![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি ... ফাগুন প্রাতের উতলা গো চৈত্র রাতের উদাসী
এ নিয়ে কবার আসা হলো কক্সবাজারে? ছাত্রজীবনে প্রথম সুযোগ পেয়েছিল, তথাকথিত শিক্ষা সফরে। কিন্তু চাটগাঁ আর কাপ্তাই দেখে শেষ করতেই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি শেষ হয়ে গেল, অন্য ছেলেরা স্যারের সাথে কক্সবাজার রওয়ানা হলেও ইশাম বেঁকে দাঁড়ালো।
-না, স্যার , আমি ফিরে যাই, চন্দ্রঘোনা কাগজের কারখানা আর কাপ্তাই হাইডেল প্রজেক্টেই যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন হয়ে গেছে, কক্সবাজারে শিক্ষার কি আছে?
দলের সবাই খুব বিরক্ত মুখে ইশামের দিকে তাকিয়ে ছিল।
-তুমি বেহুদা একজনের জায়গা নষ্ট করলে। আরে বাবা সাগরের পাড়ে গিয়ে ঢেউয়ের ইকুয়েশন সল্ভ করলেও তো পারতে, এদিক সেদিক না তাকালেও চলবে।
ইশামের বয়স তখন সতেরো, এই দলে যাওয়ার কথা ছিল না, তবে হেড স্যার তার নাম প্রথম বর্ষেই ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ইশাম নবম শ্রেণী থেকে শুরু করে একটা ক্লাসও মিস করে নি, এমন কি পরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও না। ১০৫ ডিগ্রী জ্বর নিয়েও সাবসিডিয়ারী পরীক্ষা দিয়েছিল। ওর প্রভাবশালী বাবা ভিসিকে অনুরোধ করেছিলেন অন্য দিন পরিসংখ্যানের প্র্যাক্টিকালটা নেবার নির্দেশ দিতে। কিন্তু ভিসি বলেছিলেনঃ
- ও তো সাবসিডিয়ারী, পাস করলেই চলবে, আর আপনার ছেলে ১০৫ জ্বর নিয়েও পাশ করতে পারবে, খামখা ঝামেলা করে কি লাভ।
পরীক্ষার সময় ইশামের মাথা ঘুরছিল, অপরিচিত এক্সটারনাল স্যার ছিলেন ঘরে। দু বার বলেছিলঃ - স্যার, আমার একটু শরীর খারাপ, শুধু আমার মাথার ওপরের এই ফ্যানটা একটু বন্ধ করতে পারি?
কিন্তু ইশামের চেহারায় কোন ভয় বা বিনয় দেখেননি সেই স্যার, তাই বন্ধ করতে দেন নি।
- অন্যদের গরম লাগবে।
বাড়িতে ফিরে এসে প্রায় অজ্ঞানের মত দু সপ্তাহ বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল ইশামকে। ক্লাস মিস হয় নি, কারণ তখন সামারের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। ফল বেরুলে দেখা গেল থিওরীতে পূর্ণ নম্বর পাওয়ায় ইশামের পরিসংখ্যানে গড় ৯৫% এসেছে। কিন্তু ইশাম অনুভব করে সেই বহিঃপরীক্ষকের ওপরে তার রাগ এত দিন পরেও যায় নি।
তখন কক্সসবাজার কেমন ছিল দেখা হয় নি। দ্বিতীয়বার যাওয়ার সু্যোগ আসে অনেক পরে, চাটগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পরে। একটা হর্নহীণ ভাঙা বাসে করে তারা গিয়েছিল। ইশামের স্ত্রী মুন্নি আর দুই মেয়েও সাথে ছিল। অন্য সবাই আণবিক শক্তি কমিশনের রেস্ট হাউজের লাউঞ্জে ঢালাও বিছানায় শুয়ে ছিল। শুধু কিছু মেয়ের জন্য ওপরের একটা ঘর দেয়া হয়েছিল, আর ইশামের পরিবারের জন্য আরেকটা।
সকালে উঠে বাইরে তাকিয়ে দেখে রেস্টহাউজের বাইরে রাস্তার ওপারেই ধানক্ষেত। তার পরেই কুয়াশায় ঢাকা সমুদ্র। নাস্তার পরেই সবাই কলাতলী থেকে লাবনী চলে এলো। এর আগে অবশ্য ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে আর ইটালীর ত্রিয়েস্তে ইশামের সমুদ্র দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু এমন দীর্ঘ মসৃণ বেলাভূমি দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। পুরো পরিবার পানির সাথে একবার ভেতরে যায় আবার ফিরে আসে; বেশ মজা হয়েছিল। কিন্তু সেই একরাতই। বিকেলেই সোজা চাটগাঁ স্টেশনে ফিরত রওয়ানা হয়ে রাতের ট্রেনে ঢাকা। বাচ্চারা ওপরের দুই বাঙ্কারে। বার বার উঠে দেখতে হয়েছে - পড়ে গেল না তো?
