নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অসামান্য এক প্রতিভাবান উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

২৫ শে মে, ২০২১ দুপুর ১:০২



সুকুমার রায়ের ছড়া কবিতা আমার বয়েসি কেউ পাঠ্য পুস্তকে পড়েননি এমনটা হবে বিরল । তার পুত্র সত্যজিত রায়ের নাম শোনা বা তার তৈরি সিনেমাও দেখেছেন সবাই । বহু বছর আগে রায় বংশের ঠিকুজি খুজতে গলদঘর্ম কিন্তু পাইনি । বংশানুক্রমে একটি করে প্রতিভার জন্ম এই সমাজে বিরল । আমার খুব আশ্চর্য লেগেছিল শিশু সত্যজিত রবি ঠাকুরের কাছে দাড়িয়ে তার আকা ছবিতে ছড়া লিখিয়ে নিল- আলোকচিত্র দেখে । তাদের সম্পর্কটাও পরিস্কার হয়েছে নিচের লেখাতে। বইয়ের হাট এই কদিন আগেই উপেন্দ্রকিশোরের জন্মদিন উপলক্ষে ঠিকুজির বিস্তারিত জানাল । আশা করি সমমনা পাঠক উপকৃত হবেন তাদের উত্থানের কাহিনী পড়ে।

