নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্বপ্নীল শহীদ

স্বপ্নীল শহীদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

চোত্তাখোলা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান বন্ধুত্বের নতুন ঠিকানা

১৪ ই মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:২১


চৌধুরী শহীদ কাদের

আগরতলা শহর থেকে ১৩২ কিলোমিটার দূরে বিলোনিয়ার প্রায় প্রান্তসীমায় চোত্তাখোলা নামক স্থানে গড়ে উঠেছে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান। এই উদ্যানের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী এই পাহাড় ঘেরা স্থানটি হয়ে উঠের্ছিল মুক্তি বাহিনীর অলিখিত ঠিকানা। ফেনীর আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমেদ মূলত এই জায়গায় ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল। পাক অধিকৃত ফেনী শহরের গোডাউন,ব্যাংক এসব লুট করে বিপুল অর্থসম্পদ নিয়ে তিনি চোত্তাখোলায় আসেন। শুরুতে এটি একটি ট্রানজিট শরণার্থী ক্যাম্প ছিল। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী,খাগড়াছড়ি, ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া,কুমিল্লা থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা শরণার্থীদের শুরুতে এখানে আশ্রয় দেয়া হত, একটু সুস্থ হলে তাদের কে আগরতলা, মেঘালয়, বিশালগড় এবং অনেক সময় ত্রিপুরার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হত। মে মাস থেকে এটি ট্রানজিট ক্যাম্পের পাশাপাশি মুক্তি বাহিনীর একটি ঘাটিঁতে পরিণত হয়। ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় এখানে মুক্তি ফৈাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।


চোত্তাখোলা থেকে পরিচালিত হয় বেশ কয়েকটি অপারেশন। মূলত এখান থেকে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ ঢুকে পড়ত ফেনী,কুমিল্লাসহ প¦ার্শবর্তী অঞ্চল গুলোতে। অপারেশন শেষে আবার ফিরে আসতেন চোত্তাখোলায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খুব সন্নিকট হওয়ায় এখান থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাজোয়া যানে বেশ কয়েকটি আক্রমন চালানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে চোত্তাখোলা হয়ে উঠে পাক বাহিনীর আক্রমনের কেন্দ্রবিন্দু। পাল্টা আক্রমনের জন্য মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ও সেনাবাহিনী এখানে শক্ত অবস্থান নেন। এখানে বেশ কয়েকটি বাংকার তৈরী করা হয়। যে বাংকার গুলো এখনো চোত্তাখোলা মৈত্রী উদ্যানে মুক্তিযুুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। এছাড়াও এখানে রয়েছে বেশ কিছু শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর, পাশাপাশি এখানে অনেক পাকিস্তানি সৈন্যকেও কবর দেয়া হয়েছে। এখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের কবর সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শুভল রুদ্র বলছিলেন,“ মূলত বাংলাদেশের ভেতরে আক্রমন করতে গিয়ে মুক্তিবাহিনী যে পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা করত, সহকর্মীদের সাহস বাড়ানো জন্য তাদের লাশ নিয়ে আসা হত চোত্তাখোলায়”।
আমাদের মুক্তিসংগ্রামের স্মৃতি বিজড়িত এই চোত্তাখোলাতেই বর্তমানে গড়ে ওঠেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যান। এই মৈত্রী উদ্যান গড়ে ওঠার পিছনে রয়েছে এক অনন্য ইতিহাস। চোত্তাখোলা রাজনগর ব্লক এলাকার অর্ন্তগত একটি বর্ধিঞ্চু পঞ্চায়েত। রাজনগরের বিধায়ক সিপিআইএম নেতা সুধন দাস। যিনি ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানের স্বপ্নদ্রষ্টা। এই পার্কের ইতিহাস ও বেশ পুরোনো। যেমনটি বলছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার,“ একটি প্রাচীন মসজিদকে কেন্দ্র করে এই পার্কের সূচনা”।
উদ্যানের চুড়ায় এই স্থানে রয়েছে বেশ কিছু শহীদের গণকবর