তৃতীয়বার আরো অনেক বছর পরে। ইশাম তখন এক জাঁদরেল অধ্যাপক। কমিশনের চেয়ারম্যানকে বলতেই তিনি নির্দেশ দিয়ে দিলেন - সেই রেস্টহাউজ। এসে একটু হতাশই বোধ করল ইশাম, রেস্টহাউজের অবস্থা অযত্নে হতশ্রী। আশে পাশে কলাতলীতে অনেক ভবন নির্মান শুরু হয়েছে - নিশ্চয়ই হোটেল হবে। দু'একটার ব্যবসা শুরু হয়ে গেছে। ইশামের মনে হয়েছিল খামখা চেয়ারম্যানের ফেভার না নিয়ে হোটেলে বুক করলেই পারত। তবে এখানে সবাই খুব খাতির করল, সস্তায় হিমছরী-ইনানী যাওয়ার বীচজীপ ভাড়া করে দিল। রাঁধুনীর রান্না সাঙ্ঘাতিক ভালো ছিল। চেয়ারম্যানের বন্ধু বলে কথা!
মাঝারাতেরও পরে ঘর থেকে বের হয়ে কলাতলীর সৈকতে গিয়ে সাগরের শাদা ফেনার তীরে এসে আছড়ে পড়া দেখে আর গুরু গম্ভীর ডাক শুনতে শুনতে মনটা অকারণেই কেমন উদাস হয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে বড় ছোট মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে মুন্নি বাচ্চাদের নিয়ে ফিরে গেলে ও আরো অনেকক্ষণ রয়ে গেল। ইচ্ছে করছিল সারা রাতই থেকে যায়। কিন্তু মুন্নির রাগের কথা ভেবে ঘন্টা খানেক পরে ফিরে আসে। বাচ্চাদের অবশ্য ওর সাথেই থাকার ইচ্ছে ছিল। মেয়ে দুটোর কোনটিই মায়ের মত কঞ্জারভেটিভ নয়। তবে বড়টি মাঝে মাঝে মাকে রাজনৈতিক কারণে সমর্থন দেয়, না হলে মা একলা বোধ করলে ওর খারাপ লাগে অনেক। ছোটটিও মাকে ভীষণ ভালোবাসে, কিন্তু বাপের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করতেও ভয় পায় না। ওর ধারণা ও যে কোন লোককে নিজের পক্ষে টেনে নিতে পারে যুক্তি ব্যবহার করে। বিতর্ক চ্যাম্পিয়ন ছিল, হয়তো তাই এই বিশ্বাস।
তৃতীয়বার হোটেলেই বুক করে ঢাকা থেকে। একেবারে কলাতলী বীচের সাথে। ভাবল আগের মত রাতে এসে সময় কাটানো যাবে। কিন্তু হোটেলের রান্না বেশ ভালো হলেও সার্ভিস ছিল খুব দুর্বল, মুন্নি আর বাচ্চারাও মাঝে মাঝে ক্ষেপে যাচ্ছিল বোকা লোকগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে। রাতে সাগরের পাড়ে এসে দেখল - বীচ অংশটা সঙ্কুচিত হয়ে কয়েক বিঘায় পরিনত হয়েছে। আর নোংরা দুর্গন্ধ। বেশিক্ষণ থাকা গেল না।
