নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, এথনোগ্রাফার এবং গল্পকার

সায়েমার ব্লগ

সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক

সায়েমার ব্লগ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রোকেয়ার রাষ্ট্রচিন্তা

১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৪

রোকেয়ার জাতিকল্পনা ও রাষ্ট্রসংস্কারের রূপকল্প

বেগম রোকেয়ার সময়কালটা ছিল ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকে বিংশশতকের গোড়ার দিক(১৮৮০-১৯৩২)। মাত্র ৫২ বছর বেঁচেছিলেন রোকেয়া, জানা যায়, কলকাতায় নিজের প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল চত্বরে লিখতে লিখতে টেবিলেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।মোটামুটিভাবে ধরে নিতে পারি, শেষের তিন দশক তাঁর সক্রিয়তার সময় ছিল।আর মাত্র পনের বছর বেঁচে থাকলে তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ভারতের স্বাধীনতা এবং দেশভাগ দেখে যেতে পারতেন, তিনি রংপুরের বাড়িতে থাকলে পাকিস্তানের নাগরিক হতেন, আর কর্মস্থল কলকাতায় থাকলে স্বাধীন ভারতের নাগরিক হতেন, ভারতীয় মুসলিম হতেন।তাঁর জীবন কেটে গেছে অবিভক্ত ব্রিটিশ-ভারতের প্রজা হিসাবেই, স্বাধীন সার্বভৌম কোন আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের নাগরিক তিনি কখনও হতে পারেননি।তাঁর সময়কালকে যদি অভিনিবেশ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি, সেটা ছিল ভারতবর্ষে উপনিবেশ-উত্তর আধুনিক কালের জাতিরাষ্ট্র গঠনের একটা টালমাটাল সময়।সেই সময় নানা অভিসারী ও অপসারী পক্ষসমূহ জাতি গঠনের শক্তি আকারে আবির্ভূত হয়েছিলো, নানাভাবে ক্রিয়াশীল ছিল।এই সময়ে প্রিন্ট মিডিয়ার মত একটি নবগঠিত জনপরিসরে রোকেয়ার মত নজিরবিহীন ও অভিনব একটি শক্তিশালী স্বর আত্মপ্রকাশ করলো, যা শেষ পর্যন্ত একটা সুদূর প্রসারী নারী জাগরণ আন্দোলনে পরিণত হল।আমি এই ঘটনাটাকে দেখতে পাই, জাতি গঠনকারী একটি প্রপঞ্চ হিসাবে।
বেনেডিক্ট আন্ডারসন (১৯৮৩)আধুনিক জাতিকে প্রিন্ট মিডিয়ার বাহনে উদ্ভূত চেতনা হিসাবে চিহ্নিত করেন, মুদ্রণ পুঁজিবাদের আবির্ভাবের সাথেই আধুনিক জাতির মত বিপুল আকারের এক সম্প্রদায়ের যৌথ চেতনা এবং জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠা সম্ভব হয়। তিনি বলছেন, 'জাতি একটা কল্পিত সম্প্রদায়'।এই কল্পিত সম্প্রদায়কে কল্পনা করবার মালিক কারা ছিলেন? এই কল্পনা কাদের? ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় মানস গঠনে এই নতুন কল্পনার নেতৃত্ব দিয়েছে একটা এলিট গোষ্ঠী।

জাতীয় চেতনার রূপকার ছিল উপনিবেশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বঃ জাতীয় বুর্জোয়া, ভূস্বামী, রাজনৈতিক দলগুলো, গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সমাজ ও ধর্ম-সংস্কারক গোষ্ঠী প্রভৃতি।কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা শ্রেণীর নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রামগুলো থেকে উঠে আসা চৈতন্যের উপাদানগুলো উচ্চবর্গের প্রাবল্যে জাতীয় সংস্কৃতিতে সরাসরি গৃহীত হয়নি, পরিস্রুতি এবং বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে কেবল একটা সংস্কৃত, মার্জিত ও সুশীল সংস্করণই গৃহীত ও আত্তীকৃত হতে পেরেছে, নচেৎ নয় (যেমন, পহেলা বৈশাখ)।ফলে যখন চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফসল যখন ঘরে তোলার সময় হয়েছিলো, তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নারী ও আদিবাসীসহ বহু বর্গের মানুষজন এই জাতিগঠনের গাঠনিক কাল থেকেই কোণঠাসা হয়ে প্রান্তে চলে গিয়েছিল, এখনও আছে। সম্পদ ও মিডিয়ার মালিক পুরুষ একচ্ছত্রভাবে জাতির স্বর-ভাব-ভাষা ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব দখল করেছে। রাষ্ট্র একটা 'ম্যাস্কুলিন' ক্ষমতার প্রতিষ্ঠানের পরিনত হয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে, শহরে-বন্দরে নারীরা প্রবল শক্তি নিয়ে ভারতের উপনিবেশ-বিরোধী লড়াইয়ে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ-সংগ্রাম করে গেলেও, দক্ষিণ এশিয়ায় নবগঠিত এই জাতিরাষ্ট্রসমূহে নারী পরিপূর্ণভাবে সমমর্যাদার নাগরিক কখনই হয়ে ওঠে নাই।নারীদের স্বরগুলো অশ্রুত ও অদৃশ্য থেকে গেছে, নারীদের ভাষা ও সাহিত্যের আওয়াজ মূলধারায় প্রবল হতে পারেনি। জাতীয় চৈতন্যে নারীদের কল্পনাকে স্থান পায় নাই, যার শক্তিশালী উদাহরণ হলেন বেগম রোকেয়া।

