![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি খুব সাধারন একটা ছেলে বেড়ে উঠা গ্রামে, আর ভালোবাসি বাংলাদেশ। পড়তে খুব পছন্দ করি, মাঝে মাঝে লিখারও চেষ্টা করি।
ফকির আবদুল হাই সাহেবের সাথে পরিচয় হয় যখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন। খুবই আধ্যাত্মিক আর রহস্যময় মানুষ। পেশায় একজন অধ্যাপক। অধ্যাপনা ছেড়ে আধ্যাত্মিকতা করেন, ফকির নামটি তার নিজস্ব টাইটেল। বনানীতে পৈত্রিক বিরাট বাসা, একাই থাকেন জানালেন।
আমি তখন তুমুল সাহিত্যচর্চা করছিলাম। নানান বই, সাহিত্য আড্ডা আর প্রেম ভালোবাসা নিয়ে এক অজানা মোহে ডুবে আছি। টুকটাক লেখালেখি করছি, পত্রিকায়, ম্যাগাজিনে আর ব্লগে। নানান মানুষের কাছে যেতাম, সভা করতাম, আড্ডা দিতাম। তেমনই এক সময়ে ফকির সাহেবের বাসায় গিয়ে পরিচয় হয় তার সাথে।
তার ড্রয়িং রুমে বসে আছি। রুমটা ভালো করে লক্ষ্য করলাম, কাঠের সোফা যেখানে আমি বসেছি, উনি বসেছেন একটা হেলান দেয়া আরাম চেয়ারে। হাতে সিগারেট জ্বলছে, ওনার মাথার উপর দেয়ালে একটা চিত্রকর্ম ঝুলে আছে। পাশেই বিশাল বুক সেল্ফ, শত শত বই আছে। সেলফের পাশে তিনটা বাদ্যযন্ত্র, একতারা, হারমোনিয়াম আর তবলা। রুমের ফার্ণিচারগুলো সবই দামী আর রুচিসম্মত। লোকটার নামই কেবল ফকির বাকি সব বড়লোকি আর সৌখিনতায় পরিপূর্ণ।
ফকির সাহেবকে ভালো করে দেখলাম। সাদা লম্বা দাঁড়ি, আধা পাকা বাবরি চুল, মাথায় ক্যাপ বা টুপি জাতীয় গোলাকার কিছু একটা পরে আছেন। গায়ে খাকি কালারের পাঞ্জাবি পরা, খুব ফিটফাট আর লম্বা সুদর্শন মানুষ। গায়ে অদ্ভুত এক সুগন্ধি মেখেছেন, এই সুগন্ধির গন্ধে পুরো রুম মোহ মোহ করছে।
ভালোবাসা নিয়ে আমাকে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা দিয়েছেন এই ফকির আবদুল হাই। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন; "ভালোবাসা মানে খোঁজা, আমৃত্যু প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে যাওয়া। পেয়ে যাওয়া মানে ভালোবাসা নয়, পেয়ে যাওয়া মানে ভালোবাসার পূর্ণতা পাওয়া মাত্র। খুঁজে যাওয়া মানে হলো প্রকৃত ভালোবাসা, ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে যাওয়ার পরেও খুঁজে যেতে হয় হারাবার পরেও খুঁজে যেতে হয়। কেউ যদি পাওয়ার পরে খোঁজা বন্ধ করে দেয় তাহলে বুঝতে হবে তার ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে।"
ফকির আবদুল হাই সাহেবের কথাগুলো শুনে আমি বেশ চমকে উঠলাম। আমি ফকির সাহেবকে প্রশ্ন করি, খোঁজা কিভাবে ভালোবাসা হয়?
তিনি বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে জবাব দিলেন; "আল্লাহকে মানুষ পেয়েছে কেউ? তবুওতো মৃত্যু পর্যন্ত খুঁইজা যায়। কেন খুঁজে? ভালোবাসে দেইখাই তো খুঁজে।"
আমি বলি- "না পেলে তাহলে ভালোবাসার মানে কি? মানুষ তো পাওয়ার জন্যই ভালোবাসে।"
তিনি একটু আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, "পেয়ে গেলে ভালোবাসার স্বাদ নষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকে। না পাওয়া ভালোবাসাই আজীবন টিকে থাকে। না পাওয়ার যে হাহাকার, তীব্র বেদনা, অপেক্ষা, সেই স্বাদ যে একবার জীবনে পাইছে সে-ই প্রকৃত প্রেমিক হয়ে উঠেছে।"
কথাগুলো আমার ভাবনায় তখন ভালোই আঘাত করেছিলো। আমি ফের প্রশ্ন করি, "এই অপ্রাপ্তি আর হাহাকারের ফলাফল কি? এতে কি কোন লাভ হয়?"
