। প্রিয় ছিল কৈ মাছ,কিন্তু সেটা তো এদেশে পাওয়া কঠিন, দেশী রেস্তরাঁয় মাঝে মধ্যে পেলে খেতাম। কিন্তু দীর্ঘদিন বরফে রাখা খাবারের স্বাদ জঘন্য লাগত।



হঠাৎ আমাদের টেবিলের কাছে এক স্বর্ণকেশী সুন্দরী এসে থামল। বিলকে দেখে মুখে কি হাসি। সুন্দর হাসি।

- কি ব্যাপার, এখানে কাজে এসেছ?

- না, ঠিক কাজ না। এই ভদ্রলোকের সাথে আগে এক পার্টিতে দেখা হয়েছিল। বেশ ইন্টেলেকচুয়াল লোক। অনেক কিছুই জানেন। ইচ্ছে করল পরিচয়টা আরেকটু এগিয়ে রাখি। বস না কেন আমাদের সাথে, অবশ্য তোমার যদি কিছু কাজ না থাকে।

হাবিব, এ হলো জুলি। আমার কাজিন। এখানে এমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়, অবশ্য তোমার বিষয়ে না। আমেরিকার ইতিহাস। জুলি, হাবিব এক সময় রসায়ন পড়াত তার দেশে।

জুলি আবার সুন্দর হাসল।

- বাব্বা, রসায়ন খুব কঠিন বিষয়। এমন কি ফিজিক্সের ছেলেরাও তা বলে। খুব ভালো স্মৃতিশক্তি লাগে।

আমার সৌজন্যমূলক কিছু বলা দরকার।

- ইস্কুলে থাকতে আমার ইতিহাস সব চেয়ে ভয় লাগত। আসলে আমার মনে হয় সেখানে স্মৃতিশক্তি আরো বেশি লাগে।

- তুমি কোন দেশের?

কথা এগুতে থাকল। কিন্তু আমি মহিলাদের সান্নিধ্যে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না। বিল এটা খেয়াল করল। তারপর হঠাৎ জুলিকে নিষ্কৃতি দিল।

- থাক, জুলি, অন্য সময় আলাপ করা যাবে আবার। আমি হাবিবকে তার অফিসে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।

ফিরে এসে মন বসাতে পারলাম না কাজে বেশ কিছুক্ষণ। বিল কেন ডেকেছিল? জুলি কি আসলেই আকস্মিকভাবে সেখানে এসেছিল, নাকি আমাকে পরীক্ষা করে দেখছিল। এনিওয়ে, আমার কি এসে যায়।



অবশ্য এক মাস পরেই জুলির সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিল, বিল ছিল না ধারে কাছে। ক্যাপিটল হিলের কাছেই এক ফাস্ট ফুড শপে। আমাকে দেখে হাত নাড়ল, আমিও নাড়লাম। তাই সাহস পেয়ে এক টেবিলে এসে বসল। এ কথা সে কথার পরে হঠাৎ অবাক করে বলল-

তোমার ভাগ্নের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন? বলে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

কয়েক সেকেন্ড ভাবতে হলো কোন ভাগ্নে, তারপর মনে হলো ওয়াশিংটনের ধারে কাছে একজনই তো আছে। বিলের বন্ধু তার কথা জানবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক।

- কেন, ভালোই তো।

জুলি সায় দিল।

- ভালোই তো ছেলে, অল্প বয়সে তিন চারটে পেটি মামলায় জড়িয়ে গিয়েছিল, এটা নিয়ে এত হুলস্থুল তোমার দেশে!

- আমার দেশের মানুষ খুব কঞ্জার্ভেটিভ। ও তো দেশে কখনো থাকেই নি বলতে গেলে। স্বদেশী কালচার আয়ত্ত করবে কি করে?

কিন্তু আমি সাবধান হয়ে গেলাম। এ আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? জুলি সেটা টের পেল।

- ভয় পেয়ো না। তোমার বা তোমার ভাগ্নের দায়িত্ব আমার না। হয় তো সেই অর্থে তোমারও না। এমনই বললাম। তুমি দেশে ফিরে আবার পড়ানো শুরু করো না কেন? এখানে ভালো লাগে? বিশেষ করে এই বোরিং চাকরী?



আমি চুপ করে রইলাম। আপাকে কত বলেছিলাম আমাকে সি এস আই আর-এর চেয়ারম্যান করে দিতে। কিন্তু অনেক ব্যাপারে আপার মাথা কেমন একগুঁয়ের মত কাজ করে। দুলাভাইয়ের চাকরীটাও তো রিনিউ করলেন না। এখন শশুরবাড়ির আত্মীয়কে ঐ চেয়ারম্যানের পদটা দিয়ে হয়তো একটু সান্ত্বনা পাচ্ছেন। আমাকে বলেছিলেন-

- তুই বরং ওয়াশিংটনে চলে যা। আমার ছেলেটারও একটু দেখাশোনা করতে পারবি। হয়েছে তো বাপের মতো। ব্রেইন ভালো, কিন্তু নিয়ম-টিয়ম মানতে চায় না। তুই তো সৎ আঁতেল, ওকে ট্রেনিং দিবি । আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। ওকে এখানে এসে হয় তো হাল ধরতে হবে। তবে না এলেও আমার দুঃখ নেই। এই জীবনে কোন ফুর্তি নেই রে। আমি মুখে সব সময় হাসি বটে, কিন্তু বুকে অনেক কষ্ট। কত মানুষ আমারে বিট্রে করছে বিভিন্ন সময়, ছেলেটার বাবাও। আব্বা সবাইকে মাফ করে দিতেন। আমি পারি না। কেঊ কেউ আমারে ছোটলোক বলে। বলুক। অনেকে বাচাল, অর্ধশিক্ষিত বলে, ছেলের বাবাও বলতেন। হয়তো তাই। তবে আব্বার কাছ থেকে দেখে দেখে অনেক জিনিস শিখেছি। আব্বা জেনেশুনেও ভুল করতেন। আমি আব্বার মতই জানি-শুনি, কিন্তু সিদ্ধান্ত সে-রকম নেই না।