প্রায় পাঁচশো বছর আগেকার কথা। বিহার থেকে এসে নদীয়ার চাকদহ গ্রামে বসতি স্থাপন করলো একটি কায়স্থ পরিবার। পদবী ছিল ‘দেও’ যা বাংলায় এসে হয়ে যায় ‘দেব’। সাধারণ বাঙালি কায়স্থদের মতন শাক্ত হবার বদলে এঁরা ছিলেন বৈষ্ণব। ষোড়শ শতকে এই পরিবারের সদস্য, সুপুরুষ, তীক্ষ্ণধী রামসুন্দর দেব ভাগ্যান্বেষণে ঘুরতে ঘুরতে পুব বাংলায় এসে নজরে পড়ে যান যশোদলের রাজার। ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল তারপরেই। অতএব, রাজার জামাই হয়ে যশোদলে বাস শুরু করলেন রামসুন্দর। কয়েক পুরুষ বাদে বাস উঠিয়ে এই পরিবার চলে এল ব্রহ্মপুত্রের ধারে ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে। ততদিনে মুঘল রাজসরকারে কাজ করবার সুবাদে পাওয়া 'রায়' উপাধিকেই পদবি করে নিয়েছেন তাঁরা। গড়ে তুলেছেন জমিদারী।
মসুয়ার সেই অভিজাত পরিবারে সরস্বতী অধিষ্ঠিত হলেন লোকনাথ রায়ের আমলে। বহুভাষাবিদ এই সাধক পন্ডিতের পুত্র কালীনাথও ছিলেন পিতার মতই বহুভাষাবিদ পন্ডিত। কালীনাথের পাঁচ ছেলে। সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমদারঞ্জন। এই দ্বিতীয় পুত্রটিকে পাঁচ বছর বয়সে রায়বংশের আরেক শাখার প্রসিদ্ধ উকিল ও জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরি দত্তক নিয়ে নাম বদলে রাখলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। এর কয়েক বছর পরে হরিকিশোরের নিজের একটি ছেলে হয়। ইনি নরেন্দ্রকিশোর।
1863 সালে জন্ম হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোরের। ছোট থেকেই পড়াশোনাতে ছিলেন চৌখস। 1879 সালে বৃত্তিসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করে ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে এলেন তিনি। সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে তারপর 1884 সালে স্নাতক হলেন মেট্রোপলিটন কলেজ (এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ) থেকে।
ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সাহিত্যের আঙিনায় পা পড়ে উপেন্দ্রকিশোরের; 1883 সালে, শিক্ষক প্রমদাচরণ সেনের ‘সখা’ পত্রিকায় ‘মাছি’ নামে একটা লেখার মধ্যে দিয়ে। ঐ বছরই সখা পত্রিকায় আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা চালালেন উপেন্দ্রকিশোর। ছোটদের সাহিত্যে প্রথম চলিত ভাষার প্রয়োগ করে লিখলেন ''নিয়ম ও অনিয়ম'' নামের এক অনুবাদ প্রবন্ধ। এই সময়েই উপেন্দ্রকিশোরের জীবনে আরো একটি গভীর পরিবর্তন আসে। তিনি ব্রাহ্মধর্ম অবলম্বন করে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে যোগ দেন। এর ফলে পরিবারের অনেকেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করলেও পালকপিতার পরিবারের সঙ্গে কোন বিচ্ছেদ ঘটেনি তাঁর। হরিকিশোর তাঁর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী উপেন্দ্রকিশোরকেই করে গেলেন। উপেন্দ্রকিশোর অবশ্য তাঁর ভাই নরেন্দ্রকিশোরকে বঞ্চিত করেননি। ময়মনসিংহের সমস্ত সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে নরেন্দ্রকিশোর যে ভাগ তাঁকে দিতেন তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতেন।
1886 সালে ব্রাহ্মসমাজের আর এক বিখ্যাত মানুষ দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা বিধুমুখীকে বিয়ে করে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের লাহাদের বাড়ির কয়েকটা ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু হল সংসারজীবন। একে একে জন্ম নিল সুখলতা, সুকুমার, পুণ্যলতা সুবিনয়, শান্তিলতা ও সুবিমল। সেসময় বাংলা শিশুসাহিত্যের জগতে একে একে আবির্ভূত হচ্ছে সখা, সাথী, মুকুল এবং বালকের মত পত্রিকা। ভরা সংসার চালাবার পাশাপাশি এইসব পত্রিকায় তাঁর লেখার দিগন্ত ক্রমশই প্রসারিত হচ্ছিল নানা বিচিত্র বিষয়ের তথ্যমূলক লেখার পরিসর ছেড়ে অলংকৃত গল্পে, কবিতায়। আর এইভাবেই শিশুসাহিত্যের জগতে উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের জন্ম দেখছিল বাংলা।
