নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক
রাজপথের আন্দোলনে আজ যারা পথে পথে লড়াই করছেন, আপনাদের দূর থেকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি। ১৫ জুলাইয়ে আপনাদের এক অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের রাতের প্রতিটি মুহূর্তের অনলাইন সাক্ষী হয়ে ছিলাম। আমি জানি, রাজপথের এই আন্দোলনে সাধারণত কোন পরিবারই তার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের যেতে অনুমতি দেন না।আমার নাগরিক মধ্যবিত্ত্ব বাবা-মা-ও কখনই আমাকে "রাজনীতি" করবার অনুমতি দেননি।বাবার চাকুরীর কষ্টার্জিত রোজগারের সবচাইতে দায়িত্বশীল সদ্বব্যবহার হল দ্রুততম সময়ে ডিগ্রী শেষ করে চাকুরীতে ঢুকে যাওয়া। রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো, আর পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার দায়িত্ব নেয়া। সংসারে আয়-উন্নতিতে বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের ভার লাঘব করা।
এইসব দায়িত্ব নেয়াকে অনেক বিপ্লবী বন্ধুরা হরদম "মধ্যবিত্ত্ব" "সুবিধাবাদী" "অরাজনৈতিক" আখ্যা দিয়ে থাকে। অথচ, এ-ও এক জীবন সংগ্রামের এক পর্যায়। জীবনের কোন সংগ্রামই অরাজনৈতিক হতে পারে না। আজকে রাজপথে যা হচ্ছে, তা-ও মোটেই অরাজনৈতিক নয়। রাজনীতির মৌলিক ধারনায় কোটা সংস্কারের জন্যে এই আন্দোলনও রাজনৈতিক।আবার, এটাও সত্যি যে, সেটা প্রথাগতভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জনের জন্যে দ্বি-দলীয় রাজনীতি থেকে চরিত্রগতভাবে একেবারেই ভিন্ন। নির্বাচন করে ক্ষমতায় আহরণের আকাঙ্ক্ষাবিহীন, আওয়ামী-বিএনপি-জাপা-জামাতের দলীয় মতাদর্শিক রাজনীতির আবদ্ধ গণ্ডী থেকে মুক্ত সৃষ্টিশীল এক অভিনব রাজনীতি, যা নিতান্তই তরুণদের নিজস্ব চিন্তায় গড়ে তোলা ইস্যু ভিত্তিক মাঠের রাজনীতি।এখানে আমরা তরুণ সমাজের সংকট, সংগ্রাম, আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্নকে দেখতে পাচ্ছি, যাকে অস্বীকার করা, বা ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নেই।
২০১৮ সালের আন্দোলনের সময়, আমি শুনেছি, এই আন্দোলনকে "পেটি বুর্জোয়া" অভিহিত করা হয়েছিলো। কেননা, এখানে কেবল সরকারী চাকরীর সুযোগ-সুবিধার ভাবনা ছাড়া আর কিছু নেই। সমাজের মৌলিক সমস্যাগুলো নিয়ে কোন ভাবনা নেই, মৌলিক রূপান্তরের কোন আকাঙ্ক্ষাও নেই। শ্রেণী-লিঙ্গ-জাতিবর্ণ ব্যবস্থার রূপান্তরের কোন ডাক নেই।বিসিএস পরীক্ষার জন্যে লাইব্রেরীর সামনে লম্বা লাইন দেখে অনেককে হতাশ হতে দেখেছি।হাইকোর্টের কোটা বাতিলকে অসংবিধানিক ঘোষণার প্রেক্ষিতে নতুন দফায় ২০২৪ এর আন্দোলন দানা বাঁধার সময় এমন আলোচনা হয়েছে যে, এইগুলা তো শেষ পর্যন্ত বেঞ্জির, মতিউর হইতে চায়, সরকারী ক্ষমতা চায়, অসৎ অর্থ উপার্জনের সুযোগ চায়।এই আন্দোলন সিস্টেমে ঢোকার আন্দোলন, সিস্টেম ভেঙ্গে ফেলে নতুন ব্যবস্থার আন্দোলন নয়। সম্ভবত এ কারণেও অনেকেই এই আন্দোলনকে কেবল দূর থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন, কাছে ভিড়ছিলেন না।