আমার বুকটা ধক করে উঠল। সেই দু বছর আমি বিশেষ কোন খবর নেই নি আপার। জানি আপা ভালোভাবেই খেয়াল করেছেন। ইউটিউবে আমার কোন স্বীকারোক্তির ভিডিও নেই, কারণ আমাকে কখনো ধরে নিয়ে যাওয়া হয় নি। ছিলাম তো চুনোপুঁটি, বেঁচে গেছি। চোখবাঁধা মহারথীদের পতন দেখে অনেকে অবাক হয়। কিন্তু ইসলামেই আছে, নিজের জান বাঁচানো ফরজ। আমাকে পরীক্ষা দিয়ে ফেইল করতে হয় নি, কিন্তু যদি একটু খোঁজ খবর নিতাম, তাহলে কিছু বোনাস পয়েন্ট পেতাম। চেয়ারম্যানগিরি না হলেও একটা ভালো অবস্থানে থাকতাম। ওয়াশিংটন খারাপ না। কিন্তু মন্ত্রীদের আনা-গোনা এত বেশী, বিরক্ত করে তোলে। আর ভাগ্নে তো আছেই। একদিন ভাগ্নে বলল-

মামা, আপনার একাউন্টে মাঝে মাঝে দশ বিশ হঠাৎ জমা দেখতে পারেন। আমাকে জানাবেন। আমার ব্যবসার টাকা। ইনকাম ট্যাক্সের কারণে একটু এদিক ওদিক করতে হয়, ভয়ের কিছু নেই।

তবু প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তারপরে মনে হলো এটা এমন কিছু নয়। ভাগ্নে আমাকে একটা পারসেন্টেজ সাধল, আমি একটু অপমাণিত বোধ করলাম। তখন সে একটা দুটা আকর্ষণীয় গিফট দিল, খুব দামী নয়। যেমন একটা আই-প্যাড, একটা ৬০ ইঞ্চি থ্রীডি টিভি। এগুলো আর নিষেধ করি নি।



কিন্তু কয়েক মাস আগে একটা বিরাট অংকের জমা দেখে ভীষণ আতংকিত হলাম।

- ভাগ্নে, তুমি আমাকে এর থেকে বাদ দাও। আমি তোমার শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি। আই এম একচুয়ালি ই্ওর ওয়েলঊইশার। কিন্তু এই টেনশন সইবার মত মনের জোর আমার নেই। তুমি হয়তো তোমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছ।

ভাগ্নে কিছুক্ষণ চুপ থেকে হা হা করে হেসে উঠল। বাবার মত কিছু বাইপোলার আছে। ততটুকু নয়, সহনীয়।

- মামা, তুমি এত ভয় পাও। ঠিক আছে, সমস্যা নেই। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেই এই দায়িত্ব দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্ত থকো।



কয়েকদিন পরে আবার বিলের সাথে এক পার্টিতে দেখা। এক মন্ত্রী এসেছিলেন দেশ থেকে। পরিচয় করিয়ে দিলাম। এক জন এসে বলল , এম্ব্যাসেডর সাহেব আপনাকে একটু খুঁজছেন। আমি হন্ত-দন্ত হয়ে সেদিকে গেলাম।

- বসেন হাবিব সাহেব, এইখানে। মন্ত্রী সাহেব বিলের সাথে কিছু প্রাইভেট কথা বলছেন।

তাকিয়ে দেখি তাই, এক কোণায় গিয়ে কি জানি ফিশফিশ করছেন মন্ত্রী।



কয়েকদিন পরে বিল আমাকে ফোন করল।

- হাবিব, আমার এখানে একটু এসো সময় পেলে। কফি ছাড়া কিছু খাওয়াবো না।

গেলাম। বিল একটু চুপ থেকে বলল।

- দেখ হাবিব। ক্যানাডা একটা স্বাধীন দেশ। আমাদের প্রতিবেশী, অনেক কিছুই আমরা শেয়ার করি। কিন্তু তাদের কিছুতে আমরা বাধা দিই না বা ইন্টারফেয়ার করি না।



দেশে ছুটিতে বেড়াতে এসে আপাকে বললাম। আপা ব্যপারটাকে পাত্তাই দিলেন না।

- ঠিক আছে, বাবা। তোমার আর বড়লোক হওয়া হবে না। তুমি আমার নানীর মত, তিনিও ভীতু ছিলেন। ওয়াশিংটন কেমন লাগছে? স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাথে খাতির করতে পারছ?

- দু’একজনের সাথে পরিচয় হয়েছে।

- তুমি তো ড্রিঙ্ক কর না। এ জন্যই তোমাকে ওখানে পাঠাইছি। লুজ জিহবা থেকে অনেক কথা বাইর হইয়া যায়।

- আপা, আপনার চিন্তার কিছু নেই। আমি সাবধানী। কিন্তু কিছু জানার থাকলে তা জানাবার লোকের অভাব নেই। ওদের ফাইলে সবই থাকে। ইলেক্ট্রনিক ডেটাবেস। যা জানা দরকার সেকেন্ডেই পেয়ে যায়।

- আচ্ছা হাবিব, তুই তো আইটি অনেক জানিস। বল তো, এই যে উইকিলিক্স জাতীয় লিক আউট হয়, সারা পৃথিবীতে ছড়ায়ে যায়, আমেরিকার এত সিকিউরিটি সত্ত্বেও কি করে সম্ভব?

আমি হাসলাম।

- আপা, এগুলো সাজানো লিক, ওদের সরকার নিজেই বের করে। খুব লো-লেভেলের সব হাস্যকর তথ্য। কোন পার্টিতে কোন দেশের কোন নেতা অন্য কোন দেশের কোন নেতা সম্পর্কে কি বলেছেন, হয় তো কিছু পানের পরে, সেই জাতীয়। এই সব লিকের উদ্দেশ্য হলো দু রকম। প্রথমত দু পক্ষকেই এম্ব্যারেস করে একটু নিয়ন্ত্রণে আনা। দ্বিতীয়ত এ রকম একটা কিছু জাহির করা যে এর চেয়ে সিরিয়াস কোন তথ্য তাদের কাছে নেই।

আপাকে চিন্তিত দেখালো।

- তোর ভাগ্নে সম্বন্ধে নিশ্চয়ই ফাইল খুলে বসে আছে। তুই জানিস কিছু?

