![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভূমিকা:
মুক্তিযুদ্ধের ১৩ নম্বর সেক্টর? মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের কথা আমরা সবাই জানি। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেছিল। কিন্তু তা ছিল যুদ্ধের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা বর্ণনায় সবসময় এই ১১ টি সেক্টরের কথাই বলা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ খালি যুদ্ধ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধ একসময় পূর্ব পাকিস্তানের রণাঙ্গন পেরিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাক বাহিনীর বর্বর গণহত্যা, নারী নির্যাতন, শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবন একসময় অভিঘাত হেনেছিল বিশ্বব্যাপী তৃণমূল মানুষের হৃদয়ে। তাই বাংলাদেশের জন্য একাত্তর সালে হাঙ্গেরীর সেন্ট্রাল জেলের কয়েদিরা অনশন পালন করেছিল, জার্মানীর প্রত্যন্ত এক গ্রামে গ্রামবাসীরা জড়ো হয়েছিল বাংলাদেশের সমর্থনে, প্যারিসে এক যুবক ছিনতাই করেছিল পি আইয়ের বিমান। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা পালনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২,০০০ স্কুলের শিক্ষার্থীরা পালন করেছিল অনশন।(দৈনিক কালান্তর ১৯৭১: ২ নভেম্বর) তাদের টিফিনের টাকা তুলে দিয়েছিল শরণার্থীদের জন্য। এই এক অন্য রকম সহমর্মিতা। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে, সহায়তায় বিশ্বব্যাপী তৃণমূল মানুষের এই অভূতপূর্ব সাড়াকে বলা হচ্ছে ১৩ নম্বর সেক্টর। সারা পৃথিবীব্যাপী তৃণমূল জনতার এক অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিল আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। বিশ্বব্যাপী সাধারণ জনগনের এই আকুন্ঠ সমর্থন আমাদের বিজয়কে করেছিল ত্বরান্বিত। পাকবাহিনীর বর্বর গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড়। এই সহমর্মিতা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছে সাহস, শরণার্থীদের দিয়েছে আশ্রয় ও ভালবাসা।
১৩ নম্বর সেক্টর :
রণাঙ্গনের বাইরে মুক্তিযুদ্ধ সবচাইতে বেশি প্রভাবিত হয়েছে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দ্বারা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র রণাঙ্গনের ১১ টি সেক্টরের পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক সেক্টর হিসেবে রণাঙ্গনে ও রণাঙ্গনের বাইরে মুক্তিসংগ্রামকে প্রভাবিত করেছে। তাই নিদ্বির্ধায় আমরা এটাকে মুক্তিসংগ্রামের ১২ নম্বর সেক্টর বলতে পারি। ১৯৭১ সালে এমন কোন লোক ছিল না, যে প্রতিদিন সন্ধ্যায়, সে হোক অবরুদ্ধ বাংলাদেশ বা মুক্তাঞ্চল বা রণাঙ্গন, স্বাধীন বাংলা বেতার ঘোষনার জন্য অপেক্ষা করতেন না।(মুনতাসীর মামুন ২০১৩: ০৭) কোটি কোটি বাঙালির মনোবল চাঙ্গা রেখেছিল এই বেতার কেন্দ্র। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পর মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী তৃণমূল মানুষের সহমর্মিতা দ্বারা। আমি তৃণমূল বলতে স্পষ্টত তাদেরকে নির্দেশ করছি যারা ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত নয়। সারা পৃথিবীব্যাপী ১৯৭১ সালে বাঙ্গালির মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে তৃণমূল তথা সাধারণ মানুষের যে অকৃত্রিম সহমর্মিতা সেটাকে মুক্তিসংগ্রামের ১৩ নম্বর সেক্টর বলে অভিহিত করা হচ্ছে। মূলত পৃথিবীব্যাপী সিভিল সমাজের এই আকুন্ঠ সহমর্মিতা, হৃদ্যতাকে ‘১৩ নম্বর সেক্টর’ বলে সর্বপ্রথম অভিহিত করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।(মুনতাসীর মামুন ২০১৩: ১৮)