1897 সাল। সিটি বুক সোসাইটি থেকে ‘ছেলেদের রামায়ণ’ নামে উপেন্দ্রকিশোরের লেখা ও অলংকরণ করা একটা সচিত্র বই প্রকাশিত হল। সে সময় বইতে ছবি ছাপার জন্যে কাঠের ব্লকের গায়ে ছবি অনুযায়ী দাগ কেটে ব্লক তৈরির কাজ করা হত। সেটা অনেকটাই নির্ভর করতো কারিগরের দক্ষতার ওপরে। ফলে একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই ছবি খারাপ হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। ছেলেদের রামায়ণের ক্ষেত্রেও দেখা গেল সেই ব্যাপারটাই ঘটে গেছে। ফলে গোটা প্রথম সংস্করণটাই একেবারে বিগড়ে গেল বইটার। বইয়ের ছবির দশা দেখে উপেন্দ্রকিশোর ঠিক করলেন পদ্ধতিটাই বদলে ফেলতে হবে। সে দশকের শুরুর দিক থেকেই পশ্চিমে একটা নতুন আবিষ্কৃত চিত্রমুদ্রণ পদ্ধতির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হচ্ছিল। সেটি হল হাফটোন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে যেকোনো ছবিকে ছোট ছোট ফোঁটায় বিভক্ত করে ফেলে তারপর বিভিন্ন উপায়ে সেগুলোকে ফুলটোন ছবিতে পরিণত করা হত। তাছাড়া, এই পদ্ধতিতে ছবির টোন বা আলোআঁধারির বিভিন্ন ঘনত্বও ধরা পড়ত নিখুঁতভাবে। ফলে ছবি অনেকটাই বাস্তবসম্মত হত। ছাপা যেত ফটোগ্রাফও। উপেন্দ্রকিশোরের তখন বেশ কিছুদিন হল নজর পড়েছে ফটোগ্রাফি আর মুদ্রণের মধ্যে সেতুবন্ধনকারী সেই হাফটোন মুদ্রণ পদ্ধতির দিকে। কিছু পড়াশোনাও শুরু করেছেন সেই নিয়ে। ছেলেদের রামায়ণের এই গন্ডগোলটা ঘটবার পর তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন যে এইবারে এই নতুন পদ্ধতিটাকেই বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগাতে হবে এদেশে। কিন্তু মুশকিল হল, গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই তখন এ পদ্ধতিতে কেউ মুদ্রণ করেন না। এইখানেই উপেন্দ্রকিশোর বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিলেন। হাফটোন পদ্ধতি নিয়ে কিছুকাল যাবতই তাঁর পড়াশোনা চলছিল। এইবার পৈতৃক জমিজিরেতে তাঁর অংশের অনেকখানি বিক্রি করে সেই টাকায় বিলেতের পেনরোজ কম্পানি থেকে বইপত্র, রাসায়নিক, ক্যামেরা, যন্ত্রপাতি আনিয়ে নিয়ে শুরু হল হাফটোন পদ্ধতিকে ভালো করে জেনে বুঝে নিয়ে তার উন্নতিসাধনের চেষ্টা। বাড়ি বদলে উঠে এলেন শিবনারায়ণ দাস লেন-এর অপেক্ষাকৃত বড় একটা বাড়িতে। সেখানে নতুন সব যন্ত্রপাতি বসিয়ে শুরু হল তাঁর মুদ্রণসংস্থা 'ইউ রে আর্টিস্ট'-এর জয়যাত্রা। হ্যাঁ, রায়, কারণ তিনি 'চৌধুরী' শব্দটি লিখতে চাইতেন না। বলতেন 'জমিদার' 'জমিদার' গন্ধ আছে। যাই হোক, ছাপাখানার পাশাপাশি সেখানে একটা ঘরে গড়ে তুললেন হাফটোন নিয়ে তাঁর স্টুডিও তথা গবেষণাগার। একটা স্নানঘর বদলে গেল তাঁর ডার্ক রুম-এ। প্রতিষ্ঠিত হল দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধুনিক প্রিন্টিং প্রেস। শুরুতে সীমিত ক্ষমতার হাফটোন ব্লকের কাজ হত সেখানে। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, নিজস্ব পদ্ধতিতে সাত রকম ডিটেইলযুক্ত হাফটোন ব্লকে ছবি ছাপাইয়ের বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছেন তরুণ উদ্ভাবক। ''75 থেকে শুরু করে 266 লাইনের হাফটোন ব্লক—যার যেমন পকেটের জোর তিনি তেমন মানের ব্লক নিয়ে নিন ইউ রায় আর্টিস্টের থেকে।''
