![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি খুব সাধারন একটা ছেলে বেড়ে উঠা গ্রামে, আর ভালোবাসি বাংলাদেশ। পড়তে খুব পছন্দ করি, মাঝে মাঝে লিখারও চেষ্টা করি।
কয়েকদিন হয়ে গেলো আখড়ায়। প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে সেই একইভাবে—পাখির ডাক, হালকা ঠান্ডা বাতাস, গাছের পাতায় রোদ পড়ার শব্দ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এখন আর অজান্তাকে ততটা কষ্ট দিয়ে মনে পড়ে না, বরং মনে হয়—ও যেন আমার ভেতরেই কোথাও থেকে গেছে।
মাঝে মাঝে আখড়ার পেছনের ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে হাঁটি। সেখানেই একদিন এক বৃদ্ধ ফকিরকে দেখলাম বসে আছেন—ধীরে ধীরে মাটিতে আঁকছেন এক বৃত্ত, তারপর সেই বৃত্তের ভেতরে রেখেছেন একটা শুকনো পাতা। তিনি আমাকে দেখে বললেন,
— “মানুষও তো এমনই, পঁচে যায়, শুকায়, তারপর আবার বীজ হয়।”
আমি কিছু বললাম না। তিনি আবার বললেন,
— “তুই এবার কি নাম রাখবি তোর নতুন বীজের?”
আমি চমকে উঠি। বললাম না কিছুই। শুধু মনে মনে বললাম, “আমি কি সত্যিই নতুন কিছুতে জন্ম নিচ্ছি?”
এক রাতে, গভীর ঘুমে হঠাৎ চোখ খুলে দেখি—চাঁদের আলো জানালার ফাঁক গলে বিছানায় পড়ছে। আলোটা এত পরিচিত মনে হলো যেন আমি এর ভেতরেই একসময় থাকতাম। মনে হলো কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে—অথচ শব্দ নেই, কেবল অনুভব।
আমি উঠে বাইরে এলাম। আখড়ার পেছনের বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই মধ্যবয়সী ফকির, যিনি আমাকে প্রথম দিন কাগজের টুকরো দিয়েছিলেন। এবার তাঁর চোখে ছিলো কিছুটা দৃঢ়তা, কিছুটা কঠোরতা। বললেন,
— “তুমি কি প্রস্তুত?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— “কিসের জন্য?”
— “নিজেকে শেষ করে ফেলার জন্য। একটা নাম, একটা প্রেম, একটা পরিচয় ফেলে রেখে, নতুন একজন হয়ে উঠার জন্য।”
আমি থেমে থাকলাম। তিনি বললেন,
— “তুমি জানো, তুমি কে হয়ে উঠবে। ভয় কেবল এইটুকু—নিজের পরিচিত মুখটা হারানোর। কিন্তু যে নিজেকে হারাতে পারে, সে-ই পারে সত্যিকে ছুঁতে।”
তারপর তিনি এগিয়ে এসে আমার কপালে আঙুল ছোঁয়ালেন। চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেলো মায়ের মুখ, বাবার চেহারা, অজান্তার হাসি, মাহির ভ্রু-কুঁচকানো দৃষ্টি, পুরনো দিনের বারান্দা, শ্রাবণের সন্ধ্যা, অফিসের ডেস্ক, বইয়ের স্তূপ...শুধু একটা মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠলো—ফকির আবদুল হাই।
আমি চমকে উঠলাম। ওটা আমি! আমি ধীরে ধীরে আমার হাত তুলে দেখি—আঙুলগুলো যেন বদলে গেছে। আমি আয়নায় দেখি না, শুধু অনুভব করি—আমি আর অমিত নেই, তবে এখনও পুরোপুরি ফকির আবদুল হাইও নই। একটা সেতুবন্ধ, একটা প্রবাহের মধ্যে আছি আমি। পাশেই তখন ভেসে আসছে দোতারার সুর—
"এই জগতের সাধনভজন,
যদি না করে আপন মন,
তবে সে মানুষ কিসে রে?"
