![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি খুব ভাল একটা ছেলে। আমার সবচেয়ে ভাল দিক হল, কথাটা আমি বিশ্বাস করি ! :) ব্লগের বাইরে যোগাযোগে: [email protected]
এক.
তানিয়া ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল ইনস্পেক্টর ওয়াদুদ ড্রয়িংরুমে সোফায় আধশোয়া হয়ে আছেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, লাইট অন করা হয় নি; ঘর অন্ধকার।
"কী হল, পাপা? শরীর খারাপ?"
"না মা। তোর কী খবর? ক্লাস কেমন চলছে?"
তানি মিস্টি হাসল। ওয়াদুদের হঠাৎ মনে হল, তিনি কেমন বহিরাগতের মত প্রশ্ন করছেন ! ব্যস্ততার কারণে মেয়ের সাথে কতদিন গল্প করা হয় না আর। ওয়াদুদ আধশোয়া থেকে উঠে বসলেন, "আয় তোর সাথে আজ কিছুক্ষণ গল্প করি। অনেকদিন তোকে সময় দেয়া হয় না..."
"তুমি বসো, পাপা", তানি হেসে তাকালো, "আমি একটু ফ্রেশ হয়ে চা করে নিয়ে আসি। চা খাবে তো?"
তানি অন্ধকারেই দেখতে পেল ওয়াদুদ হাসিমুখে সায় জানালেন।
চায়ের কাপ হাতে তানিয়া রুমে ঢুকতেই ওয়াদুদ হঠাৎ আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন, "আচ্ছা তানি, তুই তো অনেক পড়াশোনা করিস। মডার্ন আর্ট সম্পর্কে তোর কী ধারণা বল তো?"
"হঠাৎ?", তানি অবাক হয়ে চোখ তুলল।
"না...", ওয়াদুদ একটু থেমে বললেন, "আজ তোকে পেইন্টিং নিয়ে একটা খুব ইন্টারেস্টিং গল্প শোনাতে পারি। তার আগে বল, মডার্ন আর্ট নিয়ে তোর ধারণা কী?"
তানি কৌতুহলে সামনে এগিয়ে আসল, "আমার কী ধারণা মানে? আমার আবার কী ধারণা হবে? কী জানতে চাও সেটাই বলো"
"না মানে, কিছু কিছু মডার্ণ আর্ট দেখে তোর মনে হয় না - অনর্থক রঙের ছড়াছড়ি? বাস্তব কিছু যদি না থাকে, সেই পেইন্টিং-এর কি কোনও মানে হয়?"
তানি হালকা হেসে উঠল, "পাপা শোনো, তোমার প্রশ্ন আমি বুঝতে পারছি। তোমাকে বোর করব না, আমি খুব সংক্ষেপে আমার থিওরি জানাচ্ছি। আমার ধারণা, চিত্রশিল্প বিষয়টা আসলে অনেকটা কবিতার মত। অনেক আগে কাব্যে লেখা হত শুধু রাজা-বাদশা'দের বীরত্বগাঁথা আর পৌরাণিক কাহিনী। চিত্রশিল্পও ছিল তা-ই। মহারাজা-জমিদারদের ছবি, অথবা ঐতিহাসিক-পৌরাণিক সব বিষয়বস্তু। যখন থেকে সব কাহিনী গদ্যে লেখা হতে শুরু করল, তখন থেকে কবিতা আস্তে আস্তে হয়ে গেল মুক্ত। গল্প-কাহিনী তো মনে করো সব 'গদ্যে'ই বলা যায়, তাই কবিতায় কাহিনী'র চেয়ে জোরালো হয়ে উঠল অনুভূতি। একইভাবে, ওদিকে ক্যামেরা'র উদ্ভাবণ হল, আর চিত্রশিল্পী'রাও হয়ে গেলেন অনেকটা মুক্ত। বাস্তব দৃশ্য তো ছবি তুলেই ধরে রাখা যাচ্ছে, শিল্পী'রা তাই রং চড়াতে লাগলেন নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে। শুধু বাস্তবের রং না, সাথে মিশল অনুভূতির রং। অনুভূতি প্রকাশ করতে কারও ছবিতে আকাশের রং হল লাল, মানুষের মুখ বেগুনী..."