চতুর্থবার যাওয়ার পরিকল্পনা আমেরিকায় থাকা ছোট মেয়ের। সে-ই ইন্টারনেটে সার্চ করে বার করেছে এই নতুন হোটেলের হদিশ। কলাতলীতে ঠিক সাগরের পাশে নয়, তবে ঘুরে যাওয়া যায়। হোটেলের ভেতর আর বাইরের ছবি দেখে ইশাম অবাক হয়ে গেল। এটা সত্যি বিদেশের অন্তত চার তারা হোটেলের সাথে তুলনীয়। দুই মেয়ে আর মুন্নি সবাই ভীষণ খুশি। তবে সন্ধ্যায় লাবনী গিয়ে সবার মেজাজ প্রথমে খারাপ হয়ে গেল। মনে হলো বাংলাদেশের সব মানুষের একটা বড় অংশ সেখানে এসে জুটেছে, একটু হাঁটতে গেলেই ধাক্কা লাগবে সাবধান না হলে। রক্ষা খুঁজে পাওয়া গেল "কয়লা" রেস্তোরাঁয়। অভিনব স্টাইলে পা ছড়িয়ে হাটের গদিতে বসে মজার খাবার খেলো সবাই। সকালে নিজেদের হোটেলের ব্রেকফাস্ট ছিল অসাধারণ। দুপুরে কারো ক্ষিদেই পেলো না। কাছের কেএফসি থেকে কিছু এনে খেল, আর নোংরা কলাতলী বীচেই একটু হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এল। ইশামের মনে হলো সব হোটেল তাদের সুয়ারেজ সরাসরি কাছের সাগরেই ফেলছে। কেউ কি দেখার আছে?
মুন্নি বিকেলেই ঘুমিয়ে পড়ল-
- আমি আর রাতে খেতে বেরুবো না। আমার খিদে নেই। তোমরা যেখানে ইচ্ছে খেয়ে আসো।
একটু বৃষ্টি শুরু হলো। মেয়েরা আর ইশাম ঠিক করল রুফটপ রেস্তরাঁয় খেয়ে নেবে। সেখানে নাকি লাইভ মিউজিক শো-ও হয়। দেখা যেতে পারে। ইশাম সাথে ক্যামেরাটা নিয়ে নিল। মেয়েটার খেয়াল থাকে না, ওর ডি এস এল আর ক্যামেরায় ব্যাটারীর চার্জ নেই। ইশাম ছাদ থেকে চার পাশের ছবি তুলল, রাস্তার ছবি নিল। কি জঘন্য, ঢাকার মত ট্রাফিক জ্যাম। একটু দূরে দেখতে পেল কমিশনের রেস্ট হাউজ। কত ছোট ছিল দুই মেয়ে তখন। কখনো কখনো দুজনকে দুই কোলে নিয়ে হাঁটত। এখন একজন পিএইচডি শেষ করে অধ্যাপনা করছে, অন্যজনেরটাও শেষ হয়ে এসেছে। কি দ্রুত চলে যায় মানুষের জীবন।
আরেকটু নিচে নেমে এসে সুইমিং পুলের ধারে তিনজন বসল কিছুক্ষণ। পানি তো কোমড় সমান, নেমেছে কয়েকটা বাচ্চা। মায়েরা কড়া নজর রেখেছে। বাবারা সাঁতার-না-জানা বাচ্চাদেরও উৎসাহিত করছে, একটু গভীর পানিতে যেতে। ইশাম ভাবতে লাগল পুলের পানি এত নীল হয় কিভাবে, কি রঙ দেয়? আশা করল ফরমালিন কারবাইডের মত ব্যাপার নেই এতে। অর্থাৎ সস্তায় কাজ সারবার প্রবণতা এরা নিশ্চয়ই এড়িয়ে চলছে। এত পয়সা নেয়ার পরে ও ধরণের কাজের প্রয়োজন থাকতে পারে না। কিন্তু এটা বাংলাদেশ। তার যদি একটা ছোট্ট নাতি থাকত, এখানে হয় তো নামতে দিতে দ্বিধা করত।