১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ পার্টির বিশেষ তহবিল সংগ্রহে চন্দ্রপুর যান সিপিআইএম নেতা সুধন দাস। তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি আসন্ন নির্বাচনের প্রচারণাও একটি উদ্দেশ্য ছিল। চন্দ্রপুর গিয়ে তিনি এখানকার গহীন অরণ্যে একটি ৪০০ বছরের প্রাচীন মসজিদের কথা জানতে পারেন। স্থানীয় নেতাদের কাছে শুনেন বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর থেকে সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তাহীনতা,শঙ্কার কথা। রাজ্যে তখন কংগ্রেস টি.ইউ.জি.এস সরকার। সুধন দাস চন্দ্রপুরে ঘোষণা দিলেন সিপিআইএম ক্ষমতায় আসলে এই মসজিদটি সংস্কার করা হবে। মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে এবং প্রতি বছর ৬ ডিসেম্বর এখানে সংহতি মেলা করা হবে। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসের নির্বাচনে বিপুল মানুষের সমর্থন নিয়ে রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সুধন দাস এই এলাকা থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর ব্লকের সভায় ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পরবর্তী পরিস্থিতি ও চন্দ্রপুর গ্রামের প্রায় ৪০০ বছরের পুরোনো মসজিদে ৬ ডিসেম্বর সংহতি মেলার প্রস্তাব করা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে আন্তরিকতার সহিত এই প্রস্তাব গ্রহীত হয়। সেই বছরেই প্রথম পালন করা হয় সংহতি মেলা। প্রতিবছর পালন হতে থাকে সংহতি মেলা। ২০০৪ সালে ক্ষমতাসীন সিপিআইএম প্রত্যেক বিধায়ককে নিজ নিজ ব্লকে জনগনের বিনোদন ও সকালে হাঁটার জন্য ১টি পার্ক স্থাপনের নির্দেশ দেয়। রাজনগরের বিধায়ক সুধন দাস চন্দ্রপুরের এই মসজিদ ও আশেপাশের বেশ কয়েকটি পাহাড়,হৃদকে কেন্দ্র করে একটি পার্ক স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। সুধন দাস জানতেন এই পাহাড়,চন্দ্রপুর চোত্তাখোলা গ্রাম বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের স্মৃতি বহনকারী। মুক্তিবাহিনী ভারত সীমান্তে প্রবেশ করে এখান থেকে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাই নির্মাণাধীন এই পার্কের নাম দিলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধ পার্ক। ২০০৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর সুধন দাস এই পার্ক উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রন জানালেন রাজ্য সিপিআইএমের মুখপাত্র শ্রী গৌতম দাসকে। গৌতম দাস চোত্তাখোলায় এসে এই পার্ক দেখে আপ্লুত হন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা স্মৃতিচারণ করেন। এই চোত্তাখোলার সাথে মুক্তিযদ্ধের যে স্মৃতি সেটাকে আরো বড় পরিসরে তুলে ধরার জন্য তিনি ফিরে এসে বিষয়টি মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারকে জানান। উল্লেখ্য গৌতম দাস ১৯৭১ সালে সিপিআইএম এর ছাত্র সংগঠন এসএফআই এর সভাপতি হিসেবে চোত্তাখোলায় নানা সময়ে আসতেন। তিনি জানতেন এই চোত্তাখোলার প্রকৃত ইতিহাস। মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার ও তৎকালীন পর্যটন মন্ত্রী জিতেন চৌধুরী,গৌতম দাস মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই চোত্তাখোলায় একটি বৃহৎ পার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২০ হেক্টর জমি, সাতটি টিলা ও একটি প্রাকৃতিক ঝর্না নিয়ে গড়ে তোলা হবে এই সুরম্য উদ্যান। এই উদ্যান নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয় তৃঞ্চা অভায়ারণ্যের সহকারী বন্যপ্রাণী সংরক্ষক অভিজ্ঞ জনার্দন রায় চৌধুরীকে। সম্পৃক্ত করা হয় বাংলাদেশের কিছু অভিজ্ঞ লোককে।
