![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি ... ফাগুন প্রাতের উতলা গো চৈত্র রাতের উদাসী
(প্রথম দিন )
রাজনীতিতে কোন শেষ কথা নেই। তিনি বার বার বলতেন, আজীবন বিশ্বাস করতেন। তাঁর মেন্টর হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দী থেকে তিনি এটা শিখেছেন। সুহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন কলকাতায় ছাত্রজীবনে। পীর বংশের লোক, পীরের মতই শ্রদ্ধা করতেন। কলকাতার রায়টের সময় মেয়র সুহরাওয়ার্দী কি কষ্টেই না দাঙ্গা সীমিত রেখেছিলেন। তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। এটা তাঁর শক্তি ছিল। শহরের এ মাথা ও মাথা চরকীর মত ঘুরেছেন। দুর্বলতর মুসলমানদের উদ্ধার করেছেন । অথচ শের-এ-বাংলা ফজলুল হক এক সময় হিন্দু সাম্প্রদায়িক দলের সাথে মিলে সরকার গঠন করেছিলেন। কি শরমের বাত। সুহরাওয়ার্দী যে পরিবারের সদস্য ছিলেন, সেখানে বাংলা বলার প্রচলন ছিল না। কলকাতার অনেক বনেদী মুসলিম পরিবারেই উর্দু বলা হত, এখনো হয়। গ্রাম বাংলার ছেলে হয়েও তিনি নিজেও মোটামুটি উর্দু আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। রাজনীতি করার জন্য তা অত্যাবশ্যক ছিল। সারাজীবন তিনি ভুলভাল ইংরেজী বলেছেন। জানেন এ জন্য তাঁকে নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করে। তিনি ভালো ছাত্রত্বের পরীক্ষা দিতে রাজনীতিতে নামেন নি। কলকাতার বেকার হোস্টেলে ছাত্রত্ব বজায় রাখতে হলে যেটুকু লেখাপড়া করা দরকার, সেটুকুই করেছেন। সসম্মানে না হলেও পাশ করেছেন, গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন। তাঁর বংশে তিনিই প্রথম। যখন বিশ বছর লেগেছিল ম্যাট্রিক পাশ করতে, অনেকেই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু পাশ তিনি করে ছেড়েছেন। কি আনন্দের দিন ছিল সেটি! গ্রামে ফিরে সবার কি সম্মান আর আদর পেয়েছিলেন। আদালতের সেরেস্তাদাদের ছেলে এবার জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হবে।
হয়তো ঢাকায় এসে আইনে ভর্তি হয়ে ওটাই উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু সুহরাওয়ার্দী তো ঢাকায় এলেন না। তাঁর অবিভক্ত বাংলার স্বপ্ন রয়ে গেল চোখে। মুসলিম লীগ নির্বাচনে জিতে পূর্ব বাংলার শাসন পেয়ে গেল। সঙ্গে সিলেটের একটা বড় অংশ। কিন্তু সুহরাওয়ার্দী কলকাতার আদমী, তাঁর ঘাঁটি কলকাতায়। গুরুকে সাময়িক বর্জন করে ফরিদপুরের ছেলে ঢাকায় চলে এলো। রাজনীতিতে কোন শেষ কথা নেই।
কিন্তু নতুন দেশে তিনি তো সরকারে নেই। সুহরাওয়ার্দীর মত ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট কেউ তাঁকে সাধল না। মওলানা ভাষানী তৈরী করলেন বিরোধী আওয়ামী লীগ। তার যুগ্ম সম্পাদক হলেন পাকিস্তানী টুপি পরা বাঁটকু খন্দকার মোশ্তাক। ইনি তাঁর এক হাত উঁচু, ছাত্রসংঠনের নেতা হলেন। শুরুতেই পাওয়া গেল বিরোধী দলের জন্য একটা শক্ত খুঁটি। জিন্নাহ এসে বললেন - নতুন দেশের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, কারণ উর্দুভাষীরাই তখন মুসলিম সমাজের খান্দানী লোক, যেমন ছিলেন সুহরাওয়ার্দী, যেমন ভাষানীর দলের নাম ছিল "আওয়ামী" লীগ। ছিল সাংস্কৃতিক তামাদ্দুন মাজলিস।
বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সাথে গোলমাল সৃষ্টি ছিল তাঁর প্রধান কাজ। ঢাবির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিউনের সভাপতি হিসেবে অবশ্য তেমন কোন জুতসই কাজ পেলেন না। ভাষা আন্দোলনের সব কাজ অন্যরাই করেছে। তিনি জেল থেকে শুধু নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। ২১ শে ফেব্রুয়ারীতেও তিনি ছিলেন জেলখানায় অন্তরীন। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারীতে গুলি চালিয়ে নুরুল আমীন সরকার যে চরম ভুল করেছিল, তার ফায়দা পেল বিরোধী দল, অর্থাৎ প্রধানত তাঁর দল। অগ্নিময় ভাষায় তাঁরা নুরুল আমীনকে দেশের ঘৃন্যতম ব্যক্তিতে রূপান্তর করলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের দাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯৫৪ সালের প্রদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট তরুণ নেতাকে পুরস্কৃত করল মন্ত্রী হিসেবে। ধানমন্ডী ৩২ নম্বরে তিনি এক খন্ড এক বিঘা প্লট পেলেন, এবং দুর্নীতি দমন মন্ত্রী বেশ দ্রুতই সেখানে একটা দেড় তলা বাংলো বাড়ি বানিয়ে ফেললেন। অবশ্য তাঁর একটা চাকরীও ছিল বিভিন্ন সময়ে - আলফা ইন্সিউরেন্সের কর্মকর্তা হিসেবে। বীমা কি, সে সম্বন্ধে কোন ধারণা না থাকলেও সেই চাকরী পেয়েছিলেন এমন এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে যিনি দিব্য দৃষ্টি দিয়ে এই যুবনেতার ভবিষ্যৎ উন্নতি ও ব্যবহারযোগ্যতা দেখতে পেয়েছিলেন।
যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পেছনে আওয়ামীপন্থীদের উচ্চাশাই কি বেশী দায়ী ছিল? নাকি শের-বাংলার ক্রমবর্ধমান বয়স ও অথর্বতা? প্রাদেশিক সংসদে এক সদস্য আওয়ামী স্পীকারের দিকে চেয়ার ছুঁড়ে মারলেন। ভয়ে তিনি হার্ট এটাকে মারাই গেলেন। জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সংসদ বিলোপ করার সুযোগ পেলেন। কিছুদিন পরে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে পুরো দেশের একনায়ক হলেন জেনারেল আইয়ুব খান।
বৃটেনের সেরা মিলিটারী স্কুল স্যান্ডহারস্টের সেরা বিদেশী ছাত্র ছিলেন আইয়ুব। ভারতের স্যাম মানেকশ'য়ের চেয়ে ভালো। প্রথম দিকে দেশে বেশ কড়াকড়িতে শৃংখলা ফিরে এল। । মোটামুটিভাবে অর্থনৈতিকভাবেও এগিয়ে চলল। কিছু মুসলিম বড়লোক ভারতীয় পাকিস্তানে এসে তাদে র পুঁজি বিনিয়োগ করার সুবিধে পেল এবং কিছু কিছু বড় শিল্প গড়ে উঠল। কিন্তু শাসক গোষ্ঠিদের সাথে ভাষার সখ্যতা তাদেরকে বিশেষ সুযোগ দিক বা না-ই দিক, মুজিবের বক্তৃতায় শোনা গেল - "আমাগো দ্যাশের সোনার আঁশ পাট বিক্রি কইরা করাচীর রাস্তা সোনা দিয়া মুড়াইতেসে।" কৃত্রিম তন্তুর উদ্ভাবনে সনাতন সূর্য বিলীয়মান ঠিকই বোঝা যাচ্ছিল। বাঙ্গালীরা কৃষিকাজে অভ্যস্ত, ব্যবসার অভিজ্ঞতা বেশি ছিল ভারত থেকে আসা মুসলিম অবাঙ্গালীদের। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ঘৃণার স্লোগান সব সময়ই চিত্তাকর্ষক, সকল পাপ-অযোগ্যতা হরক। আওয়ামী লীগের ভাষ্যই সাধারণ মানুষের কাছে বেশি গ্রহনযোগ্য ছিল। যদিও তাঁর রাজত্বের প্রথম দিকে আইউব অপ্রতিরোধ্য ছিলেন, ভুট্টোকে দলে নিয়ে এবং পরে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভয় পেয়ে বাদ দিয়ে একদা স্ট্রং ম্যান আইউব ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়লেন। পুত্র গওহর আইউবের প্রতি অর্থনৈতিক দুর্বলতাও তাঁর ব্যাপক ক্ষতি করে। আইউবকে সরিয়ে সে জায়গায় এলো সেনাবাহিনী থেকে মদ্যপ নির্বোধ ইয়াহিয়া খান। পশ্চিমে ভুট্টো আর পূর্বে তখন মুজিবের বিপুল জনপ্রিয়তা। সেনাবাহিনীর আর কোন স্থায়ী ভূমিকার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না।
১৯৭০ বাংলার উপকূলে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রায় নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়ে মুজিবকে চরম সুযোগ এনে দিল। বাংলাদেশের মানুষ উপলব্ধি করল এই দেশে এক সাথে থেকে তাদের কোন লাভ নেই। এটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা হলেও মুজিব নিজেকে একটি বৃহৎ যুক্ত পাকিস্তানের প্রধান হিসেবেই চিন্তা করছিলেন। অন্যদিকে ভোট কম পাওয়া ভুট্টো মুজিবকে দেশদ্রোহী হিসেবে সেনাবাহিনীর কাছে উপস্থাপিত করে নিজের ক্ষমতার চেষ্টায় মশগুল ছিলেন। মুজিবকে ক্ষমতা হস্তান্তরে বার বার ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী টালবাহানা শুরু করে, প্রধানত ভুট্টোর ইন্ধনে। ভুট্টো বোঝায় ছয় দফা আসলে স্বাধীনতার ব্লুপ্রিন্ট। বিরক্ত ও হতাশ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষণে প্রথম 'স্বাধীনতা' শব্দটি ব্যবহার করেন, কিন্তু তিনি কি করবেন, বা করতে চান, তা তখনো মোটেই ভেবে-চিন্তে ঠিক করেন নি। ইতিহাস তার সাক্ষী। আগরতলা ষড়যন্ত্রের সময়ও কতিপয় নিম্নপদস্থ সেনা এবং কিছু অবান্তর, অসম্পর্কিত মানুষের সমন্বয়ে তিনি কি করতে চেয়েছিলেন, তা-ও অস্পষ্ট। তিনি ধমকের ওপরে কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্তু ব্রিজ বা দাবা খেলা জানতেন না। কোনটা কার্যকর সতর্কবাণী সেটা ভেবে-চিন্তে বার করতে হয়, তার কিছু বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত যে মানুষটি পাকিস্তানের হবুপ্রধানমন্ত্রী, তাকেও ইয়াহিয়ার মত নিম্ন মেধার এক সেনানী বার বার উপেক্ষা করেছে, কারণ তাঁর মধ্যে মেধা, আন্তরিকতা, সততা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব এই অপদার্থের কাছেও খেলো মনে হয়েছিল। পাকিস্তানীদের একমাত্র ভয় ছিল ভারত যাতে কোনভাবে এর সাথে যুক্ত না হয়ে যায়। মুজিব বা মুজিবানুরাগীরা কোনোদিন যুদ্ধ করে স্বাধীন হতে পারবে না, যদি ভারত সহায় না হয়, এই বিশ্বাসে অটল ইয়াহিয়া কালক্ষেপন করতে লাগল। ।
৭ই মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েও তাই মুজিব করাচী থেকে আহবানের আশায় রইলেন। তিনি আবার ভাষণের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন - যে কারণে এর অপর নাম হলো "যদি" ভাষণ - সব কিছু ইয়াহিয়ার সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ ইয়াহিয়া পাকিস্তানকে অক্ষত রাখতে হলে তাঁকে অবিলম্বে ক্ষমতা বুঝিয়ে দেবেন, "স্বাধীনতা" শব্দটি আক্ষরিক অর্থে নয়, এই সিম্বলিক অর্থে তিনি ব্যবহার করেছেন, এটাই বোঝাতে চাইলেন। কিন্তু বামপন্থী এবং কড়া আওয়ামী তরুণ গোষ্ঠীর অনেকে এই মতবাদ মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। মুজিবের ক্ষমতালাভ নয়, সর্বাঙ্গীন বিচারেই দেশ বিভাগ দরকার তাঁদের কাছে এটা অপরিহার্য মনে হলো, যদিও কেউ বুঝে উঠতে পারছিল না ভারত প্রত্যক্ষভাবে এই সংগ্রামে যুক্ত হতে না চাইলে কি করে তা সম্ভব। মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা মুখে অনেক আগুন বার করলেও রাশিয়াকে এ রকম পরিস্থিতিতে ভৌতিকভাবে জড়াবার সম্ভাবনা দেখছিলেন না।
৭ই মার্চের ভাষণের দু সপ্তাহ পরেও ২৪শে মার্চ অনেক আশা নিয়ে মুজিব ইয়াহিয়ার আহবানের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে ছয় দফা দুই দফায় পরিনত হয়েছে -- শুধু পররাষ্ট্র আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছাড়া বাকি সব ক্ষমতা প্রদেশের থাকবে ঘোষণা করল আওয়ামী লীগ। অর্থাৎ ঢিলা ফেডারেশন। ভুট্টো ক্রমাগত ইয়াহিয়া ও পশ্চিমের নেতাদের ক্ষেপিয়ে তুললেন। বিচারক কর্নেলিয়াস ও কামাল হোসেনের মধ্যে একটা আপোস প্রস্তাবের চেষ্টা কিছু এগিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। মুজিবের কাছে খবর এলো সেনাবাহিনী এবার আক্রমণ করবে , দু সপ্তাহ প্রচুর সেনা এসেছে সেই প্রদেশ থেকে। ২৫ শে মার্চ তারিখে মুজিব সব আওয়ামী নেতাকে পালিয়ে যেতে বললেন, এমন কি নিজেও পরে কামরাঙ্গির চরে তাদের সাথে যোগ দেবেন কথা দিলেন। তাজুদ্দিন প্রমুখ অবিলম্বে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বললেন। কিন্তু মুজিব বললেন এ কথা বলে রাষ্ট্রদোহের অপরাধে তিনি কি ফাঁসীতে উঠবেন, তিনি তো অখন্ড পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তাজুদ্দিনরা রাত সাড়ে দশটায় ফেরত চলে গেলেন নিরাপদ আশ্রয় নিতে। মুজিব সুটকেস গুছিয়ে রেখেছিলেন। রাত দেড়টায় তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে সংসদ ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে জেলে, পরে পাকিস্তানে। ব্যাপারটা খুব সম্মানের সাথে ঘটে নি। দু এক জন অফিসার চড়-চাপড়ও মেরেছেন নির্বাচিত প্রধান মন্ত্রীকে।
©somewhere in net ltd.