পরিচিত কারো সাথে দেখা হলো না। ঠিকই আছে। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় খেয়াল করেছিল - বেশির ভাগ উঠতি বড়লোক। এই গ্রুপে তার চেনা লোক নেই। কেউ গার্মেন্টসের, কেউ বাপ-দাদার জমি আংশিক বিক্রি করে বিশাল ধনী, কেউ রাজনীতিবিদ। সবারই বিনোদন চাই, মাঝে মাঝে। এবং তাদের সামর্থ আছে। ইশাম ধনী নয়। কিন্তু মাঝে মধ্যে বাচ্চাদের আহ্লাদ মেটাবার ক্ষমতা আছে। ‘বাচ্চা’ বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? কিন্তু ইশামের মুখে এ শব্দটাই চলে আসে। মুন্নি রাগ করে মাঝে মাঝে – তুমি ওদেরকে ছোট করে রাখতে চাইলেই তো তা আর সম্ভব না। পাত্র খোঁজার সময় এসেছে।
- ওরা নিজেদের লোক নিজেরাই খুঁজে নেবে।
- বাহ, কি মজা তোমার জন্য তাহলে। কোন দায়িত্ব নেই।
- তোমার কি মনে হয় ওদের বিচার-বুদ্ধি তোমার বা আমার চেয়ে কম।
- বুদ্ধি থাকলেই হয় না। আমরা অনেক কিছু দেখে ঠেকে শিখেছি। ওরা খুব প্রোটেক্টেড জীবন কাটিয়েছে। গাইডেন্স দরকার।
- বেশ, তুমি দুটো ভালো পাত্র সিনেমার বা টেলিফিল্মের মত এখানে আবিষ্কার করে ফেল। তারপর পরিচয় করিয়ে দেব।
মুন্নি ক্ষেপে যায়।
- তুমি কোন দিন রেস্পন্সিবল হতে জানলে না। সব কিছুতেই ফাজলামি।
কথাটা সত্যি হয় তো, খানিকটা। ইশাম কখনো কোন ব্যাপারেই খুব সিরিয়াস হতে পারে না। সে এক নামজাদা অধ্যাপক। কিন্তু তার জীবন সম্বন্ধে এটিটিউডে কোন গভীরতা নেই। তরলের মত, পাত্রের আকারই সে ধার নেয়। নিজের মেয়েদের নিয়ে তার অহংকারের শেষ নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যই তো, বাংলাদেশে তার মেয়েদের যোগ্য আসলেই কোন পাত্র আছে? এই মেধা, এই শিক্ষা, এই নিয়মানুবর্তী পরিশ্রমী জীবন। হয় তো এর চেয়ে সুন্দর মেয়ে আছে। কিন্তু ত্রিশ পয়ঁত্রিশ বছরের পরে তার গুরুত্ব কি খুব বেশি?