"আচ্ছা, কবিতার সাথে তুলনা'টা হয়তো একটু বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু ছবিতে তো বোঝার মত কিছুই থাকে না। শুধু এলোমেলো রেখা আর রং..."
"পাপা, ঐ রেখা আর রঙেই শিল্পী হয়তো তার আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করতে চাইছেন..."
"এ কেমন অনুভূতি'র প্রকাশ, যেখানে কিছুই বোঝা যায় না?"
"আচ্ছা পাপা, শোনো", তানি শান্তভাবে হেসে বলল, "মনে করো, একজন বায়োলজিস্ট যখন সাইটোপ্লাজম-ক্রোমোজম নিয়ে কথা বলেন, তখন উনি কিন্তু এই তোমার আমার শরীরের কিছু অংশ নিয়েই কথা বলেন। ওসব আমরা বাইরে থেকে খালি চোখে দেখতে পাই না, আর বায়োলজিস্ট দেখেন ভেতর থেকে। ঠিক তেমনি, একজন শিল্পীও যখন রং ছড়িয়ে ক্যানভাস সাজান, তখন উনিও এই তোমার আমার অনুভূতিগুলোই আঁকতে থাকেন। ওসবও আমরা বাইরে থেকে দেখতে পাই না, কিন্তু শিল্পী দেখার চেষ্টা করেন ভেতর থেকে !"
"হুমম", ওয়াদুদ গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন।
"কী বুঝলে, পাপা?"
"আর্ট নিয়ে তেমন কিছু বুঝিনি। তবে এটা বুঝতে পারলাম, আর্ট সম্পর্কে কিছু বোঝার চেষ্টা না করেই এতদিন আর্ট নিয়ে আজেবাজে ধারণা নিয়ে ছিলাম"
"টেনশান করো না, পাপা। তোমার দলই ভারী", তানি হেসে চায়ে চুমুক দিল, "এবার বলো, আর্ট নিয়ে কী গল্প বলবে বলছিলে?"
"হ্যাঁ তানি। এবারের কেসটা খুবই মিস্টিরিয়াস। আসলে, ডিটেকটিভ বইয়ের বাইরে বাস্তবে এ ধরণের কিছু হতে পারে বলে আমার ধারণা ছিল না।"
"তাই নাকি?", তানি আগ্রহে সোজা হয়ে বসল, "কাহিনী কী, বলো তো?"
"তোকে বলছি, কারণ এই কেসে এখন পুলিশও রীতিমত হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। এখন আসলে পুলিশের আর কিছু করারও নেই। শুধু মাথা খাটানো ছাড়া। আর তোর অ্যানালাইসিস পাওয়ার ভালো। দেখি তোর সাথে কথা বলে যদি মাথায় কোনও আইডিয়া আসে..."
"পাপা ! ভুমিকা বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে ! গল্প শুরু করো !"
"আচ্ছা, শোন তাহলে", ওয়াদুদ সোফায় হেলান দিয়ে বলতে শুরু করলেন, আর তানি গল্প শুনতে শুনতে উত্তেজনায় সোফা থেকে উঠে ওয়াদুদের সামনে কার্পেটের উপর গিয়ে বসল।
"লোকটার নাম ছিল সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। পরিচিতদের কাছে সমর সেন। বেশ বড় ঘরের ছেলে - অর্থবিত্তের অভাব ছিল না। বাইশ-তেইশ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে ইওরোপে পাড়ি জমান, সেও প্রায় আজ থেকে ষাট বছর আগের কথা", ওয়াদুদ চায়ে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিলেন, "ইওরোপে এ-শহর ও-শহর ঘোরাঘুরি করে শেষ পর্যন্ত থিতু হলেন ফ্রান্সে, পারী'র কাছাকাছি কোথাও। লোকটার ব্যবসায়ী বুদ্ধি ছিল ভালই, অল্পদিনেই ভাল উন্নতি করতে শুরু করলেন। যতদিন ছিলেন, নিজের ধন-সম্পদ বাড়িয়েই গেছেন। বিয়ে-থা'ও করেন নি; সো, নো উত্তরাধিকার। আর ভদ্রলোক ছিলেন আর্টের ভাল সমঝদার। শেষ দিকটায় আর্ট কালেকটর হয়ে উঠেছিলেন। তার অগাধ সম্পত্তি খরচ করে মাঝে-মাঝেই নিলামে বেশ দামি-দামি পেইন্টিংস কিনে নিতেন..."
