![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জোছনা ও জননীর গল্প যার হাতে সৃষ্টি হয়েছে, যার নাটকে সৃষ্টি হয়েছে ‘তুই রাজাকার’ শব্দবন্ধ, তার ছোটগল্পে মহান ১৯৭১ এর রূপ খুঁজে পাবার ইচ্ছে প্রতিটি পাঠকেরই হবে, একথা বলার অপেক্ষা থাকে না। তবে একথাও ঠিক, এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের প্রয়াণের পর আমরা এখনো তার সব ছোটগল্পকে একত্রে দেখার অপেক্ষায় আছি। আর তাই আমরা হাতের কাছে থাকা একটি গল্পসমগ্র নিয়ে তার ১৯৭১ পাঠ বিবেচনা করতে পারি। এজন্য আমি কাকলী প্রকাশনীর ২০০৬ সালের ৮ম মুদ্রন হমায়ূন আহমেদ গল্পসমগ্র বইটিকেই আঁকড়ে ধরছি। হাতে থাকা গল্পসমগ্রে মোট ৮৫টি গল্প থাকলেও এর বেশীরভাগই অতিপ্রাকৃত বিষয় অথবা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী নির্ভর গল্প। নিরেট সামাজিক গল্পও কিছু আছে অতি অবশ্যই। এসবের মাঝে ১৯৭১ নিয়ে গল্প সংখ্যা ছয়টি: ‘উনিশ শ’ একাত্তর’(পৃ.৩৬-৪১), ‘অসুখ’ (পৃ.১১৬-১২০), ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ (পৃ.৩৫২-৩৬০), ‘শীত’ (পৃ.৩৮২-৩৮৮), ‘শ্যামল ছায়া’ (পৃ.৪০৩-৪০৯) এবং ‘নন্দিনী’ (পৃ.৪৩৩-৪৩৭)।
১৯৭১ এর হুমায়ূন আহমেদ
১৯৭১ সম্বন্ধে নতুন করে কিই বা বলার আছে, যদিও নিত্য অনুভবের পালা সাঙ্গ হবে না কখনো। আর তাই হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পে আমরা এই নিত্য অনুভবের মাত্রা দেখতে চাই । দেখতে চাই, তিনি কিভাবে এর উপস্থাপন করেছেন। কয়েকটি বিষয়ের পর্যবেক্ষণ এখানে জরুরী: ক) যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে লেখকের অনুভব খ)মুক্তিযুদ্ধকালীন হানাদার সহযোগীদের কার্যক্রমের উপস্থাপনের ধরণ গ) পাক হানাদারদের কার্যক্রম ও তাদের মনস্তত্বের ব্যাখ্যা ঘ) মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা ও ত্যাগ এবং ঙ)মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বেদনার বিবরণ।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে লেখকের অনুভব
ভাবলে রক্তে কেমন শিরশিরে অনুভূতি হয়, ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে যখন শৈত্যপ্রবাহ শেষে কোমল উষ্ণ আবহাওয়ায় দেশ সিক্ত হতে শুরু করেছে, সেসময় ঢাকার শাহবাগে যখন যুদ্ধাপরাধীর সঠিক বিচার দাবিতে মানুষের রক্ত উত্তাল হতে শুরু করেছে, তার বহু আগেই জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ ‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পে যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে তার অনুভব ব্যক্ত করেছেন, চরম ব্যঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা, এমনকি সুমীল সমাজ কতটা উদাস, কতটা বুলিসর্বস্ব। যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে লেখকের অনুভব বোঝার জন্য এই একটি গল্প পড়ে দেখাই যথেষ্ট।
‘জলিল সাহেবের পিটিশন’ গল্পের কাঠামোটি খুবই সাদামাটা: জলিল সাহেব ৩০ লাখ হত্যার বিচারের দাবিতে সাক্ষর সংগ্রহের ব্যক্তিগত অভিযানে নামেন, মাঝপথে গুটিকতক মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করেন, একসময় তিনি কাজটি অসমাপ্ত রেখে মারা যান, তার শহীদ সন্তানের মেয়ে অপেক্ষা করে দাদার কাজটি কেউ সমাপ্ত করার জন্য এগিয়ে আসবে কিন্তু শেষমেশ বোঝা যায় স্বপ্নটি অধরাই থেকে যাবে। এমন সাদামাটা কাঠামোয় গল্প বলা হলেও গল্পকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ঠিকই ফুটিয়ে তুলেছেন। আমরা যারা স্বাধীনতার ফল ভোগ করছি তাদের অবহেলা, উদাসিনতা আর স্বার্থপরতা টিকই মূর্তিমান হয়েছে এই গল্পে।