- আমাকে শুধু এইটুকু জানিয়েছে যে ফাইল আছে। তাতে তার সব ইতিহাস আছে।

আপার কপালে একটু ভাঁজ পড়ল।

- আমি তো তাকে বলছি টাকা পয়সার হিসাব একটু সাবধানে রাখতে। ওর তো কন্সাল্টিং ফার্ম আছে। উপার্জনের পথ দেখাইতে পারবে মনে হয়।

আমি একটু চুপ্ থেকে বললাম।

- আপা, প্রথম দিকে আমার একাউন্টেও রাখত। এই দশ বিশ। কিছুই না। কিন্তু পরে তো অনেক টাকার একটা জমা পড়ল। তুমি কিছু মনে করো না। আমি ওকে বললাম আমাকে বাদ দিতে। ও সহজেই রাজি হয়ে গেল। নিশ্চয়ই আরো ভালো কোন ব্যবস্থা করেছে। ঐ দেশে পৃথিবীর কত জনের কত রকমের টাকা এসে জমা হয়। ব্যাঙ্ক ইন্টারেস্ট মাত্র ১ পারসেন্ট, তা সত্ত্বেও। মনে হয় ভালো উপদেশেই চলছে। ভয়ের কিছু নাই।

আপা একট দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

- উপদেশ দেয়ার লোকের অভাব নাই। কিন্তু কার কি মতলব আগে বলা মুশকিল। মঞ্জুর তো তার বসের সব টাকা নিয়া ভাগল তার দুঃসময়ে। তার বেয়াদব পোলা আমাদের এত নিকট আত্মীয় হইয়াও কি সব বলতেসে আমাদের নামে। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে ভালো মত রিমান্ডের ব্যবস্থা করতে।



কিন্তু ওয়াশিংটনে ফেরার তিন দিনের মধ্যেই দরজায় বেল বাজল। পকেট থেকে কার্ড বের করে দেখালো । হোমল্যান্ড সিকিউরিটি। সবার ওপরে।

- হাবিবুর রামান?

- হ্যাঁ।

- আপনার সাথে কিছু কথা আছে। আপনি কি একা?

- হ্যাঁ, বসুন।

লোকটা বসল। মুখে বেশ গম্ভীর ভাব। আমার কিছু আসে যায় না। ডিপ্লোম্যাটিক ইমিউনিটি আছে।

কিছু গতানুগতিক প্রশ্ন করল, কবে এসেছি, কোথায় লেখাপড়া করেছি , আগে কি কাজ করতাম এই সব। আমার পাস্ পোর্ট দেখল। তারপর আবার কিছুক্ষণ খোশগল্প করল অনেক দিনের পুরোনো বন্ধুর মত। কেন বিয়ে করি নি জিজ্ঞেস করল। ইউনিভার্সিটিতে পছন্দের কেউ ছিল কিনা তা-ও। তার পর আসল কথায় আসল।

- হাবিব, তোমার একাউন্টে একটা বড় অংকের টাকা জমা হয়েছিল কিছুদিন আগে। আমাদের সব ব্যাংকের কাছে নির্দেশ আছে। এ ধরণের ট্রান্জেকশন রিপোর্ট করা। আমরা এর পর দেখলাম এর আগেও প্রায়ই তোমার একাউন্টে দশ বিশ করে বহুবার জমা হয়েছে, আবার সাথে আথে অন্য কোথাও চলে গেছে। তুমি কোন সন্ত্রাসী দলকে সাহায্য কর না, এটা আমরা নিশ্চিত। কিন্তু অন্য কেউ তোমার আনাড়িপনার সুযোগ নিয়ে তা করতে পারে। এ বিষয়ে যদি আমাদেরকে একটু সাহায্য কর, আমাদেরও ভালো হয়, তুমিও নিরাপদে থাকতে পার।



নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। মনে হল এখানে আমার দৌত ইমিউনিটির কথা বলা অবান্তর। হোমল্যান্ডের হাত থেকে কারো নিষ্কৃতি নেই। তবে আমি তো সজ্ঞানে কোন অন্যায় করি নি।



- তোমরা যখন এতোই জানো, তাহলে আমার কাছ থেকে আর কি শুনতে চাও। আমাকে এক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে তোমাদের কি লাভ। ওই টাকা কার কোথায় যায়, সেটা আমার চাইতে তোমরাই ভালো জানো, আমি শুধু কিছু ব্যাঙ্ক একাউন্টের নম্বর জানি।



- আমরা জানি ওই টাকা প্রধানত শুধু এক পরিবারের সম্পদ হিসেবে জমা হচ্ছে, বিভিন্ন জায়গাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু কিছুটা সন্ত্রাসীদের হাতেও যাচ্ছে। সেই সন্ত্রাস আপাতত তোমার দেশেই রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ। কিন্তু এখনকার আন্তর্জাতিক পটভূমিতে তা এখানেও বিস্তৃত হতে পারে, অন্য দেশেও যেতে পারে। আমরা তো আর ৯/১১ এর ঝামেলাতে যেতে চাই না।

আমি চুপ করে শুনলাম। কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু তবু বলতে হলো।

- এটা তো প্রায় সব উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তোমরা কি সবার ওপরে সমান নজর রাখতে পারবে?