খালি চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে ওয়াদুদ বলতে থাকেন, "শেষ বয়সে সমর সেন দেশে ফিরে আসেন। শহর থেকে দূরে পাহাড়ী এলাকায় নিজের একটা বাংলো করেন। গিয়েছিলাম এই কেস-এর কারণে - আসলেই চমৎকার লোকেশান। লোকটার রুচি'র তারিফ করতে হয়। সমর সেন নিজেও অল্প-বিস্তর ছবি আঁকতেন, বাংলোতে তার নিজের একটা স্টুডিও আর পার্সোনাল আর্ট গ্যালারী ছিল। তো এই সমর সেন, প্রায় মাস ছয়েক আগে তার উইল তৈরি করেন। গল্প-উপন্যাসের বড়লোকদের মতই তিনি তার বাংলো'টা দিয়ে যান একটা অনাথ আশ্রমকে, অস্থাবর সব সম্পত্তি লিখে দেন তার তার একমাত্র ভাইপো নীল, মানে নীলেন্দ্র সেন'কে; আর তার কাছে ছিল ছয়টা অমূল্য পেইন্টিংস - যেগুলো তিনি দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ন্যাশনাল মিউজিয়ামে।"
ওয়াদুদ অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে একটু বিরতি নিলেন।
"তারপর?", তানি তাড়া দিল।
"এখন পর্যন্ত কাহিনী'র সবটা ভালই। সমস্যা শুরু হল, যখন থেকে সমর সেন বুঝতে পারলেন তার ভাইপো নীল ছবিগুলোও হাতিয়ে নিতে চায়। ছবিগুলোর ছিল আকাশছোঁয়া দাম। আমি শুধু একটা ছবি'র রশিদ দেখেছিলাম, তিনি নিলামে কিনেছিলেন প্রায় চার লাখ ইউরো দিয়ে !"
"মাই গড ! কার আঁকা ছবি ছিল?"
"শিল্পী'র নাম আমার মনে নেই, মা। ওসব নিয়ে আমার কোনওকালে আগ্রহও ছিল না। কিছু অবোধ্য ছবি'র এত দাম কেন হয় সেটাই তো আমার মাথায় ঢুকত না..."
"আচ্ছা, তুমি গল্প'টা বলো না?"
"হুম, তিনি ক'মাস আগে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু বুঝতেই পারছিস, এসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। গিফটের মত প্যাকেট করে নিয়ে গেলাম আর মিউজিয়ামে দিয়ে আসলাম - ব্যাপারটা এত সোজা না। তার আগে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকেও দেখতে হবে ছবিটা অরিজিনাল কি না, বৈধভাবে কেনা হয়েছে কিনা, আরও অনেক ফর্মালিটিস... কিন্তু সমরবাবু বুঝতে পারছিলেন, তার যা করার খুব দ্রুত করতে হবে; নীল তাকে এতটা সময় দেবে না। এবং হলোও তাই..."
"কী হলো?"
"এক রাতে হঠাৎ বাংলোতে ডাকাত পড়লো। চাকরদের জবানিতে বোঝা গেল, ডাকাতেরা মূলত ওই ছবি কেড়ে নিতেই এসেছিল, কারণ অন্য সবকিছু লুটপাট করার পরও ডাকাতের দল অনেক দীর্ঘ সময় ধরে তার আর্ট গ্যালারী তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কিন্তু ওখানেই ম্যাজিক ! ছয়টা ছবি'র একটাও ওখানে ছিল না ! ডাকাতেরা পুরো বাড়ি ছারখার করল, কোথাও নেই ছবিগুলো ! একদম ভ্যানিশ ! শেষে যাওয়ার সময় ডাকাতেরা সমরবাবু'র মাথায় গুরুতর আঘাত করে গেল।" ওয়াদুদ একটু থেমে বললেন, "সমর সেন সেই যে পড়লেন, তার আর জেগে ওঠা হয়নি। প্রায় সপ্তাহ-তিনেক কোমায় থাকার পর গত সোমবারে তিনি মারা যান। নীলের কাজ ছিল খুবই কাঁচা হাতের। ঐ ডাকাতদের মাঝে দুইজন পরের সপ্তাহেই ধরা পড়ে। আর তাদের স্বীকারোক্তিতে নীল'ও এখন জেল-এ"
"আর ছবিগুলো?"