ফকির সাহেব এবার নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে আমার পাশে এসে বসলেন। হাতের সিগারেটে লম্বা এক টান দিলেন। আমার চোখের কাছে নিজের চোখগুলো নিয়ে উত্তর দিলেন। "তুমি আজ থেকে ঠিক দশ বছর পর এই কথাটির মানে বুঝবে, তুমি দেখবে অপ্রাপ্তির মাঝেই প্রকৃত ভালোবাসা জমা হয়। পেয়ে গেলেই কেবল ভালোবাসা নয়"
আমি এই প্রথম লোকটার চোখগুলো লক্ষ্য করলাম। বড় বড় টলমলে জল চোখ, লাল হয়ে আছে। যেন এক গভীর বেদনার বিষাদে পুড়ে যাচ্ছে চোখ দুটো। লোকটার চোখে মুখে ভীষণ হাহাকার, মনে হচ্ছে কতদিন এই অশান্ত চোখগুলো প্রদীপের মত জ্বলে আছে। আচ্ছা তিনি আমাকে দশ বছর সময়ের কথা কেন বলেছেন? আমি বেশ কৌতুহলী হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার অল্পবয়সী মন তখন আর এই বিষয়ে প্রশ্ন করেনি।
ফকির সাহেব বলে চললেন; তুমি তাকে না পেয়েও ভালোবেসে যেতে পারো চাইলে। একসাথে জীবন কাটাতে পারো। পাশাপাশি এক জীবনে, তবে আলাদা আলাদা সংসারে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম; তাকে পাবো কিভাবে?
- ডাকলেই পাবে। মন থেকে ডাকলে খোদারেও পাওয়া যায়। প্রেমিকাতো সামান্য মানুষ।
- ডাকার জন্য যদি কাছে না পাই?
- কাউকে ডাকতে গেলে যোগাযোগ লাগেনা, সামনে থাকতে হয়না। শুধু আত্মার সাথে আত্মার যোগাযোগ থাকলেই হয়?
- কিভাবে?
- তুমি যদি কাউকে মন থেকে ভাবতে পারো দেখবে সেও তোমাকে মন থেকে ভাববে। তার সাথে মনে মনে কথা বলো সেও উত্তর দিবে। তাকে সাথে সাথে রাখো দেখবে সেও তোমার পাশে চলবে, মিশে যাবে তোমার আত্মার সাথে। এটাকে বলে আত্মার যোগাযোগ, এই যোগাযোগ বছরের পর বছর চেষ্টার পরে করা যায়। এটা গভীর সাধনার বিষয়।
- এটা কি টেলিপ্যাথি? আপনি টেলিপ্যাথি জানেন?
ফকির সাহেব এবার উঠে দাঁড়ালেন। কয়েক পা সামনে এগিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালেন। বললেন, টেলিপ্যাথি সম্পর্কে তোমার ধারনা আছে?
- আছে, আমি বইতে পড়েছি। টেলিপ্যাথি (Telepathy) হলো এমন এক ধরণের ধারণা বা ধারণাকৃত ক্ষমতা, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আরেকজন ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি বা মানসিক অবস্থা সরাসরি জানতে পারে — কোনো শব্দ, ইশারা, কিংবা প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই।
- তুমি টেলিপ্যাথি বিশ্বাস করো?