ঊনবিংশ থেকে বিংশশতকে ভারতের প্রিন্ট মিডিয়া যে সব বিতর্কে সয়লাব ছিল, তার মধ্যে এটা কেন্দ্রীয় আলোচ্য ছিল আধুনিক নারী ও পুরুষের রূপকল্প, নারীত্ব ও পৌরুষের বিনির্মাণ।ভারতীয় প্রথাগত লিঙ্গীয় সম্পর্কের গঠনকে জাতীয়তাবাদী পুরুষ চিন্তুকেরা একটা ব্যাপক পুনর্গঠনের প্রস্তাবনায় নিয়ে আসে - ভাবনা, আলাপ এবং কল্পনায় সম্প্রসারিত করে।এটা আশ্চর্যজনক যে, জাতির এই মানসকন্যা সৃষ্টির কর্তৃত্বও পুরুষ লেখকেরাই নিয়েছিলেন, যেখানে রোকেয়া মোক্ষমভাবে হস্তক্ষেপ করেন।সে সময়টায় আইনী সংস্কার, বিতর্ক, প্রবন্ধ, কবিতা-গল্প-উপন্যাস - এর বাহনে এমন একটি জাতীয় মানস গড়ে তোলার কাজ বেগবান হয়েছিল, যেখানে ভারতীয় নারী/বাঙালী নারী বর্গকে একটা মৌলিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।এই রূপান্তরের বাহন ছিল একদিকে বিয়ের নানা রকম সংস্কার (সতীদাহ নিরোধ, বাল্যবিয়ে রোধ, সহবাসের ন্যূনতম বয়েস, বিধবা বিয়ের প্রবর্তন ইত্যাদি), অন্যদিকে নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থান, এবং জনপরিসরে নারীর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ।নতুন জাতি গঠনে নারী-পুরুষের সম্পর্কের বদল আনতে ধারাবাহিকভাবে সামাজিক, আইনী এবং রাজনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো, যে 'লিগ্যাসি' এখনও নারী উন্নয়ন নীতির পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মধ্যে (বহুবিবাহ রোধ, যৌতুক নিরোধ, তালাক, খোরপোষ, সন্তানের অভিভাবকত্ব আইন ইত্যাদি)অব্যাহত রয়েছে।