ইশাম একদম নিচে এসে লাউঞ্জে বসে। রেখা আর শিখাও এসে যোগ দেয়।
-এখানে কি করছ।
-দেখি এদের কফি কেমন।
তিন কাপ কফির অর্ডার দেয়। ভালোই। দুই বোনই বেশ মজায় আছে।
- মাম থাকলে ভালো হতো।
বড় মেয়েটা মামকে কিছুতেই ভোলে না। ছোটটাও একমত হ্ল।
- চল, জাগিয়ে নিয়ে আসি। ওপরে খেতে যাই।
ইশাম বাধা দিল।
- এখন ডিস্টার্ব করিস না। তোদের মামের ঘুমের প্যাটার্ন আমি জানি। কাল রাতে এক্সাইটেড হয়ে রাত তিনটা পর্যন্ত টিভি দেখে ঘুমিয়েছে। আজ রাত এগারোটায় উঠবে। আমরা খেয়ে ফেরার সময় ভালো দুটো ডিশ রুম সার্ভিসে অর্ডার দিয়ে দেব।
ইশামরা ওপর নীচ আরো কিছু হাঁটাহাঁটি করল। তার ওপরে ছাদে এসে বসল। মাঝখানে খাবার নেয়ার জায়গা। চার দিকে টেবিল সাজানো। একেবারে উত্তরে একটা ছোট স্টেজ। তাতে তিন মিউজিশান তবলা কীবোর্ড আর কি কি তার যন্ত্রে টুং টাং প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইশাম চাইল স্টেজের খুব কাছে যেতে। কিন্তু ততক্ষণে এখানকার ভালো টেবিলগুলো দখল হয়ে গেছে। একটা পেল কিন্তু তার সামনেই একটা পিলার, চেয়ার নাড়িয়েও পুরো স্টেজ দেখা যায় না, শুধু একটা চেয়ার ছাড়া। রেখা সেখানেই বসে পড়ল। ও খুব দ্রুত হাঁটে। ইশাম তার পাশে স্টেজের দিকে মুখ করে বসল। তাতে গায়িকাকে দেখা গেল এবার। কিন্তু স্টেজের বাকিদের না।
হঠাৎ শিখা বলে উঠল।
_ ড্যাড, এদিকে আমার একটু অসুবিধে হচ্ছে। লোকে যেতে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। তুমি এদিকে এসো। না দেখলেও চলবে, শুনলেই তো হলো।
ইশাম একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সে জানে একটু ভীড় থাকলেই অনেক অভদ্র ছেলে মেয়েদের গায়ে ধাক্কা দেয়। উপায় নেই, সে স্টেজের দিকে পিঠ দিয়েই বসল । গায়িকাকে সে দেখেছে। সুশ্রী, কিন্তু অসাধারণ নয় দেখতে। প্রসাধন নেই বললেই চলে, খুব সাধারণ সালোয়ার কামিজ। এত বড় হোটেলে আরো ভালো আর্টিস্ট আনা উচিত ছিল, ওর মনে হলো।
খাবারের অর্ডার দিল ওরা। তার পর গান শুরু হলো। তিরিশ সেকেন্ড শোনার পরেই ইশামের মনে হলো মানুষের পূর্ব ধারণা কি ভীষণ বিভ্রান্তিকর হতে পারে। গানগুলো সবই জনপ্রিয় গান। কিন্তু এ মেয়ে গাইছে মূল গায়িকার চেয়ে ভালো। দর্শকরা হৈচৈ বন্ধ করে ওর গানই শুনছে।
রেখা আর শিখা মজা করে খাচ্ছে। ক্র্যাব, লবস্টার একদম অন্যরকম রেসিপি। ইশাম এসব সহ্য করতে পারে না, তার জন্য চিকেন। মামের জন্য কি জানি অদ্ভুত নামের কি অর্ডার দিয়েছে। পরে দেখা যাবে।
ইশাম ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করল। শিখা অমনি তীক্ষ্ণভাবে বলে উঠল।
- ওভাবে ঘুরে তাকাবে না, খারাপ দেখায়। কান দিয়ে গান শোনো। দেখে কি লাভ।
ইশাম দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলতে গেল। কিন্তু শিখা আটকে দিল।
- চুপ করে বসো তো। এভাবে ছবি তুলতে হবে না।
আসলে দু’একজন ছবি তুলছিল। কিন্তু ইশাম একটু কনফিউজড হয়ে তাড়াতাড়ি আবার বসে পড়ল।
মেয়েটা সাত/আটটা গান গাইল। সবগুলোই ইশামের কাছে অপূর্ব লাগল। অবশেষে সাহস করে বলেই ফেলল।
- আরে, এই মেয়ে দেখছি দারুণ গায়। ও কি টিভি আর্টিস্ট?
