নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কালপুরাণ

জন্ম থেকেই জ্বলছি

ড্যানিয়েল আর্যভট্ট

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি পদার্থে। সৃজনশীল সাহিত্যে আমার আগ্রহ। নিয়মিত কবিতা চর্চা করি প্রায় ১০ বছর হল। ব্লগে নিয়মিত হয়ে মূলধারার সাহিত্যিক, লেখক, সমালোচক দের সাথে যুক্ত হতে চাই।

ড্যানিয়েল আর্যভট্ট › বিস্তারিত পোস্টঃ

জীবনানন্দের শ্রেষ্ঠ কবিতা (বনলতা সেন)

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:২৮

যেসব কবিতা আছেঃ



বনলতা সেন :) আমি যদি হতাম :D হায় চিল B-) বুনো-হাঁস;) শঙ্খমালা X( নগ্ন নির্জন হাত :| হরিণেরা :(( সুদর্শনা /:) শ্যামলী :-/ দুজন X(( তুমি :P সুরঞ্জনা :-* মিত ভাষণ :| সুচেতনা B-) অঘ্রাণ প্রান্তরে







বনলতা সেন



হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।



চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‌‌‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।



সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।







আমি যদি হতাম



আমি যদি হতাম বনহংস;

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে

ছিপছিপে শরের ভিতর

এক নিরালা নীড়ে;



তাহলে আজ এই ফাল্গুনের রাতে

ঝাউয়ের শাখার পেছনে চাঁদ উঠতে দেখে

আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে

আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-

তোমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তোমার রক্তের স্পন্দন-

নীল আকাশে খইক্ষেতের সোনালি ফুলের মতো অজস্র তারা,

শিরীষ বনের সবুজ রোমশ নীড়ে

সোনার ডিমের মতো

ফাল্গুনের চাঁদ।

হয়তো গুলির শব্দঃ

আমাদের তির্যক গতিস্রোত,

আমাদের পাখায় পিস্‌টনের উল্লাস,

আমাদের কন্ঠে উত্তর হাওয়ার গান!



হয়তো গুলির শব্দ আবারঃ

আমাদের স্তব্ধতা,

আমাদের শান্তি।

আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না:

থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;

আমি যদি বনহংস হতাম,

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোনো এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে।







হায় চিল



হায় চিল, সোনালী ডানার চিল,এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !

তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে ।

পৃথিবীর রাঙ্গা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে ;

আবার তাহারে কেন ডেকে আনো ?কে হায় হৃদয় খুঁড়ে

বেদনা জাগাতে ভালোবাসে !



হায় চিল, সোনালী ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে

তুমি আর কেঁদোনাকো উড়ে উড়ে ধানসিড়ি নদীটির পাশে !







বুনো হাঁস



পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে-

জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহবানে



বুনো হাঁস পাখা মেলে- শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;

এক-দুই-তিন চার-অজস্র-অপার-



রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া

এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে-ছুটিতেছে তারা।



তারপর পড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,

হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ-দু-একটা কল্পনার হাঁস;



মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা স্যানালের মুখ;

উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক



কল্পনার হাঁস সব — পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেল পর

উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জোছনার ভিতর।







শঙ্খমালা



কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে

সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,

বলিল, তোমারে চাই:

বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ

খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়-

সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক

জোনাকির দেহ হতে- খুঁজেছি তোমারে সেইখানে-

ধূসর পেঁচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে

ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে

সোনার সিড়ির মতো ধানে আর ধানে

তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।



দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;

সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-

বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,

শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।



কড়ির মতন শাদা মুখ তার;

দুইখানা হাত তার হিম;

চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম

চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়

সে আগুনে হায়।



চোখে তার

যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!

স্তন তার

করুণ শঙ্খের মতো –দুধে আর্দ্র - কবেকার শঙ্খিনীমালার!



এ পৃথিবী একবার পায় তারে,পায় নাকো আর।







নগ্ন নির্জন হাত





আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে :

আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।



যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে

অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখি নি,

সেই নারীর মতো

ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে।



মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা

সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।



ভারতসমুদ্রের তীরে

কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে

অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে

আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিলো একদিন,

কোনো এক প্রাসাদ ছিলো;

মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ;

পারস্যগালিচা, কাশ্মীরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,

আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা;

আর তুমি নারী--

এইসব ছিলো সেই জগতে একদিন।



অনেক কমলারঙের রোদ ছিলো,

অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো,

মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক;

অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো;

অনেক কমলা রঙের রোদ;

আর তুমি ছিলে;

তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না,

খুঁজি না।



ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনি,

অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা,

লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ,

অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি,

রামধনুরঙের কাচের জানালা,

ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায়

কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের

ক্ষণিক আভাস--

আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়।



পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ,

রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ!

