নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিলাসপুরের শেষ ট্রেনটা ছেড়ে গেছে একটু আগে...

© এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের। তাই লেখকের অনুমতি ব্যতীত অন্য কোন প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে ব্যবহার না করার অনুরোধ রইল...

shapnobilash_cu

তোমাকে দেখার মতো চোখ নেই- তবু, গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই- তুমি আজো এই পৃথিবীতে র'য়ে গেছো কোথাও সান্ত্বনা নেই, পৃথিবীতে আজ; বহুদিন থেকে শান্তি নেই... facebook.com/shapnobilash

shapnobilash_cu › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিঃসঙ্গ শেরপা (প্রথম পর্ব)

০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:৩৩





আড়াই ঘন্টা ধরে বসে আছি কাস্টমস্‌ হাউজের ক্লিয়ারিং সেলে। কমিশনার সাহেবের ডাক পড়ার নাম নেই। চায়না থেকে ৬০ কন্টেইনার রিচার্জেবল ফ্যানের প্রথম চালান আটকে গেছে। কাগজপত্র সব ঠিকই আছে। কিন্তু সবকিছু ঠিক থাকার পরও চালান আটকে দেওয়ার কারণ বুঝতে পারছিনা। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, তারপরও দরদর করে ঘামছি। এল. সি পেপারে চালান আটকে দেয়ার বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। রিমার্কের ঘরে মোটা কালির কলমে শুধু লেখা আছে, “চালান গ্রহীতাকে সশরীরে সাক্ষাত করার অনুরোধ করা হচ্ছে।” সাক্ষাতের উদ্দেশ্য আমি বুঝি। এই ইউনিটে নতুন কমিশনার এসেছেন, তার সংগে নতুন করে পরিচিত হতে হবে। আর পরিচিতির অর্থই হচ্ছে হাতিয়ে দেওয়া। দ্যাশটা গেছে, এক্কেরে রসাতলে গেছে। যে যারে যেভাবে পারে হাতিয়ে দিচ্ছে। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, বিচারপতি, পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা-যে যাকে পারছে হাতিয়ে নিচ্ছে। শালা চোরের দল সব।



এই চালানের জন্য আগের কমিশনারকে মাসোহারা দেয়া হয়েছে। তাই দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই যদিও, তবু টেনশান হচ্ছে। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। ঘুষের দর-দাম না মিললে দুইজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কন্টেইনার খোলা হবে, তারপর দেখা যাবে ব্রাউন কালার কার্টুনের ভেতর সানকা ব্র্যান্ডের রিচার্জেবল ফ্যানের পরিবর্তে আছে ইয়াবা ট্যাবলেট! স্ট্রবেরী ফ্লেভারের ইয়াবা ট্যাবলেট। ট্যাবলেটের গায়ে চাইনিজ অক্ষরে ছোট ছোট করে লেখা থাকবে হুং চুং পং, যার বাংলা অর্থ হতে পারে- “খাইলেই ভালো লাগে”!!



কাস্টমস্ হাউজে টাকা দিয়ে সব হয়। টাকা ঢালতেও আমার আপত্তি নাই। কিন্তু শার্টের চেয়ে গেন্জি বড় হয়ে গেলে সমস্যা। অলরেডী অনেক টাকা ঢেলে ফেলেছি যাতে ফ্যান আমদানীর জন্য আর কেউ এলসি খুলতে না পারে। ৬০ কন্টেইনারে ৬০ হাজার পিস্‌ ফ্যান থাকবে। ৬০ হাজার পিস্‌ ফ্যানে এইবারের গরম পার হয়ে যাওয়ার কথা। কেনেডি কোম্পানী আমার ফ্যান তৈরী করতে করতেই এই সীজন শেষ। আর কেউ চাইলেও আমদানী করতে পারবেনা। সব হিসাব ঠিক থাকলে ২৪ কোটি টাকার চালানে সাড়ে তের কোটি টাকা লাভ হওয়ার কথা। এখন সমস্যা হলো ঘুষের রেট না মিললে সব হিসাব মেলানো যাবে না শেষ পর্যন্ত।



আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতেই কমিশনার সাহেবের রুম থেকে ডাক পড়লো। মনে মনে আমি “চ” অক্ষরের একটা গালি দিয়ে ফেললাম। শালার ব্যাটা কমিশনারের জন্য শ্যালিকার বাসায় দাওয়াত খেতে যেতে পারবনা। অলরেডি ৪৫ মিনিট দেরী হয়ে গেছে। ডাক পেয়ে রুমে প্রবেশ করলাম। এয়ার কন্ডিশন্‌ড রুম। বিশাল বিশাল জানালাগুলো সাদা পর্দা দিয়ে ঢাকা। বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল, টেবিলের সামনে দুই সারি চেয়ার পাতা। সবকিছু খুব পরিপাটি করে সাজানো। সরকারী অফিস এত গোছানো হওয়ার কথা না। কমিশনার সাহেব উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে কেবিনেট থেকে ফাইল বের করছেন।



কমিশনার সাহেবের মাথার উপর দেয়ালে ঝুলানো থাকা চার্টারের দিকে তাকালাম। এই হাউজে যতজন কাস্টম্‌স কমিশনার কাজ করেছেন সবার নামের তালিকা দেখা যাচ্ছে। মোট সতের জন। সবার শেষে লেখা আছে “১৭. শের শাহ্‌, পিএইচ.ডি (ট্যাক্সেশান এন্ড ফিস্‌কাল পলিসি)”।



আমার পায়ের শব্দে পেঁছনে তাকালেন। আমার চোখ ছানাবড়া। যদি ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে কমিশনার সাহেব আর কেউ নন, আমাদের “শের শাহ্‌”।



বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। চোখ বড় বড় করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ভুল দেখছি নাতো? আমার বিস্ময় সম্ভবত তিনি বুঝতে পারলেন, ইশারায় বসতে বললেন। তবু আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। বুঝতে পারছি শরীর খানিক ঠান্ডা হয়ে গেছে।



- শের শাহ্‌...

: নাহ্‌ গিয়াস ভাই, সোয়া শের শাহ্‌!!



ওর নাম যদিও শের শাহ্‌, ওকে আমরা আদর করে সোয়া শের শাহ্‌ ডাকতাম। পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতার কারণেই সেরের উপরে সোয়া সের, সেই হিসেবে শের শাহ্‌ থেকে সোয়া শের শাহ্‌। শের শাহ্‌ আমার তিন ব্যাচ জুনিয়র। ঢাবিতে একসংগে পড়েছি। আমি ছিলাম পলিটিক্যাল সায়েন্সে, ও ইকোনমিক্সে।









কিছু বুঝে উঠার আগেই ও আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরলো। মুহুর্তেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো, বুঝতে পারছি চোখটা ভিজে উঠছে। এভাবেই কেটে গেল কিছুক্ষণ।





৮২-৮৩ সালের কথা। ২৫/১ জিগাতলা, ধানমন্ডির একটা মেসে আমরা ৭ জন ঢাবি স্টুডেন্ট থাকতাম। এক বড় ভাইয়ের রেফারেন্সে শের শাহ্‌ আমাদের মেসে উঠেছিল। সাত জন থেকে হয়ে গেলাম আট জন। ঢাবি’র ইকোনমিক্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র শের শাহ্‌। সবার চেয়ে একটু আলাদা, একটু অন্য রকম। আমরা সাতজনের সবাই কমবেশি পলিটিক্সের সাথে জড়িত ছিলাম। শুরু থেকেই শের শাহ্‌ রাজনীতি থেকে নিজেকে সযতনে দূরিয়ে সরিয়ে রেখেছে। পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ছিল ও। ভার্সিটির ক্লাস শেষে তিন-চারটা টিউশনি, পড়াশোনা-এই ছিল ওর জীবন। বিনোদন বলতে প্রচুর বই পড়া আর পত্রিকায় টুকটাক লেখালেখি। ফলাফলও খুব ভাল, যথারীতি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। অনার্স মাস্টার্স দুইটাতেই। একটু একরোখা আর খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিল ও। বড়দের যথেষ্ট সম্মান করতো। আমরাও আদর করতাম। আদরক করে রিয়াজই ওর নাম দিয়েছিল সোয়া শের শাহ্‌। কেউ কেউ বলতো “মাল”। অর্থনীতি, সাহিত্য, সংগীত, দর্শন, রাজনীতি-সব বিষয়েই দারুণ জ্ঞান ছিল ওর, এজন্যই মাল উপাধি!! মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে টেবিল চাপড়ে সুন্দর ফোক গান গাইতো। ভাল কবিতা লিখতো। ওর একটা ভয়াবহ দোষ ছিল, সহজে রেগে যেত। হুটহাট প্রচন্ড রেগে যেত। রাগ পড়তেও সময় লাগতো না অবশ্য। ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের শের শাহ্‌ খুব শৃঙ্খলিত জীবন যাপন করতো।