- চেষ্টা করছি। একটা দেশ ছাড়া। তারা উন্নয়নশীল নয়, এবং তাদের সন্ত্রাস খুব টার্গেটেড; ছড়াবে না, এখানে আসবে ন। আর তাদের হাতে এদেশের সব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, একাডেমিক, মিডিয়া ক্ষমতা। তাদের ছোঁয়া যাবে না। যা হোক, তুমি আর এ সবে জড়াবে না আশা করি, তা সত্ত্বেও আমি মাঝে মাঝে এসে খবর নিয়ে যাবো।



পরদিন সকালে উঠেই আমি দূত মহোদয়ের কাছে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম। তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

- আপনি যে পদে আছেন, সেখানে আসতে বহুলোকে অনেক পয়সা খরচ করতে রাজি। অবশ্য আপনার ব্যক্তিগত সমস্যা থাকলে আলাদা কথা। সেট হলে আপনি আপনার আপার সাথে কথা বলে নেন। তিনি আপনাকে আমার হাতে অতিথি হিসেবে সমর্পন করে গেছেন। আমি আবার বকুনী খাবো, পরিবারের ভেতরেই মীমাংসা করে আমাকে জানান।

কিন্তু সে রাতেই আপা নিজ থেকে আমাকে ফোন করলেন।

- হাবিব, তুই একটু ক্যানাডা যা তো, সেখানে কি হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি না। এত সামান্য একটা কেস নিয়ে এত হৈচৈ শুরু করেছে কেন? ওখানকার দূতাবাস হয় ইনেফিশেন্ট, নয় আসলে হস্টাইল। আমাকে জানাস।



আমার আর দেশে ফেরা হলো না। ক্যানাডা গেলাম। দূত মহোদয় অনেক খাতির করলেন। আমি সমস্যাটা বললাম। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

- আমি অনেক চেষ্টা করেছি ধামাচাপা দিতে। কোন কো-অপারেশন পাচ্ছি না। যেন আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে এটা একটা বড় ইস্যু বানিয়ে কোন একটা ফায়দা নেবে। সেটা কি, তারও হদিশ পাচ্ছি না। আপনি কিভাবে এগুবেন আমি জানিনা, তবে আমার কর্মচারীরা আপনাকে সাহায্য করবে, যেভাবে চাইবেন।



আমি সংশ্লিষ্ট লোকগুলোর সাথে দেখা করলাম পরিচয় গোপন রেখে। কিন্তু ওরা সহজেই বুঝে গেল। কত বোঝাবার চেষ্টা করলাম, গরীব দেশের রাজনীতিবিদ্ এ পেশায় আসেই এজন্য। এটা তো আমাদের দেশের কোন ইউনিক দুষ্কর্ম নয়। কিন্তু তারা সবিনয়ে আমাকে জানাল – আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তারপরে গলা নিচু করে বলল, শুধু একটা লোককে সরালেই তারা সহযোগিতা করার কথা চিন্তা করবে।



আপাকে ফোন করে জানালাম।

- ওনাকে সরিয়ে দেন না কেন।

- না রে, ওকে আমি সরাতে পারব না। বিপদের দিনে যে পাশে থাকে সেই তো বন্ধু। আব্বা এটা বুঝতেন না, সবাইকেই জয় করে নেবেন, এ রকম বিশ্বাস ছিল ওনার। তার কি ভয়ানক পরিনতি হলো। এখন তার বিপদে আমি পাশে থাকব, আস্তে আস্তে বদলানোর কথা ভাবা যেতে পারে।



আপার কথা আমার অর্ধেক বিশ্বাস হলো। বাকি অর্ধেকে আমার ভাগিনা জড়িত মনে হলো, আর ঐ বিশাল অংকের টাকাটা। আমি ওয়াশিংটনে ফিরে এলাম।



বিজ্ঞান ক্লাব, প্রতিযোগিতা এসব ব্যাপারে জেআরসি স্যারের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি ওনাকে চিঠি দিলাম, ব্যক্তিগতভাবে। যদি কিছু আমাকে ভেঙে বলেন। উনি তো উপদেষ্টা ছিলেন প্রকল্পের। কিন্তু উনি সাফ জানিয়ে দিলেন কিছু জানেন না। তারপর প্রজেক্ট ছেড়ে দিয়ে আবার অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন।



মাঝখানে বিলের সাথে দেখা হয়েছিল।

- বিল, আমি তো এক বিপদে পড়লাম। আমার বোন এক কাজ দিয়েছেন। কিন্তু আমি ম্যানেজ করতে পারছি না।

বিলের মুখ গম্ভীর।

- হাবিব দেশে ফিরে যাও। তুমি একজন অধ্যাপক, এ সব ডার্টি কাজ তোমার জন্য না। ঘটনা যেদিকে মোড় নিয়েছে তাতে কারো আর সামাল দেবার উপায় নেই। তোমাদের নির্বাচন আসবে শীগগির। তোমার বোনের বিরুদ্ধে আরো নানান উপাদান দেখা দেবে। তোমার ভাগিনার সব কথা আবার উইকিলিক জাতীয় এক পদ্ধতিতে প্রকাশ পাবে। খুবই নাজুক অবস্থায় পড়বেন তিনি।

- তাহলে কি তোমাদের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে কে আগামী নির্বাচনে জিতবে?

বিল কিছুক্ষণ আনমনা রইল। তারপর বলল।

- আমিও জানি না। এগুলো অনেক ওপরে নির্ধারিত হয়। এমন কি অনেকে যে ভাবে, আমরা ইউনুসকে চাই, সেটাও হয় তো সত্যি নয়। আমাদেরকে যেটুকু বলা হয়, আমরা শুধু সেটুকুই জানি এবং করি। তবে তোমার দেশ সম্পর্কে পরিকল্পনা বেশ জটিল মনে হচ্ছে। তুমি আর এর অংশ হয়ো না। ফিরে যাও তোমার আদি পেশায়।



কিন্তু ফিরতে চাইলেই কি ফেরা যায়! আপা জানালো – কয়েক মাস অপেক্ষা করতে। আমার জন্য নাকি এক সারপ্রাইজ আছে। আপাকে বিশ্বাস নেই, তবু সরকারী আদেশকে মানতে হবে।



এর মধ্যে শাহবাগ গণমঞ্চে “ফাঁসী চাই” আন্দোলন শুরু হলো। বিলকে জিজ্ঞেস করলাম এতে ওদের হাত আছে কি না। বলল।

- নাহ, আমার উইঙ্গের অন্তত নেই। অন্য কেউ দায়িত্বে থাকলে আমি জানি না।

বুঝলাম না সত্যি বলছে না মিথ্যা।

আপাকে জিজ্ঞেস করলাম।

- আপা , তুমি কি আসলেই এদের সবাইকে ফাঁসী দেওয়াবে?

