![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সপ্নটা অনেক বড় , কিন্তু দিনকে দিন সপ্ন গুলো ফিকে হয়ে যাচ্ছে ।
চলছে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। মুসলিমদের কাছে মাসটির রয়েছে বহুল গুরুত্ব। দীর্ঘ এক মাসের রোজা শেষে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সামনে হাজির হয় পবিত্র ঈদুল ফিতর। নতুন পোশাক দেহে চাপিয়ে ধনী-গরিব ও ছোট-বড় সবাই মেতে ওঠে ঈদ উদযাপনের বর্ণিল আয়োজনে। তাই রমজানের ঈদকে সামনে রেখে চলে পোশাক কেনার প্রতিযোগিতা। শহর-বন্দর ও গ্রাম-গঞ্জের বিপণিবিতানগুলো পরিণত হয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতার মিলনমেলায়। নিজের পছন্দের পোশাকটি ক্রয় করতে একাধিক শপিংমল চষে বেড়াচ্ছে আবালবৃদ্ধবনিতা। অনেক সময় অল্পতেই মিলে যায় প্রিয় বস্তুটি আবার অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘ খোঁজাখুঁজির পর ক্লান্ত শরীরে ঘরে ফেরা পরের দিনের অপেক্ষায়। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত এভাবেই চলে পোশাক-পরিচ্ছদের দরকষাকষির মহা আয়োজন। কেউবা চলেন রঙিন লাইটের চাকচিক্যময় বড় শপিংমলে কেউবা হাঁটেন ফুটপাতের এক বাতিওয়ালা বিবর্ণ দোকানগুলোতে। যে যার মতো করে প্রিয়জনের চাহিদা পূরণে সেরে নেন ঈদ কেনাকাটা। পোশাক-পরিচ্ছদে ধনী-গরিব পার্থক্য থাকলেও ঈদ আনন্দ উদযাপনে থাকে না কোনো ব্যবধান। এভাবে সবকিছুকে মানিয়ে নিয়েই চলছে মানুষের জীবনযাত্রা।
ঊনবিংশ শতাব্দী পেরিয়ে বিশ্ব সভ্যতা অবস্থান করছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে। বিলাসিতার দুনিয়ায় সব ক্ষেত্রে এসেছে আমূল পরিবর্তন- যার প্রভাব পড়েছে মানুষের চলাফেরা, নাওয়া-খাওয়া, আরাম-আয়েশ, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাষা ও সামাজিক রীতি-নীতিতে। এককালের সাদামাটা মানুষটি বর্তমান সময়ের বহুমাত্রিক পরিবর্তন দেখে বয়সের শেষ লগ্নে দাঁড়িয়ে হয়তো তার নিস্তেজ মনকে 'যায় দিন ভালো, আসে দিন কঠিন' বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের জমানায় যা ছিল বিংশ শতাব্দীতে এসে ঘটছে তার উল্টো। হাডুডু-ডাঙ্গুলি-লুকোচুরি-লাঠিমের পরিবর্তে এখনকার ছেলেমেয়েরা খেলছে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট ও ভলিবল। কলের গান, রেডিও, সার্কাসের সাদাকালো যুগকে পেছনে ফেলে সবার সামনে এখন কম্পিউটার, আইফোন ও রঙিন পর্দার এলসিডি টেলিভিশন। ফেসবুক, টুইটার ও মুঠোফোন চিরবিদায় দিয়েছে হাতে লেখা চিঠিকে। তালের পাখা, শীতল পাটির বিলুপ্তি ঘটিয়ে এসেছে বৈদ্যুতিক ফ্যান ও এয়ারকন্ডিশনিং যন্ত্র। শিশুখাদ্যে মাতৃদুগ্ধ, নরম ভাত ও খিচুড়ি হটিয়ে স্থান দখল করেছে বার্গার, আইসক্রিমসহ রঙিন প্যাকেটে মোড়ানো বাহারি খাদ্যপণ্য। ক্লান্তি ভাব দূর করতে চায়ের কাপে এসেছে কফি, গরমে তৃষ্ণা মেটাতে পানির পরিবর্তে মানুষ পান করছে বিভিন্ন কোম্পানির বোতলজাত ঠা-া পানীয়। এত পরিবর্তনের মাঝে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে নারী-পুরুষের পোশাক-আশাকে, যা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে করছে কলুষিত।
ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে প্রদর্শিত সিরিয়াল এবং বলিউড নায়িকাদের বিশেষ চরিত্রে গায়ে জড়ানো পোশাকের প্রতি বেশি মনোযোগী হতে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের নারীদের। গত বছরের ঈদ কেনাকাটায় এমন একটি পোশাক ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়ে জয় করে নেয় তরুণী মন। স্টার জলসায় প্রচারিত সিরিয়াল 'বোঝে না সে বোঝে না'তে 'পাখি' চরিত্রে অভিনেত্রীর পরিহিত পোশাকটি তরুণীদের পছন্দের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করে। গত ঈদে 'পাখি' নামের ওই পোশাকটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর এর জের ধরে কিশোরী তরুণীদের 'পাখি' ড্রেসটি কিনে না দেয়ায় রোজার মাসে একাধিক আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। 'পাখি' পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এক স্ত্রী তার স্বামীকেও তালাক দেয়। এবারও কিরণমালা ড্রেসের জন্য ২৮ জুন আত্মহত্যা করে এক তরুণী। অনভিপ্রেত এসব ঘটনায় ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের নারীদের মধ্যে খারাপ প্রভাব পড়ছে বলে সচেতন মহল মনে করছে। আবার অনেকে মনে করছেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আমাদের দেশীয় চ্যানেলের পাশাপাশি ওইসব চ্যানেলকেও প্রাধান্য দিতে হবে এবং নারীদের মধ্যে চালাতে হবে সচেতনতামূলক প্রচারণা।
সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকে পৃথিবীটা ঘুরছে তো ঘুরছেই। রাতের পর দিন, দিনের পর রাত- এই চিরন্তন বাস্তবতায় ঘটেনি কোনো পরিবর্তন। সৃষ্টিকর্তার বেঁধে দেয়া নিয়মগুলোতে পরিবর্তন না ঘটলেও পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, রুচি ও ব্যক্তিজীবনে। এ পরিবর্তনশীলতা আমাদের দেশ ও সমাজকে পতিত করছে অসুস্থ পথে। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যকে ছুড়ে ফেলে আমরা ধাবিত হচ্ছি ভিন্ন সংস্কৃতির পথে। পশ্চিমা রীতি এসে ভর করছে বাঙালি চরিত্রে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে ঘরে বসে জানতে পারছি পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা খবর। বলিউড-হলিউডের কোনো নায়িকা বিকিনি পরে নামিদামি ম্যাগাজিনের উপরিভাগে স্থান করে নিয়েছে, কোনো ফিল্মে কোনো নায়িকা অল্প পোশাকে অভিনয় করে চমক সৃষ্টি করেছে, আবার সানি লিওনের পর নতুন কোনো পর্নো তারকা বলিউডে যুক্ত হয়েছে কিনা। এসব নোংরা খবরের ভিড়ে ভালো রুচিসম্মত অনুষ্ঠানগুলো হারিয়ে ফেলছে তার খেই। এছাড়াও স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে দিনব্যাপী প্রদর্শিত হচ্ছে বাংলা ও হিন্দি সিরিয়ালের প্রতিযোগিতা। এসব সিরিয়ালে নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে চলছে অসম প্রেম, ঘর ও সংসার ভাঙার নীরব যুদ্ধ, বউ-শাশুড়ির বাদানুবাদ, পোশাকের বৈচিত্র্য ইত্যাদি ইত্যাদি। সারা দিন কর্মব্যস্ততার ফলে সন্ধ্যার পর রিমোট হাতে শিশু ও কিশোর-কিশোরী বয়সের সন্তানদের নিয়ে গৃহবধূ বসেন টিভিসেটের সামনে। এককথায় মা-মেয়ে, মা-ছেলে এবং ভাইবোন মিলে যৌথভাবে উপভোগ করে নায়িকাদের অর্ধনগ্ন দেহ প্রদর্শনী খেলা। যা দেখে মেয়ে আকৃষ্ট হচ্ছে অশালীন পোশাকে, ছেলে ঝুঁকছে পর্নোগ্রাফিতে এবং মা বেরিয়ে পড়ছে স্বল্প কাপড়ের বস্নাউজ পরিহিত নামমাত্র কাপড় দেহে জড়িয়ে। তবে সব নারীই যে এমন, তেমনটি নয়। অনেক নারী আছেন যারা পোশাকের চেয়ে নিজের শালীনতাবোধকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাদের প্রতি সম্মানবোধ রেখেই বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্র নিয়ে লিখতে বসা।