কিন্তু, যে তরুণ নিজের যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব নিতে চায়, সে তরুণের সংগ্রাম কেন আমাদের নয়? এই যে নিজের কাঁধে সংসারের জোয়াল বইবার প্রস্তুতি তা কেন ছোট, আটপৌরে, কম মর্যাদার ? সংসারের ঘানি টানা, থলি হাতে বাজারে যাওয়া, বাবা-মা, ভাই-বোনের সুখশান্তি, নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়া, নিজের সংসার গড়ে তোলা, - নিত্যদিনের এই জোয়াল বইবার শক্তির উপরই কি অংশতঃ একটা রাষ্ট্রসমাজের টিকে থাকা নির্ভর করে না? ঘরে ঘরে বিশ্রাম ও আশ্রয়ের দুর্গ না থাকলে আপনি-আমি যুদ্ধে যাওয়ার শক্তি ও রসদই বা কোথা থেকে পাবো? লড়াই শেষে জয়-পরাজয়ের পর ফিরবো কোথায়? কিসের কাছে? দেশের কৃষক-শ্রমিক-জনতার মেধাবী সন্তানদের জন্যে চাকরীর ন্যায্য সুযোগ সৃষ্টি করা দেশ গড়বারই এক সোপান-খণ্ড নয় কি? দেশের গোটা শাসনযন্ত্র, আমলাতন্ত্র, পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ কার হাতে তুলে দিয়ে আমরা রাতে ঘুমাতে যাব? নিশ্চয়ই আজকের মত দুর্বৃত্তদের হাতে নয়? নিশ্চয়ই, নিশ্ছিদ্রভাবে সৎ, যোগ্য, দক্ষ, মেধাবী, দেশপ্রেমিক তরুণদলের হাতে।এই কাণ্ডারি তরুণদল কারা হবে, কিভাবে এদের নিয়োগ হবে, কিভাবে তাদের বাছাই করা হবে, এই ছাকুনির উপরই নির্ভর করে আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র, রাষ্ট্রের কার্যকারিতা।
এই বাছাই ও ছাঁকন প্রক্রিয়া যে এক অবিশ্বাস্য অন্যায্য ও আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ চেহারা ধারণ করেছে, তার আমূল সংস্কার করবার কোন বিকল্প নাই আমাদের সামনে। সেই কঠিন বোঝা যারা আজ নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন, পথে পথে মার খাচ্ছেন, রক্তাক্ত হচ্ছে, তাঁদের ছবি দেখে আমরা শিউরে উঠছি। এই "পেটি বুর্জোয়া"দের এই সাহস ও আত্মত্যাগ অবিশ্বাস্য ও বৈপ্লবিক।
আপনাদের মত বয়েসে যখন একদিন আমরাও ক্লাস বর্জন করে রাজপথে নামতে বাধ্য হয়েছিলাম, তখন যা শিখেছিলাম, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন পণ্ডিত, কোন শিক্ষক, কোন গুরু আমাদের শেখাতে পারেন নাই। কোন ক্লাসে থেকে এই শিক্ষা অর্জন করা যায় না, যা রাজপথের ক্লাস আপনাদের আজ শেখাবে।আজকে যারা পথে পথে লড়ছেন, এই অভিজ্ঞতা আপনাদের জীবন বদলে দেবে, আর আপনারাও এই দেশকে বদলে দেবেন।
কিভাবে?
রাজপথের আন্দোলন হল জীবনের মাস্টার ক্লাস। এই ক্লাসে যে ফার্স্ট ক্লাস হলেন, এই ক্লাসে যারা উত্তীর্ণ হলেন, তারা ব্যক্তিস্বার্থের, কেরিয়ার চিন্তার সঙ্কীর্ণ গণ্ডী থেকে বেরিয়ে জীবনের একটা বৃহৎ পরিসরে স্থান পেলেন।আপনারা যখন একটা চরম নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রশক্তি এবং তার ধূর্ত দমন-পীড়নের যন্ত্রের মোকাবেলা করতে শিখছেন, জীবনের যে কোন প্রতিপক্ষের সামনে তখন আপনি এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হতে শিখে গেলেন।একটা কঠিন নির্মম বাস্তব জগতের রণকৌশলের পরিকল্পনা করতে শিখছেন, হাজার হাজার তরুণদের নেতৃত্ব দিতে শিখছেন, সহযোদ্ধাদের সাহস ও শক্তি দিয়েছেন, মিডিয়ার সাথে আলাপের কলা-কৌশল শিখছেন, পাবলিক স্পিকিং শিখছেন, তর্ক বিতর্ক শিখছেন, প্রেস রিলিজ দেয়া শিখছেন, সাংবাদিক সম্মেলন করতে শিখেছেন, আন্দোলনের জন্যে নতুন ভাষা তৈরি করছেন, লেখালেখি করতে শিখছেন, দশের জন্যে দায়িত্ব নিয়েছেন, গোটা দেশকে সংগঠিত করেছেন- এই সবই বাকি জীবন আপনার সুপার পাওয়ার হয়ে থাকবে।যে কোন মোটিভেশনাল স্পিকারের চাইতে আপনাদের বক্তব্য আজ আকর্ষণীয়।সারা দেশ আজ কান পেতে আপনাদের কথা শুনছে।