ছবির মত একে একে সব মনে পড়ে গেল আমার। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় সবাই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। আমি আর রিয়াজ জেলে গেলাম। এরশাদ সরকারের পতনের পর কমবেশি সবাইকেই খুঁজে পেলেও শের শাহ্‌-এর খবর কেউই দিতে পারেনি। এত বছর পর আজই প্রথম ওকে দেখলাম।

- আছেন কেমন শের শাহ্‌?

: হা হা হা। আপনি আমাকে আপনি আপনি করছেন কেন গিয়াস ভাই??

- না মানে তুমি... কি খবর তোমার? এত বছর কোথায় ছিলে? কেমন আছো?

: হ্যাঁ, অনেকগুলাআ বছর। কত কী ঘটে গেল, কত কিছু বদলে গেল এই সময়ের মাঝে। মানুষের মাঝেই ছিলাম গিয়াস ভাই। ভাসতে ভাসতে এখন এই সাগরের পাড়ে কাস্টম্‌স হাউজেই আছি। আর কেমন আছি...? সেটা নিয়ে আসলে ভাবিনি। ভেবে বলতে হবে।



বেশ কয়েকজনের কাছে শুনেছিলাম, প্রেম সংক্রান্ত একটা বিষয়ে অনেক বড় ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিল শের শাহ্‌। পরে কিভাবে কিভাবে নাকি উতরে গেছে। কেউই অবশ্য বিস্তারিত বলতে পারেনি।



: আপনার কি খবর গিয়াস ভাই?

- এই তো আছি। বাপের ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবসা নিয়েই আছি। তিনপুলের মাথায় কয়েকটা দোকান আছে। ঢাকার পাটুয়াটুলিতেও একটা দোকান আছে। চায়না থেকে টুকিটাকি ইলেট্রিক-ইলেক্ট্রনিক্স প্রোডাক্ট আমদানী করি। এই আর কী। কোন রকম যায় যায় দিন।

: ২৪ কোটি টাকার এলসি, আর বলছেন টুকিটাকি? মিয়া মজা লন নাকি?

- আর মজা! শোন, অনেক বছর পর দেখা। ফ্রী হবা কখন? সময় থাকলে চলো, বাইরে বের হই।

: হুমমম... বাইরে বের হবো বলেই আপনাকে বসিয়ে রেখেছি। খানিকটা সারপ্রাইজও বলতে পারেন। আমি শুনেছি আপনি চট্টগ্রামেই সেটেল্‌ড হয়েছেন। কিন্তু স্পেসিফিক কেউই বলতে পারেনি ঠিকানা। তেমন কারো সংগে অবশ্য আমি যোগাযোগও রাখিনি। এল. সি’তে নাম ঠিকানা দেখেই কিছুটা অনুমান করলাম। বাকীটা খোঁজ-খবর।



- আর সারপ্রাইজ!! সুপার সারপ্রাইজ। এখন বের হও। চলো পতেঙ্গা যাই।

: হুমমম... ১০ মিনিট সময় দেন। কিছু সাইনিং শেষ করেই বের হবো। এই ফাঁকে আরেক রাউন্ড কফি খান।



আমি কফিতে চুমুক দিচ্ছে। বিস্ময় তখনো কাটেনি। শের শাহ্‌ কাগজপত্রে সই করছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। তারপর নিজেই কলম, পেন্সিল, ফাইল-পত্র সব গুছিয়ে রাখলো টেবিলের উপর। ছেলেটা আগের মতই আছে মে বি। গোছানো, শৃঙ্খলিত।



আধা ঘন্টা পর আমরা বের হলাম। অফিসের গাড়ি ছেড়ে আমার গাড়িতেই পতেঙ্গা যাচ্ছি। রাস্তা ফ্রী। জ্যাম নেই। দুজনেই নির্বাক বসে আছি। কম করে হলেও ২০ বছর পর দেখা। চেহারায় বয়সের ছাপ ছাড়া তেমন কোন পরিবর্তন নেই। মেদ জমেনি শরীরে। চশমা ও আগেই পড়তো। শুধু লেন্সগুলো আরেকটু মোটা হয়েছে হয়তো। ধবধবে ফর্সা শার্ট আর কালো ব্লেজারে ভালই স্মার্ট লাগছে ওকে। ও হ্যাঁ, আরেকটা পরিবর্তন হয়েছে ওর, আগে সিগারেট খেতনা, এখন খায়। ভালই খায়। গাড়িতে উঠার পর একটার পর একটা সিগারেট জ্বালাচ্ছে। চেহারায় কিছুটা চাপা বিষন্নতার ছাপ কি আছে??