আমি ধীরে ধীরে বসে পড়ি মাটিতে। চোখে জল। এই প্রথম বুঝতে পারি—আমি হারাচ্ছি, কিন্তু ভাঙছি না; বরং গড়ে উঠছি।
সকালে আমির ভাই বললেন,
— “চল, এবার ফিরি। যে জন্য এসেছিলে, তার শুরু তো হলো। এখন বাকিটা নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে।”
আখড়া ছাড়ার সময় মনে হচ্ছিল আমি একটা শরীর রেখে যাচ্ছি, একটা জীবনের গন্ধ ফেলে যাচ্ছি এই মাটিতে।
ঢাকায় ফেরার সময় গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। দূরের মাঠ, গাছ, হাট-বাজার, মানুষ—সবকিছু যেন একটু অন্যরকম লাগছিলো।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি কয়েকটা মিসড কল। একটার পাশে নাম লেখা: মাহি। বুকটা কেঁপে উঠলো। আমি ফোনটা হাতে নিয়েই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। আকাশ তখন মেঘলা, যেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না—বৃষ্টি হবে কিনা।
কিন্তু আমার ভেতরটা জানে—একটা ভাঙনের মৌসুম শেষ হলো। এখন গড়ে উঠার সময়। বাস তখন ময়মনসিংহ পার হয়ে এসেছে। জানালার বাইরে ধানক্ষেত, ছেলেমেয়েদের ক্রিকেট খেলা, ছোট ছোট দোকান—সব একরকম ঝাপসা লাগছিল। হঠাৎ করেই মনের পর্দায় ভেসে উঠলো এক বিকেলের স্মৃতি—শেরপুরের।
সেদিন বিকেলটা ছিল একেবারে নিরিবিলি। হালকা বৃষ্টির পর সবকিছু ছিল ভেজা, নরম, ধুলোহীন। আমি আর অজান্তা শহরের পুরনো রাস্তায় রিকশা করে ঘুরছিলাম। নতুনবাজার হয়ে কালীবাড়ি, তারপর শহরের শেষ প্রান্তে একটা পুকুরঘাট। রিকশা চলছিল ধীরে ধীরে। রিকশাওয়ালাকে আমরা বলেছিলাম, "মামা, দ্রুত না, আস্তে চালান।"
অজান্তা আমার পাশে বসে ছাতা ধরে রেখেছিল, আমাদের দুজনের মাথার ওপর। এক হাত দিয়ে ছাতা, আরেক হাত আমার হাতের ওপর রাখলো। আমি তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। ভেজা চুল গালের পাশে লেপ্টে গেছে, চোখে মৃদু পানি জমে আছে বৃষ্টির ফোঁটা না চোখের জল—বুঝিনি। সে হেসে বললো,
“তুমি জানো? এই শহরটা খুব নিরীহ। কিন্তু তোমার পাশে থাকলে সব শহর আমার পক্ষে হয়ে যায়।”
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম,
— “শহর কি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে হয় নাকি?”
সে বললো,
“হয়। মানুষের মন বুঝলে শহরও বদলায়। তুমি পাশে থাকলে, অচেনা রাস্তা আমার জন্য গানের মত হয়। আর তুমি না থাকলে—চেনা রাস্তাও কেমন খালি খালি লাগে।”
আমি তখন ওর হাত চেপে ধরলাম।
— “তুমি কখনো খালি থাকবা না, কথা দিচ্ছি।”
সে একবার আমার কাঁধে মাথা রাখলো। বললো,
“তুমি যদি কখনও জীবনে ক্লান্ত হয়ে পড়ো—সব ছেড়ে-ছুড়ে দিতে ইচ্ছে করে—এই শহরে চলে এসো। আমি রিকশা করে তোমাকে পুরো শহরটা আবার ঘুরিয়ে দেখাবো। পুকুরঘাটে বসবো, দোকান থেকে ঘুগনি খাবো, আবার হেসে উঠবো।”
আমি বলেছিলাম,
— “আর যদি আমি না আসি?”
সে বলেছিলো,
“তাহলে আমি প্রতি শুক্রবার রিকশায় করে ঘুরবো, এই আশায় যে তুমি হয়তো হঠাৎ চলে আসবে। একদিন ঠিক দেখা হবে।"
রিকশা তখন কালীবাড়ি মোড় ঘুরছিলো। আমরা দুজনই চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার হাত তখনও ওর হাতে। শহরটা সেই মুহূর্তে যেন আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো—সময় থেমে ছিলো।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছিলো, ছাতায় কাজ হচ্ছেনা। আমি অর্ধেক ভিজে গিয়েছি। অজান্তার আমাকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। আমি কিভাবে ঢাকা ফিরবো, সেই সাথে বৃষ্টিতে ভিজলেই আমার জ্বর হয় সেকথা অজান্তা জানে। রিক্সা সাইডে থামাতে বলে অজান্তা রিক্সাওয়ালাকে বললো, "মামা প্লাস্টিক দেন, আমার অমিত ভিজে যাচ্ছে" রিক্সাওয়ালা রিক্সা থামিয়ে প্লাস্টিক বের করে আমাদের ঢেকে দিলো। রিক্সাটাকে একটা ছোট্ট খুপরি ঘরের মত লাগছে যেখানে আমরা দুইজন জড়োসড়ো হয়ে বসে আছি। আমার মধ্যে অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করলো। জীবনে প্রথম কোন মেয়ের সাথে এমন মুহূর্ত।
বাতাসের সাথে বৃষ্টির ঝাপটা আমাদের মুখে লাগছে। আমার চশমা ভিজে ঘোলা হয়ে গেছে, সামনে কিছুই দেখছি না। অজান্তা আমার দিকে ভীষণ মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে। সে হাত দিয়ে আমার চশমা খুলে ফেললো। আমি ডান হাতটা অজান্তার পিঠের পেছনে নিয়ে তাকে ধরে রাখলাম। অজান্তা আমার বুকের কাছে এসে মাথা রাখলো। আমি ওর কপালে চুমু দিলাম। নিজেকে তখন এই খুপরি ঘরের প্রিন্স মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এক বিকেলের বৃষ্টিভেজা কোন সিনেমার দৃশ্যের নায়ক।
অজান্তা আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
— একটা কথা বলি অমিত?