সারা বিশ্বের সিভিল সমাজ যে আকুণ্ঠভাবে বাংলাদেশের যুদ্ধকে সমর্থন যুগিয়েছে তা অভূতপূর্ব। যুক্তরাজ্যে বা যুক্তরাষ্ট্রের কথা স্মরণ করুন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে কিন্তু সারা আমেরিকার সাধারণ মানুষ ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। ইন্দোনেশীয় সরকার ছিল পাকিস্তানের পক্ষে কিন্তু দেখা যাচ্ছে ছাত্র বা বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের পক্ষে। আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ মুসলিম প্রধান দেশগুলি পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। তারা ভাবেনি, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। যেহেতু তারা সুপার পাওয়ার সেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতাটিকে তারা এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। কারণ, গণহত্যার দায় দায়িত্বতো তাদের ওপরও বর্তায়। সে কারণে, বিশ্বের সিভিল সমাজের যে অবদান তা কখনও তেমন ভাবে উঠে আসেনি। আমাদের দেশেও তা উপেক্ষিত। সারা বিশ্বের সিভিল সামজ যেভাবে সমব্যথী ছিল তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। (মুনতাসীর মামুন ২০১৩: ০৮) আমেরিকা বা ইংল্যান্ড বা অন্যান্য রাষ্ট্র ও সিভিল সমাজের পাকিস্তান বিরোধিতার জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন করলেও যুদ্ধে নিজেদের জড়ায় নি। আর সারা ভারত যেভাবে উদ্বেলিত হয়েছিল তার তুলনা মেলা ভার। ‘ভারত নিজের স্বার্থে শুধু পাকিস্তান ভাংতে চেয়েছে’ এ তত্ত্বে যারা বিশ্বাস করেন তারা ভুল করেন। ভারতের সিভিল সমাজের চাপ এতটা প্রবল ছিল যে, তৎকালীন ভারত সরকারের বাংলাদেশকে সমর্থন করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। বিদেশের এই সিভিল সমাজকে আমি উল্লেখ করছি ১৩নং সেক্টর হিসেবে।
কোথায় ইকুয়েডর সেখানেও একজন পত্রিকায় বাংলাদেশের পক্ষে লিখছেন। বুয়েনেস আয়ার্সে বোহের্স, ওকাম্পো বাংলাদেশের সমর্থনে রাস্তায়, জার্মানীর গ্রামে গ্রামবাসীরা জমায়েত হয়েছেন বাঙালিদের জন্য, আনা টেইলর হোয়াইট হাউসের সামনে অনশন করছেন। ভিরমিয়েরের ছবি চুরি করছেন একজন, প্যারিসে এক যুবক ছিনতাই করছেন পিআইএয়ের বিমান, লন্ডনে একজন বাংলাদশকে সহায়তা করার জন্য বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, ভাবা যায়?
১৩ নম্বর সেক্টরের ভূমিকা:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচারের দাবীতে ১১ আগস্ট ১৯৭১ ভারতের আগরতলা কেন্দ্রীয় কারাগারে দেড়শ বন্দী দুপুরের খাবার বর্জন করেন এবং দুপুরের খাবারের জন্য বরাদ্ধকৃত ৩৫০ টাকা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশের ত্রাণ তহবিলে দান করেন।(ফজলুল বারী ১৯৯৭: ৪৮) সমাজতান্ত্রিক হাঙ্গেরীর সেণ্ট্রাল জেলের বন্দীরা ৪ নভেম্বর অনশন পালন করেন বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদে।(হিন্দুস্থান স্ট্যা-ার্ড ১৯৭১: ১১ নভেম্বর) বাংলাদেশে পাকবাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা বিশেষ করে শিশুদের হত্যার প্রতিবাদে সেন্ট্রাল জেলে এই দিন প্রায় ১৫০০ বন্দী এই অনশনে যোগ দেয়। অনশন শেষে গণহত্যায় নিহত শিশুদের স্মরণে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। ৩১ আগস্ট ভারতের বিশাখাপত্তনম সেন্ট্রাল জেলের বন্দীরা বাংলাদেশের রিলিফ ফা-ে ৯০০ টাকা দান করেন। কারাগারের বন্দীদের মধ্য থেকে চাদাঁ তুলে এই টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে।(দৈনিক কালান্তর ১৯৭১: ৯ সেপ্টেম্বর)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগাগোড়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানো, জাতিসংঘে বার বার ভেটো প্রদান মার্কিন প্রশাসনের বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকাকে স্পষ্ট করেছে। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন যখন তীব্র বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ ঠিক সেই সময় অন্যমাত্রা লক্ষ্য করা গেছে মার্কিন জনগনের মধ্যে। আমাদের মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে ভারতের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন ছিল। সিনেটর জন এফ কেনেডি থেকে শুরু করে স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েরা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। তেমনি একটি খবর ২ নভেম্বর ভারতের দৈনিক কালান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
বাংলাদেশ শরণার্থীদের সমবেদনায়
বার হাজার মার্কিন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী একদিন লাঞ্চ খাবে না
ওয়াশিংটন, ১ নভেম্বর (এপি)-ভারতে আগত বাঙলাদেশের শরণার্থীরা যাতে ক্ষুধার্ত না থাকে সেইজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা আগামী বুধবার তাদের “লাঞ্চ’ (দুপুরের খাবার) খাবে না। ৭শ’রও বেশি কলেজ এবং ১২ হাজার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এই অনশনে অংশগ্রহণ করবে।
