নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
The inspiration you seek is already within you. Be silent and listen. (Mawlana Rumi)
তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান শুরু হয় স্থানীয় সময় রাত ৯টার কিছু পরে। আমি টের পাই সাড়ে ১০টার পরে। তখনো বুঝিনি অদ্ভূত সব অভিজ্ঞতায় ভরা নতুন এক রাত ও ভোর অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ইস্তাম্বুলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের যে ডর্মেটরিতে থাকি সেখানে ছেলেরা প্রথমবারের মতো এ খবর পায় আমার কাছ থেকেই। তারপর শুরু হয় হৈচৈ আর উৎকণ্ঠা। মধ্যরাতে সরকার পতনের অজানা আতঙ্ক আর শেষ রাতে তুরস্কের গণমানুষের বিজয় উল্লাসের সাথে আমরা বিদেশিদের স্ব:স্তি। রাত ১১টা। আঙ্কারা থেকে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে দেশটির প্রধান ও সবচেয়ে বড় শহর ইস্তাম্বুলে। ততক্ষণে দেশে সামরিক আইন জারি করে বিদ্রোহী গোষ্ঠিটি। দেশটির প্রায় গুরুত্বপূর্ণ সব দপ্তর, সংসদ ভবন, এশিয়া-ইউরোপ সংযোগ সেতু, বিমানবন্দরসহ গুরুস্বপূর্ণ সবকিছুই দখল করে নেয় সেনাবাহিনী। রাষ্ট্রীয় বেতারে ঘোষণা করা হয় সরকার পতনের খবর। এরই মধ্যে সামাজিক গোযাযোগ মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান পরিবারসহ বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছে। এবার আতঙ্ক হুহু করে বাড়ে। এরদোয়ান সরকারের পতন হয়েছে ধরে নিয়ে সবার চোখ রাখি টিভি পর্দায়। যেখানে বিদ্রোহীদরে বিভিন্ন অর্জন দেখানো হচ্ছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নিলে আমরা যারা বিদেশী শিক্ষার্থী তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। পরে অবশ্য এরদোয়ান কন্যা নিহতের গুজব নাকচ করেন।
রাত ১২টার পর অভ্যুত্থান নিয়ে গণমাধ্যমে প্রথম কথা বলেন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইয়েলদ্রিম। তখনো কেউ ভাবেনি এরদোয়ান সরকার কাল পর্যন্ত টিকবে। তবে সবকিছু পাল্টে যায় রাত ১টার পর। এক মোবাইল বার্তায় প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তার সমর্থকদের আহ্বান জানান রাস্তায় নেমে আসতে। তিনি নিজেও রাস্তায় নামার ঘোষণা দেন। তারপরই সশস্ত্র এ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ঢল নামে সাধারণ জনতার। কারো হাতে তুর্কি পতাকা, কেউ এরদোয়ানের ছবি হাতে, কেউ কপালে তুরস্কের পতাকা বেঁধে। জনতা রাস্তায় বেরিয়ে সেনাবাহিনী ট্যাংকগুলো দখলে নেয়। এসময় তারা আল্লাহু আকবারসহ এরদোয়ান এবং গণতন্ত্রের পক্ষে নানা স্লোগান দেয়। নিজেরাই সেনা সদস্যদের গ্রেপ্তার করে পুলিশের হাতে দেয়। জনতার চাপে তুরস্কের প্রধান বিমানবন্দর থেকে রাতেই সরে যেতে বাধ্য হয় সেনাবাহিনী। এরদোয়ান বিমানবন্দর হয়ে ইস্তাম্বুল ফিরে টেলিভিশনে ভাষণ দেন। এরপর রাস্তায় রস্তায় শুরু হয় সেনা-জনতা সংঘর্ষ। গোলাগুলির শব্দে যেন ঘোর কাটে আমাদের। সবাই দলবেধে বারান্দায় যাই। সতর্ক হয়ে দেখি আমাদের আবাসস্থলে হামলা হচ্ছে কি না। ফেসবুকে তুরস্কে বসবাসরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাইরে বের না হতে অনুরোধ করে স্ট্যাটাস দেন ইস্তান্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের তার্কিশ ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রের ম্যানেজার গোজদে ওরহান। তিনি ইস্তান্বুলে থাকা বিদেশি ছাদের সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করেন। তারপর মেইল চেক করি, দেখি ইস্তান্বুল কনস্যুল জেনারেল বাংলাদেশ অফিস থেকে সতর্ক বার্তা। আমরা যেন প্রয়োজন ছাড়া বের না হই সে বিষয়ে অনুরোধ করা হচ্ছে। কথা বলি, কনসাল জেনারেল এএফএম বোরহান উদ্দিনের সাথে। তিনি ভালো আছেন। বাংলাদেশি সবাই ভালো আছে বলে জানান। এবার আমি নিজেই অন্য সবার খোঁজ-খবর নেই। বাংলাদেশের সবাই ভালো আছে। এরই মধ্যে পাই আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জরুরি কন্টাক্ট নম্বর। নিজ দেশের এমন দায়িত্বশীল এমন তৎপরতা সত্যিই ভালো লাগে।
