![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইঞ্জিনিয়ার পড়ুয়া ছেলের বাপ পরিচয়ে কতটা গর্ব করা যায়,
সেটা উপলব্ধি করেন গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক মোতালেব মিয়া।
গাঁয়ের হাটে গেলেই মানুষজন এখন তাঁকে হাত তুলে সালাম দেয়।
উচ্চস্বরে ডেকে চা বিস্কিটের নিমন্ত্রন করে।
লোকোগুঞ্জনে নিজের নামের সাথে ইঞ্জিনিয়ার ছেলের নামটাও ভেসে আসে কানে।
যা বছর চারেক আগেও তাঁর কাছে কল্পনাতীত ছিলো।
সবাই তাঁকে ইঞ্জিনিয়ারের বাপ বলে ডাকে। শুনতে বেশ ভালোই লাগে মোতালেব মিয়ার। এই ডাক শুনতেই বোধহয় প্রতিদিন তিনি একবারের জন্য হলেও গাঁয়ের হাটে যান।
নতুন লুঙ্গির খচখচ শব্দে আশেপাশের মানুষের বোঝার বাকী থাকেনা ইঞ্জিনিয়ারের বাপ দপদপিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন!
তাঁর সুযোগ্য পুত্র সাব্বির আহমেদ সুজন এবার বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করছে। ঢাকায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে।
ছেলের গুনে সমাজে মোতালেব মিয়ার পরিবারের একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরী হয়েছে।
মোতালেব মিয়ার দিন বদলেছে সময়ের সাথে সাথে।
পুরনো জামাগুলো এখন ধুয়ে পরিস্কার করে পরেন। ঘরের টিন আগামী বর্ষার আগেই পাল্টাবেন। ছেলে এখন অনেক বড় ইঞ্জিনিয়ার। আর কতো দিন ভাঙ্গা ঘরে থাকা যায়!
গ্রামের মসজিদে ১০০০ ইট অনুদান হিসেবে দেবেন বলে ওয়াদা করে রেখেছেন। মক্তবের হুজুরকে কাল থেকেই তাঁদের বাড়িতে রোজানা খেতে বলবেন ভাবছেন। আরো হাজারো স্বপ্ন জমে আছে গর্বিত পিতা আব্দুল মোতালেবের বুকে।
সব এই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া ছেলে সুজনকেই ঘিরে।
বাপ-দাদার আমলের কিছু জমি জিরাত আছে। তাতে চাষ করে আর মানুষের জমি বর্গা নিয়ে কোন রকম সংসার চালিয়েছেন।
ছেলে ঢাকার একটা নামিদামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করছে। সবাই জানে সরকার তার ছেলের লেখাপড়ার খরচ দিয়েছে। নইলে তার মতো গরীবের পক্ষে কি আর সম্ভব হতো ছেলেকে পড়ানো!
পাশ করা মাত্রই সরকার তাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। তখন আর মোতালেব মিয়ার দুঃখের দিন থাকবে না।
সুজন তার গ্রামের লোকের সরলতায় যতটা মুগ্ধ তার চেয়ে বেশি বিব্রত হয়। সকলের ধারনা সরকার তার জন্য চাকরি নিয়ে বসে আছে!
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলেই দেশে অসংখ্য চাকরির পদ খালি পড়ে আছে যেন।
বলা বাহুল্য,
বাংলাদেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদেরও ন্যুনতম বেতন ধার্য করা আছে কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারদের তা নেই।
এই ধ্রুব সত্যটি গ্রামের মানুষদের বোঝাতে পারেনা সে। পাশ করে বড় ভাইদের সহায়তায় একটি কোম্পানিতে নামে মাত্র বেতনে চাকরি নিয়েছে। মেসে থেকে, খানাখরচ আর যাওয়া আসার ভাড়া দেয়ার পর তেমন কিছু থাকেনা। তাই একটা টিউশন করে মাসশেষে সেই টাকা বাড়িতে পাঠায়।
সুজন এবার ছুটিতে গ্রামে এসেছে।
তার বাবা মা আবার অল্পতেই খুশি হন।
তাই সংসারের জন্য খুব বেশি খরচ করতে হয়না তার।
মাসের মাঝামাঝি অবস্থায় বাড়ি আসায় হাতে পর্যাপ্ত টাকা নেই।
যা টাকা আছে তাতে ঢাকা যেয়ে চলাই কষ্টকর হয়ে যাবে। সংসারের প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটি জিনিষপত্র কিনতে গিয়ে প্রায় সবগুলো টাকাই তার খরচ হয়ে গেল!
ঢাকা ফেরার পথে গ্রামের রাস্তার দুই পাশের চায়ের দোকানগুলোতে নিয়মমাফিক একবার ঢুঁ মেরে যাওয়া লাগে। বাল্যকালের সেই স্কুল পালানো হতভাগা বন্ধুরা যেখানে বসে আড্ডার পসরা বানায়। আনুষ্ঠানিকতার খাতিরে তাদের সাথে কুশল বিনিময় করতে হয়।
চা দোকানে ঢুকতেই সবাই ইঞ্জিনিয়ার এসেছে বলে যোগাড় তোলে। চোখসম্মানের জন্য হলেও রীতিমতো চায়ের অর্ডার দেয়া লাগে। আরো কিছু টাকা খর্চা হয় এখানেও।
গ্রামে আসা মানেই পকেট খালি হওয়া।
তবুও সে অখুশি নয়। তার বাবাকে সন্তষ্ট করতে পেরেছে। গ্রামের মানুষদের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চেষ্টা করেছে।
শেষ পর্যন্ত হাতে রইলো শুধু বাস ভাড়া।
বন্ধুদের আবদারের কমতি নেই। আর একটা দিন থাকলে কিইবা ক্ষতি হতো!
তাদের সেই আবদার রাখার ক্ষমতা নেই সুজনের।
ঢাকায় যেয়ে ঠিক সময়েই অফিস করতে হবে। এমনিতেই বাপের নানা রকম বাহানায় দুই দিন বেশি থেকেছে। অফিসের বস কখন কি বলে বসে কে জানে!
'মরার উপর খাড়া' হয়ে এলো নতুন বিপত্তি।
রাস্তায় গ্রামের মসজিদের ইমামের সাথে দেখা হলো।
ইমাম সাহেব ভ্রু কুঁচকে মুচকি হাসি হেসে ডাক দিলেন।
কি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব,
তোমার বাবা বলেছিলো মসজিদের জন্য কিছু সাহায্য করবে। দীর্ঘদিন যাবত তালিকায় তোমার নামটা পেন্ডিং পড়ে আছে। তা এবার কিছু দিয়ে টিয়ে যাও মিয়া...
সুজনের পকেটে মোট ৭০০ টাকা আছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছিলোনা।
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে ৫০০ টাকা ইমামের হাতে দিয়ে দেয় সে।
বাস স্টেশনে এসে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ইঞ্জিনিয়ার সুজন।
তার শার্টটা প্যান্টের মাঝে গুঁজা।
গা থেকে পার্ফিউমের ঘ্রান আসছে। শার্ট লন্ড্রি করা, জুতা জোড়া কালি করা।
সে একজন ইঞ্জিনিয়ার।
বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক। তার পকেটে বাস ভাড়া নেই।
মাস চলার টাকা নেই। চাকরির কোন নিশ্চয়তা নেই।
উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে সুজন ভাবে,
কি লাভ হলো এই লোমের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে!
©somewhere in net ltd.