ছাত্ররাই তাদের স্কুল এবং কলেজের ক্লাশে বা চত্বরে ঐ অনশন পরিচালনা করবে। অক্সফাম-আমেরিকা ইনকরফোরেটড এই অনশনের উদ্যোক্তা। সংস্থার শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর শ্রীমতি সিন্থিয়া ডিগল আজ একথা জানিয়ে বলেছে, কোনো ছাত্র ইচ্ছা করলে তার লাঞ্চের পয়সা দান করতে পারে । এইভাবে যে অর্থ সংগৃহীত হবে তা শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য পাঠানো হবে। শ্রীমতি ডিগর আরো জানান যে, আরফানসাস ও রোড স্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের এই দুটি অঙ্গ রাজ্য ঐ দিনটিকে “অনশন দিবস” হিসেবে ঘোষণার কথা চিন্তা করছে।
অক্টোবরে বাংলাদেশ স্বাধিকার আন্দোলন দমনে মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের প্রতিবাদে প্রায় শতাধিক মার্কিন ছাত্র নিউইয়র্ক পার্লামেন্ট হাউসের সামনে মিছিল করেন।(নিউইয়র্ক টাইমস ১৯৭১: নভেম্বর) এই সময় শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। পন্ডিত রবি শংকর একটি যন্ত্র সংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যেখানে টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার ১ম দিন ১০ ঘণ্টায় ৩৬০০০ টিকিট বিক্রি করা হয়েছে।(সোহরাব হাসান ২০০৮: ২৩) পন্ডিত রবি শংকর ছাড়াও অনুষ্ঠানের বাটল গোষ্ঠীর অন্যতম জর্জ হ্যারিসন ও রিংগো স্টার অংশ নেন। যে কর্নসাট কর্নসাট ফর বাংলাদেশ নামে খ্যাত। যে কর্নসাটে জর্জ হ্যারিসনের গাওয়া ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি হয়ে পড়েছিল আমাদের মুক্তি সংগ্রামের এক অন্যন্য ইতিহাস।
মার্কিন সিনেটে ৫৭ জন সংসদ সদস্য ১৯ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত মোট ১৬৬ বার আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে বক্তব্য দিয়েছে। (তাজুল মোহাম্মদ ২০০১ঃ ৪৮)
আমেরিকার বাল্টিমোর বন্দরে নোঙ্গর করবে পাকিস্তানি জাহাজ পদ্মা। বাংলার নদীর নামের এই জাহাজটিতে বোঝাই হবে মার্কিন অস্ত্র। ফিলাডেলফিয়ার রিচার্ড টেইলর, তাঁর স্ত্রী আনা টেইলার, বিল মোইর ও তাদের কয়েকজন বন্ধু বাংলাদেশী মহিলা সুলতানা, তাঁর স্বামী ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লাউস ও ছেলে কায়াক বেচেঁ নিলেন এই জাহাজকে ঠৈকানোর পন্থা। [রিচার্ড কে টেইলর, (অনুবাদ মেসবাহউদ্দিন মুনতাসীর) ১৯৯৭:৪৮] তারা শিপিং এজেন্ট অফিসের সামনে মানববন্ধন করেন, শ্রমিকদের অনুরোধ করেন পদ্মায় মাল না তুলতে। মূলত এই ঘটনার পর ফিলাডেলফিয়া বন্দর বন্ধ হয়ে যায় পাকিস্তানী জাহাজের জন্য। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের সাহায্যের পরিমাণ প্রায় ৮৯১৫৭০০০ ডলার। (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস : ২)
বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়া সরকারের সাহায্য বৃদ্ধির দাবিতে দুই অষ্ট্রেলীয় নাগরিক ছয়দিন ধরে মেলবোর্ন কেন্দ্রীয় পোষ্ট অফিসের সিড়িতে অনশন পালন করেন। (দৈনিক কালান্তর ১৯৭১: ১৯ সেপ্টেম্বর)
বাঙলাদেশ শরণার্থীদের সাহায্য বৃদ্ধির দাবিতে অষ্ট্রেলিয়ায় অনশন
মেলবোর্ণ, ১৯ সেপ্টেম্বর (ইউ এন আই)- লাখো লাখো বাঙলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সরকারী সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধির দাবিতে দুই অষ্ট্রেলিয়ার নাগরিক গত ছয় দিন ধরে মেলবোর্ণ কেন্দ্রীয় পোস্ট অফিসের সিড়িতে অনশন করছেন। অনশনব্রতীরা এতদিন ধরে পথচারীদের কাছ থেকে ২ হাজার ডলার সংগ্রহ করেছেন। উল্লেখযোগ্য স¤প্রতি চারশো জন অষ্ট্রেলিয় বুদ্ধিজীবি এবং রাজনৈতিক নেতা বাঙলাদেশ সংকটে অষ্ট্রেলিয়া সরকারের মনোভাব পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য অস্ট্রেলিয়ান সরকার বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা দান করেন।
