নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দেখতে দেখতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের ১ বছর পূর্ণ হয়ে গেল । এই এক বছরে তাদের উত্থান, পতন, লড়াই, সংগ্রাম সবই দেশবাসী দেখেছে। একদিকে এক পক্ষের কাছে তারা পেয়েছে অকুন্ঠ প্রশংশা, আরেক পক্ষের কাছ থেকে পেয়েছে নিন্দা। কিন্তু, আমরা না হয় আবেগ আর ঘৃণার বদলে যুক্তি ও নিরপেক্ষতা দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি, আসলে এটা কি ছিল , আর এর স্বরূপই বা কি?
এই লেখাটি লিখতে গিয়ে ফিল কলিন্সের সেই অমর গান, “উই অলওয়েজ নিড টু হিয়ার বোথ সাইড অফ দ্য স্টোরি” মনে পড়ে যাচ্ছে। একটি মুদ্রার দুটো পিঠ থাকে। তাই, সারা দেশে আলোচিত এই মঞ্চের কাজকর্মের ইতিবাচক আর নেতিবাচক, দুই দিকই বিচার করে দেখা উচিত।
আর এক্ষেত্রে বিশ্বাস করা উচিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর বাণী –“সমালোচকের চেয়ে আর বড় বন্ধু নাই”
(১)
শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ প্রথমেই সবার কাছ থেকে সাধুবাদ পাবে তাদের আসাধারণ সাহস আর নির্ভীক মনোভাবের কারনে। যদিও ব্লগারদের অনেকেই ব্লগ আর অনলাইনে জামাত-শিবির ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে অনেক আগে থেকেই ‘ভারচুয়াল যুদ্ধ’ চালিয়ে আসছিলেন, কিন্ত, কেউই ভাবতে পারেন নাই যে, তারা এভাবে জামাত-শিবিরের মত একটা সংগঠিত ও উগ্র শক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি রাজপথের লড়াইয়ে নেমে সফলতার সাক্ষর রাখবে। কিন্তু, তারা অনেক ঝুকি ও হুমকিকে উপেক্ষা করে তাদের আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল, এবং জামাত-শিবিরের ভিত সত্তিকারভাবেই কাপিয়ে দিতে পেরেছে।
অনেকেই অভিযোগ করেন যে, ‘মহাপ্রতাপশালী’ আওয়ামী লীগ কাদের মোল্লার রায়ের আগে জামাত শিবিবের সাথে আঁতাত করতে গিয়েছিল। কিন্তু এখনও কারও জানামতে গনজাগরণমঞ্চের কেউ জামাত-শিবিরের সাথে কাছে নতি স্বীকার করেনি, যা তাদের অত্যন্ত বড় একটি সাফল্য।
(২)
সাম্প্রদায়িক শক্তি মাঝে মাঝেই দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিরোধ অপরিহার্য এই জন্য যে, এই প্রতিবাদ ও সচেতনতা না থাকলে তা যে কোন সময়ে মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গনজাগরণ মঞ্চ এই ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি এবং অসাম্প্রদায়িক ও প্রতিবাদি মানস সৃষ্টিতে অনেকটাই ভাল ভুমিকা রেখেছে। ‘নির্বাচন’-এর পড় দেশে যখন জামাত-বিএনপি এবং কিছুটা আওয়ামী লীগ কতৃক দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন শুরু হল, তখন গনজাগরন মঞ্চের ‘রোড মার্চ’ খুব আসাধারণ একটি কাজ ছিলো।
এর পাশাপাশি মঞ্চের কর্মীদের অহিংস মনোভাবও অনেকের মন জিতে নিয়েছে। মাঝে মধ্যেই দুবৃত্তরা তাদের উপর হামলা চালালেও তারা অহিংস উপায়েই এর প্রতিবাদ করে গেছে, যা খুবই ভাল একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
(৩)
শাহবাগ আন্দোলনকে যদি আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে যাই, তাহোলে প্রথমেই আমাদের চোখে ভাসে সেই অসাধারন, আভাবনিয় দৃশ্য --- লক্ষাধিক লোকের হাতে মোমবাতি ; মোমবাতি নিয়ে তারা নিসচুপ দাঁড়ীয়ে আছে। পুরো এলাকা জুড়ে নিচ্ছিদ্র নিরবতা, কিন্তু তারপরও সেই নিরবতার আওয়াজ ছিল লক্ষ বজ্রধনির সমতুল্ল, যা বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়িদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেইদিন আলোর বন্যায় চারিদিক ভেসে গিয়েছিল। সেই আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাধিয়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল গোঁড়া ধর্মভিত্তিক দলগুলো।