"গায়েব। একদম বাতাসে মিলিয়ে গেছে। তার বাংলো'র সবকটা ঘর, সম্ভাব্য সব জায়গা দেখা হয়েছে। সমর সেনের বন্ধু-বান্ধব তেমন কেউ ছিল না দেশে। অন্তত এমন বিশ্বস্ত কেউ ছিল না, যার কাছে তিনি কোটি কোটি টাকা দামের ছবিগুলো রেখে যাবেন।"
"চাকরেরা সরায় নি তো?"
"চাকরেরা ছিল সবাই পাহাড়ি চাষা-ভুষা'র দল। এসব ছবি'র মর্ম বা মূল্য বোঝার সাধ্য ওদের নেই।"
"হুমম... তাহলে? একদম কোনও ক্লু নেই?"
"ওখানেই তো মজা !", ওয়াদুদ রহস্যের হাসি হাসলেন, "ঐ যে বললাম, সমরবাবু আগে থেকেই টের পেয়েছিলেন নীল ছবিগুলো বাগিয়ে নিতে চাইবে, তাই তিনি নিজেই ঐ ছয়টা ছবি লুকিয়ে গিয়েছিলেন। আর এর ক্লু রেখে গেছেন তার নিজের আঁকা একটা ছবির পেছনে..."
"কেমন ক্লু?", তানিয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল।
"বলছি শোন। আমরা ছবিগুলো'র ব্যাপারে জানতে পেরেছি তার উইল থেকে। তল্লাশী'র জন্যে যখন বাংলোয় গেলাম, দেশি পুরো আর্ট গ্যালারী খালি। অন্য কোনও রুমেও তো ছবিগুলো পেলাম না। শুধু তার স্টুডিওতে দেখলাম, বোর্ডের সাথে একটা ছবি লাগানো। বোঝা যাচ্ছিল সেটা ওখানে বসেই আঁকা। দোতলার ঐ স্টুডিও'র বিশাল জানালা দিয়ে বাইরের যে দৃশ্যটা দেখা যায়, ছবিটা ঐ দৃশ্যটারই ল্যান্ডস্কেপ। তা সবশেষে ঐ ছবিটা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল, ছবি'র উল্টোপিঠে ছোট একটা কবিতা'র মত কয়েকটা লাইন। লাইনগুলো ভালরকম জটিল, অর্থ এখনও উদ্ধার করা যায়নি। কিন্তু এটা মোটামুটি কনফার্ম যে, লাইনগুলো ঐ ছয়টা ছবি'র লোকেশন ইঙ্গিত করেই লেখা..."
"কিভাবে কনফার্ম হলে?"
"পুরোপুরি কনফার্ম বলিনি, মোটামুটি।", ওয়াদুদ পকেট থেকে একটা ছোট কাগজ বের করলেন, "আমি লাইনগুলো লিখে এনেছি। পড়ে দেখ, তোরও তা-ই মনে হবে।"
তানিয়া কাগজটা রীতিমত কেড়ে নিয়ে পড়তে শুরু করল~
ছয়টা তারা নিদ্রারত
আজ অদিতি'র বক্ষে নত
দীর্ঘতম সৌরদিনে
দেখবে কেমন চমকপ্রদ -
কৃষ্ণ-চূড়া'র দীর্ঘ ছায়া,
নিখুঁত এবং বিস্তারিত,
যখন সময় পাই - তখনই
ওদের এসে জড়িয়ে নিত
ওয়াদুদ বিড়বিড় করতে লাগলেন, "আজকালকার লোকগুলো মারা যাওয়ার আগে এমন সব ক্লু রেখে যাচ্ছে... এরা কি মনে করছে, বাংলাদেশে শার্লক হোমস এসে বসে আছে ওদের জন্যে?..."