৮ জুন হাঙ্গেরীর শ্রমিক শ্রেণী বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরণার্থীদের সহায়তায় তাদের একদিনের বেতন দান করেন। (দৈনিক কালান্তর ১৯৭১: ৮ জুন) এই সংগৃহীত অর্থ দিয়ে তারা তাবু, কম্বল, ঔষধপত্র ভারতে পাঠান। ভারতের লক্ষেèীর শিল্পীদের একটি দল পথে পথে নাটক দেখিয়ে ১৮০২.৭৫ টাকা সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত এই টাকা কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনে দান করা হয়।(মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী উৎসব স্মরণিকা ২০০১: ১৬) সারা ভারত প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি প্রায় ১ কোটি টাকা সংগ্রহ করে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে দান করেন।(বিকচ চেীধুরী ২০০৩ : ১১)
৪ জুলাই কলকাতা কর্পোরেশন ক্লার্কস ইউনিয়ন সদস্যদের কাছ থেকে ১০০১ টাকা সংগ্রহ করে কলকাতা মেয়রের তহবিলে দান করেন।(দৈনিক সংবাদ ১৯৭১: ৮ জুলাই) জয়পুরের ১২ জন যুবক রাজস্থান বিধান সভার বাইরে জুতা পালিস করে বাংলাদেশের সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। ১ দিনই তারা ২৫০ টাকায় অধিক আয় করেন। (দৈনিক কালান্তর ১৯৭১: ১৫ এপ্রিল) ত্রিপুরার তুলসীবতী স্কুল, ফটিকরায় স্কুল, বোধজং স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা টিকিটের টাকা বাঁচিয়ে সংগৃহীত অর্থ শরণার্থীদের শিবিরে দান করেন। (সুকুমার বিশ্বাস ২০০৭: ১৮৫) এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ও টাকা সংগ্রহ করেন। এছাড়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান শরণার্থীদের সহায়তা ও মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তার দাবীতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে সভা, সমিতি, বিক্ষোভ মিছিল শোভাযাত্রায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের অষ্টপ্রহর ছিল কোলাহলমুখর। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় এ মিজোরামের প্রত্যেকটি নাগরিক কোন না কোন ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে। তাদের সম্পৃক্ততায় এসব অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ রূপ নিয়েছিল জনযুদ্ধে।
১৪ আগষ্ট থেকে ২০ আগষ্ট পর্যন্ত দক্ষিণ অফ্রিকায় বাংলাদেশ শরণার্থী ত্রাণ সপ্তাহ পালন করা হয়। এই সময় দেশব্যাপী মসজিদ, মন্দির ও চার্চে বাংলাদেশে গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে প্রার্থনা করা হয়। এই সময় অনেক আফ্রিকান নাগরিক তাদের এক সপ্তাহের আয় সাহায্য তহবিলে দান করেন। বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করেছে যুগোস্লাভিয়া ও ভেনিজুয়েলা শ্রমিক সংঘ। বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য দেওয়ার দাবীতে ইন্দোনেশিয়ার কবি পল পোয়েনোনোক ৩১ দিন ধরে অনশন পালন করেন।(মুনতাসীর মামুন ২০১৪: ২৮) অষ্ট্রোলিয়ান পার্লামেন্টের সামনে অনশন পালনরত অবস্থায় তাঁর শারিরীক অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে ক্যানবেরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অষ্ট্রিয়ার ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র বাংলাদেশের শরণার্থীদের সমর্থনে ২৩ নভেম্বর অনশন পালন করেন। (দৈনিক কালান্তর ১৯৭১: ২৪ নভেম্বর)
বাঙলাদেশ শরণার্থীদের সমর্থনে ভিয়েনায় ছাত্রদের অনশন
ভিয়েনা, ২৩ নভেম্বর (ইউএনআই)-বাঙলাদেশ শরণার্থীদের সমর্থনে এবং পূর্ববঙ্গে সন্ত্রাস রাজের প্রতিবাদে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র তীব্র শ্রীত ও প্রচ- তুষারপাত উপেক্ষা করেও গতকাল থেকে অনশন ধর্মঘট করেছে। ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘ওমেগা’র উদ্যোগ ইউরোপের বিভিন্ন রাজধানী শহরে অনুরূপ অনশন শুরু হচ্ছে।
খোদ পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ ২৮ মার্চ বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রখ্যাত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মির্জা মহম্মদ ইব্রাহিম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক এরিক কিপরিয়ান, শ্রী আবদুল্লাহ মালিখ, শ্রী ইমারাত রহমান, খ্যাতনামা সাংবাদিক শ্রী হামিদ আখতার, কবি হাবিব গালিব, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মামুদ মুনাওয়াব, আওয়ামী আদাবে আঞ্জুমানের শ্রী আমেদ সালিম, বেগম তাহিরা প্রমুখ ব্যক্তিরা।(দৈনিক কালান্তর ১৯৭১: ২৯ মার্চ)