আপার কন্ঠে দুঃখ ফুটে উঠল।

- দেখ আমরা তো পীরের বংশ। একটু ইসলাম বায়াস আব্বারও ছিল। এই বদমাশগুলো অনেক মানুষ মেরেছে। রেপ করেছে, লুট করেছে। তবু আমি যাবজ্জীবনেরই পক্ষে ছিলাম। জাজকেও সেটা বলে দেয়া ছিল। কিন্তু পাব্লিক সেন্টিমেন্টকে সবার ওপরে দাম দিতে হয়। বাংলাদেশের মানুষ লাশ দেখতে পছন্দ করে।

- সাকা কে তুমি ফাঁসী দিতে পারবে?



মনে হলো আপার এক দুর্বল জায়গাতে আঘাত করেছি। তিনি একটু বিরক্ত হলেন।

সেটা পরে দেখা যাবে। আগে ইলেকশন তো জিতি। এত টক শো আর আঁতেল। ৭১ এ যারা কেউ কিছু করে নি, তারাও এখন পরম দেশপ্রেমিক। বানিয়ে বানিয়ে গল্প শুনিয়ে নিজেকে হিরো হিসাবে জাহির করে। আব্বা তো আসলে সবাইকে মাফ করে দিয়েছিল, এমন কি হারামজাদা ভুট্টোকেও দাওয়াত দিয়ে এদেশে এনেছিল। আমার সেই ক্ষমতা নাই। তবু দেখা যাক, ইলেকশনের পরে।



জুলি এল একদিন আমার অফিসে।

- তোমরা একজনকে আসলেই ফাঁসী দিয়ে দিলে?

আমি একটু ক্লিষ্ট হাসি হাসলাম।

- কেন তোমাদের দেশেও তো এই শাস্তি অনেক স্টেটে আছে। জর্জ বুশের টেক্সাসে সব চেয়ে বেশি হয়। আর কালোদের হয় সাদাদের কয়েকগুণ।

জুলি একটু বিব্রত বোধ করল।

- হ্যাঁ, আমাদের দেশে একটা ইউনিফর্ম সভ্য আইন থাকা উচিত। তুমি কি মৃত্যুদন্ড সমর্থন কর?

- ব্যক্তিগতভাবে আমি করি না। কিন্তু সরকারী আইনে থাকলে আমার তার বিরুদ্ধে যাওয়ার বা বলার অধিকার নেই। আমার দেশের অধিকংশ লোক এখনো এটাকে ভালো ডেটারেন্ট মনে করে। ইস্রাইলে নেই বলে। কিন্তু আসলে তারা যে টারগেটেড কিলিং করে, তা তো আরো খারাপ। ওসামাকে হাতে পেয়ে না ধরে মেরে ফেলা হলো, পাপেট সরকার আর বিচারক দিয়ে সাদ্দামকে ঝোলানো হলো, লিবিয়ায় গাদাফীকে খুন করানো হলো। কাকে কি বলছ?

আমার কন্ঠে একটু স্বদেশী উষ্মা প্রকাশ পেয়েছিল বোধ হয়।

-সরি। আমি তোমাকে কোনভাবে আহত করতে চাই নি। পৃথিবী এখনো পুরোপুরি সভ্য হয় নি, এবং অনেক কপট অহংকার রয়ে গেছে।



হঠাৎ জুলি প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল।

- আমি গেল সপ্তাহে স্ট্যানফোর্ডে এক কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। সেখানে ক্যাফেটেরিয়ায় তোমার দেশী এক কাপল-এর সাথে দেখা হলো। ভদ্রলোক আই টির আর মহিলা কেমিস্ট্রির। তোমাকে চেনে কিনা জিজ্ঞেস করলাম। মহিলা বললেন তুমি তার ক্লাসমেট ছিলে।

- হুম, মুনিরা।

- খুব সুন্দর দেখতে। তোমার কোন দুর্বলতা ছিল না ? দুষ্টুমির হাসি হাসল জুলি।

আমিও হাসলাম।

- এতদিন পরে আর এসব জিজ্ঞেস করে কি লাভ! তবে তোমাকে এক গল্প বলি। সেকেন্ড ইয়ারে প্র্যাক্টিকালের সময় হঠাৎ কিছু ক্লোরিন গ্যাস ইনহেল করে ফেললাম। সঙ্গে সঙ্গে এক দম সিক হয়ে গেলাম। তখন মুনিরা আমাকে সেবা-শুশ্রূষা করে সুস্থ করে দেয়। আমাকে ও স্নেহ করত। ওর বয়সও হয় তো আমার চেয়ে বেশি ছিল। দেখতেও অনেক লম্বা-চওড়া, আর আমি ওর চেয়ে দু ইঞ্চি শর্ট, ওজনে দশ কেজি কম। কোন রোমান্টিক ফিলিং-এর সম্ভাবনা ছিল না।

জুলি কথা ঘুরিয়ে ফেলল। ক্রিস্মাস সেল থেকে কিছু কিনব কি না জানতে চাইল। দেশে কখন বেড়াতে যাবো তা-ও।



একদিন বিল এসে বলল।

- আমার সাথে চল। তোমাকে একটা ম্যাজিক শো দেখাবো। অবশ্য তোমাদের দেশে শুনেছি এক বড় ম্যাজিশান আছে।

- হ্যাঁ, জুয়েল আইচ। খুবই সুন্দর উপস্থাপনা। দেখলে ডেভিড কপারফীল্ডের ভক্তদেরও তাক লেগে যাবে।

- তুমি কি সুপারন্যাচারালে বিশ্বাস কর?