ভারত সরকারের অনুরোধে উদ্যানটির পরিকল্পনা ,ডিজাইন ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক বিষয়ের জন্য চার বাংলাদেশীর সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি। এর চার সদস্য হচ্ছেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, শিল্পী হাশেম খান,স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ও অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপু মণি এই পার্কের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এরপর শুরু হয় এর বহুমুখী নির্মাণ কার্য। বিলোনিয়া মহকুমার জগন্নাথদিঘি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে গড়ে উঠা এই উদ্যানে নির্মাণ করা হয়েছে ২ টি সৃদৃশ্য ঝুলন্ত সেতু, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের অনুকরনে একটি স্মৃতিসৌধ, বেশ কিছু ভাস্কর্য। এর ভেতরে বয়ে চলা প্রাকৃতিক হৃদ বৃদ্ধি করেছে উদ্যানের সৌন্দর্য্য। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা হবে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নান চিত্রকর্ম। বাংলাদেশের খুলনায় অবস্থিত ১৯৭১: গণহত্যা- নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের সৌজন্যে এখানে স্থাপিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ভাস্কর্য পার্ক। বিধায়ক সুধন দাস বললেন,এখানে একটি গেস্ট হাউস বা পর্যটন নিবাস গড়ে তোলা হবে। গড়ে তোলা হবে একটি ইকো পার্ক।
বর্তমানে পার্কটির প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ১২ ফুট লম্বা স্মৃতিসৈাধ। যার প্রতিবিম্ব লেকের জলে অপূর্ব আবহের সৃষ্টি করে। এ ছাড়া বিচ্ছিন্ন টিলাগুলোকে যুক্ত করতে প্রাকৃতিক আবহ ধরে রাখতে তৈরি হয়েছে কাঠের সেতু। ভাস্কর্যের পেছনে টেরাকোঠায় চিত্রিত করা হয়েছে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নানা বাঁক। এর মধ্যেই প্রচুর পর্যটক চোত্তাখোলায় ঘুরতে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই উদ্যান আমাদের মুক্তিসংগ্রামের দূর্বার দিনগুলো যেমন স্বরণ করিয়ে দিবে, ঠিক তেমনি ফুটিয়ে তুলবে একাত্তর সালের ত্রিপুরা রাজ্যের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার ইতিহাস। এই উদ্যানটি হতে পারে দুই দেশের পর্যটনের নতুন ঠিকানা। বাংলাদেশ থেকে আখাউড়া কিংবা বিবির বাজার স্থল বন্দর দিয়ে খুব সহজে যাওয়া যাবে চোত্তাখোলা। বিবির বাজার স্থল বন্দর হয়ে বিলোনিয়া থেসেবুজ বনানী। যাওয়ার পথে ঘুরে যেতে পারেন সিপাহীজলা, ত্রিপুরা কি মাত্র ৩০ মিনিটের দূরত্ব চোত্তাখোলা মৈত্রী উদ্যান। আখাউড়া হয়ে আগরতলা থেকে বিশাললগড় , সোনামুড়া, নিদয়া হয়ে অল্প সময়ে যাওয়া যাবে চোত্তাখোলায়। যাওয়ার সময় রাস্তার দুপাশে রাবার শাল,অর্জুন, কর্পূর গাছের বশ্ববিদ্যালয়, নীর মহল কিংবা বাইসনের অভয়ারণ্য তৃঞ্চায় কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে।
এই মৈত্রী উদ্যান নির্মান এক দিকে হতে পারে বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস, অন্যদিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন মাত্রা। হতে পারে পর্যটনের নতুন ঠিকানা।
[লেখক: শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.