আজ রাস্তায় যারা বন্ধু হলেন, তারা বাকি জীবন আপনার বন্ধু হল, এরাই আপনার সোলমেট। দেশে-বিদেশে এত রকম গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ তৈরি হবে যে, নেটওয়ার্কিং নামক কসরতের কোন প্রয়োজনই আপনাদের হবে না।আপনারা নিজেই এখন এক একজন মেন্টর হয়ে উঠতে পারবেন।রাজপথে যারা কাঁধে কাঁধ মেলালেন, তারা ব্যক্তি স্বার্থের ক্ষুদ্র চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে একটা বৃহত্তর উদ্দেশ্যে নিজেদের সমর্পিত করলেন। যারা একা একা ছিলেন, নিঃসঙ্গ ছিলেন, তাঁদের আজ অনেক অনেক পরীক্ষিত বন্ধু পেলেন।নিজেদের কিভাবে কোন যৌক্তিক কারনের সংগঠিত করতে হয়, তার পথ আপনারা নিজেরাই বাৎলে দিলেন। রাজপথে যে নেতৃত্ব শিখে নিলেন, তা আপনাদের সামনের জীবনের পথে নেতা হওয়ার দীক্ষা দিয়ে দিয়েছে, যা কেউ কখনও কেড়ে নিতে পারবে না।
এই আপনারা যখন দেশে কাণ্ডারি হবেন, তখন আমরা সবাই শান্তিতে রাতে ঘুমাতে যেতে পারব।
মঙ্গলবার
জুলাই ১৬, ২০২৪
উইস্কন্সিন, যুক্তরাষ্ট্র
পুনশ্চঃ লেখাটি কোটা আন্দোলনের শুরুতে আমার ভাবনা প্রকাশ করে!
#কোটাসংস্কার
#quotamovement2024
২| ২৭ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১১:৪৮
ইফতেখার ভূইয়া বলেছেন: ব্যক্তিগতভাবে আমি তারুন্যের সময়টা পেছনে ফেলে এসেছি তবে বিগত ক'মাস এই তরুনদের সাথে রাজপথে থেকে থেকে অনেক প্রতিভাবান তরুনদের সাথে পরিচয় হয়েছে তাদের মনোভাব অনেকটাই বুঝতে পেরেছি বলে মনে হয়। তাদের সাথে যথেষ্ট ভাব ও তথ্য আদান-প্রদান হয়েছে, অনেকেই আমার গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, বড় ভাই হিসেবে ক্যারিয়ারের বিভিন্ন ইস্যুতে মতামত চেয়েছেন। আমি যতটুকু সম্ভব তথ্য দিয়ে সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। অনেকেই আমার সাথে লিঙ্কন্ডইনে যুক্ত হয়েছেন। পুরো বিষয়টিকে আমি বেশ পজিটিভলিই দেখছি।
ওদের জানার আকঙ্খা, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর আমাকে বরাবরই অনুপ্রাণিত করে। ওদের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু মনে হয়েছে অনেকগুলো বিষয় আপনি শেষ প্যারায় উল্লেখ করেছেন। রাজ পথের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আসলেই মাস্টার ক্লাস। ওদের হাত দিয়ে সুন্দর আগামী আসবে এটা আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। আপনার লিখাকে সাধুবাদ জানাই। ধন্যবাদ।
৩| ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:১৮
Tanner Huff বলেছেন: লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই আলোকিত, অন্তর্দৃষ্টি এবং অনন্যতা প্রদান করে। বিষয়বস্তু শুধুমাত্র আকর্ষণীয় নয় বরং স্পষ্টভাবে এবং সুসঙ্গতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা পাঠকদের জন্য উপলব্ধি এবং চিন্তা করা সহজ করে তোলে। এটি একটি দুর্দান্ত কাজকে চিহ্নিত করে, পাঠককে অনুপ্রাণিত করে এবং তাদের আরও অন্বেষণ করতে চায়। ব্লগ পড়ার অনেক ঘন্টা পরে, আমি প্রায়ই মজা করার জন্য https://driftbossgame.co/ যোগদান করি।.
৪| ২৮ শে অক্টোবর, ২০২৪ রাত ৯:৪৮
সায়েমার ব্লগ বলেছেন: আপনাদের মন্তব্যের জন্যে অশেষ ধন্যবাদ!
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই আগস্ট, ২০২৪ সকাল ৭:৪২
কামাল১৮ বলেছেন: ১৫ই আগস্টের সাক্ষী হন নাই।এতো সুন্দর নৃত্য হলো।