ছাপাখানার ব্যবসার পাশাপাশি, সেই 1897 থেকেই ব্রিটেনের গ্রাফিক আর্টের বিখ্যাত জার্নাল পেনরোজ অ্যানুয়ালে একের পর এক প্রবন্ধে প্রকাশিত হতে শুরু করল হাফটোন মুদ্রণপদ্ধতি নিয়ে তাঁর মৌলিক গবেষণার ফলাফল। 1911 সালের মধ্যে তাঁর নটা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় এই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জার্নালে। প্রবন্ধগুলোর নাম নিম্নরূপ-
ফোকাসিং দ্য স্ক্রিন (1897)
দা থিওরি অব হাফটোন ডট (1898)
দা হাফটোন থিওরি গ্রাফিক্যালি এক্সপ্লেইনড (1899)
অটোম্যাটিক অ্যাডজাস্টমেন্ট অব দা হাফটোন স্ক্রিন (1901)
ডিফ্র্যাকশান ইন হাফটোন (1902-03)
মোর অ্যাবাউট হাফটোন থিওরি(1903-04)
দা সিক্সটি ডিগ্রি ক্রস লাইন স্ক্রিন (1905-06)
মালটিপল স্টপস্‌ (1911-12)
হাফটোন প্রযুক্তিতে উপেন্দ্রকিশোরের প্রধান অবদান দুটো। আবিষ্কার করেন হাফটোন ক্যামেরার জন্য অটোমেটিক স্ক্রিন অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন্ডিকেটর, যার সাহায্যে হাফটোন ক্যামেরার ফোকাসিং-এর জন্যে পর্দার সঠিক অবস্থানটা যান্ত্রিক নির্ভুলতায় নির্ধারিত হয়ে যেত। সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটি বের হয় পেনরোজ পত্রিকার 1901 সালের সংস্করণে। সে যন্ত্র তাঁর পদ্ধতি মেনে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি শুরু হল ব্রিটেনে। ''পেনরোজ'' তার 1904-05 সংখ্যার সম্পাদকীয়তে, হাফটোনের জন্য নিখুঁত নেগেটিভ তৈরি করবার ক্ষেত্রে তাঁর আবিষ্কারের মৌলিক গুরুত্বকে সশ্রদ্ধে স্বীকারও করে নিল। ইতিমধ্যে 1902 সালে তিনি তৈরি করেছেন রে’জ টিন্ট প্রসেস। 1903 সাল থেকেই সেই পদ্ধতি অবলম্বন করে ম্যাগাজিনে হাফটোন রঙিন ছবি ছাপাইয়ের কাজ শুরু হয়ে গেছে। রঙিন হাফটোন ছাপার এই পদ্ধতিটা তখন ব্রিটেনের বেশ কিছু প্রযুক্তি শিক্ষালয়ে ব্যবহৃতও হতে শুরু করেছে।
ঘরে বাইরে দু জায়গাতেই স্বীকৃতি পেয়েছিল তাঁর এইসমস্ত অসাধারণ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন। রবীন্দ্রনাথ 1898 সালে ভারতী পত্রিকায় সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোরের এই নতুন পরিচয়টি সগর্বে ঘোষণা করে বলেন, ''অনেকেই হয়তো জানেন না হাফটোন লিপি সম্বন্ধে উপেন্দ্রবাবুর নিজের আবিষ্কৃত বিশেষ সংস্কৃত পদ্ধতি বিলাতের শিল্পীসমাজে খ্যাতিলাভ করিয়াছে---------সর্বপ্রকার পরামর্শ ও সহায়তার অভাব সত্ত্বেও এই নূতন শিল্পবিদ্যা আয়ত্ত এবং তাহাকে সংস্কৃত করিতে যে পরিমাণ অধ্যবসায় ও মানসিক ক্ষমতার প্রয়োজন তাহা অব্যবসায়ীর পক্ষে মনে আনাই কঠিন।''
লন্ডনের প্রসেস ওয়ার্ক অ্যান্ড ইলেক্ট্রোটাইপিং নামের জার্নালে দেখছি, ''কলকাতার উপেন্দ্রকিশোর রায় গবেষণার মৌলিকত্বে ইউরোপ ও আমেরিকার গবেষকদের থেকে অনেক এগিয়ে আছেন। এ জাতের কাজের প্রধান কর্মকেন্দ্রগুলোর থেকে এত দূরে বসে এমন সাফল্য অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার।'' একই প্রতিধ্বনি শোনা গেল বাংলার জনশিক্ষা দফতরের প্রধানের মুখেও। এদেশি স্কুলের বইগুলোকে অলংকরণের ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে উপেন্দ্রকিশোরের ছাপাই পদ্ধতি নিয়ে তাঁর মন্তব্য, ''বাংলায় এত ভালো ছবি ছাপা হয় সে কথা আমার কল্পনাতেও আসে নি।''
ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যিনি মুদ্রণ সম্পর্কিত এই গুরুগম্ভীর প্রবন্ধগুলি লিখেছিলেন, তিনিই আবার একই স্বচ্ছন্দতায় লিখেছিলেন 'টুনটুনির বই'। তবে তার আগেও আছে খানিক কথা। কিছুকাল যাবৎ ‘মুকুল’ পত্রিকায় প্রাচীন পৃথিবী ও প্রাগৈতিহাসিক জীবজন্তুদের নিয়ে ছোটদের জন্য আকর্ষণীয় সব লেখা বের হচ্ছিল উপেন্দ্রকিশোরের। সেগুলোকে একত্রে সংকলন করে 1903 সালে প্রথম এ জাতীয় বাংলা বইটি প্রকাশিত হল। নাম ''সেকালের কথা।'' 1897 সালের সেই ব্যর্থ বই 'ছেলেদের রামায়ণ' নবকলেবরে নিখুঁত ভাবে পুনঃপ্রকাশিত হল 1907 সালে। এ বইয়ের পান্ডুলিপি আর প্রুফ সংশোধন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। 1908 সালে বের হল 'ছেলেদের মহাভারত'। 1909 সালে প্রকাশিত হল মহাভারত নিয়ে নিজস্ব ঢঙ-এ গল্পাকারে 'মহাভারতের গল্প'। ছেলেদের রামায়ণ আর ছেলেদের মহাভারতের জনপ্রিয়তা শতবর্ষ পার করে আজও অব্যাহত রয়ে গেছে। তবে এই অবধি প্রাচীন ভারত ও পৃথিবীর দিকেই মুখ ফেরানো ছিল সৃজনশীল লেখকের। 1910 সালে এসে লেখার গতিমুখ বদলে গিয়ে দৃষ্টি ফেরালেন তিনি জীবন্ত অতীতের দিকে। গ্রামবাংলার মা ঠাকুমাদের মুখে মুখে প্রচলিত বেশ কিছু গল্প একত্রে সংগ্রহ করে লেখা হল তাঁর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকীর্তি, চিরকালীন গ্রামবাংলার পটভূমিতে সাজানো অনবদ্য সংগ্রহ ''টুনটুনির বই''। অসাধারণ গল্পকথন আর ততোধিক সুন্দর ছবিতে সাজানো এ বই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নিজস্ব প্রকাশনা থেকে। সে ছাপাখানার তখন নাম বদলে গেছে। 1910 সালে ছেলে সুকুমার সঙ্গে যোগ দিতে তার নাম বদলে হয়েছে 'ইউ রায় অ্যান্ড সন্স'। কাজের পরিধি বেড়েছে বহুগুণ। সাদাকালো ও রঙিন হাফটোনের মৌলিক ডিজাইন তৈরি করছেন তাঁরা তখন বই, পত্রিকা, ক্যাটালগ লেটারহেড, এইসমস্ত যাবতীয় মুদ্রণবিষয়ক ক্ষেত্রেই। 1911 সালে এই ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে বের হল কবিতা আকারে “ছোট্ট রামায়ণ”।
পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চলছিল অজস্র গল্প, প্রবন্ধ রচনার কাজ, পুরাণ, বিজ্ঞান, ইতিহাস, জীবনী। আবিষ্কারের কথা, দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প, মৌলিক গল্প, কবিতা—সহজ সরল কৌতুকদীপ্ত ভাষায় তাদের কাছে বৃহত্তর দুনিয়ার নানা দিকের খবর তুলে ধরছিলেন ঋষিপ্রতীম মানুষটি।
এরই মধ্যে 1913 সালের গ্রীষ্মকালে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদনায় ইউ রায় অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হল ছোটদের জন্য ঝকঝকে পত্রিকা 'সন্দেশ'। তিন পুরুষের সুনাম পেরিয়ে চতুর্থ পুরুষে এসেও যা নিজস্ব মহিমায় আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে বাংলা শিশু সাহিত্যের আসরে। প্রচ্ছদ, অলংকরণ, অজস্র লেখা, সম্পাদনা মুদ্রণ—পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকেই সন্দেশের সমস্ত এলাকাতেই তাঁর বিদগ্ধ সৃজনশীলতার সেই ছাপটা যে এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, আজও তা ম্লান হল না বাঙালি পাঠকের চোখে। ১৯১৫ সালে গিরিডিতে ডায়াবেটিস রোগভোগে মৃত্যুর আগে অবধি সন্দেশের মোট 33টা সংখ্যার সম্পাদনা করে যেতে পেরেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। তৈরি করে গিয়েছিলেন সন্দেশ-এর মূল ভিত্তিটি। চেয়েছিলেন, এ পত্রিকা তার নির্মল সুস্বাদ উপাদান দিয়ে শিশুদের সঙ্গে সঙ্গে বড়োদেরও সমান আনন্দ দিক। সন্দেশের প্রথম সংখ্যায় এ বিষয়ে তাঁর এই কথাকয়টি বিষয়টাকে পরিষ্কার করে দিয়েছিল— ''ইহা পড়িয়া যদি সকলের ভালো লাগে আর কিছু উপকার হয় তবেই ইহার 'সন্দেশ' নাম সার্থক হইবে।'' এই 'সকলের' শব্দটা এইখানে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এই সন্দেশেই 1914 সালে প্রকাশিত হয় উপেন্দ্রকিশোরের শেষ উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম গুপিগাইন বাঘা বাইন।