- বিশ্বাস করি, তবে আমি এখনো শিখতে পারিনি।
- টেলিপ্যাথি আর আত্মার যোগাযোগ এক জিনিস না। টেলিপ্যাথিতে মানুষ অন্যের মনের ভাষা অনুমান করে। অন্যদিকে আত্মার যোগাযোগ মানে হইলো নিজের মনের ইচ্ছায় অন্যকে চালানো। আত্মার সাথে আত্মায় কথা বলা, ছুঁয়ে থাকা। তুমি যখন যেভাবে চাইবে তোমার ভাবের মানুষ তোমার ডাকে সাড়া দিবে।
আমি ব্যপারটা নিয়ে কিছুক্ষন ভাবলাম। ফকির সাহেব রুমের জানালার বাইরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বাসার নীচে কয়েকটি উঁচু মেহগনি গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে। তার পরে বনানী মাঠ, মাঠে এই মুহূর্তে একদল কিশোর ক্রিকেট খেলছে। আকাশে ঝলমলে রোদ, কয়েকটি কাক বিক্ষিপ্ত উড়ে বেড়াচ্ছে। আমার ভাবনা শেষ হলে আমি ফকির সাহেবের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম।
- আপনি কি কারো জন্য অপেক্ষা করেন?
- আমরা সবাই কারো না কারো জন্য প্রতিনিয়ত অপেক্ষা করি।
- কিভাবে?
- প্রিয়জনকে হারাইলেই মানুষ তার সেই প্রিয়জনের অপেক্ষায় থাকে। কারো প্রিয়জন বাপ মা, কারো সন্তান, কারো কোন বন্ধু আর কারো তার প্রেম। মানুষ মৃত্যুর জন্য যেমন অপেক্ষা করে তেমনি প্রিয়জনের জন্যও করে।
- আপনি কার জন্য করেন?
- আমি করি এক একুশের বালিকার জন্য। যার বয়স একুশেই আটকে আছে। যাই হোক সেই গল্প আরেকদিন করা যাবে।
- আমি কি আরেকদিন আসবো?
- তোমার সাথে আমার দেখা হবে হয়তো এক যুগ পরে। যদি আমি বেঁচে থাকি, আর নইলে তুমিও হয়তো আমার জন্য অনন্তকালের অপেক্ষা করবে।
সেদিন ফকির আবদুল হাই সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। এরপর আর কখনো তার কাছে যাওয়া হয়নি।
বছর দশেক পর আমি একদিন নিজেকে আবিষ্কার করি আমি কাউকে খুঁজে যাচ্ছি পাগলের মত। আমার অপুর্ণ ভালোবাসার মানুষকে চারপাশে খুঁজি। অজান্তাকে হারিয়ে ফেলেছি দুই বছর আগে। অজান্তা আমার জীবনের অংশ ছিলো ছয় বছর। হারিয়ে ফেলার পর বুঝতে পারলাম এই একুশ বছর বয়সী অজান্তাই আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রিয় মানুষ। আমি রাস্তায় হেঁটে যাই তার সাথে কথা বলতে বলতে। অথচ সে পাশে নেই। যখন তাকে খুব অনুভব করি আমি তার স্পর্শ টের পাই। আমার হাত ধরে সে কবিতা পড়ে।
"একটি নদী, নিরবধি
বয়ে চলে একা
লোকে বলে চোখের জল
আমি বলি বিষন্নতা।"
একদিন তার সাথে যোগাযোগ হয়, সে আমাকে প্রশ্ন করে;
- এত জ্বালাও কেন রোজ?
- আমি তো তোমাকে জ্বালাই না, নিজে নিজে খুঁজি।
- আমি কেন তোমাকে মন থেকে সরাতে পারছি না?
