![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গন্তব্যহীন যাত্রা, লক্ষ্যের সন্ধানে ছুটছি , মায়া, ভালবাসা আর বাস্তবতার বন্দরে নৌকা ভিড়াই কিন্তু লক্ষ্যের দেখা পাইনা, আবারো ছুটে চলি দিক হারা নাবিকের মত ------চলার পথে ছায়া হয়ে থাকে মানুষের অপার মমতা আর ভালবাসা।
বাইরে ভোরের কুয়াশা জানালার কাঁচে ঝাপসা চাদর টানিয়ে দিয়েছে, বিদায়ী শীতের ঠাণ্ডা হাওয়া এখনও কাপন ধরায়। বাইরের ধুসর পর্দায় দৃষ্টি হচ্ছে প্রতিহত। নির্জন রাস্তার দুপাশের সারিবদ্ধ গাছ গুলো নতুন দিনের সুর্যের অপেক্ষায় নত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরও দূরে তাকিয়ে যত পারা যায় শেষবারের মত মনের শখ মিটিয়ে নিজের জন্মভূমিকে দেখে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে শাহরিয়ারের। নিজের অজান্তেই মনের কষ্টগুলো জমাটবাধা বরফ গলা পানি হয়ে দুচোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে। পাশেই ওর সবসময়ের সহযোগী ও বন্ধু ছোট মামা বসে আছেন, চুপচাপ। ভাগ্নেকে এয়ারপোর্টে পৌছে দিতে এসেছেন সেই খুলনা থেকে। ভাগ্নের চোখের পানি তার মনকেও ভরাক্রান্ত করে তুলছে। দীর্ঘ কয়েক বছর বাইরে থেকে ভাগ্নে দেশে ফিরে এসেছে অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে, পরিবার বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে সুখে বাস করবে জন্মভূমিতে। ব্যবসা শুরু করেছিল কাছের কিছু বন্ধু বান্ধব কে নিয়ে। কিন্তু ওর বন্ধুরা এবং এমনকি পরিবারের কিছু খুব কাছের মানুষেরা ওর বিশ্বাসের গোড়ায় কুড়াল মেরে ওকে একপ্রকার পথে বসিয়ে দিয়েছে। আর দুই বছর পর সব স্বপ্ন হারিয়ে শূন্য বুকে ফিরে যাচ্ছে শাহরিয়ার। বন্ধুদের কাছ থেকে ও যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে বেশী কষ্ট ও পেয়েছে যে মেয়েকে ভালবাসত তার কাছ থেকে। ওর এই দুঃসময়ে সেই মেয়েটিও সাথে থাকেনি, ওকে চেড়ে চলে গিয়েছে। অথচ ওর দেশে ফিরে আসার একটি বড় কারন মেয়েটি। শাহরিয়ার আর হয়ত দেশে ফিরবে না, দোয়া থাকবে যেন তার ভাগ্নের আগামী দিনগুলো সুখের হয়।
অনেক ভাল মন্দ স্মৃতি ভেসে উঠছে শাহরিয়ারের চোখের পর্দায়। দেশের বাইরে থাকতে অনেক কথা হত ওর মহুয়া’র সাথে, রাত জেগে চ্যাট করত, ফোনে কথা হত কয়েকবার প্রতিদিন। দুজনের অনুভুতির উচ্ছাস তুলে দিয়েছিল হাজার মাইল দুরত্বের দেয়াল। কত শত গিফট আদান প্রদান, নিজেকে বড় সুখী মন হত। ওর অনুপ্রেরনায় একপ্রকার বন্ধু-পরিবার সবার নিষেধ উপেক্ষা করে শাহরিয়ার দেশে ফিরে আসল। শুরু করল ব্যাবসা, নিল অভিজাত অফিস, বেকার বন্ধু আর আত্মীয় স্বজন গুলোকে বিভিন্ন ব্যবসার উইং এর দায়িত্ব দিয়ে কাজে লাগালো। দেশে আসার পরও সবকিছুই ভাল চলছিল। কিন্তু মাস কয়েক আগে ব্যবসায় ধস নামতে শুরু করলো, কারনগুলো জানতে পারলেও করার ছিল না কিছুই। আর ঠিক এই দুঃসময়ে মহুয়া’ও মুখ ফিরিয়ে নিল। পরিবর্তনটা আরও আগেই কিছু টের পেয়েছিল শাহরিয়ার কিন্তু বিশ্বস্ত মন পাত্তা দেয়নি। ওর হয়ত মোহমুক্তি ঘটেছে। এখন আর শাহরিয়ারের ফোন ধরেনা মহুয়া। অথচ, শাহরিয়ার কখনও অর ফোন না ধরলে করত অভিমান, কেদে ভাসাত বুক। অনেক বার ভেবেছে শাহরিয়ার কী ছিল ঐ মেয়ের মধ্যে, কী দেখে ভুললো ওর মত পাথর হৃদয় মানুষ?” হ্যা ঠিক যা ছিল তা তো মহুয়ার মধ্যে নয়– ছিল শাহরিয়ারের বিমুগ্ধ মনের সৃজনশীল কল্পনায়। আছে তার প্রণয়াঞ্জনলিপ্ত নয়নের দৃষ্টিতে। সে যে আপন মনের মাধুরী মশিয়ে মহুয়াকে করেছে রচনা। জগতে শাহরিয়ারের মত মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুখে অনন্ত মিশ্রিত। যুগে যুগে এই নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে, ভালোবেসেছে, তারপর সারা জীবনভর কেঁদেছে। হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে রসঘন, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গানচিত্র, ভাষ্কর পাষাণ-খণ্ডে উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা। জগতে বুদ্ধিমানেরা করবে চাকরি, বিবাহ, ব্যাংকে জমাবে টাকা, স্যাকরার দোকানে গড়াবে গহনা; স্ত্রী, পুত্র, স্বামী, কন্যা নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করবে সচ্ছন্দ সচ্ছলতায়। তবু মেধাহীনের দল একথা কোনদিনই মানবে না যে, সংসারে যে বঞ্চনা করল, হৃদয় নিয়ে করল ব্যঙ্গ, দুধ বলে দিল পিটুলী– তারই হলো জিত, আর ঠকল সে, যে উপহাসের পরিবর্তে দিল প্রেম। শাহরিয়ার কখনও ভাবেনি উপন্যাসের বিরহের ঘটনা তার নিজের জীবনেই সত্য হয়ে ধরা দেবে। সস্তা সান্তনা হল, রবী ঠাকুরের ভাষায়- প্রকৃত প্রেম নাকি নাকি শুধু কাছেই টানে না, দুরেও ঠেলে দেয়। যাযাবরের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে শাহরিয়ার নিজেও বলতে চায় - যে নারী, প্রেম তার পক্ষে একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র। আবিষ্কার নয়, যেমন পুরুষের কাছে। মেয়েরা স্বভাবত সাবধানী, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর বাঁধে। ছেলেরা স্বভাবতই বেপরোয়া, তাই প্রেমে পড়ে তারা ঘর ভাঙ্গে। প্রেম মেয়েদের কাছে একটা প্রয়োজন, সেটা আটপৌরে শাড়ির মতই নিতান্ত সাধারণ। তাতে না আছে উল্লাস, না আছে বিষ্ময়, না আছে উচ্ছ্বলতা। ছেলেদের পক্ষে প্রেম জীবনের দুর্লভ বিলাস, গরীবের ঘরে ঘরে বেনারসী শাড়ির মতো ঐশ্বর্যময়, যে পায় সে অনেক দাম দিয়েই পায়। তাই প্রেমে পড়ে একমাত্র পুরুষেরাই করতে পারে দুরূহ ত্যাগ এবং দুঃসাধ্যসাধন। এমন প্রেমিকের জন্য কোন দিন কেউ করবেনা প্রার্থনা, পঠিবেনা কল্যান তরে কায়মোনা বাক্য, প্রবাসে অদর্শন বেদনায় কোন চিত্ত হবে না উদাস উতল। রোগশয্যায় ললাটে ঘটবে না কারও উদ্বেগকাতর হস্তের সুখস্পর্শ, কোনো কপোল থেকে গড়িয়ে পড়বে না নয়নের উদ্বেল অশ্রুবিন্দু। সংসার থেকে যেদিন হবে অপসৃত, কোন পীড়িত হৃদয়ে বাজবে না এতটুকু ব্যথা, কোনো মনে রইবে না ক্ষীণতম স্মৃতি। প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয়না অথচ দহন করে। সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দাহনে পলে পলে দগ্ধ হল শাহ্রিয়ারের মত বহু কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য পুরুষ।
প্লেন ছুটতে শুরু করেছে বিপুল গতিতে, কিছুক্ষনের মধ্যেই ডানা মেলে দেবে নীল আকাশের বুকে। চোখের নোনা জলে জানালা দিয়ে সব কিছুই ঝাপসা ভাবে সুরে সরে যাচ্ছে। জানে যতক্ষন না আ্কাশের বুকে মিলিয়ে যাবে প্লেন, ততক্ষন ওর মামা চেয়ে থাকবে আকাশ পানে। ইমিগ্রিশনে ঢোকার আগে ওকে জড়িয়ে ধরে মামার শিশুর মত কান্না সচকিত করেছে আশে পাশের যাত্রীকে, অশ্রুসজল চোখে বাহুডোরে ধরে শাহরিয়ার শুধুই দিয়েছে নীরব সান্ত্বনা । দীর্ঘদিন যোগাযোগ না থাকা মহুয়াকে লিখেছে একটা চিঠি, মামার মারফতে হয়ত পেয়ে যাবে শীঘ্রই। খাম খুললেই দেখতে পাবে একটি কবিতা, যেখানে লেখা -
আমি শঙ্খচিল হয়ে তোমাকে ছুতে ঊড়তে থাকি,
তুমি তোমার আকাশকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে যাও।
আমি তোমাকে লক্ষ্য ধরে ছুটতে থাকি,
তুমি তোমাকে যোজন যোজন পিছিয়ে নিয়ে যাও।
অবশেষে সব কিছু আমার অধরাই রয়ে যায় ;
আমার ক্লান্তি, আমার কষ্ট !!!
না, ওগুলো নাহয় অনুক্তই থাক ;
নেই কোন অভিযোগ, অভিমান...
আমি তোমাকে তোমার নিজের কাছেই সমর্পন করে গেলাম
তোমাকে তুলে দিলাম তোমার বিবেকের কাঠগড়ায়
আদালতের রায় শেষে যদি বোধদয় হয় তবে
আমাকে আর খুজো না,
খুজে নিও অন্য কাউকে, বিলিয়ে দিও আমার না পাওয়া গুলো
ভালো থেক, অনেক অনেক ভালো......।।
ইতি
(স্বপ্নবাজ শাহরিয়ার)
ছবিসুত্র -গুগল
(গল্পের কিছু উক্তি বিনয় মজুমদারের উপন্যাস থেকে ধার করা।)
©somewhere in net ltd.