২০ সেপ্টেম্বর ফরাসী লেখক আঁদ্রে মালরো ঘোষণা দেন, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে যোগদান করতে চান। ফিনল্যা-ের ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব ফিনিস স্টুডেন্টস বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ফিনল্যা-ের ছাত্র সমাজের সংহতি প্রকাশের কথা জানান।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের
জন্য মরিশাঁসের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী
নয়াদিল্লী ২৭শে অক্টোবর: টিফিন না খেয়ে এবং হাত খরচ থেকে পয়সা বাঁচিয়ে মরিশাঁসের পোর্টলুই শহরস্থ লরেটো কনভেন্ট স্কুলের প্রথামিক শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ ভারতে আশ্রিত পূর্ব বঙ্গের শরণার্থীদের জন্য একশত টাকা পাঠিয়েছেন তাদের গভীর সহানুভূতির নিদর্শন হিসাবে। এরা পোর্টলুই এর ভারতীয় হাই কমিশনে উক্ত অর্থ সমর্পণ করেন। (দৈনিক সংবাদ ১৯৭১: ৩১ অক্টোবর)
বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টস (আইইউএস)। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলামের নিকট প্রেরিত এক তার বার্তায় আই ইউ এস গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার নিরাপরাধ বাঙালিদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।
৪ অক্টোবর বেলজিয়ামের হেট ভোক দৈনিক এক ব্যক্তি ফোন করে জানায়, তার কাছে প্রখ্যাত ওলন্দাজ চিত্র শিল্পী ভেরমিয়ারের বিখ্যাত তৈলচিত্র ‘দি লাভ লেটার’টি আছে। এই মাষ্টারপিসটি ব্রুসেলসের ফাইন আর্টস প্যালেস থেকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর চুরি যায়। তখন এর বাজার মূল্য ছিল ৫০ লক্ষ ডলার। ঐ ব্যক্তিটি জানায় চিত্রকর্মটি তিনি চুরি করেন। পত্রিকাকে তিনি জানান, কর্তৃপক্ষকে ৪০ লক্ষ ডলার বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য দান করতে হবে। এ অর্থ দিতে হবে রোমান ক্যাথলিক দাতব্য সংস্থা কারিসাত-কে। এবং চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়টি টেলিভিশনে দেখাতে হবে। পত্রিকার মতে, ইন্সুরেন্স বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, একদিনের মধ্যে এ ধরনের চুক্তি করা ও টেলিভিশনে প্রচার করা অসম্ভব। অজ্ঞাতনামা ঐ ব্যক্তি নিজের নাম দিয়েছিলেন ‘টিল অব লিমবার্গ’। টিল ইট্টলেমসপিগেল ছিলেন রবিনহুডের মধ্যে কিংবদন্তীর মানুষ যিনি বড়লোকদের ধন কেড়ে গরিবদের মধ্যে বিলোতেন। ‘টিল অব লিমবার্গ’ আরো ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর দাবি না মানলে আরো ৩৯টি ভেরমিয়ার উনি চুরি করবেন। ভেরমিয়ারের তৈল চিত্রের সংখ্যা এর বেশি নয়। পত্রিকা থেকে প্রমাণ দাবি করলে তিনি পত্রিকার এক আলোক চিত্রীকে আমন্ত্রণ জনানা। এবং বেলজিয়ামের এক গহীন জঙ্গলে ভেরমিয়ারের চিত্র শিল্পটির ছবি তোলার সুযোগ দেন। ওলন্দাজ জাদুঘর ছিল চিত্রকর্মটির মালিক। খুব সম্ভব ব্রুসেলসে তা প্রদর্শনীর জন্য নেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই লোক পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। মারি রামান্স নামক এই ওলন্দাজ নাগরিকের তিন বছরের জেল হয়। বেলজিয়াম জুড়ে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরে প্রতিবাদের মুখে তাঁর কারাদ- কমিয়ে ৬ মাস করা হয়। অল্প কিছু দিন পর মাত্র ২৮ বছর বয়সে এই মানবতাবাদী লোকটি মারা যান। (দৈনিক প্রথম আলো ২০১১: ২ডিসেম্বর)
কতোদূর লাতিন আমেরিকা! কোথায় আজেন্টিনা, কোথায় চিলি বা ভেনিজুয়েলা। কিন্তু ১৯৭১ সেখানেও মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছিল। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো নামটি আমাদের বিশেষভাবে পরিচিত রবীন্দ্রনাথের কারণে। কিন্তু তিনি নিজ গুণেই আর্জেন্টিনার বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। বোহের্সের তো এখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি স্পেনিশ ভাষার অন্যতম লেখক হিসেবে। বাঙালির প্রতি ওকাম্পোর দূর্বলতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাম দিয়েছিলেন বিজয়া। অনুমান করছি আর্জেন্টিনার বুদ্ধিজীবীরা যে বাঙালিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তার উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভিক্টোরিয়া। ১৯৭১ সালের ১১ জুন আর্জেন্টিনার লেখক, অ্যাকাডেমিশিয়ান, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা মিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একটি স্বারকলিপি পেশ করেন। স্মারকলিপির মূল কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের যা চলছে তা অনভিপ্রেত বিশেষ করে ভারতে শরনার্থীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সুতরাং, এর প্রতিকার হওয়া উচিত। তাঁরা লিখেছিলেন মানবতার দুর্দর্শা স্থানীয় নয়, এটি সমগ্র মানবজাতির আশঙ্কা। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের যা হচ্ছে তাতে মানবতা জাগ্রত হচ্ছে বলে মনে হয় না। যারা স্বাক্ষর করেছিলেন তাঁদের নামের পুরো তালিকা পাওয়া যায়নি তবে ভেনিজুয়েলার এক রিপোর্ট থেকে কিছু নাম পাওয়া যায়। এখানে যে তিনজের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, জর্জ লুই বোহের্স এবং রেভারেন্ড ফাদার ইসমায়েল কুইসেল। তার পর পরই ২৪ জুন ভেনিজুয়েলার ‘কাউন্সিল ফল ওয়ার্ল্ড পিস এ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ এক কড়া বিবৃতি প্রদান করে। সংস্থার সেক্রেটারি জেনারেল ড. রিকার্ডো মোলিনা মার্টি কঠোর ভাষায় পাকিস্তানীদের নিন্দা করেন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর জন্য। তাঁর ভাষায় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল ও সমরবিদরা চারদিকে তাদের ফ্যাসিস্ট বাহিনী পাঠিয়ে গণহত্যা চালাচ্ছে। (বাংলাদেশ ডকুমেন্টস :২)
প্যারির অর্লি বিমানবন্দর। পাকিস্তানের বিমান বহরের (পি আই এ) একটি বিমান উড়াল দেবে পাকিস্তানের দিকে। পশ্চিম জার্মানীর চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট এসেছেন সরকারি সফরে ফ্রান্সে। ব্রান্ডট সমর্থন করেছিলেন বাঙালিদের। আর জাঁ কুয়ে আটকে (পত্রিকার ভাষায় ‘হাইজ্যাক’) দিলেন পিআইএর বিমান টিকে। জাঁ কুয়ের দাবি খুব সাধারণ। বাঙালির মারা যাচ্ছে। তাদের সহায়তা দরকার। ফ্রান্সকে ওষুধ ও ত্রাণ পাঠাতে হবে বাঙালিদেও জন্য এবং এই বিমানে করেই। পিআইএর বিমানে প্রেরণের ব্যাপারটা ছিল প্রতীক, পাকিস্তানীরা গণহত্যা চালাচ্ছে। তাদেরই বহন করতে হবে প্রাণ রক্ষাকরী ওষুধ ও ত্রাণ।
ব্রান্ডট আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পিডুর আলোচনায় শিকেই উঠল। আলোচনা শুরু করতে হবে জাঁ কুয়ের সঙ্গে। সরকার কী অত সহজে একজন হাইজ্যাকারের সঙ্গে বসতে চায়। তারা সৈন্য সামন্ত দিয়ে ঘিরে ফেলল বিমান বন্দর। কিন্তু, উপায় নেই। আলোচনায় বসতে হলো জাঁ কুয়ের সঙ্গে। পাঁচ ঘন্টা আলোচনার পর ফরাসি সরকার নতি স্বীকার করল। ২০ টন ত্রাণ সামগ্রী বিমানে ওঠানো হলো। রওয়ানা হলো বিমান, গ্রেফতার করা হলো জাঁ কুয়েকে। অদ্রেদ্য মন্তে নামে একটি সংস্থার নাধ্যমে এই ত্রাণ পাঠানো হয়। ততদিনে বাংলাদেশ স্বাধীনতার দ্বার প্রান্তে। জাঁ কুয়ের কী হলো শেষে তার আর জানা যায় নি। (দৈনিক প্রথম আলো ১৯৭১ : ডিসেম্বর)
২৭ অক্টোবর কাবুলে মিলেছে হাজার হাজার আফগান। উদ্দেশ্য বাঙালীদের প্রতি পাকিস্তানের স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন ও গণহত্যার নিন্দা জানানো। পিপলস্ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা বারবাক কারমাল ছিলেন এই সমাবেশের উদ্যোক্তা। ২৮ অক্টোবর মনিং ষ্টার এর সংবাদে বলা হচ্ছে প্রায় ১৫.০০০ লোক এতে সমবেত হয়েছিল। (মনিং ষ্টার ১৯৭১: ২৮ অক্টোবর) সোভিয়েত সমর্থনপুষ্ট কারমাল পরে ক্ষমতাচ্যুত হন ও তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের কথা বাদ দিই, এখনও বাংলাদেশের অনেক শিক্ষিত মানুষ পাপুয়া নিউগিনির নাম শুনেছেন কীনা সন্দেহ। কিন্তু, সেই ১৯৭১ সালে, পাপুয়া নিউগিনি থেকেও বাংলাদেশের কবিদের একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে, পাপুয়া নিউগিনির রাজধানী পোর্ট মর্সবি থেকে পৃথ্বিন্দ্র চক্রবর্তীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা সঙ্কলন ঞড় ঊধপয গু ইষড়ড়ফ ধহফ ঙঃযবৎ ঐুসহং. পৃথ্বিন্দ্র নিশ্চয় বসবাস করতেন পোর্ট মর্সবিতে, হযরত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কবিতা লিখতেন। সে সুদৃর পাপুয়ায় তিনি এ সঙ্কলনটি প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশের প্রতি জনমত আকর্ষণের জন্য। পাপুয়া পকেট বুক সিরিজের ২৬নং বই ছিল সঙ্কলনটি। (দৈনিক আনন্দবাজার ১৯৭১: ২২ ডিসেম্বর)