জলিল সাহেবকে যখন তার পরিচিতজনেরা বলে, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার পিতা হিসেবে পরিত্যক্ত বাড়ির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে কারণ ‘বাড়ি পাওয়ার হক আছে’ তার, তখন তিনি স্পষ্ট বলেন: ‘আমার দুই ছেলের জীবন কি এতই সস্তা? একটা বাড়ি দিয়ে দাম দিতে চায়? কতবড় স্পর্ধা চিন্তা করেন।’ জলিল সাহেব রাষ্ট্রের কাছে কিছু প্রত্যাশা করেন না যদিও তিনি খুব স্বচ্ছল আরামপ্রদ জীবন যাপন করছেন, তা নয়। তিনি বরং রাষ্ট্রের কাজটিই সহজ করে দিতে চান কিন্তু রাষ্ট্র বা সমাজ একাজে এগিয়ে এসেছে বলে কোন প্রমাণ আমরা গল্পে পাই না। ৩০ লাখ হত্যার বিচারের দাবিতে জলিল সাহেব স্বাক্ষর সংগ্রহ করে চলেছেন। এই কাজে সবাই তার উপর বিরক্ত। যে ব্যক্তির শ্যালককে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলিা হয়েছিল সেই ব্যক্তিও জলিল সাহেবকে উটকো ঝামেলা মনে করে। পত্রিকা অফিসে গেলে বলে, ‘কেন পুরানা কাসুন্দি ঘাঁটছেন? বাদ দেন ভাই।’ গল্পের শুরুতে ১৪৩০০টি স্বাক্ষরের কথা আমরা জানতে পারি যা জলিল সাহেবের মৃত্যুর পূর্বে ৩২০০০টিতে এসে শেষ হয়। যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের জবানিতে আমরা এই গল্প শুনি তিনি একসময় প্রবাসী হন এবং আমেরিকার ফার্গো শহরে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের নিয়ে ‘আবদুল জলিল সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করেন কারণ তার ভাষায় ‘বিদেশে বসে দেশের কথা ভাবতে খুব ভাল লাগে। সবসময় ইচ্ছে করে একটা-কিছু করি।’ কিন্তু বাসএব কিছুই ঘটে না। জলিল সাহেবের মৃত্যুর পর এই প্রফেসর একবার দেশে আসলে জলিল সাহেবের বাসাতেও যান, জলিল সাহেবের নাতনিকে বলেন যে তিনি আবার আসবেন এবং স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজটি শেষ করবেন। কিন্তু গল্পটি শেষ হয় এ’কটি কথার মাধ্যমে: ‘জলিল সাহেবের নাতনিটি হয়তো অপেক্ষা করে আমার জন্য। দাদুর পিটিশনের ফাইলটি ধুলো ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রাখে। এই বয়েসি মেয়েরা মানুষের কথা খুব বিশ্বাস করে।’
জলিল সাহেব যেন দেশের আপামর জনতা যাদের হাতে পরিকল্পনা বা পরিশ্রুতি বাস্তকায়নের নির্বাহী ক্ষমতা নেই, যারা কেবল স্বপ্ন দেখতে জানে, দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে পারে বিচারের আশায় আর কেবল চিৎকার করতে পারে। গল্পের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, পত্রিকাওয়ালা, বাড়িওয়ালা আর আরো অনেকে যেন দেশের স্বার্থপর ব্যক্তি ও গোষ্ঠি যারা সবসময় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে দপ্তর-মাঠ সরগরম করে কিন্তু দায়িত্ব হাতে তুলে নেয় না। পুরো গল্পটিই আমাদের জন্য এক চপোটাঘাত।
মুক্তিযুদ্ধকালীন হানাদার সহযোগীদের কার্যক্রমের উপস্থাপনের ধরণ