আমি অজান্তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলি,
— বলো পাগলী।
অজান্তা আমার গালটা দুই হাত দিয়ে ধরে বলে,
— তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, এই জীবনটা তোমাকে ছাড়া ভাবতে পারিনা। তোমাকে আমার লাগবেই লাগবে।
অজান্তা এত সুন্দর করে কথাগুলো বললো আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এর উত্তর কিভাবে দিতে হবে বুঝতে পারছিলাম না। আমি অজান্তার মাথায় হাত বুলিয়ে আধো ভেজা চুলগুলো ঠিক করে দিলাম। কানের উপরে উঠা চুলগুলো কানের পেছনে ঠেলে দিতে দিতে বলি;
— আমি তোমার সারাজীবনের সেই দায়িত্বটা নিতে চাই। তোমাকে আমি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসি।
অজান্তা আমার টি-শার্টের কলার ধরলো এবার। আমার ঘাড়টা নিজের কাছে টেনে আনলো। তারপর মাথাটা উঁচু করে আমার ঘাড়ে একটা চুমু খেলো। আমি কিছুটা অবাক হয়ে তাকালাম। অজান্তা লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলো। জিজ্ঞেস করলাম;
— ঘাড়ে কেন?
অজান্তা হেসে দিলো। তারপর বলে;
— কারন তোমার ঘাড়টাই আমার সবচেয়ে পছন্দের। তোমার ঘাড়ে ঝুলে থাকতে চাই সারাজীবন। আর তোমার ঘাড়ত্যাড়া যে স্বভাব আছে তা আদর করে করে কমিয়ে দিবো।
আমি হাসতে লাগলাম। রিক্সা তখন কলেজ গেটের কাছাকাছি। বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কমে এসেছে। ফুটপাতে মানুষজন দোকানের সামনে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করছে। শহরের রাস্তায় পানি জমে যাচ্ছে। আমাদের এসব দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমরা তখন ডুবে আছি ভালোলাগার মহেন্দ্রক্ষনে।
অজান্তা আমার ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমাকে বলে;
— আমার এখন কি ইচ্ছে করছে জানো অমিত?
আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বললাম;
— কি?
অজান্তা আমার দিকে ফিরে চোখ বড় বড় করে বলে;
— আমার ইচ্ছে করছে কোন একটা ম্যাজিক করে তোমাকে একদম ছোট পুতুলের মত বানিয়ে আমার ব্যাগে ভরে বাসায় নিয়ে যাই। আমার যখন ইচ্ছে করবে তোমাকে ব্যাগ থেকে খুলে দেখবো, ছোঁব, আদর করবো। আবার ব্যাগে ভরে রাখবো। তুমি আমার সাথে সাথেই থাকবে সারাদিন।
আমি ওর বাচ্চামি দেখে হাসি। অজান্তাও হাসে আমার দিকে তাকিয়ে। মাঝেমাঝে অজান্তা বাচ্চাদের মত হয়ে যায়। আহ্লাদ করে, ঢং করে, আমাকে হাসায়, নিজে হাসে। আর মাঝেমাঝে সে হয়ে যায় পাহাড়সম ব্যাক্তিত্ববান। মনে হয় খুব ম্যাচিউর, বড় হয়ে গেছে। তখন আমাকে বুঝায়, জ্ঞান দেয়, বাস্তবতার কথা বলে। অজান্তা সময়, পরিস্থিতি আর শিক্ষায় এতটা পরিপূর্ণ ছিলো যে ওর উপর নির্ভর করা যেতো।
বাসের জানালা দিয়ে হঠাৎ একটা ঠান্ডা বাতাস এসে মুখে লাগলো। আমি আবার বর্তমানে ফিরি। অজান্তার সেই কণ্ঠস্বর, সেই চোখের ভেতরকার আলো, আর সেই রিকশার ছায়ায় ঢাকা বিকেলটা—সব আবারও মনে পড়ে যায়।
আমার চারপাশে এখন শুধু হাইওয়ে, অচেনা মানুষ, আর ছুটে চলা। কিন্তু আমার ভিতরে এখনো সেই শহরের রাস্তায় একজোড়া চুপচাপ প্রেমিক-প্রেমিকার ছায়া রয়ে গেছে। বাস ঢাকার দিকে ছুটছে, আমির ভাই পাশে ঘুমাচ্ছে। জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমি জানিনা। আমি নিয়তির দাস হয়ে যাচ্ছি, সময়ের সাথে সাথে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি।
(অপেক্ষা-ষষ্ঠ পর্ব© শামীম মোহাম্মদ মাসুদ)
©somewhere in net ltd.
১|
২৬ শে মে, ২০২৫ রাত ২:২৪
মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: পর্ব পাঠে ভালো লাগল।