তানিয়া বাবা'র কথা শুনতে পায়নি। তার চোখ চকচক করছে। সে মুখ তুলে সরাসরি প্রশ্ন করল, "পাপা, ছবিটা এখন কোথায়?"
"আমার অফিসে..."
"আমি কাল ছবি'টা দেখতে যাব !"
ওয়াদুদ ইতস্তত করতে লাগলেন। তানিয়া তার হাত ধরে অস্থির গলায় বলে উঠল, "কী হল পাপা, প্লিজ? দেখো, সমর সেন বেঁচে নেই। ডাকাতেরা সব হাজতে। নীলেন্দ্রও ধরা পরেছে। ছবিগুলা'র কথা হয়তো আর কেউ জানেও না এখানে। পত্রিকায় বলা হয়েছে?"
"না, পেপারে শুধু ডাকাতি'র খবর আর ডেথ নিউজ'টা গেছে। ছবিগুলো'র নিরাপত্তার জন্যেই ওসবের কথা মিডিয়ায় বলা হয়নি। আমরাই খুঁজে দেখছি !"
"গুড ! তাহলে দেখো, ফিল্ডে আর কেউ নেই ! এটা একটা সেফ ট্রেজার হান্ট ! প্লিজ পাপা, প্লিজ..."
ওয়াদুদ বেশ খানিকক্ষণ ভেবে বললেন, "আচ্ছা, তোকে কাল আমার অফিসে নিয়ে ছবি'টা দেখাবো। বাট স্পটে নিয়ে যেতে পারবো না। তানি, তোকে নিয়ে আমি কোনও রিস্ক নিতে রাজি না..."
"আচ্ছা বাবা আচ্ছা !", তানি খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে তারপর ছুটে রুমে চলে গেল। কাগজটা তখনও তার হাতে ধরা।
সে রাতে তানিয়ার ঘুম হল না।
দুই.
ইনস্পেক্টর ওয়াদুদের টেবিলের উপর সমর সেনের স্টুডিওতে পাওয়া শেষ পেইন্টিং'টা ছড়ানো। ৪০ ইঞ্চি বাই ৩২ ইঞ্চি ক্যানভাস। তানিয়া ঝুঁকে পড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মুখ তুলে বলল, "ছবির নিচে দুজনের সিগনেচার দেখছি ! সমর সেন, আর রাতুল শাহ। এই রাতুল শাহ'টা কে?"
"চারুকলা'র ছাত্র। সমর সেনের ফোনবুক থেকে নাম্বার নিয়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। সমরবাবু'র খুব পরিচিত কেউ না। ডাকাতির মাত্র এক সপ্তাহ আগে রাতুল'কে নিয়ে গিয়েছিলেন এই ছবিটা আঁকাতে। তবে রাতুল ছবিটা শেষ করে আসতে পারে নি, সমরবাবু তাকে অত সময় দেন নি। সে যতক্ষণ আঁকছিল, সমর বাবু নাকি প্রায় পুরো সময়টাতেই তাকে তাড়া দিচ্ছিলেন", ওয়াদুদ কাছে এসে ছবিটার দিকে আঙ্গুল তুলে বললেন, "এই ছবি দেখার পর রাতুল বলছে, সে চলে আসার পরও এই ছবি'র উপর আরও কিছু কাজ করা হয়েছে। সম্ভবত বাকি কাজটা সমর সেন নিজেই করেছেন।"
"বাড়তি কী আঁকা হয়েছে, রাতুল ধরতে পেরেছে?"
ওয়াদুদ খানিকটা তৃপ্তি আর প্রশংসা'র দৃষ্টিতে তাকালেন, এই মেয়ে'র প্রশ্নগুলো খুব শার্প হয়। তবে জবাবটা মোটামুটি হতাশার।
"সমর সেন নিজে থেকে বাড়তি কিছুই আঁকেন নি। রাতুলই মোটামুটি ছবিটা এঁকে দিয়ে এসেছিল। সমরবাবু শেষে শুধু কিছু আলো-ছায়া'র ইফেক্ট দিয়েছেন।"
"আলো-ছায়া'র ইফেক্টও কিন্তু বেশ পাকা হাতের কাজ বলে মনে হচ্ছে..."