রাত দেড়টার পর বেশ ক’জন তার্কিশ বন্ধুর সাথে কথা বলি, কথা বলি কয়েকজন শিক্ষকের সাথে। তারা সবাই ভালো আছেন। এদের বেশির ভাগই এরদোয়ান বিরোধী। তারা এরদোয়ানের পতন চায়, তবে সামরিক অভ্যুত্থান চায় না। যারা এরোদয়ানের সমর্থক তারা ততক্ষণে রাস্তায়। সালিহা অখোমুশ নামে এক শিক্ষককে ইনবক্স করে জানতে চাইলাম কেমন আছেন। জবাবে বললেন, ভালো নেই। রাস্তায় আছি। আসলে নারী পুরুষ ভেদে এরোদয়ান সমর্থকেরা মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে আসেন। রাস্তায় নামেন প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিক পিপলস পার্টির (সিএইচপি) ও দ্বিতীয় প্রধান বিরোধী দল ন্যাশনাল মুভমেন্ট পার্টির (এমএইচপি) নেতাকর্মীরাও । তারা সবাই
ইসলামপন্থী এরদোয়ান সরকারের পতন চান, তুরস্কের মূলনীতি ফেরৎ চান। তবে এসব চান নিয়মতান্ত্রিকভাবে। এ দুটি দলসহ সব রাজনৈতিক দলই রাতে বিবৃতি দিয়ে সেনা ক্যুর নিন্দা জানান এবং এরদোয়ান সরকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। কেন তারা এরদোয়ান সরকারের বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান চান না, এটা রাতেই বিবৃতি দিয়ে পরিষ্কার বেরন সিএইচপি প্রধান কামাল খেলেচদারওলো। তিনি বলেন, আমরা গণতন্ত্রকে সমর্থন করি। এদেশে বহুবার সেনাবাহিনীর অভ্যুথান হয়েছে। যার জন্য মূল্য দিতে হয়েছে রাষ্ট্র তূরস্ককে। তিনি মিলিটারি ক্যুপ একটি সমস্যা অভিহিত করে পুনরায় তা চাননা বলে জানান।
আমার বন্ধু, সাংবাদিক ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে কথা বললে সে জানায়, আমরাও রাষ্ট্রের কিছু পরিবর্তন চাই। এরদোয়ান আমলে হারিয়ে যাওয়া কিছু জিনিসের পুন: প্রতিষ্ঠা চাই। তবে অস্ত্রের মাধ্যমে এ পরিবর্তন চাই না। এবার আমি শিক্ষক বন্ধু ছাড়াও আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে অভ্যুত্থানের কারণ জানার চেষ্টা করি।
কেন সেনাবাহিনী এ সরকারের পতন চায়? আর কারাই বা এ অভ্যুত্থানের পেছনে!
তাদের সাথে কথা বলে বুঝি সেনাবাহিনী ও বিরোধী দলের সাথে এরদোয়ান সরকারের যে তীব্র বিরোধ তা মূলত আদর্শিক। সেনাবাহিনীসহ অন্য বিরোধী দলগুলো বারবার অভিযোগ করছে, এরদোয়ান সরকার যা করছে তা এ রাষ্ট্রের আদর্শ বিরোধী। এ সরকার অব্যাহতভাবে ইসলামপন্থার দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে যা তুরস্কের রাষ্ট্রীয় ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের জন্য হুমকি। এর বাইরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি এক নায়কের মতো দেশ চালাচ্ছেন। দিনে দিনে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছেন। সম্প্রিত সিরিয়ান রিফিউজিদের নাগরিকত্ব দেওয়া প্রশ্নেও এরদোয়ানের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন তুরস্কের সব মহল। এরদোয়ানের সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্কুল কলেজে হিজাব পরিধানসহ বিভিন্ন ইসলামী রীতিনীতি পুনপ্রচলন করেছেন, তুরস্কে যা ১৯২৩ সালের পর থেকে নিষিদ্ধ ছিল। মূলত এসব রীতনীতির পুনবিদায় চায় এরদোয়ান বিরোধী শক্তি। তারা আধুনিক তুরস্কের প্রবর্তক মোস্তফা কামাল পাশার মূলনীতির সমূল বহাল চায়। এ অভ্যুত্থানের পেছনে এসব কারণই প্রধান বলে অনেক বিশ্লেষক বলছেন।