ইতিমধ্যে 'সন্দেশ'-এর প্রকাশনের বছরেই ইউ রায় অ্যান্ড সন্স উঠে আসে 100 নম্বর গড়পার রোডের তেতলা বাড়িতে। তার সমস্ত নকশাও উপেন্দ্রকিশোরের নিজের হাতে করা। বাড়ির ছাদে ছিল উপেন্দ্রকিশোরের তারা দেখবার ঘর। নিচের তলায় প্রেস, দোতলায় ব্লক বানাবার আর টাইপসেটিঙের বন্দোবস্ত। বাড়ির পেছনদিকের মহলে পরিবারের বসবাস। এই গড়পাড়ের বাড়িতেই ছবি আঁকায় হাতেখড়ি সত্যজিত রায়ের। একটুকরো কাগজে কিছু একটা হিজিবিজি এঁকে নিয়ে প্রসেস ক্যামেরার মূল চালক রামদীনের কাছে গিয়ে শিশু মানিক দাবী করত, ''এটা সন্দেশের জন্য।'' উপেন্দ্রকিশোরের নিজের হাতে তৈরি ক্যামেরাম্যানটি একগাল হেসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে দেখাত ক্যামেরার পর্দায় কেমন দেখায় তার ছবির উলটো প্রতিরূপটি। বালকটির মনে হয়ত সেই থেকেই বাসা বেঁধেছিল ক্যামেরার প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ! কে জানে! হয়ত সেই বীজটিই অংকুরিত হয়ে আমাদের উপহার দিয়েছে সত্যজিত রায়ের মতন প্রতিভাধর চলচ্চিত্রকারকে।
আসলে খ্যাতি ও কর্মব্যস্ততার মধ্যগগনে থেকেও উপযুক্ত উত্তরাধিকারী গড়ে তোলার ব্যাপারে পরিপূর্ণ মনোযোগী পিতা ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। মেয়েদের পড়বার জন্যে স্কুল বানিয়ে দিয়েছিলেন বাড়ির মধ্যে। বাবার কাছে জ্ঞানবিজ্ঞানের, পুরাণের গল্প শোনা, বাবার সাথে এগজিবিশান দেখতে গিয়ে মহাযত্নে সবকিছু বুঝে নেয়া, বেড়াতে যাওয়া, নিভৃত সন্ধ্যায় বাড়িতে বাবার বেহালার সুর শোনা, তাঁর কাছে ছবি আঁকতে শেখা, এই সমস্ত মধুর স্মৃতির ভান্ডারের সন্ধান মেলে তাঁর মেয়ে পুণ্যলতার আত্মজীবনীটিতে। ছেলে সুকুমারকে মুদ্রনশিল্পের প্রশিক্ষণ দিতে বিলেত পাঠিয়েছিলেন। নিজের সৃজনশীল জীবনের প্রতিটা ধাপে বেড়ে ওঠা সন্তানদের পরম স্নেহে জড়িয়ে নিয়ে বেড়ে ওঠবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন স্বাধীনভাবে। এর সুফল ভোগ করেছে দেশের পরবর্তী প্রজন্ম। সাফল্যের সঙ্গে বহুসংখ্যক প্রতিভার এক দীর্ঘস্থায়ী সঞ্চয় রেখে গেলেন তিনি, যাঁরা তাঁর দেখানো পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বাংলা সৃজনশিল্পকে। নিজে হাতে লালন করেছিলেন সুকুমারের প্রতিভাকে। তার সমস্ত সৃজনশীল ক্ষ্যাপামোকে সযত্নে বাড়তে দিয়ে, ন’বছর বয়স থেকে তাকে সাহিত্যের আঙিনায় টেনে এনে, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বিজ্ঞানসাধনায় ও প্রকাশনাশিল্পে নিজের উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তুলে, এবং সবশেষে মুদ্রণ ব্যবসা এবং সন্দেশের পরিচালনভার ধীরে ধীরে তার হাতে তুলে দিয়ে।
সুকুমার, সুখলতা, পুণ্যলতা, শান্তিলতা, সুবিমল, সুবিনয়, ভাইঝি লীলা এবং পরবর্তী প্রজন্মে এসে সত্যজিত রায়, নলিনী দাশ, এবং তারও পরে বর্তমান প্রজন্মের সন্দীপ রায়—ধারাটি ক্রমশ প্রবহমানই রয়ে চলেছে শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্রের নানান সৃজনশীল ধারায়। এঁদের অনেকেরই সাহিত্যজীবনেরও হাতেখড়ি তাঁদের ঘরের পত্রিকা উপেন্দ্রকিশোরের তৈরি সন্দেশের জমিতেই। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বাস্তবে এক মহীরূহ সমান, যে বৃক্ষের ডালপালা ক্রমশই বিকশিত হয়ে সিঞ্চিত করে চলেছে বাংলার সাংস্কৃতিক ভূমিকে ; প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
জন্মদিবসে এই মহান স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম।
~ শ্রেয়সী সেন
তথ্যসূত্র : ছেলেবেলার দিনগুলি, পুণ্যলতা চক্রবর্তী
লীলা মজুমদারের বিভিন্ন লেখা
উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে মে, ২০২১ দুপুর ২:৪০