এত গেলো তাদের ইতিবাচক কাজকর্মের বিশ্লেষণ। কিন্তু, প্রদীপের নিচেই থাকে অন্ধকার, সেটা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকেই মনে হয় খুব ভাল বোঝা যায়। শাহবাগ আন্দোলনের পটভূমির দিকে তাকালেই বিষয়টা একটু একটু করে পরিস্কার হবে। আমরা যারা মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলি, তাদের কাছে তাদের আন্দোলন এক অর্থে ছিল অপ্রয়োজনীয় একটা বিষয়। কারণ, মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যাবজ্জীবন বা ২০ বছরের সাজাই সরবচ্চ শাস্তি। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই যেখানে মৃত্যুদণ্ড অমানবিক আর নিষ্ঠুর কাজ বলে পরিত্যাজ্য হচ্ছে, সেখানে ‘ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই’ স্লোগানে চারিদিক মুখর করে তোলা ‘অমানবিক ও চরমপন্থি আন্দোলন’ বলে কার কাছে মনে হলে সেটার জন্য কাউকে দোষ দেয়া যাবেনা। কারণ, গনজাগরণের আন্দোলনকারি ও এর সমর্থকরা মৃত্যুদন্ড ছাড়া অন্য কিছু মানতে কখনই রাজি ছিলোনা এবং এখনও রাজি নয়। যাবজ্জিবন ও মৃত্যুদন্ড মধ্যে তাদের চোখে আকাশ-পাতাল তফাৎ । কিন্তু, মৃত্যুদন্ড, আর যাই হক, মানবাধিকার ও সভ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে একপ্রকার ‘কিলিং’ ছাড়া আর কিছু নয়। শাহবাগের আন্দোলনকারী ও এর সমর্থকেরা বলতেই পারেন যে, তাদের আন্দোলনের কারণেই কাদের মোল্লা ও অন্যান্য রাজাকারদের ফাঁসির রায় হচ্ছে; বিশেষ করে বিএনপির অত্যন্ত প্রভাবশালি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীরও একি পরিনতি হয়েছে, কিন্তু, ‘রাজাকারদের গুরু’ গোলাম আযম (১৯৯২ সালে শহিদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালতে যার ফাসির রায় হয়েছিলো) ও আব্দুল আলীমের হল যাবজ্জিবন। এটা করা হয়েছে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। কিন্তু, গণজাগরন মঞ্চ এই রায়গুলো না মেনে প্রতিবাদ মিছিল বের করে ও এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার ঘোষণাও করেছিল। মোটকথা, মৃত্তুদন্ড বা ‘হত্যার বদলে হত্যা’র রায় তাদের চাই-ই চাই।
মানুষের চোখে তারাই হিরো, নিয়মনিস্ঠার প্রতি অটলতার পাশাপাশি যারা শত্রুর প্রতিও দয়াদ্র হয়ার দুঃসাহস দেখায়। শাহবাগের আন্দোলনকারী ও গণজাগরণ মঞ্চ নিঃসন্দেহে এই শ্রেণিতে পড়েন না।
(৪)
শাহবাগের আন্দোলন কিছু মানুষকে এমন পরিমাণ প্রচার ও জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে, যা অন্য মানুষেরা হয়তো সারাজিবনেও পান না। ২রা ফেব্রুয়ারী, ২০১৩-এর আগে ইমরান এইচ সরকার ও লাকী আক্তারের মত মানুষেরা ছিলেন আমজনতা। আর আট- দশটা মানুষের মতই রাজনৈতিক বা সামাজিক সচেতনতার জন্য প্রচেষ্টা চালাতেন তারা। কিন্তু, শাহবাগের আন্দোলন তাদের জীবনটাকেই পরিবর্তন করে দিলো। সারা দেশ তাদের এক নামে চিনতে শুরু করল। কিন্তু, ইমরান যেমন আওয়ামী লিগের কর্মী ও সমর্থক হিসেবে পরিছিত, লাকী যেমন ছাত্র উনিওন- এর সমাজ কল্যান বিষয়ক সম্পাদক, তেমনি শাহবাগের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আর বামপন্থী দলগুলোর পরিচালিত আন্দোলনই ছিল (যদিও প্রথম দিকে অনেক দল নিরপেক্ষ মানুষ শাহবাগে এসেছিলেন)। রাজাকার ও জামাত-শিবির বিরোধি আন্দোলন না হয়ে এটা যদি কোন সরকার বিরোধি আন্দলন হত, তাহলে সরকার এটাকে একদিনের বেশি দুইদিনও টিকতে দিতোনা। পুলিশ বা র্যানব দিয়ে তাদের শাহবাগ থেকে উঠিয়ে দেয়া হত।
