নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
The inspiration you seek is already within you. Be silent and listen. (Mawlana Rumi)
তুরস্কের স্কলারশিপ টিমের সঙ্গে বিদেশি শিক্ষার্থীদের মনোমালিন্য চলছিল মাসখানেক ধরেই। যা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে ২ অক্টোবর শুক্রবার সন্ধ্যায়।
শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী এক ডর্ম ছেড়ে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরের এক ডর্মে যাওয়ার তাৎক্ষণিক নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরাও এ নোটিশের প্রতিবাদ করে ডর্ম না ছাড়ার ঘোষণা দেয়। ফলে পরিবেশটা হঠাৎ অন্যরকম হয়ে পড়ে। দুই পক্ষের মধ্যে তর্কবিতর্ক আর বচসা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আইনের কাছে হার মানতে হয় শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের গোছগাছের জন্য সময় দেওয়া হয় আধঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যে ব্যাগ গোছগাছ করে আমরা বাসে চড়ে বসি। শুরু হয় ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক যাত্রা। আর শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ তখন তুরস্কের স্কলারশিপ টিম থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সাধারণ জনগণের ওপরেও। জানি না নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এ ক্ষোভ কবে দূর হবে।
৩ অক্টোবর ছিল আমার জন্মদিন। বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় বন্ধুরা মোবাইল, মেইল, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে শুভেচ্ছা জানানো শুরু করেন। তারা যখন আমাকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন তখন আমি বাসে। বাসে চড়লে অনেকের বমির বেগ হয়। কিন্তু আমার হয়নি কখনো। তবে ওই দিন হচ্ছিল। ভেতর থেকে সব যেন বের হয়ে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম এটা আসলে আমার ভেতরের ক্ষোভ আর ঘৃণা। বুকের ভেতর চাপা কষ্ট হয়ে আছে। যা বমি ও চোখের পানি হয়ে বের হতে চাচ্ছে। জীবনের কত কিছুই জমা রেখে দিয়েছি। একদিন জবাব দেওয়া হবে বলে। ২ অক্টোবর রাতটাও আমরা জমা রেখেছি একটি কালো রাত হিসেবে। যে রাতে সবার চোখে পানি। আর চেহারায় ঘৃণা।
নতুন ডর্মে যখন পৌঁছাই বাংলাদেশে তখন ভোর রাত। এই রাতেও আমাদের ডর্মের রেজিস্ট্রেশনসহ নানা ফর্মালিটিস সম্পন্ন করতে বাধ্য করে কর্তৃপক্ষ। এখানেও তাদের সঙ্গে আমাদের তর্ক হয়। নিয়ম রক্ষা শেষ করে রুমে গিয়ে ঘুম দিই। রাতেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই এ ডর্মে না থাকার। তাই সকাল হতেই বাসা খুঁজতে বের হই। সারা দিন বাসা খুঁজে সন্ধ্যা হলে আমি আজ আর অত দূরের ডর্মে ফিরব না সিদ্ধান্ত নেই। সঙ্গে থাকা অপর বাংলাদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্য কোথাও রাত কাটাব বলে স্থির করি। তবে শেষ পর্যন্ত আমাকে নিজের ডর্মেই ফিরতে হয়।
মানুষ কখনো কখনো নিজের অজান্তেই মন্দের পেছনে ছোটে। কখনো বা ভালোর পেছনে। ওই রাতে আমিও ফিরলাম। এর আগে কয়েকবার ফোন দিয়ে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুমিন খবর নিল আমি ডর্মে ফিরছি কিনা। সে বারবার ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছিল আমি কত দূরে আছি। আমি ভেবেছি রাত হয়ে গেছে বা গত রাত থেকে আমাকে একটু বেশি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল বলেই হয়তো খোঁজ খবর নিচ্ছে। তার সঙ্গে আছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল কাইয়ূম।লেখকের জন্মদিনে বন্ধুদের কেনা কেক
ডর্মে পৌঁছানোর পর মুমিন জানাল তার কাছে খাবার আছে। একটু পর আমাকে তার রুমে যেতে বলে। ডর্মে খাবার রান্না করা নিষিদ্ধ। অবশ্য আমরা মাঝে মধ্যে নিয়ম ভেঙে লুকিয়ে বাংলাদেশি খাবার রান্না করে খাই। আমি তাই ওর কথাটাকে খুব বেশি আমলে নিই না।