- না, মাথা খারাপ! আমি ঐসব মুভিও দেখি না। হাসি পায়।

কিছুক্ষণ বিনোদিত হলাম। লোকটা মনে হলো ইটালিয়ান। নাম জোভানী, চোখগুলো বেশ বড়। আইটেমগুলো জুয়েল আইচের মতই।

- এর পর আমি দেখাবো আমার হিপ্নোটিজমের খেলা। আমি জানি আপনাদের অনেকের ধারণা এ সব ঢং, আসলে শেখানো লোককে দিয়ে খেলা দেখানো হয়। যদি এই আসরে নতুন এদেশে আসা কেউ থাকেন, একটু হাত তুলুন।

বিল আমার হাতটা ওপরে তুলে ধরল আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

- গ্রেট , আমরা একজন বিদেশী ভলুন্টিয়ার পেয়ে গেছি। আগে সবার কাছে আপনার পরিচয় দিন, যাতে বোঝা যায় আপনার সাথে আমার কোন চুক্তি থাকতে পারে কি না।

আমি বিলের ওপরে বেশ বিরক্ত হলাম। দেখি মিটিমিটি হাসছে। তবু এত লোকের সামনে সিন ক্রিয়েট করা যায় না।

- আমার নাম হাবিবুর রাহমান। আমি এসেছি দক্ষিণ এশিয়া থেকে, যেটা হয়তো আমাকে দেখেই বোঝা যায়। না, আমার সাথে আগে এই জাদুকর ভদ্রলোকের কোন দেখা হয় নি। কিংবা হয়তো রাস্তায় বা কোন শপিং মলে হয়েছে, কিন্তু আমি ওনাকে চিনি না।



- আপনি একটু দশ সেকেন্ড আমার চোখের দিকে তাকান, এবং মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনুন।

- গুড। আপনি এখন ডান পা টানতে টানতে আমার কাছে ডান দিক দিয়ে এই স্টেজে চলে আসবেন। যদিও আপনার পা’তে কোন ত্রুটি নেই।

ভীষণ বিরক্ত বোধ করলাম। তারপর বাঁদিক দিয়ে মিলিটারি ভঙ্গীতে হেঁটে স্টেজের দিকে এগুতে গেলাম। কিন্তু পারলাম না। সবিস্ময়ে দেখলাম আমার ডান পা কেমন যেন আটকে যাচ্ছে। আর মনে হচ্ছে ডান দিক দিয়ে না গেলে আমি হোঁচট খাব। জাদুকরের নির্দেশের যথার্থতা দেখে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল এবং আমার রাগী মুখ দেখে সবার মনে হলো ব্যপারটা সাজানো নয় হয় তো। এর পরে জোভানী আমাকে দিয়ে আরো অনেক কাজ করালো স্টেজে। তার পছন্দ মত একটা রুমাল নিতে বাধ্য হলাম পাশের গুলো বাদ দিয়ে, তার পছন্দের একটা ফুল নিলাম টেবিল থেকে, শেষে তার নির্দেশমত তার সুন্দরী এসিস্টেন্টকে একটা হাল্কা চুমু দিয়ে ফিরে এলাম, নির্দেশিত বাঁদিক দিয়ে।



বিল ঘাড় নাড়ল।

- আজ পর্যন্ত মাত্র দু’জনকে দেখেছি জোভানীর কথা উপেক্ষা করতে।

আমি রাগ বিরক্তি আর ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বললাম।

- আমি আর কখনো এঁর মুখোমুখি হতে চাই না। এ আসলেই হিপ্নোটিজম জানে। খুবই বিপজ্জনক।

বিল আমার পিঠ থাবড়ে দিল।

- এত নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। তুমি কি ফাইন্ম্যানের আত্মজীবনী পড়েছ?

ফাইন্ম্যান পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন। ভীষণ স্বাধীনমনা ছিলেন। কিন্তু তিনিও একবার এক জাদুকরের পাল্লায় তার কথা মত কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, লিখেছেন আত্মজীবনীতে। সাহিত্যিকরা ম্যাজিক রিয়েলিজমের কথা বলে, সেটা তো কল্পনা, আর্ট ফর্ম। কিন্তু বাস্তবেও ম্যাজিক আছে।



রাতে অচেনা মহিলার কন্ঠে ফোন এলো। কয়েক সেকেন্ড পরে টের পেলাম - মুনিরার।

- হাবিব, তুমি আমেরিকায় এতদিন জানতাম না। আমাকে জুলি নামে একজন তোমার নম্বর দিল। কি মজা, ওয়েস্ট কোস্টে এলে অবশ্যই আমার এখানে এসে উঠবে কিছুদিনের জন্য।

- মুনিরা, খুব ভালো লাগছে তোমার কথা শুনে। জুলি আমাকে আগেই তোমার সাথে দেখার কথা বলেছে। তোমরা সবাই ভালো?

- আমরা এখনো দুজনই আছি। বাচ্চা আর হলো ন। কি আর করা। হ্যাঁ, আমার হাজব্যান্ড ভালোই আছে। তুমি বিয়ে কর নি, বলল জুলি। কি ব্যাপার, ছ্যাঁক ট্যাক খেয়েছ নাকি। কিন্তু তুমি তো লজ্জায় মেয়েদের দিকে মুখই তুলতে না। অনেকে তোমাকে নিয়ে ইন্টারেস্টেড ছিল। ঐ বাচ্চা বাচ্চা ভাব! সুযোগ হারিয়েছ।

- চলে যাবে জীবন। ভেবো না।



রাতে স্বপ্ন দেখলাম আবার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ফিরে গেছি। মুনিরা তার বিয়ের কার্ড আমাকে দিয়ে বলছে – এসো কিন্তু , খেয়ে দেয়ে শরীরটা বড়সড় কর। মেয়েরা স্বাস্থ্যবান ছেলে পছন্দ করে। তারপর আবার জোভানীর স্বপ্ন দেখলাম। ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে আর বলছে-

- এবার আমাদের অতিথি কান ধরে উঠ বস করবেন।

আমার ঘুম ভেঙে গেল।



হঠাৎ খবর এলো আপা আসবেন ছেলের কাছে নির্বাচনের পরে। ফলাফল তো জানাই আছে, তাই পরিকল্পনা করতে বাধা নেই। শুরু হলো দৌড়াদৌড়ি। বিলও খবর পেয়ে বলল, তোমার বোনের সাথে আলাপ করিয়ে দিও সুযোগ পেলে। বললাম – ঠিক আছে। কিন্তু ওই জাদুকরের শো-য়ে নিয়ে যেতে পারবে না। ওনার একটু কৌতূহল আর কৌতুকবোধ বেশি, কিন্তু আমাদেরকে পদমর্যাদার দিকে চোখ রাখতে হয়। বিল হেসে বলল – চিন্তা নেই। আমিই ওনার বাড়ি যাবো। আর জোভানী এখন এখানে নেই।