: পতেঙ্গা ক্রাউডি, তারচেয়ে চলেন নেভাল এভিনিউতে যাই।

নীরবতা ভেঙ্গে কথা বলা শুরু করল শের শাহ্‌।

- নেভালে যাবা? ওকে, চলো সমস্যা নাই।

: গিয়াস ভাই, আপনি কিন্তু আমাকে তুই করে বলতেন।



নিজেই কিছুটা লজ্জিত হলাম। কত বছর আগের কথা!! আমি আর রিয়াজ ওকে খুব আদর করতাম। জুনিয়রদেরকে তুই করেই বলতাম সবাই। ওর কথায় ওর দিকে আরেকবার তাকালাম।



- তারপর বল, কি খবর? এত বছরে বে-খবর ছিলি কেন? কি করলি একা একা এতগুলো বছর??

: হুমমম... এতগুলো বছর! অনেকটা সময় গিয়াস ভাই। কেটে গেল আর কী!! কত ঘটনা-দুর্ঘটনা, কত নাটকীয়তা! জীবনটাই যেন কেমন গিয়াস ভাই!! কত কিছু ঘটে গেল। জীবনটাকে কেমন করে ভেবেছিলাম, আর কী-ই-বা হলো!! ভাল্লাগেনা গিয়াস ভাই। এজন্যই ডুব দিয়েছিলাম, একলাই ছিলাম, তারপর আয়োজন করে আবার একলা হলাম...



এতটুকু বলেই চুপ হয়ে গেছে। ওর কথায় বিষন্নটা স্পষ্ট। মানুষের গোপন কষ্টের সাক্ষী হতে নেই। কিন্তু ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ভয়াবহ কোন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি।



রাস্তা ফাঁকা পেয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম। দশ মিনিটের মধ্যেই নেভাল। গাড়ী পার্ক করে রাস্তার পাশের সিমেন্ট রেলিং এর উপর বসলাম আমি। শের শাহ্‌ দাঁড়িয়ে আছে সাগরের দিকে তাকিয়ে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। চোখে উদাস দৃষ্টি। যেন জনম জনমের উদাসীনতা ভর করেছে দু’চোখ জুড়ে।

- শের শাহ্‌...

: বলেন ভাই।

- কথা বলবি বলে আসলি, চুপ করে আছিস কেন? বল কেন এমন ডুব দিয়ে ছিলি, কেমন ছিলি এতদিন?



আমার কথায় শুকনো হাসি হাসলো ও। জ্বলন্ত সিগারেট পা দিয়ে পিষতে পিষতে আবার বলা শুরু করল।

: সে অনেক কথা গিয়াস ভাই। কথা বলা শুরু করলে রাত ফুরিয়ে যাবে।

- আরে মিয়া শুরু করো আগে। রাত হলে হবে, প্রয়োজনে আমার সংগে থাকবি আজকে। বউ গেছে ঢাকায়। বাসা ফাঁকা। দু'জনে জম্পেশ আড্ডা দেব সারা রাত। ভাবীকে ফোন করে বলে দে যে ফিরতে দেরী হবে।

: ভাবী আসবে কোথা থেকে....



কথা শেষ না করেই শের শাহ্‌ শব্দ করে হেসে উঠলো। ওর হাসি শুনে বুকটা কেমন জানি করে উঠলো আমার। এটা স্বাভাবিক মানুষের হাসি না। এই হাসির মাঝে অদ্ভূত এক শূন্যতা আছে। আছে হাহাকার। আমির ওর কাঁধে হাত রাখলাম। পাশে বসালাম। কিছু ভাল লাগছে না আমারও।



- মিথিলার কথা আপনার মনে আছে গিয়াস ভাই?



ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শুকনো মুখ। ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেট। এই মুহূর্তে একটা মিথিলার কথাই মনে পড়ছে, সেটা তাহ্‌সানের বউ। ও হ্যাঁ, আরেকটা মিথিলার কথা মনে আছে, প্রাচীন ভারতবর্ষে মিথিলা নামে একটা জায়গা ছিল। মিথিলায় একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন, কবি বিদ্যাপতি। বাঙলার ছেলেরা মিথিলায় যেত, আর বুক ভরে নিয়ে আসতো বিদ্যাপতির কবিতা।



- কোন মিথিলার কথা বলছো? ভার্সিটির কেউ?

: নাহ্‌... ঐ যে পত্রিকায় আমার লেখা পড়তো... আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতো...



হ্যাঁ, এতক্ষণে মিথিলার কথা মনে পড়েছে আমার। পত্রিকায় গল্প-কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল ওর। নিয়মিত প্রকাশিতও হতো সেসব। আমরা সবাই সাগ্রহে পড়তাম। ওকে উতসাহ দিতাম। লেখার হাতও বেশ ছিল। তখন চিঠি-পত্রের যুগ। অনেকেই চিঠি লিখতো। সবই কিশোরী-তরুণী মেয়ে। একেকটা চিঠি এলে শের শাহ্‌ শুধু আমাকেই দেখাতো, চুপিচুপি দরজা বন্ধ করে। আমি মজা করে বলতাম, প্রেম করস না ক্যান ব্যাটা? এত ফ্যান তোর। প্রেম কর। ও লজ্জা পেত। এমনই একজন মিথিলা। সম্ভবত চট্টগ্রাম মেডিকেলের স্টুডেন্ট ছিল। ওদের মধ্যে নিয়মিত চিঠি আদান প্রদান হতো জানতাম। প্রতি সপ্তাহেই একাধিক চিঠি আসতো। পরে এই মেয়েকে নিয়েই খুব জটিলতায় পড়ে গিয়েছিল শের শাহ্‌। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে আমি তখন জেলে। পরে কি হয়েছিল আর জানতে পারিনি।



- হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে... কি খবর ওর? ওর সংগে না তোর প্রেম ছিল? বিয়ে করিসনি ওকে?



কিছুক্ষণ চুপ থেকে ও আবার শুরু করলো।



: না গিয়াস ভাই। বিয়ে করা হয়নি।

- বিয়ে করা হয়নি মানে কি? আমাকে ডিটেইল বলতো। কয়েকজনের কাছে শুনেছি, ঐ মেয়ে সংক্রান্ত বিষয়েই তুই জেলে গিয়েছিলে। আমিও তখন পলিটিক্যাল কারণে জেলে ছিলাম চার বছরের উপরে। খোঁজ নিতে পারিনি। জেল থেকে বের হবার পর যাদের সংগে যোগাযোগ হয়েছিল ওরাও কেউ বলতে পারেনি কিছু। তুইও কারো সংগে আর যোগাযোগ রাখলিনা...



: আর যোগাযোগ! সব শালাকে চেনা আছে গিয়াস ভাই। বিপদে পড়লে নিজের বাপও চেনেনা। প্রায় একটা বছর জেলে ছিলাম, প্রথম প্রথম দু-একজন যা-ও খোঁজ নিয়েছে, পরে আর কেউই যোগযোগ রাখেনি। মিথ্যে মামলায় জেলের ভেতর পঁচলাম। তারপর একজনের নির্মম করুণায় বের হলাম, ততদিনে পৃথিবীটা সম্পূর্ণই বদলে গেছে, অন্তত আমার জন্য।



এটুকু বলেই গলা ভারি হয়ে এলো ওর। ও অন্যদিকে ফিরে আছে। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম।



- আসলে কি হয়েছিল বলতো। ডিটেইল বল, শুনি।

: কী আর হবে। আপনার হয়তো মনে আছে, মিথিলা মেডিকেলে পড়তো। ফার্স্ট ইয়ারে থাকতেই আমাদের পরিচয়। পাঁচ বছরের চেনাজানা, যদিও দেখা যয়েছিল একবারই। ওর তখন ইন্টার্নশীপ। আমার মাস্টার্স শেষ। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে মাস্টার্সের রেজাল্টের অপেক্ষায় ছিলাম। একটা পার্ট টইম জব ছিল জানেনিই তো। কোন রকম দিন পার করছিলাম আর জবের ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম একের পর এক। আপনি আর রিয়াজ ভাই তখন জেলে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দু-একদিন পর পর পুলিশ মেসে রেড দেয়। আমি ক’দিন এখানে, তারপর ওখানে-এভাবেই দিন পার করছিলাম।

- তারপর...??

