নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ইদের শুভেচ্ছা

শামীম শাহ

শামীম আহমেদ

শামীম শাহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাল্যবিবাহ

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৫৩

২০০৭ এর দিকের ঘটনা।
আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে কীভাবে বাল্যবিবাহ রোধে সমাজে জনসচেতনতা বাড়ানো যায়, এই বিষয়ে ভাবছি।
একেক বন্ধু একেক রকম বুদ্ধি নিয়ে আসছিলো।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আইডিয়াটা ছিলো দলবদ্ধভাবে বাল্যবিবাহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বিবাহ বন্ধ করে দেয়া।
কিন্ত সেজন্য সর্বপ্রথম আমাদের দলবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।
শুধু বাল্যবিবাহ নয়, সমাজকে যৌতুকপ্রথার কবল থেকেও মুক্ত করা জরুরী। পাশাপাশি গরীব পরিবারের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় উৎসাহী করতে আর্থিক সহায়তা এবং অন্যান্য নানাবিধ পরিকল্পনাও আমাদের কার্যক্রমের তালিকাভুক্ত ছিলো।
এছাড়াও পরিবেশ বান্ধব গাছ লাগাতে মানুষকে উৎসাহী করা, ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা, বেসরকারী স্কুলগুলোতে শহীদ মিনার তৈরী করে দেয়া ইত্যাদি।

সম্পুর্ণ আমার ব্যক্তিগত উদ্যেগে একটা সংগঠন গড়ে তুললাম সুর্যমুখী নামে। সংগঠনের আদর্শ উদ্দেশ্য এবং আমাদের সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম দেখে এলাকার তরুনরা আগ্রহভরে যোগদান করতো প্রতিদিন।
আমাদের মূল মুভমেন্টটা ছিলো যৌতুক প্রথা বন্ধ করা এবং বাল্যবিবাহ রোধ করা।

ঠিক সেই সময়ে দেশের কোনো এক জেলায় চাঞ্চল্যকর একটি বাল্যবিবাহের ঘটনায় মিডিয়াজুড়ে মোটামুটি আলোচনা চলছিলো। সেটা দেখে আমরা আরো অনুপ্রাণিত হলাম।
পুর্বে সংগঠিত হওয়া বালহ্যবিবাহগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে এলাকাভিত্তিক জরিপ অনুযায়ী আমরা তাদের পরিচয়সহ একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে বিস্তারিত লিখতাম। এতে করে পরিবারগুলো যেমন লজ্জিত হতো, একইভাবে এই বিষয়টা সম্ভাব্য বাল্যবিবাহগুলো রোধেও ব্যাপক ভুমিকা রেখেছিলো। এটা সম্ভব হয়েছিলো আমাদের অভিনব প্রচারব্যাবস্থার কারনেই মুলত।
শুধু পত্রিকায় লিখেই আমরা থেমে থাকিনি। লিফলেট, ব্যানার ইত্যাদি মাধ্যমেও আমরা এসবের বিরুদ্ধে প্রচারনা চালিয়েছিলাম।
সেই বছরের (২০০৭) আমরা মোট নয়টি বাল্যবিবাহের উপর জরিপ করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করেছিলাম।
যে বিবাহগুলোতে মাত্র একবছরের মাথায় বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক সমস্যা তৈরী হয়েছিলো। এদের মধ্যে সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যু হয়েছিলো দুজনের। বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে তিনটি। বাকি পরিবারগুলোতেও নানান সমস্যা/জটিলতার তথ্য পাওয়া গিয়েছিলো।

আমরা পোস্টারে লিখে রেখেছি যে,
কোথাও বাল্যবিবাহ হচ্ছে এমন কোনো সংবাদ পাওয়া মাত্রই যাতে আমাদের জানানো হয়।
লোকাল থানার নির্বাহী অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে আমরা হাজির হয়ে যাবো।
যোগাযোগের জন্য আমাদের ক্লাবের প্রচার সম্পাদক/আর সভাপতির কন্টাক্ট নাম্বার দেয়া ছিলো।

খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। প্রচারের সুব্যবস্থার কারনে পুরো এলাকাজুড়ে আমাদের সংগঠনের নাম ছড়িয়ে পড়লো।
এরই মধ্যে গোপনসুত্রে আমরা একটি সংবাদ পেলাম যে, আজ রাত বারোটা নাগাদ অমুক বাড়িতে বিনাআয়োজনে শুধুমাত্র পারিবারিকভাবে একটি বিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পাত্রী এস এস সি পরীক্ষার্থী। বিপত্নিক পাত্রের এটি দ্বিতীয় বিবাহ।
শুধুমাত্র অর্থলোভে, মেয়ের ভবিষ্যত সুখের আশায় পাত্রীর পরিবার নিজেদের আদরের কন্যাকে একটা বুড়ো ভামের হাতে তুলে দিচ্ছে!
আমরা ঠিক সময়েই সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম। আরেকটু দেরী করলেই বিয়ের কাজটি সেরে যেতো। তখন জোরপুর্বক বিয়ে বন্ধ করলেও মেয়েটির উপর একটি সামাজিক কলংক লেফটে যেতো,
‘আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো’
সংসার হয়েছে কিনা সেটা মুল ব্যাপার নয়। এই পরিচয়ে ছেলেদের মধ্যে তেমন প্রভাব পড়েনা।
আমাদের দেখে তাদের চিনতে তেমন অসুবিধে হয়নি। মেয়ের বাবা টের পেয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে আমতা আমতা করে অনুরোধ করছিলেন তিনি বিবাহ বন্ধ করবেন। কিন্ত এই বিষয়টা কোনোভাবে প্রকাশ না করার অনুরোধ জানালেন। কথাগুলো তিনি লজ্জিতমুখেই বলছিলেন।
অতঃপর পাত্র এবং পাত্রের অভিভাবকদের ডেকে এনে আমরা বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে তাদের নসিহত করছিলাম।
আইনের ভয় দেখালাম। বিগত বছরে সংগঠিত নয়টি বাল্যবিবাহের পরিণাম সম্পর্কে বিস্তারিত জানালাম।
তারাও মোটামুটি লজ্জিত হয়ে বিবাহ বন্ধের পক্ষে রাজী হলো।
এরপর পাত্রীকে ডেকে আনা হলো।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম.... আমরা সবাই একে অন্যের দিকে দেখছি।
রাজকন্যার মতো এমন সুন্দরী একটা মেয়েকে এই বিবাহিত বুড়ো ভামের সাথে বিয়ে দেয়া হচ্ছে!!
এরা সংসার করবে... এই মেয়ে সংসারজীবনে বাপের বয়সী এই লোকটার সঙ্গে সুখে থাকবে?
লোকটার প্রতি তার মনে ভালোবাসা তৈরী হবে কোনোদিন?
মনে হয়না।
এটা রীতিমতো অন্যায়।
আমাদের কথোপকথনের এক পর্যায়ে পাত্রীর মা এসে বিতর্ক শুরু করে দিলেন। বিয়ে বন্ধ করা যাবেনা।
আমাদের মেয়েকে আমরা বিয়ে দিচ্ছি আপনারা বাধা দেয়ার কে !
তাইতো...
আমরা বাধা দেয়ার কেউ না।
আমরা এসেছি মানবিক বিবেচনায়। এখানে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। একটি অবুঝ মেয়ের পক্ষে কথা বলতে এসেছি। যে আদৌ জানেনা আজ তার ভাগ্যে কী ঘটতে চলেছে!

কিন্ত মেয়ের মা নাছোড়বান্দা। তিনি জোরগলায় কথা বলে লোক জড়ো করছিলেন।

আমাদের প্রচার সম্পাদক শিহাব তাঁকে এক পাশে ডেকে নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিকে পাত্রপক্ষের সবাই আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। মেয়ের বাবা আমাদের জন্য চা বিস্কিট নিয়ে এলেন। তিনি নিজেও আমাদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন।

কিছুক্ষন পর দেখলাম মেয়ের মা হাসিমুখে আমাদের জন্য পানের বাটলা নিয়ে এলেন। সাথে প্রচার সম্পাদক শিহাব। তার চেহারাতেও হাসির ঝলকানি।
এতোকম সময়ে ক্ষোভের চেহারায় হাসি কীভাবে ফুটলো তা ভেবে আমরা চিন্তায় পড়ে গেলাম। যাই হউক, চা-পান খাওয়া শেষে আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

মহিলার সেই হাসির রহস্য জানা গেলো তিনমাস পর। তার কন্যাকে বিয়ের জন্য শিহাব নিজেই প্রস্তাব দিয়ে এসেছে!!
সে আমার ভয়ে সেদিন কাউকে কিছু জানায়নি।

তবে তাদের বিয়েটা হবে ঠিক দুইবছর পর। তার আগে অ্যাঙ্গেইজমেন্টও হবেনা।
কারন তা করলে রুল ভঙ্গের দায়ে আমরা সবাই তার সঙ্গ ত্যাগ করবো... তাকে শাস্তির আওতায়ও আনা হতে পারে।
সেটা সে ভালো করেই জানে!

শিহাবের এই আচরণে অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিলো। সেজন্য ক্লাবের অ্যাক্টিভিটি দিনদিন কমতে শুরু করেছিলো।
এসব দেখে আমি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি এবং একবছরের মাথায় আনুষ্ঠানিকভাবে ক্লাবটি বন্ধ করে দেই। সুনাম অক্ষুন্ন থাকতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।
আর তাই আজও সমাজে কোনো দুর্নীতি অনিয়ম হলে আমাদের সংগঠনের নামটি মানুষের মুখে মুখে আলোচিত হয়।

আমরা শুধু আমাদের এলাকায় জনসচেতনার জন্য এমন উদ্যেগ হাতে নিয়েছিলাম। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রতিনিয়তই তো ঘটছে এমন অসংখ্য ঘটনা।
কেউ এসব নিয়ে ভাবেনা। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর মিডিয়াপর্যন্তই শেষ।
সব ঘটনা তো মিডিয়ায় আসেনা !

সচেতন ব্লগাররা/ফেসবুকাররা যদি দলবদ্ধভাবে নিজ নিজ এলাকায় এমন ছোটখাটো সংগঠন তৈরী করে জনসচেতনা তৈরী করে, নিশ্চিতভাবে বলা যায় দেশে বাল্যবিবাহ কমবেই !
বর্তমানে ফেসবুক যোগাযোগের সবচেয়ে সহজ মাধ্যম।
আমাদের মতো ক্লাব সংগঠন করার প্রয়োজন নেই। ইচ্ছে থাকলে ভার্চুয়াল সংগঠনও তৈরী করা যায়। শুধু চাই আন্তরিক প্রচেষ্টা...

এতে করে শুধু বাল্যবিবাহই নয়, যৌতুকপ্রথাসহ অন্যান্য সামাজিক অনিয়মগুলোও কমে যাবে।
প্রয়োজন শুধু কয়েকজন সৎ, একনিষ্ঠ দেশপ্রেমী যুবক।
তবে খেয়াল রাখতে হবে,
সেসব দলে/সংগঠনে কোনো 'শিহাব' যাতে না থাকে !!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.