নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কোন এক সময় লেখালেখি শুরু করবো। এখন যা লিখছি তা সেই সময়ের জন্যে প্রস্তুতি আসলে। আর লেখার জন্যে নতুন নতুন তথ্য যোগাড় করছি আপাতত।

ফায়েজুর রহমান সৈকত

মুক্ত সকল চিন্তা করি, নিজের সাথে নিজেই লড়ি।

ফায়েজুর রহমান সৈকত › বিস্তারিত পোস্টঃ

সূর্য দীঘল বাড়ি_একটি বাংলাদেশের চিত্র

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৯

মাঝেমাঝে কিছু সিনেমা বিনোদনকে পাশ কাটিয়ে বাস্তবিক জীবনের দলিল হয়ে ওঠে। তখন তাকে কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা যায়না। বরং এর থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের শিক্ষা। আজ সেরকম একটি সিনেমার গল্প বলতে চাই।

দেশভাগের সময় আমাদের বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা কেমন ছিল তার সুস্পষ্ট চিত্রায়ন করেছেন উপন্যাসিক আবু ইসহাক তার সূর্যদীঘল বাড়ি উপন্যাসে। তার রচিত প্রতিটি চরিত্র যেন তখনকার মানুষদের বাস্তবিক রূপ। সেই রূপকে সেলুলয়েড ফিতায় জীবন্ত করেছেন পরিচালক মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। উপন্যাস পড়ে মানুষ যে জয়গুন, হাসু, মায়মুনদের কল্পনায় এঁকেছিল, তাদেরকে সবার সামনে উপস্থাপন করেছেন পরিচালকদ্বয়।

তেতাল্লিশ সালের ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের কারণে গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে যাওয়া বহু দরিদ্র পরিবার শহরে কোন কাজ না পেয়ে, কিছু খেতে না পেরে আবার গ্রামেই ফিরে আসে। তেমনি একটি পরিবারের প্রধান জয়গুন তার দুই সন্তান আর বাওস সহ তারা গ্রামে ফিরে আসে। নিজের পিতার রেখে যাওয়া তালগাছের ভিটাতে জয়গুন ঘর বাঁধে। কিন্তু এই তাল গাছের ভিটাটিতে কোন পরিবার বাস করতে এলেই সেই পরিবারের কেউ না কেউ অস্বাভাবিক ভাবে মারা যেত। তাই এতদিন ধরে ভিটাটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকতো। সেই ভিটাতেই জয়গুন বাস করতে থাকে। তাদের সেখানে বাস করা, কাজের সন্ধানে আবার শহরে ছুটে চলা, পারিবারিক আর সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা, বিভিন্ন সামাজিক আর ধর্মীয় আচার, কুসংস্কার, শোষণ কিন্তু তারপরেও বেঁচে থাকার জন্য লড়াই ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে সূর্যদীঘল বাড়ি বইটি এক অনন্য উপাখ্যান। তার কয়েকটি প্রধান চরিত্রকে ব্যাখ্যা করলে বইটি সম্পর্কে আমরা আরো স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি।

জয়গুনঃ গল্পটি যেন জয়গুনকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে যার প্রথম স্বামী জব্বর মুন্সী মারা যাবার পরে করিম বক্স নামক আরেকজনের সাথে তার বিবাহ হয়েছিল কিন্তু করিম বক্স আবার অন্যত্র বিবাহ করে তাদের ছোট সন্তান কাসুকে নিজের কাছে রেখে দিয়ে জয়গুনকে তাড়িয়ে দেয়। অসহায় জয়গুন তার প্রথম স্বামীর ছেলে হাসু এবং দ্বিতীয় স্বামীর মেয়ে মায়মুনকে সাথে নিয়ে জীবন সংগ্রামে নামে। শহরে সে কাজ করে, এক জায়গা থেকে কম দামে চাল এনে অন্য জায়গা বেঁচে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবজি বেঁচে। আবার সে মায়ের দায়িত্বটিও ঠিকঠিক পালন করে। সন্তানদের খাবার ব্যবস্থা করে। মেয়ের বিয়ে দেয়। অসুস্থ কাসুকে সেবা করে সুস্থ করে তোলে। গাঁয়ের মোড়ল তাকে বিয়ে করতে চাইলে সে মানা করে দেয়। এমনকি দ্বিতীয় স্বামী করিম বক্স তাকে আবার ঘরে তুলতে চাইলেও সে রাজি হয়না। নিজের সম্মান ঠিক রেখে যেন সংগ্রাম করে চলতেই সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে।