সরকারের সমর্থনে, র্যা ব আর পুলিশের বেষ্টনীতে আসলেই কোন ‘বিপ্লব’ বা ‘জাগরণ’ হয় কিনা, সে প্রশ্ন তাদের বিরুদ্ধে অনেকেই তুলেছিলেন, যা ভবিষ্যতেও অনেকেই করতে পারেন।
(৫)
অথচ, শাহবাগ আন্দোলন অনেক মানুষকেই আশান্বিত করেছিল। আওয়ামী লিগ ও বিএনপি জোটের প্রচলিত নোংরা, লজ্জাহীন ও হানাহানির রাজনিতিতে অতিষ্ট মানুষ, যারা কিনা এখন বিশ্বাস করেন যে তরুণ সমাজই দেশের রাজনিতিতে ইতিবাচক পরিবরতন আনবে, তারা অনেকেই আশান্বিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে ‘এই গনজাগরনের তরুণরা’ নতুন একটা শক্তি হিসেবে আভিরভূত হবে। কিন্তু তাদের আশায় গুড়েবালি পড়তে বেশি সময় লাগেনি। যখন আওয়ামী সমর্থক লোকজন এবং ১৪ দলীয় জোটের সাথে যুক্ত ছাত্র সংগঠনের ছেলেমেয়েরা এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করে, তখন আওয়ামী লিগের আর কট্টর বাম রাজনীতির সমর্থকরা ছাড়া বাকি সবাই এই আন্দোলনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বর্তমানে এমনকি অনেক বাম রাজনিতির সমর্থকও এটিকে ‘আওয়ামী মঞ্চ’ বলতে ছাড়েন না।
কাজেই, আচমকা সাড়া জাগানো এই মঞ্চের আগমণে যারা, ভিক্ষুখের পাতে পয়সা পড়ার শব্দে ভিক্ষুক যেমন চমকিত হইয়া উঠে, ঠিক তেমনি পুলকিত হইয়া উঠিয়াছিলেন, তারা পরবর্তীতে যারপরনাই হতাশ হলেন। হতাশ হননি কেবল আওয়ামী লিগ, বাম দলগুলোর কট্টর কিছু সমর্থক এবং যারা কিনা ‘রাজাকার’ বিরধিতাকে একমাত্র প্রতিবাদ এবং ‘পাকিস্তান বিরধিতা’কে একমাত্র আদর্শ মনে করেন, সেই তারা। সন্দেহ নেই , রাজাকারদের শাস্তি বাংলার মাটিতেই হতে হবে, কিন্তু’ ‘এ কোন তরুণ প্রজন্ম’ যারা দেশের অন্য কোন সমস্যা নিয়ে মাঠে নামা তো দূরের কথা, এসব ব্যাপারে চিন্তাই করে না? অনেকেরই প্রশ্ন যে, ‘এ কোন তরুণ প্রজন্ম’ যারা দুর্নীতি, সরকার কতৃক গনতান্ত্রিক অধিকার হরন, সাম্রাজ্যবাদের অগ্রাসন –এসব ব্যাপারে যাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই?’
‘এ কোন তরুণ প্রজন্ম’ যারা পাকিস্তান কতৃক বাংলাদেশের অভ্যন্তরিণ বিষয়ে নাক গলানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদি হয়, কিন্তু সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতন বা ভারতের দালালি করা নিয়ে কোন কথাই বলেনা?’
তাই অনেকেই দাবি করেন, এই ‘গনজাগরণ মঞ্চ’ ১৪ দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই কাজ করে চলেছে। কিন্তু, এই কথা মনে জরুরি যে, দালালী করে আর ভ্রষ্ট নিতি নিয়ে, আর যাই হোক জাগরণ হয়না। একটা খারাপ কাজ করে আপনি আরেকটা খারাপ কাজকে রুখতে পারেন না।
(৬)
উগ্র জাতীয়তাবাদ যুগে যুগে সব দেশেই মানুষের উপকারের বদলে অপকারই করে এসেছে। হিটলার ১৯৪০-এর দশকে এতা দেখিয়েছেন। রাজাকার ও আলবদররা ১৯৭১-এ সেতা দেখিয়েছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ মানুষকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দেয়না, যেটার প্রমান আমরা দেখি ১৯৭১-এ। রাজাকার ও আলবদররা বাংলাদেশের বদলে পাকিস্তানকেই নিজের দেশ বলে মনে করেছিল এবং সেই দেশের অখন্ডতা রক্ষা করা তাদের ‘পবিত্র দায়িত্ত’ বলে মনে করেছিলো।
পাকিস্তানিরা ক্যামন, সেটা আমরা সবাই মোটামুটি জানি। পাকিস্তানীরা অসভ্য হলে যে আমাদেরও এই দিক দিয়ে তাদের সাথে পাল্লা দিতে হবে -- তার কোনও মানে আছে? আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা বাংলাদেশিরা প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে পারি। কিন্তু, অন্য দেশের দূতাবাসের সামনে গিয়ে জুতা দেখানো, জুতা আর ঢিল নিক্ষেপ কি আমাদের মানায়? এতে করে কি সেই দেশের সব মানুষকেই কি আমাদের অপমান করা হয়না?