যেহেতু ঔপনিবেশিক পলিসির মধ্য দিয়ে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক 'এজেন্সি' অভিসারী না হয়ে ক্রমাগতভাবে অপসারী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিলো, মুসলমান নারীদের ঐতিহ্যগত জীবনব্যাবস্থার রূপান্তরনও অনেকটাই পৃথক হয়ে পড়েছিল। জাতীয়তাবাদীদের 'লিবারেল' আদর্শে মুসলমান নারীদের অন্তর্ভুক্ত করবার বিষয়টি বিলম্বিত হয়।এই সময়ে বেগম রোকেয়া যেহেতু প্রথমে রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে এবং পরে কলকাতায় মুসলমান মেয়েদের জন্যে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠা করে নারী শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক দ্বার উন্মুক্ত করেন, তাঁকে প্রধানত নারী জাগরণের ও নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসাবে বন্দনা ও উদযাপন করা হয়।রোকেয়ার স্বশাসিত চৈতন্য এবং 'অ্যাক্টিভিজম' এর এটা একটা বড় দিক হলেও, রোকেয়ার মৌলিক অবদান ছিল বৈষম্যবিহীন জাতি কল্পনায় এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তায় যেখানে নারীদের সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী বর্গ হিসাবে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর কল্পপ্রকল্পে ছিল এমন একটি রাষ্ট্রসমাজ, যেখানে 'ফেমিনিনিটি' এবং 'ম্যাসকুলিনিটি'র মর্যাদাপূর্ণ মিথোজীবিতায় পরিবার ও কমিউনিটি গড়ে উঠবে, আর এই স্বাস্থ্যউজ্জ্বল স্বচ্ছল শক্তিশালী পরিবারগুলো হবে জাতির গঠনের দুর্ভেদ্য পাটাতন(সুলতানার স্বপ্ন, অর্ধাঙ্গী, সুগৃহিণী, গৃহ)। রোকেয়ার এই নারীবাদ ছিল 'প্রো-ফ্যামিলি ফেমিনিজম', যেখানে গৃহস্থালী ও জন পরিসরকে রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসাবে সংস্কার করে সহিংসতার বদলে মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি করা হয়েছে।আবার, আবার বিয়েকে নারীর একমাত্র ভবিতব্য হিসাবেও প্রত্যাখ্যান করেছেন।তিনি তার সাহিত্যের মাধ্যমে এমন সামাজিক ও মতাদর্শিক অবকাঠামো গঠন করেছেন, যেখানে বিয়েই নারীর একমাত্র নিয়তি নয়।বরং, বিয়ের গণ্ডীর বাইরেও নারীর জীবনের বহু সার্থকতা ও চরিতার্থতা সম্ভব। যেমন পদ্মরাগে তারিণীভবন নামে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে বিয়েকে আবশ্যিক পরিণতি বলে বরণ না করে নারীরা নানা রকম সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী কাজে সম্মিলিত হতে পারছেন।

কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রোকেয়ার এই রাষ্ট্রদর্শনকে হ্রাসকৃত ও খণ্ডিত আকারে পরিবেশন করে তাঁকে আগাগোড়া কেবল মুসলমান মেয়েদের অবরোধমুক্ত করবার 'লিবারেল' একজন প্রবক্তা হিসাবে দেখা হয়।রোকেয়া যে আমাদের আধুনিক জাতিকল্পনার অন্যতম জননী, সেটি এভাবে অস্বীকার করা হয়।

ছবিঃ উনবিংশ শতকের ঢাকার অভিজাত মুসলিম নারী| সৌজন্যঃ ফিলিপ থনটর্ণ


#সায়েমারলেখা
#BegumRokeya
#রোকেয়াদিবস

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:২৭

সৈয়দ কুতুব বলেছেন: আপনার ব্লগ অনেক বড়ো হয়, পড়তে পড়তে হয়রান লাগে। তবুও বেগম রোকেয়াকে নিয়ে লিখেছেন সেজন্য পড়লাম। বেগম রোকেয়া না থাকলে আজকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৪০ কোটি হইতো। বাঙালি পুরুষের অত্যন্ত প্রিয় কাজ ছিলো বছর বছর মহিলাদের পেট ভরে দেয়া। রোকেয়া মেয়েদের আধুনিক শিক্ষার আলোতে এনে তারা যে একটি চিন্তাশীল সত্ত্বা তা বুঝিয়েছেন। এখন ও বাঙালি পুরুষ ঠিক করে দিতে চায় একজন নারী কি করবে, কোন ধরণের পোশাক পড়বে! নারী প্রধান পরিচয় সে একজন নারী দ্বিতীয়ত সে একজন মানুষ এই ধারণায় অধিকাংশ বাঙালি পুরুষ বিশ্বাসী।

২| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ২:৫৪

জেনারেশন৭১ বলেছেন:




১৬ বছরে ৬০টি মন্তব্য করেছেন ব্লগে, আপনি তো কারো লেখা পড়েন বলে মনে হয় না' আপনি বেগম রোকেয়া নিয়েও পড়েননি সঠিকভাবে; বেগম রোকেয়াকে সঠিকভাবে জানলে, গরুর রচনা লেখার দরকার হতো না।

৩| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০

রাজীব নুর বলেছেন: জেনারেশন৭১ বলেছেন: ১৬ বছরে ৬০টি মন্তব্য করেছেন ব্লগে, আপনি তো কারো লেখা পড়েন বলে মনে হয় না' আপনি বেগম রোকেয়া নিয়েও পড়েননি সঠিকভাবে; বেগম রোকেয়াকে সঠিকভাবে জানলে, গরুর রচনা লেখার দরকার হতো না।

৪| ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৪২

জটিল ভাই বলেছেন:
সুন্দর লিখেছেন। কিন্তু আফসোস, আমরা বেগম রোকেয়াকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ :(

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.