হাসুঃ জয়গুন আর তার প্রথম স্বামীর ঘরের প্রথম সন্তান হাসু। বাবা মারা যাবার পরে দরিদ্রতার চাপে পরে গ্রাম ছেড়ে মায়ের সাথে কাজের সন্ধানে শহরে চলে যায় সে। কিন্তু সেখানে তাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। লেদা যখন তাকে বলে, গেরাইম্মা কামে কেমুন খাটনি এলা বুঝ।
হাসু বলে, শহইরা কামেও খাটনি কম না লেদু ভাই। আসলে খাটনি ছাড়া কোন কাম নাই আর কাম ছাড়া ভাত অ নাই।
শহরে গিয়ে হাসু কুলির কাজ করে, মিস্ত্রির কাজ করে, কারখানায় ভারী ভার নেয় কাঁধে। কিন্তু এত ছোট বয়েসে এসব কাজের চাপ সে সবসময় সহ্য করতে পারেনা। তার ঘাড় ব্যথা করে, পায়ে ঘা হয়, জ্বর আসে। আবার ভাই বোনের জন্যেও হাসুর মায়া আছে। মেলা থেকে চড়কি আর কদমা কিনে লুকিয়ে গিয়ে কাসুকে দেয়। মায়মুনের জন্য চুড়ি কিনে নিয়ে যায়। দেশের প্রতিও তার ভালবাসা আছে। ‘৪৭ সনে দেশ স্বাধীন হলে সে মায়ের শাড়ি কেটে পাকিস্তানের পতাকা বানিয়ে গাছে উড়ায় আর ভাই বোনদের নিয়ে স্লোগান দেয়, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। জীবন নিয়ে হাসুর বড় কোন স্বপ্ন নেই। কোনমতে খেয়ে পরে চলতে পারলেই তার হয়।

শফির মাঃ জয়গুনের বাওস শফির মা। স্বামীর বোনের সাথে সেও শহর থেকে গ্রামে ফিরে এসে সন্তান সহ তালগাছের ভিটাতে ঘর বাঁধে। গ্রামে কোন কাজ পায় না বলে সে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভিক্ষা করে। জয়গুনের জন্য গদু প্রধানের থেকে সে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসে। জয়গুন রাজি না হলে পরে জয়গুনের মেয়ে মায়মুনের জন্য সে সুলেমান খার ছেলের হয়ে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে আসে। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে জয়গুনকে সে রাজি করায়।

মায়মুনঃ জয়গুন আর তার দ্বিতীয় স্বামী করিম বক্স এর ঘরের প্রথম সন্তান মায়মুন। মা আর ভাইয়ের সাথে তাকেও করিম বক্স ঘর থেকে বের করে দেয়। মিষ্টি মেয়ে মায়মুন সারাক্ষণ শুধু হাসে। মায়ের সাথে সে সংসারের কাজ করে। তার হাঁস পালার খুব শখ তাই লেদু ভাইকে বলে সে কয়েকটা হাঁস আনায়। সেই হাঁস ডিম পাড়ে। সেই ডিম থেকে সে হাঁসের আরো ছাও ফুটায়। সুলেমান খার ছেলের সাথে কম বয়সেই মায়মুনের বিবাহ হয় কিন্তু স্বামীর সংসারে অল্প খাবার খেয়ে কাজ করতে পারেনা বলে স্বামী তাকে নিজের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। মায়মুন আর সেখানে যায়না।

করিম বক্সঃ স্বামী মারা যাবার পরে জয়গুনকে বিবাহ করে করিম বক্স। তাদের দুটি সন্তানও হয়, মায়মুন এবং কাসু। কিন্তু কাসুকে নিজের কাছে রেখে দিয়ে সে জয়গুনকে তার দুই সন্তান সহ ঘর থেকে বের করে দেয়। কিছুদিন পরে সে আবার নিকাহ করে। সেই ঘরে তার একটি সন্তান হয়। কাসুকে সে কিছুতেই জয়গুন আর তার সন্তানদের সাথে দেখা করতে দেয়না। একদিন কাসুর প্রচণ্ড নিউমোনিয়া জ্বর হলে জয়গুনকে সে তার বাড়িতে ডেকে পাঠায়। তখন জয়গুনকে তার আবারও বিবাহ করতে ইচ্ছে হয়। গোপনে সে প্রস্তাবও দেয়। জয়গুন রাজি হয়না তাই তাকে বশে আনার জন্য সে ফকিরের কাছ থেকে তাবিজ কবজ আনে। রাতের আধারে সেই তাবিজ সে জয়গুনের ভিটাতে পুঁতে রাখতে যায়।