কীথ ওয়াটারহাউস লন্ডনের ডেইলি মিররে নিয়মিত কলাম লিখতেন। জুনেরন ৯ তারিখে পত্রিকার প্রথম পাতায় তার একটি কলাম বের হলো। বিষয়, বাংলাদেশের শরণার্থী। লিখলেন, তাঁর কলামটি বৃহস্পতিবার লেখার কথা কিন্তু তিনি বুধবারই লিখছেন। কারণ, সময় নেই। একদিন অনেককে বাঁচাতে পারে মৃত্যু থেকে। কীথ বৃহৎ শক্তিগুলিকে ব্যঙ্গ করে মন্তব্য করেছেন, ‘এদের কথা বলে লাভ নেই। আপনি যা করতে পারেন তাই বলছি। সময় নষ্ট করার সময় নেই।
বরং এটি করুন, দুপুরের আগেই করুন।
যোগাড় করুন একটি খাম
কলম হাতে নিন
খামের ওপর লিখুন
একটি জীবন বাঁচান (ঝঅঠঊ অ খওঋঊ)
বক্স ১৮৯, ডেইলি মিরর
১ লাবিস ইন, লন্ডন।
আপনার হয়ত অন্য কোন প্রিয় দাতব্য সংস্থা আছে। হয়ত ঠিকানা পাচ্ছেন না। ভাবছেন এই যে, দান যাচ্ছে তার কতোটা যাচ্ছে প্রশাসনিক ব্যয় মেটাতে, ভ্ক্তুভোগীরা কতটুকু পাচ্ছে।
এসব দ্বিধা দ্বন্দ্ব জাতিসংঘের ওপর ছেড়ে দিন। বরং খামের ওপর তিন পেনির একটি স্ট্যাম্প লাগান। এক পাউন্ডের একটি নোট নিন।
যদি না থাকে যোগড় করুন।
ধার করুন।
গ্যাস মিটারের জন্য রাখা টাকা থেকে নিন।
বাচ্চার পকেট মানি বাদ দিন।
ভাড়ার টাকা থেকে নিন।
সিগারেট না খেয়ে বাঁচান।
কিছু বিক্রি করুন।
বন্ধক রাখুন।
খামে এক পাউন্ডের নোটটি ঢোকান।
খাম বন্ধ করুন
পোষ্ট করুন
ব্যাস, তাতেই একটি প্রাণ পঁচবে। (ডেইলি মিরর ১৯৭১ঃ ৯ জুন)
১১ জুনের সংপদটি ছাপা হওয়ার দু দিনের মধ্যেই ৩৩,৪০০ পাউন্ড জমা হয়েছিল ডেইলি মিররে এবং খাম আসছিল অব্যাহত। (ডেইলি মিরর ১৯৭১ ঃ ১১ জুন)
ইতালী রাজধানী রোমে ইতালীর বিশপদের এক সম্মেলনে ১০ অক্টোবর বাংলাদেশে বর্বর গণহত্যার প্রতিবাদ ও শরনার্থী শিশুদের জন্য একদিনের অনশন পালন করা সিদ্ধান্ত নেয়। পোপ পল ও এতে অংশ নেয়। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় রোববার গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা ও শরনার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হবে।
(দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ১৯৭১ ঃ ১১ অক্টোবর)
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জার্কাতায় এপ্রিলের শুরুতে বাংলাদেশে পাক বাহিনীর বর্বর গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ৫০ জন ছাত্র জার্কাতার রাজপথে বিক্ষোভ করেন। (আবুল ফজল শামসুজ্জামান ২০০২ঃ ৪০)
১৩ নম্বর সেক্টরের প্রভাবঃ
বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের এই আকুণ্ঠ সমর্থন আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে করেছে ত্বরান্বিত। পাক বাহিনীর বর্বর গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়। এই সহমর্মিতা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছে সাহস, শরনার্থীদের দিয়েছে আশ্রয় ও ভালবাসা। তৃণমূল জনতার এই স্বত:স্ফুর্ত সহায়তা মুক্তিযুদ্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। যথাঃ
১। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে আন্তর্জাতিক জনমত বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও নিজ নিজ দেশের জনগণের জনমতের কারণে বাংলাদেশের বিপক্ষে সরাসরি অস্ত্র ধারণ করেনি। ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা থেকে শুরু করে আফ্রিকায় পর্যন্ত বাংলাদশের সমর্থনে লোকজন রাস্তায় নেমে এসেছে। সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততায় বিশ্বব্যাপী আমাদের মুক্তিসংগ্রামের স্বপক্ষে ও পাক বাহিনীর নির্মম গণহত্যার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক জনমতের সৃষ্টি হয়।
২। বিভিন্ন দেশের তৃণমূল জনগণ যখন পাক বাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদে রাস্তার নামে তখন সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো জনদাবী মেটানোর জন্য কুটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। বাঙালীর নায্য দাবীর প্রতি কুটনৈতিক সমর্থন বৃদ্ধি পায়।
৩। বিশ্বের নানা প্রান্তে জনগনের এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সহায়তা ভারতে আশ্রয়লাভকারী প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। শরণার্থীদের মানবেতর জীবনে সামান্যটুকু হলেও পরিবর্তন আসে। ঔষুধ প্রয়োজনীয় দ্রব্য, নগদ অর্থ, শিশু খাদ্য, শুকনো থাকার, শীতবস্ত্র দিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন নেমেছে কোন না কোন দেশের উড়োজাহাজ।