: আমরা দুজনে একটা সুসময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। জাস্ট একটা জব হলেই বিয়ের প্রস্তাব দেব ওর ফ্যামিলির কাছে। এর মাঝেই একদিন অসর্তকতাবশতঃ আমার একটা চিঠি ওর মায়ের হাতে পড়ে যা। এই ঘটনার পরই ওর বিয়ের জন্য ওর বাবা-মা উঠে পড়ে লাগলেন। ওর বাবা ছিল ডিফেন্সে, বিগ্রেডিয়ার। আমার তো মা-বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। ছোটবেলা থেকেই ফুফুর কাছে মানুষ। গার্ডিয়ান বলতে উনিই। খুব স্ট্রং কাউকে পাচ্ছিলাম না যাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠানো যায়। ভরসা ছিল ভাল একটা জব হয়ে গেলেই যা করার করে ফেলব।





এতটুকু বলে ও আবার থেমে গেছে। সম্ভবত নিজেকে সামলে নিচ্ছে। হাতের সিগারেটটা জ্বলছে তখনো। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস সাহস পাচ্ছি না।



: তারপর একদিন ওর চিঠি এলো। ৮৮’র জুন মাসের ১ তারিখ সেটা। ও আমাকে জানালো আমি যেন যেভাবে পারি ৩ তারিখের আগে চট্টগ্রামে চলে যাই। ৩ তারিখ দুপুর দুইটার পর ও ওয়ার সিমেট্রি গেটে থাকবে। ৪ তারিখ ওকে দেখতে আসবে বরপক্ষ। ছেলে ডাক্তার, বিসিএস ক্যাডার। পছন্দ হলে সেদিনই এংগেজমেন্ট।



সিভিল সার্ভিসের প্রতি আমার কখনো কোন আগ্রহ ছিল না। আমি চেয়েছিলাম ভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেত। কিন্তু, মিথিলা সব সময়ই বলতো, ওর বাবার প্রথম পছন্দ হলো বিসিএস ক্যাডার। কোনরকমে ক্যাডার হতে পারলে ছেলের আর কিছুই দেখবেনা। ওর খুব ইচ্ছে ছিল, আমিও যেন ক্যাডার হই। এডমিন কিংবা কাস্টমস্‌ এ।



চিঠি পেয়ে আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। কাছের গার্ডিয়ান টাইপ এমন কেউই ছিলেন না যার কাছ থেকে একটু সাজেশান নেব। আপনি আর রিয়াজ ভাই জেলে, বাকিরা সব দৌড়ের উপর। আমার নাই কোন চাকরী, নাই পায়ের নিচে একটু শক্ত মাটি। তবু ডিসিশানন নিলাম পালিয়ে বিয়ে করে ফেলব দরকার হলে। কথামত আমি দুই তারিখ রাতে চট্টগ্রামে রওয়ানা হলাম। যাওয়ার পতে গাড়ী নষ্ট হলো। দুই তারিখ রাতে থাকলাম ফেনীতে। তিন তারিখে চট্টগ্রাম পৌঁছলাম। দুপুরে ওয়ার সিমেট্রি গেলাম।



আহা... কত অপেক্ষা, কত প্রতীক্ষার পর আমাদের প্রথম দেখা হলো, পাঁচ বছরের জানাশোনার পর প্রথম দেখা। কালো রঙ্গের বোরখা পরে এসেছিল ও। দেখতে তেমন আহামরি কিছু না। খুবই সাধারণ, শ্যামলা গড়ন, বড় বড় চোখ। মোটা আই ভ্রু। এত সাধারণ, তবু যেন কী এক দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল সেই চাহনিতে!



ওকে অনেক কথা বলবো বলে ভেবেছি যেতে যেতে। কিন্তু যখনই ওর সামনে দাঁড়ালাম গলা শুকিয়ে গেল। একটি শব্দও বলতে পারিন। কিন্তু ও ছিল খুব স্বতঃস্ফূর্ত। কত কথা বলে গেল, মুহুর্মুহু হাসিতে আমার পুরো পৃথিবীটাই যেন বদলে গেল মুহুর্তের মাঝে!! একটা মেয়ে এত কথা বলতে পারে আমার ধারণার বাইরে ছিল।



অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে ওকে নিয়ে ঢাকায় আসবো, বিয়ে করে সরাসরি গ্রামের বাড়ি পাবনাতে চলে যাবো। পরে যা হবার হোক।





(দ্বিতীয়/শেষ পর্ব রাত বারোটার পর)





বি. দ্র: সব চরত্রি কাল্পনিক। কারো সাথে মিলে গেলে তা অনভিপ্রেত কাকতাল মাত্র।

মন্তব্য ১৯ টি রেটিং +৮/-০

মন্তব্য (১৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:৪৯

গ্য।গটেম্প বলেছেন: ভাল

২| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:৪৯

রুদ্রপ্রতাপ বলেছেন: ভাল্লাগতেছে, কিপ গোয়িং।

৩| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:৫১

সান্তু বলেছেন: Awesome.... Part 2 ta taratari den vhi....

৪| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:৫৬

অসামাজিক ০০৭০০৭ বলেছেন: বেশ ভালো লাগলো...
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম

৫| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:৫৭

ঘুমন্ত আমি বলেছেন: ভালো খুব।তয় সব দোষ কাকতাল মাত্র বলে চাপায়া দিলেন ।

৬| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৯:৫৭

ঘুমন্ত আমি বলেছেন: ভালো খুব।তয় সব দোষ কাকতাল মাত্র বলে চাপায়া দিলেন ।

৭| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:০৬

ভাবের পোলা বলেছেন: পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম

৮| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:০৬

সহ্চর বলেছেন:
শালা!! কি লিখছিস এইটা?? মাথা নষ্ট ম্যান।

আরে ব্যাটা ১১ টায় ট্রেন।তুই তো জানিস। বের হব দেখি এই লেখা। পড়তে পড়তে একদম ডুবে গেলাম।

দুর্দান্ত হইছেরে মামা!!! !:#P


কইশ্যা প্লাস।

০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:০৯

shapnobilash_cu বলেছেন: ট্রেনে বইসা পড়িস। বাকি পর্ব একটু পরেই দিয়ে দেব। আধা ঘন্টার মধ্যেই দেব।

৯| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:১০

আবদুর রহমান (রোমাস) বলেছেন: ..
খুবই মন খারাপ করা লেখা.......তবে অনেক যত্নের সাথে লিখেছেন..
অসাধারন বললেও কম হবে...

০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:১৬

shapnobilash_cu বলেছেন: সত্যি কথা হলো, গল্পটা আমি আরো তিনদিন আগে দিতাম, পারিনি। সামান্য রিরাইটের দরকার ছিল। দ্বিতীয়বার এডিটিং করতে গিয়ে পারিনি, নিজের চোখই ভিজে গেছে। বাকি অংশ পড়বেন কষ্ট করে, তাহলে মন খারাপের ষোলকলা পূর্ণ হবে।


ধন্যবাদ জানবেন।

১০| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:২১

পথিক অপু বলেছেন: দাদা , পরে পড়বো । এখন যাই । কমেন্টও দিয়ে রাখলাম । কিছু মনে করো না । মোডেম ইউজ করার টাইম শেষ ! :(
:P

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৪৫

shapnobilash_cu বলেছেন: ধন্যবাদ।

১১| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:২৩

অর্ণব আর্ক বলেছেন: অনেক ভালো লাগলো সবুজ। তুমি চাইলে আরো সুন্দর লিখতে পারো। জানিনা হয়তো সময় হয়না লেখার। এখন ভাবছি লেখালেখি পুরো ছেড়ে দিয়ে শুধু পড়বো। কারন জানতে হবে অনেক। নাইলে শুশীল/জানোয়ারদের সাথে পেরে ওঠা কঠিন। ওরা খুবলে খাচ্ছে জ্ঞানতাত্ত্বিক জগৎ।

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৪৬

shapnobilash_cu বলেছেন: সবুজ কিডা দাদা?

১২| ০৮ ই জুন, ২০১২ রাত ১০:৫৮

মোমের মানুষ বলেছেন: একটু পড়েছি, খুব ভাল লাগল , প্রিয়তে রেখে দিলাম। পরে পড়ব

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৪৬

shapnobilash_cu বলেছেন: ধন্যবাদ।

১৩| ১৩ ই জুন, ২০১২ রাত ১১:৪৮

পানকৌড়ি বলেছেন: এই গল্প কাল্পনিক হয় কেমনে!!!

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:৪৬

shapnobilash_cu বলেছেন: জানিনা ভাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.