শেরজা তপন বলেছেন: এ বিষয়ে আমার জানার ব্যাপক আগ্রহ ছিল।
লেখাটা শেয়ার করার জন্য আপনার প্রতি রইল আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। ++

২৫ শে মে, ২০২১ বিকাল ৩:১৯

শাহ আজিজ বলেছেন: আমারও ব্যাপক আগ্রহ ছিল । সবচে বড় ব্যাপার পরিবারটি পরিযায়ী ধরনের ছিল । বিহার থেকে নদিয়া হয়ে ময়মনসিংহ এবং সবশেষে কলকাতা ।

২| ২৫ শে মে, ২০২১ রাত ১১:০০

সোনালী ঈগল২৭৪ বলেছেন: গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য জানলাম। খুব ভালো লিখেছেন।

২৬ শে মে, ২০২১ সকাল ১০:০৪

শাহ আজিজ বলেছেন: লেখাটি সংগৃহীত । বিবিধ তথ্য পরিপূর্ণ থাকায় ছেপে দিলাম । আমি নিজেও রায়দের উৎপত্তি সন্মন্ধে জানতাম না ।


ধন্যবাদ ।

৩| ২৬ শে মে, ২০২১ রাত ১২:৩৯

কামাল১৮ বলেছেন: সত্যজিৎ পর্যন্ত সবাই প্রতিভাবান,পরের প্রজন্ম একটু কম।

২৬ শে মে, ২০২১ সকাল ১০:০৭

শাহ আজিজ বলেছেন: হুম আমি তাই ভাবি বেশ আগে থেকেই । সত্যজিত রায় পর্যন্ত এসে রায় বা দেও দের নাও ঠেকে গেছে ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.