এদিকে এরদোয়ান, সরকার এ অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ফেতুল্লা গুলেন এর হাত রয়েছে বলে দাবি করেছে। গুলেন আন্দোলনের এ নেতার সমর্থন নিয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেছিল এরদোয়ান। এরপরই দু’জনের মধ্যে নানা
বিষয়ে শুরু দ্বন্ধ্ব। পুরো তুরস্ক জুড়ে এখনো গুলেনের প্রচণ্ড প্রভাব, রয়েছে বিশাল ভক্ত বাহিনী। তবে এরদোয়ানের সাথে তুরস্কের অভ্যন্তরে লড়াই করার ক্ষমতা ক্রমেই গুলেনের কমছে। এখন যা ‘নাই’ এর ঘরে এসে থামবে বলেই বলছেন বিশ্লেষকরা। এর আগে পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ থেকে গুলেনপন্থীদের বিদায় করেন এরদোয়ান। গতকালের অভ্যুত্থানের পর এক শ’ এর
উপরে ইতোমধ্যে চাকরি ছাড়া করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। তাদের একটি বড় অংশই গুলেনপন্থী বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যাইহোক রাত বেড়ে চলছে, পৌনে ৩টা, ৩টার দিকে গুলাগুলির আওয়াজ কমে আসে। ঠিক এ সময়ই আসে তুর্কি প্রাধানমন্ত্রীর ঘোষণা তিনি বদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছে বলে ঘোষণা করে সবকিছু তার সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেন। ততক্ষণে বিজয়োল্লাস দেখা যায় রাস্তায়, ফেসবুকে। যেই শিক্ষক রাত ১টায় বলেছিলেন ভালো নেই। তিনি উল্লাস প্রকাশ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। বিদ্রোহিদের
ব্যাঙ্গও করেন এ রমনী।
রাত ৪টার পর আবার গুলাগুলির আওয়াজ শোনা যায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে আমাদের মধ্যে। বেশ কয়েকটা যুদ্ধ বিমান আমাদের ডর্মের পাশ দিয়ে প্রচণ্ড আওয়াজে উড়ে যায়। মনে হচ্ছিল, যেন আমাদের ওপরই বোমাবর্ষণ হচ্ছে। ভয়ে সবাই দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। এর কিছুক্ষণ পর পুনরায় আসে তুর্কি প্রধানমন্ত্রীর পুন:ঘোষণা। তিনি জানান, কিছু বিপথগামী কয়েকটি বিমান দখল করে এসব করছে। ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এরই মাঝে টটেলিভিশনগুলোতে লাইভ কথা বলেন এরদোয়ান। তাকে ঘিরে রেখেছে সমর্থকরা। এভাবেই ভোর আসে, বিদ্রোহিতের জন্য বিষাদ আর এরদোয়ান সমর্থকদের জন্য হাসি নিয়ে।
আজও রাস্তায় থাকার জন্য তার সমর্থকদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। গত রাত থেকেই তুরস্কের মসজিদগুলোতে কিছুক্ষণ পর পর আজান হচ্ছিল, দুয়া দুরুদ পড়র আওয়াজ ভেসে আসছিল। সরকারপন্থী বিভিন্ন এনজিওর পক্ষ থেকে সবাইকে রাস্তায় নামার জন্য অনুরোধ জানেয় ম্যাসেজ আসছিল। প্রেসিডন্টে নিজের নামে একটি ম্যাসেজ পাঠান সবাইকে।
ব্যর্থ এ অভ্যুত্থান শেষ হলেও এখনো বিদ্রোহীদের একটি অংশ সক্রিয় রাজধানী আঙ্কারায়। তারা অস্ত্রসমর্পণ করেননি। তাই প্রেসিডেন্ট গণতন্ত্র রক্ষায় তার সমর্থকদের আঙ্কার যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ আঙ্কারার পথ ধরেছে। মসজিদে মসজিদে চলছে দুয়া দুরুদ।
এ লেখা যখন লিখছি, ১৬ জুলাই স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে শুরু হয়েছে সর্বদলীয় বৈঠক। এ বৈঠক থেকে একটি যৌথ ঘোষণা আসবে বলে শােনা যাচ্ছে। তবে ঘোষণা যাইহোক এরদোয়ান সরকার এ যাত্রায় টিকে যাচ্ছেন বলা যায়। আর তুর্কি নিজেদের আবার নতুন করে চেনালেন সাহসী বীর হিসেবে। যাদের সাহসের কাছে সেনাবাহিনীর ট্যাংক বা জেট বিমানের ভারী গোলা বর্ষণ তুচ্ছ।
লেখাটি আজকের যুগান্তরে প্রথম পাতায় প্রকাশিত, ভয় শংকা আর উল্লাসের রাত
©somewhere in net ltd.