শিখা ঠোঁট উল্টালো।
-কি জানি। তাহলে এখানে কেন? তবে ভালো গায়। শোনা যায়।
রেখা একটু ভেবে-চিন্তে বলল।
- আমার মনে হয় এত বড় হোটেলে ভালো আর্টিস্টই এনেছে। কিন্তু মেয়েটার সাজ খুব সাধারণ। সেলেব্রিটিরা ধার করে হলেও ভালো কাপড় পরে।
শিখা একটু বিরক্ত মুখে রেখার দিকে তাকালো।
- এসব আবার তুই কোথায় পেলি?
রেখাকে নিয়ে এটা একটা মুশকিল। ও দার্শনিক। ওর চিন্তা নানাদিকে চলে যায়, অনেকেই খেয়াল রাখতে পারে না।
গান থেমে গেছে, খাওয়া শেষ। ওরা উঠতে উদ্যত হয়। ইশাম বলেঃ
- আরেকটু বসি না। ঘরে ফিরে কি লাভ এত তাড়াতাড়ি।
কিন্তু শিখার গলা বেশ শক্ত হয়ে গেল।
- না নিচে চল, বাইরে একটু হাঁটি। সেখানেও বেশ সুন্দর বাতাস।
ইশাম তবু একটু দেরি করে। ওর আশা ছিল মেয়েটা ওদের পাশ দিয়ে এদিক দিয়ে নামবে, তখন ও একটু ভালো করে তার চেহারাটা দেখে নেবে, তারপর সিডির দোকানে খোঁজ করে তার কিছু গান কিনবে। কিন্তু একটু পরেই বুঝল স্টেজের পেছনে নিচে নামার একটা সার্ভিস সিঁড়ি আছে, মেয়েটা সেখান দিয়ে নেমে গেছে।
ওরা নিচে নেমে এলো। ইশাম ডেস্কে গিয়ে হিসেব পত্র মিলিয়ে নিল, যাতে সকালে সহজে ব্রেকফাস্টের পরেই বেরিয়ে যেতে পারে। লম্বা পথ। রেখা আর শিখা একটু হোটেলের সামনে আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করল। হোটেলের সাইনবোর্ডের লাইটগুলো সত্যি চমৎকার। একটা নান্দনিক প্যাটার্নে বদলাতে থাকে। আসলেই শিখার ইন্টারনেট রিসার্চ ভালো কাজে এসেছে।
হঠাৎ ইশাম খেয়াল করে একটু দূরেই লাউঞ্জে সেই মেয়েটা কফি খাচ্ছে একা। ইশাম থাকতে পারল না। ওর পাশে গিয়ে বসল।
- আপনার গান শুনলাম, আপনি ভীষণ ভালো গান। মনে হচ্ছিল বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল।
- মেয়েটা ওয়েটারকে আরেক কাপ কফি আনতে বলল। তারপর ইশামকে বললঃ
আপনার জন্য এক কাপই বললাম, কারণ শিখা নিজেও আমার টেবিলে আসবে না, রেখা আপুকেও আসতে দেবে না, এবং আপনার ভাগ্যে অনেক গাল আছে, আগেই বলে রাখলাম।
ইশাম হাঁ হয়ে গেল।
- আপনি ওদেরকে চেনেন।
- আংকেল, আপনার মুখে “আপনি” শুনতে মজা লাগলেও আর বলবেন না। আমি শিখার ক্লাসমেইট ছিলাম স্কুলে। আপনি যখন ওকে আনতে আসতেন, আমাকে রোজই দেখতেন ওর পাশে, কারণ আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। আপনি আমাকে কয়েকবার চকলেটও দিয়েছেন এক সময়।
ইশাম মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।
- তোমার নাম কি?