গদু প্রধানঃ গদু প্রধান গাঁয়ের ধনী মোড়ল। দুইটা বিবাহ করেছে সে। কিন্তু জয়গুনকে বিবাহ করার জন্য খলিল মাতবরকে দিয়ে আবার প্রস্তাব পাঠায়। জয়গুন রাজি হয়না বলে সে শালিস ডেকে জয়গুনকে বাড়ির বাইরে কাজে যেতে বাধা দেয়। সারা গায়ে তার নামে কু রটনা ছড়ায়। এমনকি রাতের আড়ালে এসে জয়গুনদের তালগাছের ভিটা বাড়িতে ভয় দেখানোর জন্যে ঢিল ছুঁড়ে। করিম বক্স তা দেখে ফেললে গলা টিপে তাকে হত্যাও করে। শেষমেশ এক গভীর রাতে নিজের লোক দিয়ে জয়গুনদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে তাদের গ্রাম ছাড়া করে।

এভাবে একটি করুণ এবং অজানা পরিণতির মধ্য দিয়ে গল্পটির সমাপ্তি হয়। হয়ত জয়গুনরা আবার শহরে ফিরে যাবে। কিন্তু এমন ভয়াবহ দূর্ভিক্ষ আর কাজের আকালের সময় তারা কি করবে, কি খেয়ে জীবনধারণ করবে, কি পরবে, কোথায় থাকবে কিছুই জানেনা কেউ। জয়গুন আর তার সন্তানদের জন্যে দর্শকের হৃদয়ে এক গভীর বেদনার সৃষ্টি হয়।

সামান্য একটি অবাস্তব গল্প কিভাবে অসামান্য আর ভীষণ বাস্তবিক হয়ে উঠে দর্শকের হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয় এটি যেন তারই প্রমাণ। এই বইয়ে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, ডলি আনোয়ার , রওশন জামিল, জহিরুল হক , কেরামত মাওলা , এটিএম শামসুজ্জামান, সৈয়দ হাসান ইমাম, ফখরুল হাসান বৈরাগী, নাজমুল হুদা বাচ্চু , সেতারা বেগম, ইলোরা গহর প্রমুখ। প্রতিটি চরিত্রকে দিয়ে নিখুঁত অভিনয় করিয়ে পরিচালক মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী নিজেদের কাজটি ঠিকঠাক করতে পেরেছেন। গল্পকার আবু ইসহাকের সূর্যদীঘল বাড়িকে ১৯৭৯ সালে তারা জীবন দিয়েছেন। আর তাইতো সরকারী অনুদানকৃত প্রথম এই বাংলাদেশী বইটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরষ্কার সহ প্রায় সব বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার ঘরে তুলে। তেতাল্লিশ সালে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের পরে আর সাতচল্লিশে দেশ ভাগের সময় বাংলাদেশের চিত্র নিয়ে এমন সুন্দর আর বাস্তবিক বই আর দ্বিতীয়টি হয়নি। এমনকি আজ পর্যন্ত এর মত এত সুন্দর বাংলাদেশী বই আর কি হয়েছে আমার সঠিক জানা নেই। যারা বাংলাদেশকে জানতে চান, বাংলাদেশের ইতিহাস আর এর মানুষদের জীবন সংগ্রাম দেখতে চান তারা সূর্যদীঘল বাড়ি দেখে নিবেন। আমি বারেবারে বিস্মিত হচ্ছিলাম যে এমনকি আমাদের আদি পুরুষদের মুখের ভাষাটি পর্যন্ত এই বইয়ে অবিকৃত রাখা হয়েছে। এখনও গ্রামের মানুষেরা ঠিক যেভাবে কথা বলেন, সেভাবে। তাই বইটি দেখার সময় আমার বারেবারে গ্রামের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিলো।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৩২

কালীদাস বলেছেন: সিনামাটা দেখা হয়নি আজও, ন্যাক্কারজনক :( সেসময়কার অভিনেতারা জানত অভিনয় কি জিনিষ; এখনকার বেশিরভাগের মত পোজার ছিল না।

বাইদ্যাওয়ে, হুমায়ুনের মধ্যাণ্হ মুটামুটি ভালই কাভার করেছে দেশভাগ হওয়ার দিন পর্যন্ত, পরেরটুকু আর আসেনি।

০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:১৯

ফায়েজুর রহমান সৈকত বলেছেন: ইউট্যুবে ভাল প্রিন্ট এসেছে । সময় করে দেখে নিতে পারেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.