![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নাগরিকদের পরিচয় শনাক্তকরণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম জাতীয় পরিচয়পত্র। সরকারিভাবে এখনো বাধ্যতামূলক করা হয়নি এ পরিচয়পত্র। বরং জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক না করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। তারপরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান মনগড়াভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করায় সুযোগটি লুফে নিয়েছে একটি চক্র। এতে রাজধানীসহ সারা দেশে বেড়েই চলেছে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র বেড়ে যাওয়ায় সমাজে বেড়ে চলেছে অপরাধ। কারণ, ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের সিংহভাগই ব্যবহার করছে অপরাধীরা। এমনকি বিদেশি নাগরিকরাও এসব ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় উদ্বেগ জানালেও রহস্যজনকভাবে নীরব রয়েছে পরিচয়পত্র প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন (ইসি)- সম্প্রতি রাজধানীতে অর্ধলাখেরও বেশি জাল পরিচয়পত্রসহ দুই অপরাধী আটক হলে বিষয়টি সবার নজরে চলে আসে।
প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের নীরবতার সুযোগে অপরাধী চক্রের কার্যক্রম উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলছে। রাজধানীতে ৫৩ হাজার জাল পরিচয়পত্র উদ্ধার তার একটি বড় প্রমাণ। দেশের নাগরিকদের পরিচয় শনাক্তকরণের এ পরিচয়পত্র জাল করার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক না করতে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রতিষ্ঠান তা মানছে না। যার ফলে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছে একটি অসাধু চক্র।
জাতীয় পরিচয়পত্র শুধু মোবাইল ফোনের সিম, ব্যাংক একাউন্ট ও পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, চাকরি থেকে শুরু করে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কাজেই অপরিহার্যভাবে চাওয়া হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র। যে কারণে অপরাধীচক্র জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির ব্যবসা খুলে বসেছে। অথচ এসব ক্ষেত্রে পরিচয়পত্র ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়ার কথা নয়।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০ এর ধারা ১১(১) এ বলা আছে, সরকার, সরকারি গেজেটে এবং তদতিরিক্ত ঐচ্ছিকভাবে ইলেকট্রনিক গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, উহাতে উল্লিখিত যে কোন সেবা বা নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে, নাগরিকগণকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শন ও উহার অনুলিপি দাখিলের ব্যবস্থা চালু করতে পারবে। তবে শর্ত থাকে যে, বাংলাদেশের সমগ্র এলাকায় সাধারণভাবে নাগরিকগণের অনুকূলে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এইরূপ প্রজ্ঞাপন জারি বা ব্যবস্থা চালু করা যাবে না।
ধারা (২) এ বলা আছে, উপ-ধারা (১) এর অধীন প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদর্শন, কিংবা ক্ষেত্রমত, জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি দাখিল করার জন্য কোন নাগরিককে বাধ্য করা যাবে না এবং জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকার কারণে কোন নাগরিককে নাগরিক সুবিধা বা সেবা পাওয়ার অধিকার হতে বঞ্চিত করা যাবে না।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বাধ্যতামূলক না করার নির্দেশ সত্ত্বেও দেশের সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ নাগরিকদের অনেকে। এর ফলে সারা দেশে বেড়ে গেছে অবৈধ ও ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের রমরমা বাণিজ্য। কমিশন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক না করা হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানই তা আমলে নিচ্ছে না। দেশের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই জাল পরিচয়পত্র কীভাবে তৈরি হচ্ছে এর সন্ধান জানতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
রাজধানীর অলিগলিতে গজিয়ে উঠেছে মোবাইল সিম বিক্রির দোকান। সিম বিক্রিতে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ বাধ্যতামূলক হওয়ার কারণে এসব দোকানদাররাই স্বউদ্যোগে যোগান দিচ্ছে জাল পরিচয়পত্র। আর এটা তৈরি করছে একটি জালিয়াত চক্র। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র নিরাপত্তা এবং আর্থিক খাতসহ নানাখাতে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশে কী পরিমাণ ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্রধারী রয়েছে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই নির্বাচন কমিশনের কাছে। তবে বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা গেছে, দেশে কমপক্ষে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ ভুয়া পরিচয়পত্র রয়েছে। জানা গেছে, বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির প্রায় ৭০ লাখ সিম রয়েছে। এর বেশির ভাগই জাল জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কিনেছে অপরাধীরা। বাকি সিমগুলো কিনেছে ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স অর্থাৎ ভোটার হওয়ার বয়স হয়নি। মূলত মোবাইল সিম ব্যবহার করার জন্যই এরা নিয়েছে জাল পরিচয়পত্র।
নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, কমিশন দুই দফা গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার বাধ্যতামূলক না করতে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে। তারপরও কেউ আমলে নিচ্ছে না। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পর কেউ বাধ্যতামূলক করলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা মামলা করতে পারে। এছাড়া পরিচয়পত্র জালকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিষয়ে আইনের ১৮ ধারায় বলা আছে। বিষয়টি নিয়ে কমিশন উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন একজন নির্বাচন কমিশনার।
বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অবস্থান জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ শীর্ষ নিউজকে বলেন, জাল পরিচয়পত্র বন্ধে কমিশনের কিছুই করার নেই। আমরা আইন তৈরি করে দিয়েছি। অপরাধীদের শাস্তি দেবে আদালত।
সম্প্রতি আটক হওয়া পরিচয়পত্র সম্পর্কে কমিশনের অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ অপরাধীদের আটক করেছে, তারাই মামলা দিয়েছে। এখানে কমিশনের কিছু করার নেই। জাল টাকার ক্ষেত্রে যেমন সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। এটাও ঠিক সেরকম।
পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক না হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সেবা দিতে না চাওয়ার বিষয়ে এ কমিশনার বলেন, আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সকলকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি, সকল নাগরিকের পরিচয়পত্র তৈরি হওয়ার আগে পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা যাবে না। এরপর কেউ যদি হয়রানির শিকার হয় তাহলে আইনের আশ্রয় নিতে পারে।
সূত্রমতে, নামে-বেনামে ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা, অন্যের জমি বিক্রি বা দখল এবং অবৈধ মোবাইল সিম কার্ড ব্যবহার করতে এসব ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব জালিয়াতির সাথে খোদ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একটি শক্তিশালী চক্র জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় এক প্রবাসীর জমি বিক্রি করতে গিয়ে জাল পরিচয়পত্রধারী এক দালাল ধরা পড়লে বিষয়টি সবার নজরে আসে।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা জেলা নির্বাচন অফিস থেকে অযোগ্য ব্যক্তিদের সুপারিশের মাধ্যমে ভোটার করে পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। ইসি’র ঊর্ধ্বতন কয়েক কর্মকর্তার যোগসাজশে এ অপকর্ম চলছে।
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইনের ১৮ (১) ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করলে বা জ্ঞাতসারে উক্তরূপ পরিচয়পত্র বহন করিলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ বলে গণ্য হবে এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য অনূর্ধ্ব সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে।
ধারা (২) অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করার কাজে সহায়তা বা উক্তরূপ পরিচয়পত্র বহনে প্ররোচনা করলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনিও অনূর্ধ্ব সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
নাগরিকদের ভোটার হওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে নির্বাচন কমিশন। তাই পরিচয়পত্রের যাবতীয় বিষয়ের দায় কমিশন এড়াতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খোদ নির্বাচন কমিশনেরই এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। ওই কর্মকর্তার মতে, কমিশনের কাজ সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করা। জাতীয় পরিচয়পত্র জালসহ বিভিন্ন বিষয়ের দায় কমিশন নিতে না পারলে কমিশনের উচিত এ দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করা।
আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় এবং পরিচয়পত্রের অপব্যবহারের কারণে অপরাধটি বেড়েই চলছে। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। সম্প্রতি রাজধানীর বংশালে ৫৩ হাজার জাল পরিচয়পত্র আটক করা হয়। এর তদন্ত করতে গত ২০ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি একটি উপ-কমিটি গঠন করে। কমিটি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলে কাজ করার কথা থাকলেও এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। (সুত্রঃ শীর্ষনিউজ )
©somewhere in net ltd.