- আংকেল, ওরা আমাকে যে নামে ডাকে সেটা আমার স্কুলের নাম না। এখন আর জেনে কি লাভ। শিখার সাথে আমার এখন আর কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি ওর খবর রাখি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর যখন আমার বাবা আবার বিয়ে করেন, তখন আপনাকে আর শিখা বা রেখাপুকে এক সাথে দেখলে আমার অনেক হিংসে হতো।
দরজার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো।
- শিখা আসছে, আমি অন্য টেবিলে যাই। আমার সাথে কথা বলেছেন, বলবেন না, ও অনেক রাগ করবে।
রেখা ওর মায়ের কাছে চলে গেল।
শিখা এসে একটু তাকিয়েই পিরিচের ভেজা দাগ দেখে বুঝল আর একজন ছিল। তার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে সেই মেয়েকে খুঁজে পেল, যদিও ওদের দিকে পিঠ দিয়ে বসেছিল।
- কথা হলো ওর সাথে?
- তুই রাগ করেছিস? তোরা তো বন্ধু ছিলি এক সময়।
- না, রাগ করি নি। আমি যে কার ওপর রাগ করব তা-ই বুঝতে পারছি না। ওর কি দোষ। ওর সৎ মায়ের জ্বালায় বাড়িতে থাকতে পারত না, ওর বাবাও কোন খোঁজ রাখত না। স্কুল থেকে নাম কাটা গেল। পাড়ার এক মাস্তানের সাথে পালালো। সেটা আবার রাজনীতি করত, ওকে নেতার বাড়িতে তুলে দিল। সেখান থেকে এক টিভি প্রডিউসারের কাছে। তখনো মনে আশা ছিল একদিন নাম করা গায়িকা হতে পারবে। স্কুলে থাকতে কয়েকবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। কিন্তু ওর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়, বেশিদূর এগুতে পারে নি।
হঠাৎ শিখা চেঁচিয়ে ওঠে।
- বিলকিস, এদিকে আয়।
বিলকিস মুখ ফিরিয়ে শিখাকে দেখে প্রথমে আঁতকে ওঠে। শিখা হাসে।
- আয়, বলছি, না হলে মার খাবি, এত লোকের সামনে।
এবার বিলকিস আশ্বস্ত বোধ করে। আবার পুরোনো টেবিলে আসে।
- না রে, আমি যাই, খুব টায়ার্ড লাগছে। একটু জ্বর ছিল। কিন্তু প্রোগ্রাম থাকাতে আসতে হলো।
বিলকিস হাসি মুখেই বিদায় নিল। ওর মোবাইল নম্বরটা শিখাকে দিয়ে গেল। ইশামের হঠাৎ মনে পড়ে গেল একদিন তাকেও ১০৫ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে পুরো ফ্যান ঘুরিয়ে পরিসংখ্যান প্র্যাক্টিকাল দিতে হয়েছিল। কার উদ্দেশ্যে জানি মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলঃ
“বাস্টার্ড!
ইশামের সভ্য-ভব্য মেয়েটি তার বাবাকে কিছুই বলল না।
২| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৩:৩৫
ডার্ক ম্যান বলেছেন: মনে হচ্ছিল কোন সত্য ঘটনা পড়ছি। খুব ভালো লাগলো।
৩| ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ৭:২১
ইঞ্জিঃ সামি বলেছেন: chomotkar
©somewhere in net ltd.
১|
২৯ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৩৬
রফিক মাহমুদ বলেছেন: আমারও মনে হয়
১। সত্যিকার বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না।
২। পৃথিবী জারজে ভর্তি হলেও কাজের মানুষ কাজ করে যেতে পারে।