জুলি আমাকে ক্রিস্মাসে আজব একটা বই উপহার দিল। অনেক পুরোনো, এন্টিক। ফন্ট এত পুরোনো যে পড়তে মনোযোগ দিতে হয়। এ ধরণের জটিল বই আমার প্রিয় না। যেমন এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড। ফ্যান্টাসীর জগৎ কেমন যেন অস্থির করে ফেলে।



দুই বাচ্চা একবার মাঠে খেলতে খেলতে একটা বুলেটের মত জিনিস পেল। ভাইটাই সেটা রেখে দিল। কিন্তু বোন বার বার দেখতে চাইল। শেষে ভাই সেটা বোনের সামনে বের করল। এটাতে একটা প্যাঁচ দেখে আস্তে আস্তে খুলে ফেলল, তখন একটা দৈত্য বেরিয়ে এল। সেটা বোনটাকে খেয়ে উড়ে চলে গেল। তার পর অনেক ঘটনার পরে ভাইটা দৈত্যকে মেরে তার পেট থেকে বোনকে উদ্ধার করল।



আমি ভাবতে লাগলাম জুলি কেন আমাকে এই বাচ্চাদের বই দিল। তারপর মনে হলো এটা তো এন্টিক, অনেক দামি। কালেকশনে রাখার মত। ভেতরে অনেক চমৎকার ছবি, এত বছরেও বিবর্ণ হয় নি। কি এক আকর্ষণে আমি বইটা বার বার ওল্টালাম। যদি আমার একটা বাচ্চা থাকত তাকে পড়ে শোনাতে পারতাম। মুনিরারও বাচ্চা নেই। কিন্তু স্বামী আছে। আমি একা।



কাজের ফাঁকে সময় পেলে মাঝে মাঝে দু একটা তাত্ত্বিক পেপার লিখতে চেষ্টা করি। একটা পাব্লিশ হয়েছে। আমার বিষয় নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রি। বিভিন্ন ভরের রেডিওএক্টিভ আইসোটপের সেপারেশন। এই কাজটা এটম বোমা বানাবার সব চেয়ে বড় অংশ। পাকিস্তানী কাদির বিদেশ থেকে শিখে এসে পাকিস্তানী সরকারকে বলে বিশাল ডিফিউশন প্ল্যান্ট বানিয়ে নেয়। ভারতও এগিয়ে যাচ্ছিল। আমেরিকানরা মনে হয় পাকিস্তানকে একটু ভিন্ন চ্যানেলে অর্থাৎ চীনের সাহায্যে কিছু বুস্ট দেয়। ফলে একটা বোমা বানাবার মত ফিউয়েল দু দেশই একই সাথে অর্জন করে এবং ভারত তার বোমা ফাটিয়ে উল্লাস শেষ করবার আগেই এক সপ্তাহের মধ্যে অলৌকিক্ভাবে পাকিস্তানও তাদের বোমা ফাটাতে সমর্থ হয়। আমার সব চেয়ে কৌতূহলের আইসোটপ হলো পোলোনিয়াম ২১০।



২০০৪ সালে ইয়াসের আরাফাত হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর রামাল্লাহ বাসভবনে। ইস্রায়েলি মিডিয়ায় খবর বের হয় এটা তাঁর অন্তিম অসুখ। আমার তখন কৌতূহল্ হয়েছিল কি বিষ তারা ব্যবহার করে এত নিশ্চিত বোধ করছে, সে সম্পর্কে। অসুখের সিম্পটম কাগজে বের হয়েছিল, তার মধ্যে প্রধান ছিল ব্লাড প্লেটলেট হঠাৎ কমে যাওয়া। এটা ডেঙ্গুতেও হয়, কিন্তু রামাল্লায় কোন ডেঙ্গু নেই। অবস্থা খারাপ হওয়ায় আরাফাতের ডান হাত বলে পরিচিত আব্বাস এক ফরাসী হাস্পাতালে হেলিকপ্টার দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই যাত্রাটা আমি লাইভ দেখেছিলাম। আরাফাত তার বন্ধু আব্বাসের হাত জড়িয়ে ধরতে গিয়েছিল, কিন্তু আব্বাস যেন এক আতঙ্কে সেটা সবলে ছাড়িয়ে নেয়। তখনই টের পাই বিষটা রেডিওএক্টিভ, এবং আব্বাস তা জানেন এবং ভয় পাচ্ছেন যে ছোঁয়াছুয়ি হলে তেজস্ক্রিয়তা তাঁকেও বিপদগ্রস্ত করে ফেলবে কি না। আমি আশা করেছিলাম যে আরাফাতের স্ত্রী এব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তখন তিনি তা করেন নি। তখন পত্রিকায় বের হয়েছিল, মৃত্যু ইস্রায়েলী বিষপ্রয়োগে জেনেও স্ত্রী চুপ আছেন, কারণ তিনি গোপনে বিপুল ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। আবার ২০১৩ সালের শেষে এসে সেই স্ত্রীই আবার বিচার চাইলেন। সম্ভবত আরো ক্ষতিপূরণ চেয়ে ব্যর্থ হয়ে, অথবা প্রতিশ্রুত মাসিক রেট বন্ধ করে দেয়ায়। তখনই দেখেছিলাম এই কাজে সব চেয়ে এফেকটিভ আইসোটোপ হতে পারে পোলোনিয়াম ২১০, যার হাফ লাইফ মত্র ১৩৮ দিন, অর্থাত সাড়ে চার মাসেই কমে অর্ধেক হয়ে যায়। দ্রুত ব্যবহারের জন্য নিরাপদ সময়, আবার কয়েক বছর পরে তেজস্ক্রিয়তা স্বাভাবিক ব্যাকগ্রাউন্ড লেভেলে, সুতরাং দশ বছর পরের টেস্টে ফরাসী হাসপাতাল নিজেকে নির্দোষ দাবি করতেই পারে।