৪। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছিল এই ১৩ নম্বর সেক্টর।
৫। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ জনতার সাহস ও মনোবল ধরে রাখতে, সমস্ত প্রতিকুলতাকে মোকাবেলার শক্তি দিয়েছিল ১৩ নম্বর সেক্টর।
উপসংহার :
মুক্তিযুদ্ধ একসময় রণাঙ্গন পেরিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের আবেগ অনুভূতিতে অভিঘাত হেনেছিল। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর মানবেতর জীবন, পাক বাহিনীর নারী নির্যাতন, গণহত্যার সংবাদ বিশ্ব গণমাধ্যমে স্থান করে নেয়। বিশ্বের মানবতাবাদী লোকজন জড়ো হয় বাংলাদেশের সমর্থনে। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের সমর্থনে দেখা দেয় এক অভূতপূর্ব সহমর্মিতার। মুক্তিযুদ্ধ পরিণত হয় জনযুদ্ধে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান, মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তার জন্য বৃদ্ধি পেতে থাকে আন্তর্জাতিক জনমতের। অব্যাহত আন্তর্জাতিক জনমত কুটনৈতিক তৎপরতাকে প্রভাবিত করে। অনেকগুলো বৃহৎশক্তি রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও জনমতের চাপে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে। জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর তৎপরতাও বৃদ্ধি পায়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ভারতে অবতরণ করতে থাকে শত শত বিমান। প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দু:সহ জীবনে এই সাহায্য বেশ সহায়ক হয়েছিল। আমি বিশ্বব্যাপী তৃণমূল মানুষের এই ভূমিকাকে আলাদা একটি সেক্টর হিসেবে উপস্থাপন করেছি। সত্যিকার অর্থে রণাঙ্গনের অন্য ১১ টি সেক্টরের মত এই সেক্টরটিও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। এই সেক্টরটি হয়ত সরাসরি শত্রুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেনি, কিন্তু সারা বিশ্বে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে কেন্দ্র করে যে কুটনৈতিক যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে আমাদের যে বিজয় তার অন্যতম সৈনিক ছিল এই ১৩ নম্বর সেক্টর। ভারতে আশ্রয় লাভকারি প্রায় এক কোটি শরণার্থী প্রয়োজনীয় প্রায় সকল সাহায্যই পেয়েছে এই ১৩ নম্বর সেক্টর থেকে। আমাদের দু:সময়ের সবচেয়ে বড় শক্তি মনোবল বৃদ্ধিতে স্পষ্টত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এই সেক্টরটি। বিশ্বব্যাপী তৃণমূল জনতার এই স্বতঃস্ফূর্ত সহমর্মিতা তথা ১৩ নম্বর সেক্টরের জন্য মাত্র নয় মাসে আমরা স্বাধীনতা পাই ।
তথ্যসূত্র:
দৈনিক কালান্তর, কলকাতা
হিন্দুস্থান স্ট্যা-ার্ড, কলকাতা
মনিং ষ্টার, ল-ন
নিউইয়র্ক টাইমস, নিউইয়র্ক
দৈনিক আনন্দবাজার, কলকাতা
ডেইলি মিরর,ল-ন
দৈনিক প্রথম আলো, ঢাকা (নাইর ইকবাল, আপরাধী এক বেলজিয়ান)
দৈনিক সংবাদ, আগরতলা
মুনতাসীর মামুন, মুক্তিযুদ্ধের ১৩ নম্বর সেক্টর, সূবর্ণ, ঢাকা, ২০১৩
সত্যব্রত চক্রবর্তী, এপারে একাত্তর, আগরতলা, ১৯৭৪
সোহরাব হাসান, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের ভূমিকা, ঢাকা, ২০০৮
তাজুল মোহাম্মদ, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রবাসী বাঙালি সমাজ, ঢাকা, ২০০১
রিচার্ড কে টেইলর, (অনুবাদ মেসবাহউদ্দিন মুনতাসীর), আবরোধ, ঢাকা, ১৯৯৭
বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, ভলিউম ২
ফজলুল বারী, একাত্তরের আগরতলা,ঢাকা, ১৯৯৭
গৌতম দাশ(সম্পাদিত), মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী উৎসব স্মরণিকা, আগরতলা, ২০০১
সুকুমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগরতলা ত্রিপুরা দলিলপত্র, ঢাকা, ২০০০৭
মুনতাসীর মামুন, গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, খ- ১৮, ঢাকা, ২০১৪
মুনতাসীর মামুন, কবির অনশন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকা, ২০১৪
আবুল ফজল শামসুজ্জামান, জাকার্তায় একাত্তরের ঢেউ, ঢাকা, ২০০২
বিকচ চেীধুরী, লক্ষ মুঠিতে ঝড়ের ঠিকানা, ত্রিপুরা দর্পণ, আগরতলা, ২০০৩
©somewhere in net ltd.