স্বাধীন বাংলাদেশের পাঠক হিসেবে আমরা প্রথমেই ধরে নিতে পারি যে হুমায়ূন আহমেদ হানাদারদের সহযোগীদের এমনভাবে উপস্থাপন করবেন যাতে করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের মনে প্রচন্ড ঘৃণা ও দ্রোহের সৃষ্টি হয়। তবে আমরা যখন গল্পে প্রবেশ করি তখন দেখি, হুমায়ূন আহমেদ তার ঐতিহাসিক স্বত্তার চেয়ে লেখক স্বত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে গল্পগুলোতে রাজাকার আলবদরদের উপস্থাপন করেছেন। তবে এখানে যে কোন বিভ্রান্তির সুযোগ নেই, তা আমরা বুঝতে পারবো ‘উনিশ শ’ একাত্তর’ এবং ‘নন্দিনী’পড়লে।
‘উনিশ শ’ একাত্তর’গল্পটিতে আমরা রফিকউদ্দিনকে পাই হানাদারদের সহযোগী হিসেবে। তবে রফিকের যে উপস্থাপন এখানে হয়েছে তা বেশ সূক্ষ্ণ। স্থূলরসের পাঠকের দৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদের উপস্থাপন কৌশল প্রথমে ধরা নাও পড়তে পারে, উল্টো বলা হতে পারে, লেখক রাজাকার-আলবদরদের প্রতি তেমন ঘৃণা দেখাননি এই গল্পে। আসলে লেখক পাঠকের হাতে বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে হানাদার ও তাদের সহযোগীদের প্রতি নিরঙ্কুশ ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছেন।
রফিককে দেখা যায় এমন এক ভূমিকায় যেন একুল ওকুল দুকুলই রক্ষা পায়। সে যেন হানাদারদের সঙ্গ ছাড়তে পারছে না, আবার গ্রামবাসীদের কোন রকম বিপদ হোক সেটাও যেন সে চাচ্ছে না। কিন্তু আমরা যখন গল্পের আজিজ মাস্টারের সঙ্গে রফিকের তুলনা করি তখন রফিককে সুবিধাভোগী স্বার্থপর কাপুরুষ হিসেবে দেখতে পাই। যে আজিজ মাস্টারের ভীতু চরিত্রের জন্য তার মা তাকে ‘পা ভাঙা বিড়াল’ এর সঙ্গে তুলনা করে সেই আজিজ মাস্টার মেজরের গায়ে থুতু ছুঁড়ে দেয়। অপরপক্ষে রফিক কিন্তু এরপরও সেই মেজরকেই অনুসরণ করে চলে। এভাবেই হানাদার সহযোগীর উপস্থাপন করা হয় যেন পাঠক নিজেই এমন মানুষের প্রতি ঘৃণায় ফেটে পড়ে।
‘নন্দিনী’গল্পে আমরা রাজাকারের বিকৃত রুচি আর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তার শেষ পরিণতির কথা জানতে পারি। এই গল্পের রাজাকার হলো আজিজ খাঁ। হিন্দু মেয়ে নন্দিনীর যখন কোন আশ্রয় পাওয়া যাচ্ছিল না আজিজ খাঁ তাকে আশ্রয় দেয় ধর্মান্তরিত করে বিয়ের মাধ্যমে। এখানে মানবিকতার পরাজয় ঘটে আজিজ খাঁর হাতে। তবে এই রাজাকার শেষমেষ হত হয়। এ যেন ইঙ্গিত দেয়, এদের পরাজয় সর্বত্র।
পাক হানাদারদের কার্যক্রম ও তাদের মনস্তত্বের ব্যাখ্যা
‘উনিশ শ’ একাত্তর’ এবং ‘অসুখ’ গল্পদুটির প্রথমটিতে পাক হানাদারদেরকে সরাসরি গল্পের চরিত্র হিসেবে দেখতে পাই, দ্বিতীয় গল্পটিতে আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের মুখে তাদের কথা শুনতে পাই। কোন গল্পেই লেখক, গল্প কথক কিংবা গল্পের চরিত্র, কেউই সরাসরি পাক হানাদারদেরকে আক্রমন করে কোন কটুক্তি করেন না। তারপরও যে পাঠক ১৯৭১ দেখেনি, সে সম্বন্ধে কিছু শোনেওনি, এমন পাঠকও ঠিকই বুঝে যায় কতটা রুচিহীন, দানবীয়, অমানবীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল এই হানাদাররা।