"রাতুলও সেটা স্বীকার করেছে। সমরবাবু অন্তত আনাড়ি শিল্পী ছিলেন না।"
"এর মানে কী দাঁড়াচ্ছে?", তানিয়া বিড়বিড় করতে লাগল, "গ্যালারি আর স্টুডিও থেকে সব ছবি সরিয়ে ফেলেছিলেন, শুধু এটা ছিল। হয়তো শেষ দিন পর্যন্ত এটা নিয়ে কাজ করছিলেন, তাই না পাপা?"
"হতেই পারে।"
"ভদ্রলোকের বয়স ছিল আশি'র ওপর। বুঝতে পারছিলেন হাতে সময় ছিল কম। এই সময়ে তিনি একটা সপ্তাহ ধরে এই ছবি নিয়ে মেতে ছিলেন... অথচ ছবিতে বলার মত প্রায় কিছুই নেই ! সামনের গাছগাছালি, কয়েকটা টিলা, কী ক্লু রেখে গেলেন এটা?"
"ইয়াং লেডী", ওয়াদুদ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, " ক্লু'টা ক্যানভাসের এই পাশে না, অপর পাশে। ছবিতে না, ছড়ায়।"
"রাইট", তানি ছবিটা ওল্টালো। মোটামুটি পরিস্কার হাতের লেখা। সম্ভবত 2B পেন্সিল দিয়ে লেখা হয়েছে। সেই অদ্ভূত আট'টা লাইন:
ছয়টা তারা নিদ্রারত
আজ অদিতি'র বক্ষে নত
দীর্ঘতম সৌরদিনে
দেখবে কেমন চমকপ্রদ -
কৃষ্ণ-চূড়া'র দীর্ঘ ছায়া,
নিখুঁত এবং বিস্তারিত,
যখন সময় পাই - তখনই
ওদের এসে জড়িয়ে নিত
ছয়টা তারা বলতে নিশ্চয়ই ছয়টা ছবি, ছবিগুলো এখন ঘুমিয়ে আছে। অদিতি'র বুকে। অদিতি'টা কে? তানি মুখ তুলতেই ওয়াদুদ বুঝে নিয়ে জবাব দিলেন, "অদিতি নামে কারও হদিশ মেলেনি। ওটাই প্রথম সূত্র ধরে ট্রাই করা হয়েছিল"
তানি আবার চোখ নামালো, ঠিকই তো। নিশ্চয়ই অদিতি নামে কাওকে পাওয়া যাওয়ার কথা না। নিশ্চয়ই এত জটিল একটা ধাঁধাঁ'য় এত সহজে একটা নাম তুলে দিয়ে যান নি সমর সেন। এত রহস্য করে ক্লু'টা তিনি লিখেছেন যাতে নীল বা নীলের মত কেউ ধরতে না পারে। অদিতি নামে পরিচিত কারও নামই যদি তুলে দিতেন, তাহলে এটা পাওয়ার পর নীল তো প্রথমেই ঐ অদিতি'কে হামলা করে বসতো। অদিতি কারও নাম না। তাহলে প্রশ্ন'টা হবে, 'অদিতি কী?'
পরের লাইনটা প্রথম দুই লাইন থেকে খাপছাড়া, তবে এখন পর্যন্ত এই লাইনটাই হয়তো বোঝা যাচ্ছে - "দীর্ঘতম সৌরদিনে", সৌরবছরের দীর্ঘতম দিন। জুনের ২১ তারিখ। এই ছবি আঁকার কাছাকাছি সময়ের একটা দিন। ওই দিনটায় চমকপ্রদ কিছু হয়েছিল ! ওইদিন তিনি ছবিগুলো সরিয়েছিলেন? অদিতি'র বুকে রেখে এসেছিলেন? হতে পারে। তানি আবার মুখ তুলল,
"পাপা, জুনের ২১ তারিখ সমর সেন ঠিক কী কী করেছিলেন, সে বিষয়ে কিছু জানা গেছে?"