এসব বিষয় বুঝতে গনজাগরণ মঞ্চকে কখনই তেমন চিন্তিত মনে হয়নি । যখন হাতে বড় বড় রাজনৈতিক দলের পয়সা আর ব্যাকিং হাতে থাকে, তখন অনেকের চিন্তাভাবনাই ঠিকমত কাজ করেনা। ইমরান সরকার ও তাদের অনুসারীদের অবস্থা কি এই রকম কিছু? নাকি, এসব তাদের অপরিপক্কতা?
(৭)
চিন্তা-ভাবনা ঠিকমত কাজ না করার উদাহরণ গনজাগরণ মঞ্চ আরও দেখিয়েছে। ২০১৩-এর মাঝামাঝি যখন বিসিএস পরীক্ষায় কোটা বিরধি আন্দোলন যখন তুঙ্গে, গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের সম্পরকে বলা হল অনেক নেতিবাচক কথাবারতা। এমনকি তাদের ‘ফকিন্নির পোলা’ বলেও সম্মধন করা হল এক জায়গায়। বলা হল, এই আন্দোলন জামাত-শিবিরের আন্দোলন। আসলেই কি এটা তাই ছিলো?
দৈনিক সমকাল ও দৈনিক প্রথম আলো কখনই জামাত-শিবিরকে সমর্থন করে কোন রিপোর্ট বা প্রতিবেদন লিখেছে বলে কেউ দাবি করতে পারবেনা। জামাত-শিবিরের বিপক্ষে তাদের নীতিগত অবস্থান সবাই জানে। তারাও কিন্তু, এই কোটা বিরধি আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল তাদের বিভিন্ন লেখায়। কিন্তু, গনজাগরন মঞ্চ থেকে এদের জামাত-শিবিরের সমর্থক বলে উল্লেখ করা হল।
সন্দেহ নেই এই আন্দোলনকে জামাত-শিবির নিজেদের পক্ষে কাজে লাগাতে চেয়েছিল । এই আন্দোলনে কিছু শিবিরের ছেলে-পেলেও ছিলো। কিন্তু, এই আন্দলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল সাধারণ ছাত্ররা। তাদের ন্যায্য দাবিকে ব্যঙ্গ করে গনজাগরন মঞ্চ কি সেইসময় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয় নি?
(৮)
তাদের সর্বশেষ কীর্তি হলো আইসিসি আর ইন্ডিয়ান ক্রিকেট বোর্ড -এর অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যখন সারা বাংলাদেশ প্রতিবাদে মুখর হল, তখন তারা পালন করল পরম নিরবতা। ইমরান সরকার, মারুফ রসুল, মাহমুদুল মুনশি প্রমুখ গণজাগরণের বাঘা বাঘা নেতাদের (!) ফেসবুক একাউন্ট আর পেজেও পাওয়া গেল না তাদের কাছ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া। এমনকি ‘গণজাগরণ মঞ্চ’-এর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজেও এই বাপারে পাওয়া গেলনা কিছুই...!
এরাই কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফরের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর একটা আন্দোলন করেছিল...!
‘গণজাগরণ মঞ্চ’কে সমর্থন করে, কিন্তু ভারত ও আইসিসির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুখর, আমার এক ছোট ভাই তাই বললো, “ভারত যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আক্রমণও করে, তাও এই লোকেরা চুপচাপই থাকবে...”।
এখানে আসলে আর কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। এখন কেউ যদি এই ‘গণজাগরণ’ মঞ্চের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদের কি দোষ দেয়া যাবে?