- কারন আমি তোমাকে মন থেকে সরাই না।
- দেখা হয়না, কথা হয়না তবুও কোথাও না কোথাও তুমি আছো। স্মৃতিতে, দুঃস্বপ্নে, অসম্ভব যন্ত্রনায়, মন খারাপ করা গানের লাইনে, মাঝরাত্তিরের বুকের ব্যথায় তুমি আছো।
- কারন ঠিক এভাবেই আমিও তোমায় রাখি। এটাকে বলে আত্মার সাথে আত্মার যোগাযোগ। আমার আত্মা তোমার সাথে যোগাযোগ করা শিখে গেছে।
- অবেলায় অসময়ে আর জ্বালাতন করিও না। যাকে হারিয়ে ফেলেছো তার কোন কিছুতে থাকা উচিত না।
- আমরা সবাই আমাদের প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষায় থাকি। যে হৃদয় একবার আত্মার যোগাযোগ তৈরী করতে পারে সে হৃদয়কে থামানোর সাধ্য আর কারো থাকেনা।
এভাবে কথা বলতে বলতেই আমার ফকির আবদুল হাই সাহেবের কথা মনে পড়ে গেলো। আমি কেমন যেন ঠিক তার মতই কথা বলছিলাম। এত বছরে আমি লোকটার কথা ভুলে গিয়েছি। সময়ের হিসাব কষে দেখলাম দশ বছর আগে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। তিনি যেভাবে বলেছিলেন আমি ঠিক সেরকম হয়ে গেছি। আমার জীবন কাটে এখন অপেক্ষায়। প্রিয়মানুষটিকে সব জায়গায় খুঁজে খুঁজে, তার সাথে কথা বলে, তাকে সাথে নিয়ে আমি চলছি।
এবার আমার আবদুল হাই সাহেবকে খুঁজে বের করতে হবে। তিনি কিভাবে জানতেন আমার এই পরিণতি হবে? তিনি কি ভবিষ্যত বলতে পারতেন? নাকি আমার চিন্তার জগতে নতুন এক চিন্তার বিস্তর তৈরী করে আমাকে সেই পথে চালিত করেছেন। লোকটাকে আমার লাগবে, অনেক প্রশ্ন জমে আছে।
একদিন বিকেলে বাসা থেকে বনানীর উদ্দেশ্যে বের হলাম। ফকির সাহেবের বাসা চিনতে আমার ভুল হয়নি। দশ বছরে বনানীর খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। বনানী মাঠের পাশের রাস্তা পেরিয়ে ওপারে যেতেই প্রথম রোডের ১৭ নাম্বার বাড়িটা। আমি বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালাম। একই রকম আছে, হালকা ধূসর রঙ করা। বাসার সামনে একটু খালি জায়গা, মেহগনি গাছগুলো এখন আরো বিশাল আকারের হয়েছে। বাসার নীচে পাতার স্তুপ দেখে মনে হলো অনেক বছর কেউ নেই এখানে। গেটে ঢুকতে পারিনি, তালাবদ্ধ গেটে জং ধরে গেছে। আশেপাশের কাউকে জিজ্ঞেস করা দরকার। পাশের বিল্ডিংয়ের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি জানালেন বিগত তিন বছর ফকির সাহেব এখানে নেই। দেশের বাইরে গেছেন। কবে আসবেন তিনি জানেন না। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো।
আমি ফের বাসার উদ্দেশ্যে ফেরত যাচ্ছি। মাথায় অনেকগুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার এখন ফকির সাহেবের জন্যও অপেক্ষা করা লাগছে। তিনি ১২ বছর পরে দেখা হওয়ার কথা বলেছিলেন। আমাকে হয়তো আরো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে। আর যদি দেখা না হয় তাহলে অনন্তকালের অপেক্ষা।
আমি ফকির সাহেবকে নিয়ে ভাবতে লাগলাম। তার সাথে কি আমার আত্মার যোগাযোগ তৈরি হবে? দুই বছর অনেক লম্বা সময়। রাস্তার ওপারে কাউকে দেখা যাচ্ছে। ফকির সাহেবের মত মনে হচ্ছে। আমি বিভ্রমে পড়ে যাচ্ছি। এদিকে অজান্তা আমাকে ডাকছে। সে আমার অপেক্ষায় বসে আছে সমস্ত বিকেলজুড়ে। আকাশে মেঘ কালো হয়ে গেছে, বৃষ্টি নামবে। বনানী মাঠে একদল কিশোর ক্রিকেট খেলছে, চারদিকে চিৎকার হৈ হুল্লোড়। বৃষ্টি এলেই অজান্তা আমার সাথে ভিজতে চায়। আমি তার হাত ধরে খালি পায়ে শহরের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে হেঁটে চলি। সে কবিতা পড়ে;
"হায়রে কবি, বেখেয়ালি
হারিয়ে ফেলে প্রেম
লোকে বলে একা ভীষণ
আমি বলি আছি, ছিলেম।"
(গল্পঃ অপেক্ষা-১ম পর্ব, © শামীম মোহাম্মদ মাসুদ)
©somewhere in net ltd.