আমি মুমিনের রুমে যাওয়ার পর দুই বাংলাদেশি শিক্ষার্থী তানভীর হাসনাইন ও মেহেদী হাসানকে আসতে দেখেও বিশেষ কিছু মনে হয়নি আমার। আসলে এতটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে সারাটা দিন ছিলাম যে, জন্মদিন নামক শব্দটাই বোঝা মনে হচ্ছিল।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু, সাংবাদিক হুসাইন আজাদ জন্মদিনে আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন—‘হাসিও তুই, বাতিও তুই/তুই-ই দিশার ঘর/তুই-ই পথের প্রেরণা-দম/ভালোবাসার স্বর…।’ আমি তার কবিতা বারবার পড়ি। পড়া শেষ করে আবার পড়ি। কিন্তু কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি না। তরুণ চলচ্চিত্রকার অর্ণব মামুন, সাংবাদিক মাহফুজ সবুজ তাদের লেখায় আমাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। সাংবাদিক বন্ধু আনিসুর সুমন, আফরোজা হাসি, আরিফুল ইসলামসহ বন্ধুরা কতভাবেই না উইশ করছে। যে মানুষটি হাসলে আমার আকাশ হাসে, সেও জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। কোনো কারণে কষ্ট পাচ্ছি বুঝতে পেরে ভয়েস মেসেজ করেছে। তার আর কটা শব্দের আর একটা মেসেজ ওই রাতেই আমাকে করতে পারত পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। ওই রাতটিও কালো থেকে হতে পারত আলোকিত রাত। হয়নি, আসলে হতে দেয়নি।
শুভানুধ্যায়ীদের এত এত শুভেচ্ছার পরও মন ভালো হয়নি। তুরস্কের স্কলারশিপ টিমের কাছ থেকে এত বাজে আচরণ পাব এটা আমাদের কল্পনায়ও ছিল না। বিষয়টাতে কোনোভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। এমন মন খারাপের দিনেই ওরা আমাকে রুমে ডাকল। আমি গেলাম ও বিস্মিত হলাম। সবাই একসঙ্গে আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল। আমি সত্যিই সত্যিই হাসলাম। শেষ পর্যন্ত উদ্যাপিত হলো আমার জন্মদিন। যা ভোলা যায় না, ভুলবার নয়। এমন উদ্যাপনের জন্য মুমিন ও কাইয়ূমকে কী বলে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছি না।
আমি জানি, কষ্ট আমার একার হচ্ছে না। ওদেরও আমার মতো বাধ্য হয়েই প্রায় গ্রামের মতো একটি এলাকায় চলে আসতে হয়েছে। এটা শহর হলেও এখানে শহরের সুবিধাগুলো তেমন নেই। এই কষ্টের মধ্যে ওদের এমন আয়োজন আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়। চোখেমুখে স্ফূরণ হয় ভালোবাসা। এই প্রবাসে কত কিছুই না মিস করি আমরা। এরই মধ্যে খানিকটা আনন্দ আয়োজন। তাও এমন এক সময় যখন আমরা দুঃখ আর অপমানের সাগরে ফুঁসছি।
শেষ করছি, যারা তুরস্কে উচ্চশিক্ষার জন্য আসতে চান তাদের প্রতি কিছু কথা বলে। গত বেশ কয়েক দিন ধরে শুনছি বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এখন রাস্তায় ঘুরছেন। তাদের একদল ইতিমধ্যে দেশেও ফিরে গেছেন। একদল দালাল উচ্চশিক্ষার নাম করে এই দেশটিতে তাদের পাচার করেছে।
আসলে আমরা বিদেশে শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা জানি না বা নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে সচেতন নই বলেই দালালরা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করার সুযোগ পায়। তুরস্কে ইউরোপের পার্শ্ববর্তী দেশ। এখানকার জীবনযাপন ইউরোপের মতো স্ট্যান্ডার্ড। তবে এখানে মুদ্রার (লিরা) মান কিন্তু ইউরো থেকে অনেক অনেক কম। ইস্তাম্বুলের কথা বলি, এ শহরে জীবনযাপন খুবই ব্যয়বহুল। কিন্তু পার্টটাইম কাজের কোনো সুযোগ নেই। এই সুযোগ নেই বলে একজন শিক্ষার্থী পূর্ণ স্কলারশিপ ছাড়া এখানে এসে পড়তে পারে না। পড়া সম্ভবও নয়।
আমরা বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এখানে তুরস্কের গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা করছি। আমাদের থাকা-খাওয়া ও বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি সম্পূর্ণ ফ্রি। ট্রাভেল কস্ট অর্ধেক। তার ওপর প্রতি মাসে কয়েক শ ডলার পকেট মানি হিসেবে দেওয়া হয়।
এরপরও আমাদের মনে হচ্ছে এই টাকা ইস্তাম্বুলে বসবাস করার জন্য যথেষ্ট নয়। এবার আপনি সিদ্ধান্ত নেন কোনো স্কলারশিপ ছাড়া বা ইউনিভার্সিটি থেকে পাওয়া নামকাওয়াস্তে একটা স্কলারশিপ নিয়ে দেশটিতে চলে আসবেন কিনা। এ ছাড়া তুরস্কে এখন একটি ঝুলন্ত সরকার বিরাজ করছে। সামনে নির্বাচন। আইএস, সিরিয়াসহ নানা আঞ্চলিক সমস্যায় জর্জরিত এ দেশ। তাদের অর্থনীতিও গত ১২ বছরে মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় পর করছে। এ নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল। আজ এ পর্যন্তই।
শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে বাংলাদেশ এই কামনায়। আমাদের মধ্যে থেকেই কেউ হবে আগামীর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এমন স্বপ্নে শেষ করছি। [img|http://s3.amazonaws.com/somewherein/pictures/saroujmahady/saroujmahady-1444064893-b7a7560_xlarge.jpg
লেখাটি আজকের প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে- কষ্টের দিনে খানিক আনন্দ
©somewhere in net ltd.