তোমার নগ্ন নির্জন হাত;



তোমার নগ্ন নির্জন হাত।







হরিণেরা



স্বপ্নের ভিতরে বুঝি–ফাল্গুনের জোছনার ভিতরে।

দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে



হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;

বাতাস ঝরিছে ডানা —মুক্তা ঝ’রে যায়



পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে-বনে বনে-হরিণের চোখে;

হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।



হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে

হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে–



বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা আহা;

ফাল্গুনের জোছনায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।



বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে–

হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।







সুদর্শনা



একদিন ম্লান হেসে আমি

তোমার মতন এক মহিলার কাছে

যুগের সঞ্চিত পণ্যে লীন হতে গিয়ে

অগ্নিপরিধির মাঝে সহসা দাঁড়িয়ে

শুনেছি কিন্নরকন্ঠ দেবদারু গাছে,

দেখেছ অমৃতসূর্য আছে।



সবচেয়ে আকাশ নক্ষত্র ঘাস চন্দ্রমল্লিকার রাত্রি ভালো;

তবুও সময় স্থির নয়,

আরেক গভীরতর শেষ রূপ চেয়ে

দেখেছে সে তোমার বলয়।



এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন

তোমার শরীর; তুমি দান করো নি তো;

সময় তোমাকে সব দান করে মৃতদার ব’লে

সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।







শ্যামলী



শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন:

যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল

সুদূরে নতুন দেশে সোনা আছে ব’লে

মহিলারই প্রতিভায় সে ধাতু উজ্জ্বল

টের পেয়ে, দ্রাক্ষা দুধ ময়ূরশয্যার কথা ভুলে

সকালের রূঢ় রৌদ্র ডুবে যেত কোথায় অকূলে।



তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনও

আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রে নীল,

দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,

বিকেলের উপকন্ঠে সাগরের চিল,

নক্ষত্র, রাত্রির জল যুবাদের ক্রন্দন সব–

শ্যামলী, করেছি অনুভব।



অনেক অপরিমেয় যুগ কেটে গেল;

মানুষকে স্থির স্থিরতর হতে দেবে না সময়;

সে কিছু চেয়েছে বলে এত রক্ত নদী।

অন্ধকার প্রেরণার মতো মনে হয়

দূর সাগরের শব্দ —শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে

কাল কিছু হয়েছিল —হবে কি শাশ্বতকাল পরে।







তুমি



নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারি দিকে উজ্জ্বল আকাশ;

বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস;

কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে —গঙ্গাফড়িং সেও ঘুমে;

আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি।



‘মাটির অনেক নীচে চলে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে

তুমি আজ? কোন্‌ কথা ভাবছ আধারে?

ওই যে ওকানে পায়রা একা ডাকে জমিরের বনে;

মনে হয় তুমি যেন ওই পাখি-তুমি ছাড়া সময়ের এ-উদ্ভাবনে



আমার এমন কাছে —আশ্বিনের এত বড় অকূল আকাশে

আর কাকে পাব এই সহজ গভীর অনায়াসে –’

বলতেই নিখিলের অন্ধকার দরকারে পাখি গেল উড়ে

প্রকৃতিস্থ প্রকৃতির মতো শব্দে —প্রেম অপ্রেম থেকে দূরে।







সুরঞ্জনা



সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো;

পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;

কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছ;

গ্রিক হিন্দু ফিনিশীয় নিয়মের রূঢ় আয়োজন

শুনেছ ফেনিল শব্দে তিলোত্তমা - নগরীর গায়ে

কী চেয়েছে? কী পেয়েছে? - গিয়েছে হারায়ে।



বয়স বেড়েছে ঢের নরনারীদের,

ঈষৎ নিভেছে সূর্য নক্ষত্রের আলো;

তবুও সমুদ্র নীল; ঝিনুকের গায়ে আল্পনা;

একটি পাখির গান কী রকম ভালো।

মানুষ কাউকে চায়- তার সেই নিহত উজ্জ্বল

ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল।



মনে পড়ে কোন এক তারাভরা রাতের বাতাসে

ধর্মাশোকের ছেলে মহেন্দ্রের সাথে

উতরোল বড় সাগরের পথে অন্তিম আকাঙ্ক্ষা নিয়ে প্রাণে

তবুও কাউকে আমি পারিনি বোঝাতে।

সেই ইচ্ছা সঙ্ঘ নয় শক্তি নয় কর্মীদৈর সুধীদের বিবর্ণতা নয়,

আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়।



যেন সব অন্ধকার সমুদ্রের ক্লান্ত নাবিকেরা।

মক্ষিকার গুঞ্জনের মতো এক বিহ্বল বাতাসে

ভূমধ্যসাগরলীন দূর এক সভ্যতার থেকে

আজকের নব সভ্যতায় ফিরে আসে;-

তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মুতদের রোল

দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল।







মিতভাষণ



তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন।

মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে

ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো

আমাদের নিয়ে যায় ডেকে

শান্তির সঙ্ঘের দিকে —ধর্মে —নির্বাণে,

তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।



অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে,

দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি

সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু

দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি:

যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে

তার স্নিগ্ধ মানতীসৌরভে।



মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;

বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা;

ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প-স্বপ্নের

উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।

তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো;

এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।







সুচেতনা



সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ

বিকেলের নক্ষত্রের কাছে;

সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে

নির্জনতা আছে।

এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা

সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।

কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে;

তবুও তোমার কাছে আমার হৃদয়।



আজকে অনেক রূঢ় রৌদ্রের ঘুরে প্রাণ

পৃথিবীর মানুষকে মানুষের মতো

ভালোবাসা দিতে গিয়ে তবু,

দেখেছি আমারি হাতে হয়তো নিহত

ভাই বোন বন্ধু পরিজন পড়ে আছে;

পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন;

মানুষ তবুও ঋণী পৃথিবীরই কাছে।



কেবলি জাহাজ এসে আমাদের বন্দরের রোদে

দেখেছি ফসল নিয়ে উপনীত হয়;

সেই শস্য অগণণ মানুষের শব;

শব থেকে উৎসারিত স্বর্ণের বিস্ময়

আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরও প্রাণ

মূক করে রাখে; তবু চারিদিকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।



সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে —এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;

সে অনেক শতাব্দীর মনীষীর কাজ:

এ বাতাস কী পরম সূর্যকরোজ্জ্বল;–

প্রায় তত দূর ভালো মানবসমাজ

আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে

গড়ে দেব আজ নয়, ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে।



মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,

না এলেই ভালো হত অনুভব করে;

এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি

শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;

দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়–

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।







অঘ্রাণ প্রান্তরে



‘জানি আমি তোমার দু’চোখ আজ আমাকে খোঁজে না আর পৃথিবীর’ পরে-

বলে চুপে থামলাম, কেবলি অশত্থ পাতা পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে

শুকনো মিয়োনো ছেঁড়া;- অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;

সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে

হেমন্ত এসেছে তবু; বললে সে, ‘ঘাসের ওপরে সব বিছানো পাতার

মুখে এই নিস্তব্ধতা কেমন যে-সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার

ছড়িয়ে পড়েছে জলে; কিছুক্ষণ অঘ্রাণের অস্পষ্ট জগতে

হাঁটলাম, চিল উড়ে চলে গেছে-কুয়াশার প্রান্তরের পথে

দু-একটা সজারুর আসা-যাওয়া; উচ্ছল কলার ঝড়ে উড়ে চুপে সন্ধ্যার বাতাসে

লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে;

আমাদের জীবনের অনেক অতীত ব্যাপ্তি আজো যেন লেগে আছে বহতা পাখায়

ঐ সব পাখিদের ঐ সব দূর দূর ধানক্ষেতে, ছাতকুড়োমাখা ক্লান্ত জামের শাখায়;

নীলচে ঘাসের ফুলে ফড়িঙের হৃদয়ের মতো নীরবতা

ছড়িয়ে রয়েছে এই প্রান্তরে বুকে আজ ……হেঁটে চলি….. আজ কোনো কথা

নেই আর আমাদের; মাঠের কিনারে ঢের ঝরা ঝাউফল

পড়ে আছে; খড়কুটো উড়ে এসে লেগে আছে শড়ির ভিতরে,

সজনে পাতার গুঁড়ি চুলে বেঁধে গিয়ে নড়ে-চড়ে;

পতঙ্গ পালক্‌ জল-চারি দিকে সূর্যের উজ্জ্বলতা নাশ;

আলোয়ার মতো ওই ধানগুলো নড়ে শূন্যে কী রকম অবাধ আকাশ

হয়ে যায়; সময়ও অপার-তাকে প্রেম আশা চেতনার কণা

ধরে আছে বলে সে-ও সনাতন;-কিন্তু এই ব্যর্থ ধারণা

সরিয়ে মেয়েটি তাঁর আঁচলের চোরাকাঁটা বেছে

প্রান্তর নক্ষত্র নদী আকাশের থেকে সরে গেছে

যেই স্পষ্ট নির্লিপ্তিতে-তাই-ই ঠিক;-ওখানে সিগ্ধ হয় সব।

অপ্রেমে বা প্রেমে নয়- নিখিলের বৃক্ষ নিজ বিকাশে নীরব।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.