ওয়াদুদ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসেছিলেন। প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে বললেন, "দীর্ঘতম সৌরদিনে? না, চমকপ্রদ কিছু জানা যায় নি। বাংলোতেই ছিলেন, এরিয়া'র বাইরে কোথাও যান নি। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে শোনা। প্রতিদিনের মত সারা সকাল স্টুডিওতে ছবি আঁকা, দুপুরের পর একটু বাইরে হাঁটাহাঁটি, সন্ধ্যার পর থেকে আবার বাংলো'তে। ডেইলি রুটিন।"
আচ্ছা লোক তো ! এমন একঘেঁয়ে জীবনযাপন করতে করতে যাওয়ার আগে এমন মারাত্মক একটা ধাঁধাঁ রেখে গেল ! তানি পরের লাইনে গেল। প্রায় সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ওয়াদুদ বলে উঠলেন, "আর হ্যাঁ, বাংলো'র ত্রিসীমানায় কোনও কৃষ্ণচূড়া গাছের সন্ধান মেলে নি !"
উফফ ! এর মানে কী ! ধাঁধাঁয় যা যা লেখা হয়েছে তার কোনওটারই বাস্তব অস্তিত্ব নেই !
"পাপা?", তানি খানিক বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল, "তাহলে কি এমন হতে পারে এটা শুধুই একটা ধাঁধাঁ? যাস্ট ফর ফান?"
"হতেই পারে", ওয়াদুদ উঠে দাঁড়ালেন, "কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়, ওই ছয়টা মহামূল্যবান ছবি তাহলে গেল কোথায়?"
"হুমম, এটা একটা ধাঁধাঁ-ই। ভয়াবহ জটিল একটা ধাঁধাঁ।" তানি মাথা নাড়ল।
ওয়াদুদ এসে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন, "তানি চল, এখন বাসায় যাই। আজ অনেক হল।"
"পাপা, ছবিটার একটা কপি কি আমি নিতে পারব?"
"এত বড় ছবি এই মুহুর্তে কপি করা তো ঝামেলা'র ব্যাপার। তুই বরং আপাতত তোর ক্যামেরায় ছবি তুলে নিয়ে যা, পিসিতে দেখতে পারবি। মন্দের ভাল যা হয়।"
তানি তাই করল। এই ছবি না নিলে রাতে তার ঘুম হবে না।
এতটা থ্রিলিং একটা ট্রেজার হান্ট বাস্তবে হচ্ছে এটা তানি'র এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না ! আর একাজ সে করছে একা ! একা !! হোমসের ওয়াটসন ছিল, ফেলুদা'র ছিল তোপসে। তার সাথে কে আছে? তূর্য? ধুর, তূর্য'র বুদ্ধি-শুদ্ধির ব্যাপারে এখনও ভাল রকম সন্দেহ আছে। তবু কথা শোনার জন্যে হলেও একজনকে লাগে। পাপা তো সবসময় এরকম সময় দিতে পারে না ! কাল ছুটির দিন। সকাল সকাল তূর্য'কে নিয়ে বসতে হবে। উত্তেজনায় তানি সকালের অপেক্ষায় রাত পোহাতে লাগল !
*******************************************************************
সেই রাতে ২টা ৪৫ মিনিটে দরজার ধুপধাপ শব্দে ওয়াদুদ ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে উঠলেন ! দরজার ওপারে তানি চিৎকার করছে !
(অবশ্যই চলবে...)
শেষ অংশ এখানে
২০ শে মে, ২০১৩ রাত ১১:১২
শাহেদ খান বলেছেন: লিখতে টায়ার্ড লাগতেসিলো !
কালকে বাকিটা দেয়ার ইচ্ছা আছে ! আশা করা যায়...
২| ২০ শে মে, ২০১৩ রাত ১১:৩৩
সায়েদ রিয়াদ বলেছেন: অপেক্ষায় থাকলাম
২০ শে মে, ২০১৩ রাত ১১:৪০
শাহেদ খান বলেছেন:
৩| ২০ শে মে, ২০১৩ রাত ১১:৪৪
ভারসাম্য বলেছেন: এত বড় করেও..."অবশ্যই চলবে"!