‘উনিশ শ’ একাত্তর’গল্পে আমরা এমন এক পাকিস্তানি মেজরের সাক্ষাৎ পাই যে এমনকি বাংলা বলতে পারে, বুঝতে তো পারেই। এ কারণে আমরা ধরে নিতে পারি যে এই মেজর বাংলার আলো-হাওয়ায় মানুষ হয়েছে। এমনও হতে পোরে যে সে এক অতি চৌকস অফিসার। কিন্তু তার প্রতিটি পদক্ষেপে বাংলার মানুষের প্রতি তার বিদ্বেষ, নির্ভেজাল ক্রুরতা স্পষ্ট প্রকাশিত হয়। মেজর তার দলবল নিয়ে আজিজ মাস্টারের গ্রামে প্রবেশ করলে যে পাগল এগিয়ে আসে তাকেও সে গাছে বেঁধে ফেলার আদেশ দেয়। গ্রামের লোকজন যখন শিক্ষিত আজিজ মাস্টারকে মেজরে কাছে পাঠায় একথা বোঝানোর জন্য যে তাদের গ্রামে সবাই পাকিস্তানি, তখন মেজর তাকে কৌশলী জেরা করতে থাকে। ৪০ বঝর বয়স্ক আজিজ মাস্টার অবিবাহিত জেনে মেজর তাকে জিজ্ঞেস করে: ‘তাহলে চালাও কিভাবে?’ এরপর সবার সামনে তাকে উলগ্ন করে। প্রথমেই পায়জামাটা খুলিয়ে ফেললেও, গায়ের জামাটাকেও খুলিয়ে নেয় যেন এই বাঙালিকে সবকিছুর সামনে নতজানু, পরাজিত, অপদস্ত প্রমাণ করা যায়। এমনই স্যাডিস্ট এই মেজর। গ্রামকে বাঁচানোর জন্য আজিজ মাস্টার যখন মিথ্যে কথা বলে চলছে, মেজর তখন প্রশ্ন করে বসে:‘তুমি কি আমাকে পছন্দ করো?’ আজিজ মাস্টারের সহ্যের সীমা পার হলে সে মনের কথা বলা শুরু করে এবং শেষমেষ মেজরের গায়ে থুতু ছঁড়ে দেয়। আর তখনই দেখা যায়, মেজর আজিজ মাস্টারকে ফেলে রেখে যাত্রা শুরু করে। মেজরের পরাজয় এখানেই।
‘অসুখ’ গল্পে আমরা কোন হানাদার সদস্যকে দেখতে পাই না কিন্তু কেবল দুটি কথাই আমাদের সামনে তাদের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা খোকনের মা অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন একথা জেনে যে তার সন্তানকে মিলিটারিরা ধরে ফেলার পর অমানবিকভাবে মাঠের মধ্যে নিয়ে জবাই করে। খোকনের বন্ধুকে মাঝে মাঝে গিয়ে সেই মায়ের সামনে মিথ্যে বলতে হয় যে খোকন গুলিতে আহত অবস্থায় নৌকায় মারা গিয়েছিল। এই মিথ্যে বলতে বলতে খোকনের বন্ধুও অপ্রকৃতিস্থ হতে শুরু করেছে কিন্তু এই মিথ্যেটি শোনার পর কিছুদিন সেই মায়ের কিছুটা শান্তিতে ঘুম আসে। খোকনের মা যখন মিথ্যেটি বিশ্বাস করতে চায় না তখন বন্ধুটি অসহায় হয়ে বলে: ‘তা ছাড়া ওরা মানুষ কীভাবে জবাই করবে? ওরা নিজেরাও তো মানুষ।’ এখানেই হুমায়ূন আহমেদের কৃতিত্ব। তিনি বুঝিয়ে দেন, হানাদারেরা কতটা অমানুষ।
মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা ও ত্যাগ
মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতার গল্প শেষ হবার নয়। তবুও নতুন প্রজন্মের জন্য প্রামাণ্য চিত্র, সিনেমা আর গল্প রেখে যাওয়া প্রয়োজন। ‘উনিশ শ’ একাত্তর’, ‘অসুখ’ এবং ‘শ্যামল ছায়া’ গল্পে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব আর ত্যাগের মহিমা দেখত পাই।
‘উনিশ শ’ একাত্তর’গল্পে যে মুক্তিযোদ্ধাকে দেখতে পাই সে যে ভীরু কাপুরুষ ছিল। তার মা তাকে ‘পা ভাঙা বিড়াল’ এর সঙ্গে তুলনা করেছিল। পাকিস্তানি মিলিটারির আসার কথা শুনে তাকে বারবার প্রস্রাবখানায় যেতে হচ্ছিল। সেই আজিজ মাস্টার কিন্তু এ ঘটনার আগেই স্কুলের পাকিস্তানের পতাকা ফেলে দিয়েছিল কারো সঙ্গে পরামর্শ না করে নিজ সিদ্ধান্তেই। এই তো মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়। গ্রামের মানুষকে বাঁচাতে পাকিস্তানি মেজরের সামনে পুরো নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে মিথ্যে বলতে বলতে শেষশমষ সে মেজরের গায়ে থুতু ছুঁড়ে ফেলে। এই তো শান্তিপ্রিয় বাঙালির পরিচয়, শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা কিন্তু প্রয়োজনে প্রাণ দেয়া তবু মান রক্ষা করাটাই তার ধর্ম।