পৃথিবী যেমন এগিয়ে চলছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছে আমাদের রুচিশীলতা। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায় রুচির ধরন ও মান। আজ এটি তো কাল সেটি। লাল সালোয়ারের সঙ্গে চকচকে কামিজ, থাকতে হবে রঙ মিলিয়ে জুতাজোড়া এবং জুয়েলারিসামগ্রী। সব মিলিয়ে যেন বলিউড অভিনেত্রী কারিনা কাপুরের কার্বন কপি। ঈদ কেনাকাটা পূর্ণতা পায় এমন ফ্যাশনে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বাজারও দখল করে নিয়েছে ভারতীয় নায়িকাদের পরিহিত নানা ঢঙের পোশাক। কিশোরী-তরুণী ও নারীরাও ঝুঁকছে সেদিকে। তাদের প্রথম পছন্দ বলিউডমার্কা এসব বেনামি পণ্য। সংবাদে প্রকাশ, জনপ্রিয় হিন্দি গান 'সারারা, সারারা, মে হু এক সারারা'তে যে ডিজাইনের পোশাক পরে দর্শক মাতিয়েছেন অভিনেত্রী শমিতা শেঠী, সেই পোশাকের বেশ চাহিদা এবার ঈদবাজারে। 'সারারা' নামের এ পোশাকটির দাম সাড়ে ৬ হাজার থেকে সোয়া ১ লাখ টাকা। আর ছোটদের 'সারারা' পাওয়া যাচ্ছে ৫ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকায়। সারারা ছাড়াও কিরণমালার প্রতি রয়েছে তরুণীদের ব্যাপক আকর্ষণ। কিরণমালা ও সারারার পাশাপাশি এবারের ঈদে জলপরী, রাই কিশোরী, ভিনয় কোশিশ, আনারকলি, আশিকি, মাসাককলি, সানি, কোয়েল, চিকনি চামেলি, বিপাশা, অর্চনা, অমিত, ডিসকো চালি, জীবিকা, রিভা, বীরা, ছানছান, ঝিলমিল, পাঙ্খুরি, আশিকি টু, বুগিউগি, টুপুরসহ নানা বাহারি নামের ভারতীয় পোশাক একচেটিয়া দখল করে নিয়েছে রাজধানীসহ সারা দেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরের বিপণিবিতানগুলো। শাড়িতেও রয়েছে ভারতীয় নায়িকা ও সিনেমার প্রভাব। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি সিনেমা 'বজরঙ্গি ভাইজান' সিনেমায় চিত্রনায়িকা কারিনা কাপুর যে ধরনের সালোয়ার-কামিজ পরেছেন সেটি 'কারিনা ড্রেস' নামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ভারতীয় সিনেমা কিংবা সিরিয়ালের নায়িকার নামে এসব পোশাক কিনতে বাংলাদেশী তরুণীরা আকৃষ্ট হলেও ভারতের কোথাও এমন নামের পোশাক খোঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশীয় তৈরি পোশাক যেখানে ইউরোপ-আমেরিকার বাজার মাতাচ্ছে সেখানে মুনাফালোভী কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছরই ভারতীয় পোশাক নিয়ে এমন 'বেনামি' ব্যবসা করে থাকেন। যাতে করে আমাদের কিশোরী-তরুণীরা সহজেই তাদের বিভ্রান্তির জালে পা দিচ্ছে। অসাধু এ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করছে সচেতন মহল।
শুধুই কি পোশাক-পরিচ্ছদ। কোমলমতি শিক্ষার্থীও বাদ পড়েনি ভারতীয় সিরিয়াল 'পাখি' ও 'কিরণমালা'র কবল থেকে। মে'তে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ, শিক্ষার্থীদের হাতে দেখা যায় ভারতীয় সিরিয়ালের নায়িকাদের ছবিসংবলিত মলাটের খাতা। একটি হচ্ছে 'কিরণমালা খাতা'। এর মলাটে স্টার জলসার কিরণমালা সিরিয়ালটির প্রধান চরিত্রের অভিনেত্রীর বড় ছবি রয়েছে। পাশেই লেখা রয়েছে, 'রূপকথার রাজকন্যা কিরণমালা কি পারবে অচিনপুরের সুখ ফিরিয়ে আনতে?' মলাটের নিচের অংশে রাখা হয়েছে শিক্ষার্থীদের ও বিদ্যালয়ের নাম, শ্রেণি, শাখা, বিষয় এবং রোল লেখার জায়গা। একইভাবে 'পাখি' খাতাতেও শোভা পাচ্ছে চরিত্রটিতে অভিনয় করা অভিনেত্রী ও এক অভিনেতার ছবি। পাশে লেখা রয়েছে সিরিয়ালটির নাম বোঝে না সে বোঝে না। নারীদের পর অধঃপতনের শিকার এবার শিক্ষার্থীরা। এ যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে কোথায় যাচ্ছি আমরা, কোথায় যাচ্ছে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি? এমন প্রশ্নের সঠিক উত্তর কি আছে কারও কাছে। হয়তোবা নেই। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা। ভালোকে গ্রহণ, মন্দকে পরিহার করার শিক্ষা নিতে হবে। তা না হলে এমন কুসংস্কৃতি আমাদের শালীনতা-বিবর্জিত পথে ধাবিত করবে।
©somewhere in net ltd.