মনে হয় ছবিতে বাংলোর সামনের যে ল্যান্ডস্কেপ সেখানে ভবনের ছায়ার সাথে অথবা/এবং ছবিতে কৃষ্ণচূড়ার অনূভুতি হিসেবে যে রঙ ব্যাবহৃত হয়েছে এবং বাড়তি হিসেবে যে আলো-ছায়ার কাজ সমর সেন করেছিলেন তার সাথে ছবি গুলো রাখার সম্পর্ক আছে। ছবিগুলো সম্ভবতঃ বাংলোর সামনের মাঠে পূঁতে রাখা আছে।
২১ জুন রাতের আকাশের এমন ছয়টি তারার সাথেও ছবিগুলোর অবস্থানের একটা সম্পর্ক থাকতে পারে যে তারাগুলো এখন ( গল্পে বর্ণিত সময়ে ) রাতের আকাশে ছিলনা।
আর্টও বুঝিনা। রাতের আকাশের তারাদের নকশাও জানা নাই। তবে তানিয়া হয়তো আগামী দিনের ফেলুদি হতেই যাচ্ছে। তানিকে আর পিচ্চি মেয়ে আর ওয়াদুদ সাহেবের লুকিয়ে লুকিয়ে রাখার জায়গায় রাখবেন না। ও'কে দিনে দিনে আরও বড় আর স্বাধীন করে দিন।
+++
২০ শে মে, ২০১৩ রাত ১১:৫৫
শাহেদ খান বলেছেন: গতকালের লেখা'টা ছিল হঠাৎ লিখে ফেলা, খুব শর্টকাটে। তবে লিখতে মজা পাচ্ছিলাম। তাই আজ রীতিমত বিস্তারিতই লিখতে বসা। তবে, ব্লগে বড় পোস্ট পড়া যে কী বিরক্তিকর, সেটা আমি নিজেও বুঝি। কী করি বলেন তো?
অনেক কিছু আন্দাজ করছেন ! আমার সাথে কিছু মিলে যাচ্ছে তো ! তবে অনেক কিছুই অন্যরকম বের হবে এই কাহিনীতে। যদি উপভোগ করেন, তাতেই আমি খুশি !
তানি'কে নিয়ে কোনও মহাপরিকল্পনা নেই আপাতত !
কষ্ট করে পড়ায় অনেক ভাল লাগা !
৪| ২১ শে মে, ২০১৩ সকাল ১০:২৪
কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:
চলবে মানে অবশ্যই চলবে
২১ শে মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:২১
শাহেদ খান বলেছেন: চলেছে !
শেষ অংশ একটু আগেই প্রকাশিত ! ধৈর্য ধরে এত বড় পোস্ট পড়ে কমেন্ট করে যাওয়ায় অনেক ভাল লাগা জানবেন !
৫| ০৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:০৩
রাতুল_শাহ বলেছেন: "ছবির নিচে দুজনের সিগনেচার দেখছি ! সমর সেন, আর রাতুল শাহ। এই রাতুল শাহ'টা কে?"
আমার নাম!!!!!!!!!!!! বিখ্যাত হয়ে গেলাম মনে হয়।
গল্পটার মাঝে দারুণ আকর্ষন আছে।
আট'টা লাইনও চমৎকার।
পরের পর্বে গেলাম।
০৮ ই জুন, ২০১৩ রাত ১০:০১
শাহেদ খান বলেছেন: হাহ হা, রাতুল। আমি লেখার সময় নামের ব্যাপারে খুব আলসেমি করি। আশে-পাশে যে নাম দেখা যায় বা যার নাম মনে আসে, সেটাই লিখতে থাকি। ভবিষ্যতে আরও লিখলে সেখানেও তোমার নাম আসাটা খুব স্বাভাবিক হতে পারে...
আমিও এবার পরের পর্বের কমেন্ট দেখতে যাই !
©somewhere in net ltd.
১|
২০ শে মে, ২০১৩ রাত ১১:০৫
ইমরাজ কবির মুন বলেছেন:
বেশ ভাল্লাগতেসিলো পড়তে। এ জায়গায় কি মনে করে থামসেন?? ধুর ||