‘অসুখ’গল্পে আমরা দেখি যে খোকনকে মিলিটারিরা ধরে ফেলার পর জবাই করে হত্যা করে সব ধরনের যুদ্ধনীতির তোয়াক্কা না করে, সেই খোকনের সহযোদ্ধা স্বাধীন দেশে একটা চাকুরি বা ব্যবসার জন্য সৎ চেষ্টায় রত। স্বাধীন দেশে সবকিছু তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে মনে হলেও সে আশা ছাড়তে চায় না। এই তো মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র। ‘শ্যামল ছায়া’ গল্পে ক্রাচে ভর দিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধা হেঁটে বেড়ায় সেই মজিদ বলে: ‘স্বাধীনতার কাছে এই ক্ষতি খুব সামান্য।’ সে তার অবুঝ মাকে একথা বোঝায়। এমন ত্যাহের মহিমা তো মুক্তিযোদ্ধার জীবন।
মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বেদনার বিবরণ
যে মা কিংবা বাবা তার সন্তানকে মৃত্যুর মুখে পাঠানো নিশ্চিত জেনেও মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছে, যে স্ত্রী বিধবা হয়েও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর যে কোন চিহ্ন ধরে রেখে মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছ তাদের বেদনার গাথা পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে। এসব পরিবারের সদস্যরা পারেনা তাদের বুকের কথঅ মুখ ফুটে বলতে, আর তাই হুমায়ূন আহমেদ তার ছোটগল্পে তাদের বেদনা তুলে ধরেছেন, তবে কৌশলে, যেন তা উপকারভোগী কিন্তু স্বার্থপর বা কিছুটা হলেও কৃতঘ্ন দেশবাসীর ভালমানুষির মুখোস ছিঁড়ে ফেলতে পারে। আমাদের হাতের গল্পসমগ্রের ছয়টি গল্পের মধ্যে ‘শীত’ ও ‘শ্যামল ছায়া’-য় আমরা এমন উপস্থাপন দেখি।
‘শীত’ গল্পে মুক্তিযোদ্ধা মেছের আলির বৃদ্ধ বাবা প্রচন্ড শীতে কাতর। শীতে এতটাই কাতর যে সে তার নাতিকে পাশে পেতে চায় যেন শরীরের উষ্ণতায় আরাম পেতে পারে। শহীদ ছেলের বীর্য-রক্তে জন্মে নেয়া সন্তানের দেহের উষ্ণতায় মুক্তিযোদ্ধার পিতা বেঁচে থাকতে চায়। এ যেন পুরো দেশের চিত্র। আমরা সবাই তো সেই মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তে গড়া দেশে প্রাণ পেয়েছি।এখানে চরম অপমান আর উদাসিনতার চিত্রও আছে। গত বছর যখন মেছের আলির পিতা রিলিফের গম নিতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ছেলের পরিচয় দেয়, তখন প্রশ্ন আসে: ‘মেছের আলির জন্যও গম দেয়া লাগবে? সেও রুটি খাবে?’ আর একথার উত্তরে ‘লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই হেসে উঠল। যেন এ রকম মজার কথা তারা বহুদিন শুনে নাই।’ এ চিত্র যেন বাংলাদেশের সাধারণ চিত্র। আসলে হুমায়ূন আহমেদ মেছের আলির পিতার বয়ানে আমাদের সবার গালে স্পষ্ট চপেটাঘাত করলেন। এবার শীতে মেছের আলির বাবা যখন একটা কম্বল আর পঞ্চাশ টাকা পেলেন, তখন শহীদ ছেলের প্রতি তার কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে উঠল। রাতের বেলায় কম্বলের উষ্ণতায় শুয়ে থেকে শহীদ ছেলের বউ ফুলজানের কান্নাটাও তখন মধুর শোনাল, ‘কেমন যেন গানের সুরের মত শোনায়।’ আমরা যেমন এমনই, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের ফসল আমরা ভোগ করব, আর সব ভুলে নিজ নিজ সুখ অর্জনে ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত থাকব। মেছের আলির বিধবা বউ ফুলজান, যে কেবল ফুঁপিয়ে কাঁদতে পারে, তার খোঁজ কেউ নেয় না। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানটি আদৌ শিক্ষার কোন সুযোগ পাচ্ছে কিনা এ বিষয়ে কোন খবর নেই।