২০০৬ সালেও লন্ডনে কেজিবির এক এজেন্ট বেইমানী করায় রাশিয়ানরা তাকে চায়ের সাথে পোলোনিয়াম ২১০ খাইয়ে মেরে ফেলে। লন্ডনের হাসপাতালে ব্যাপারটা ধরা পড়ে যায়। আসলে পোলোনিয়ামের সব গুলো আইসোটপই তেজস্ক্রিয়, কিন্তু সব চেয়ে বিপদজনক ২১০। সুতরাং রিফাইন করে নিতে হয়েছে। এর জন্য টেকনোলজী দরকার। যারা ব্যবহার করেছে, তাদের আছে।



আপা আসার আগের দিন হঠাৎ বিলের ফোন।

- হাবিব, আমরা গোপন খবর পেয়েছি তোমার ফ্ল্যাটে তোমাদের এক সন্ত্রাসী দলের এক আক্রমণ হতে পারে। আমাদের এক খুব দক্ষ লোক রাতে তোমার সাথে থাকবে, প্লিজ আপত্তি করো না।

বেশ ভয় পেলাম। বললাম।

- আমার এখানে কেন, আমি তো চুনোপুটি। আমার ভাগ্নের বাড়ি পাহারা দেয়ার ব্যবস্থা কর।

- হ্যাঁ সেটা আমার আগেই করেছি। কিন্তু তুমি কিছু টাকা পয়সার সাথে জড়িত ছিলে। সেখান থেকেও কোন উদ্যোগ হতে পারে। এই মুহূর্তে আর কিছু বলতে পারবো না। তুমি শান্ত হয়ে বাড়িতে থাকো আপাতত।

সন্ধ্যার সময় খুব সুদর্শন এক সাদা পোশকী ম্যারিন সেনা এসে আমার লিভিং রুমে আস্তানা নিল। আমি তার সাথে বেশি কথায় গেলাম না। তবে আমার বেড রুমের দরজাটা ভালো করে বন্ধ করে ঘুমাতে গেলাম, কয়েকটা বড়ি খেয়ে।



সকালে সে ছোকরা আমাকে ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দিল। তারপর বলল।

- আপনি ভালো ঘুমান। রাতে বিল এসেছিলেন একজনকে সাথে নিয়ে। আপনি জেগে আছেন এই ধারণা ছিল। আমি কয়েকবার দরজায় আঘাত করেছি, কিন্তু ভেতর থেকে আপনার নাক ডাকার শব্দই শুধু শুনলাম। কিছু মনে করলেন না আশা করি।

আমি প্রাণ ভরে হাসলাম।

- যাক, তুমি সত্যি কথটা বললে। ঘুমালে আমার বেশ নাক ডাকে, কিন্তু নিকট আত্নীয়রাও বলতে লজ্জা পায়। এখন কি করব আমরা।

- আপনাকে অফিসে পৌঁছে দেব। সেখান থেকে আপনি এয়ারপোর্টে যাবেন আপনার বোনকে রিসিভ করতে।



আপা সব সময়ই হাসি-খুশী। নির্বাচনের কোন অর্থ না হলেও কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্ত, এই সময়টা ব্যবহার করছেন। ভাগ্নের বাড়িতে এক পার্টির ব্যবস্থা হলো। গিয়ে অবাক হয়ে দেখি জুলিও সেখানে। আমাকে দেখে এগিয়ে এলো।

- বিল আসতে পারে নি, আমাকে পাঠালো। তোমার ভাগ্নের সাথে আলাপ করলাম। বেশ সপ্রতিভ ইয়াং ম্যান।



হঠাৎ রাস্তায় দুটো গাড়ির মধ্যে ভীষণ শব্দে ধাক্কা লাগল। সবাই জানালার কাছে চলে গেল। কিন্তু আমার চোখ ছিল জুলির ওপরে। আপার টেবিলের কাছেই ছিল। দাঁড়ালো বটে কিন্তু কোথাও গেল না। ব্যাগ থেকে একটা বুলেটের মত জিনিস বের করল। তার পরে ক্ষীপ্রহাতে সেটার প্যাঁচ খুলে আপার চায়ের কাপের ওপরে ধরল। তার পর সরে আসতে গিয়ে দেখল আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কাছে এসে আমার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল।

- তুমি তো ঘুমিয়ে ফেল করলে, তাই আমাকে দিয়ে প্ল্যান বি। মনে রাখবে কিছুই দেখ নি। শুধু দুর্ঘটনার শব্দ শুনেছ। তোমার অসুস্থ লাগছে, তুমি এখন বাড়ি চলে যাবে।

জুলির পেছনে পেছনে আমিও এসে আমার গাড়িতে উঠলাম।



মন্তব্য ৭ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:৫৪

হাসান মাহবুব বলেছেন: চরম বোরিং লাগতেসে। পরে আরেকবার ট্রাই নিমু নি।

২| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:০০

সাপিয়েন্স বলেছেন: এটা তো মনোরন্জনের গল্প নয়, রিসার্চ পেপার!

৩| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৪৯

অলওয়েজ এ্যান্টি গর্ভণমেন্ট বলেছেন: এতো ভয়ংকর রুপক !!!

৪| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:৩৯

সবুজ সাথী বলেছেন: কি বলব ভাষা খুজে পাচ্ছিনা। সায়েন্স, মেসমেরিজম, হিপ্নটিজম, রোমান্টিসিজম, লোকাল আর ইন্টারন্যাশ্নাল পলিটিক্স - কি নাই এতে?

আসলেই "ভয়ংকর রুপক"।

৫| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:২১

হাসান মাহবুব বলেছেন: বেশ সাহসী লেখা। অনেককিছু ডিল করেছেন। পরিমাণটা একটু কম হলে উপাদানগুলোর বাঁধন আরো পোক্ত হতো। বর্ণনাভঙ্গি একঘেয়ে।

৬| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৪:৪৪

ই=এমসিস্কয়ার বলেছেন: আসলেই এ এক ভয়ংকর রুপক

৭| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:০৮

রফিক মাহমুদ বলেছেন:
স্যার দেখছি রোমান্টিক গল্প লেখা বাদ দিয়ে রাজনীতিতে ঢুকে গেলেন। তবে আরাফাতের ব্যাপারটা আমিও খেয়াল করেছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.