আর ‘শ্যামল ছায়া’ গল্পে আমরা অশিক্ষিত বাবা-মার সন্তান মজিদকে পাই। শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত, রাজনীতি সচেতন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিলে মজিদের মা রহিমা কেবল তার জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে পারে। সেসময় রহিমার অসুখ হয়, রাতে ঘুম আসে না, ঘুম আসলে ঘুম ভেঙে নি:শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। যুদ্ধ থেমে গেলে একদিন মজিদ হাসিমুখে দরজার সামনে এসে ডাকল,‘মা আমি মরি নাই গো, দেখ বেঁচে আছি।’ রহিমার অসুখটা তখন আরো বাড়ল, ক্রাচের শব্দে বুকের ধড়পড়ানি আরো বাড়ল। রহিমাও মজিদের মত ভাবতে চেষ্টা করে: ‘একটি স্বাধীনতার কাছে এই ক্ষতি খুব সামান্য।’ কিন্তু রহিমা মজিদ নয়। তার ঘুম আসে না। তার কষ্টের কমতি হয় না কারণ রহিমা জানে মজিদ শিখাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু সে আশা পূরণ তো ঘটেনি, আর ঘটবেও না। এই আশাপূরণের অভাব যেন মুক্তিযোদ্ধাদের আশা পূরণে দেশবাসীর ব্যর্থতার রূপক হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের যে অসামান্য যন্ত্রণা, এই গল্প তা তুলে ধরে মজিদের মায়ের অনুভবের মাঝে। একই সঙ্গে আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করি: আমরা কি মুক্তিযোদ্ধাদের আশা পূরণে আমাদের দায়িত্ব পালন করছি?
‘শীত’ ও ‘শ্যামল ছায়া’, উভয় গল্পেই আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের বেদনার গাথা অনুভবে পাই। তবে গল্পকার এখানে মুক্তিযুদ্ধের ফলভোগী পাঠকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করিয়ে দেয়, অনেকটা যেন চপোটাঘাত করার মাধ্যমেই। আমরা যে এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান করতে পারিনি তা যে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। মেছের আলির বাবা, সন্তানেরা যেন এখন অপাঙতেয়। মজিদের মায়েরা যেন নিজের সঙ্গে লড়াই করে মেনে নিতে চায় যে স্বাধীনতার জন্য তাদের সন্তানের জীবনদান, অঙ্গদান আসলেই সার্থকতা পেয়েছে।
ইতিহাস প্রাণ পেয়েছে
হুমায়ূন আহমেদ তার গল্পে ইতিহাস রচনা করবেন, এমন প্রত্যাশা আমাদের নয়, সৃষ্টিশীল লেখকের কাছে এমনটা প্রত্যাশা করাও বোধহয় ঠিক নয়। কিন্তু হেমার যেমন ইতিহাসকে পুনর্নির্মান করেছেন কালজয়ী সত্যকে উপস্থাপনের জন্য হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭১ এর প্রেক্ষাপটকে ঠিক সেভাবেই তার ছোটগল্পে তুলে ধরেছেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে লেখকের অনুভব তার সময়কে জয় করে বর্তমানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ২০১৩-র ফেব্রুয়ারিতে হুমায়ূনের গল্প যেন বাংলার মাটিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ছোটগল্পকার হুমায়ূন আহমেদ তার গল্পের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের জন্য সত্য ইতিহাসে প্রাণ দিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন হানাদার সহযোগীদের কার্যক্রম, পাক হানাদারদের কার্যক্রম ও তাদের মনস্তত্বের নিরাবেগ উপস্থাপন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা ও ত্যাগ এবং মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের অনুভবকে উপস্থাপনের মাধ্যমে।
©somewhere in net ltd.