(৯)
কিশোর-তরুণদের অনেকেই ট্রান্সফরমারস সিরিজের সিনেমার দারুণ ভক্ত। ট্রান্সফরমারস সিরিজের ৩ নম্বর সিনেমা ‘ডার্ক অফ দ্য মুন’-এর একটি দৃশ্যকল্পের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেখানে দেখা যায় কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘অপ্টিমাস প্রাইম’ অনেকদিন ধরেই পৃথিবীতে বসবাস করছে। ভিনগ্রহের ডিসেপ্টিগনরা যখন পৃথিবীকে আক্রমন করে এবং আরেক কেন্দ্রিয় চরিত্র ‘সেন্টিনেল প্রাইম’ ওয়াদা ভঙ্গ করে ডিসেপ্টিগনদের সাথে হাত মেলায়, তখন অপ্টিমাসের সাথে সেন্টিনেলের সংঘর্ষ বাধে। অপ্টিমাস সেন্টিনেলকে পরাজিত করার পর জিজ্ঞাসা করে যে, সে কেন পৃথিবীবাসীকে ধোঁকা দিল, তখন সেন্টিনেল বলে, সে তার গ্রহ সাইবারট্রনকে বাচানোর জন্যই এটা করেছে এবং অপ্টিমাসকে ধোঁকা দিয়েছে।
কিন্তু, অপ্টিমাস সেন্টিনেলের যুক্তি আগ্রায্য করে তাকে বলে, “আপনি আমাকে নয়, নিজেকেই ধোকা দিয়েছেন”।
গণজাগরণ মঞ্চের অনেকেই হয়তো যুক্তি দেখাতে পারে যে, তারা সাম্প্রদায়িক আর মৌলবাদীদের হাত থেকে দেশকে বাচাতে চায় বলেই ১৪ দল ও তাদের সমরথক প্রতিবেশী দেশের দালালী করছে। কিন্তু, তাদের এই যুক্তি কিন্তু সেন্টিনেলের যুক্তির মতই অসার মনে হবে দেশবাসীর কাছে।
১৪ দলের উমেদারি হয়তো তাদের ‘দীরঘমেয়াদী পরিকল্পনা’র অংশ, যার কারণে তারা আপাতো এই রাস্তা বেছে নিয়েছে। কিন্তু, ইতিমধ্যেই ‘দালাল’ বা ‘এজেন্ট’ হিসেবে তাদের যে দুর্নাম জুটেছে, তা কি তারা সহজে মুছে ফেলতে পারবে???
আসলে কি বলবো? ঘৃণা নয়, ভালবাসাই হোক আমাদের ভাষা। তাই, এই মঞ্চের শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলতেই পারি, এই একচোখা নীতি ও পক্ষপাতদুষ্ট দালালীর মনোভাব থেকে বের হয়ে আসা তাদের জন্য জরুরী। না হলে তারা দেশের তরুণ সমাজকেই নয়, নিজেরাই নিজেদের ধোঁকা দেবে...।
(১০)
জামায়াতে ইসলামি যেমন ইসলাম ধর্মকে টিস্যু পেপারের মত ব্যবহার করে, ঠিক তেমনি অনেকের ধারনা যে, আওয়ামী লীগও মুক্তিযুদ্ধকে একিভাবে ব্যবহার করে। এখন পর্যন্ত অনেকেরি দৃঢ় বিশ্বাস, গনজাগরণ মঞ্চের তরুণরা এমন কিছু করেনা। কিন্তু, এই অভিযোগ যদি তাদের বিরুদ্ধে উঠে ভবিষ্যতে যে, তারাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই ‘ব্যবহার’ই করেন, তাহলে সেটা কি তাদের জন্য ভাল কিছু হবে?
(১১)
যখন শাহরিয়ার কবির, নাসিরুদ্দিন বাচ্চুর মতো চিহ্নিত আওয়ামী লিগের অন্ধ সমর্থক গনজাগরণ মঞ্চের সভায় গিয়ে আওয়ামী সরকারের গুনগান করে, তখন গণজাগরণ মঞ্চের নিজস্ব স্বকীয়তা বলে কিছু থাকেনা। তেমনি, ইমরান সরকার যখন বলে যে, পাকিস্তানি দূতাবাস ঘেরাওয়ের সময় তাদেরকে জামাতপন্থি পুলিসই পিটিয়েছে, তখন মনে হয় যেন, যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা কেবল তাদেরই রয়েছে – কূটনৈতিক পাড়ায় গিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি আর গন্ডগোল সৃষ্টির ‘অসাধারণ অধিকার’তো বটেই – সেটা দেশের অন্য কারও থাকুক আর না থাকুক।
আর প্রচুর উগ্র নাস্তিক সমর্থক রয়েছে এই মঞ্চের যারা কিনা ব্লগে মাত্রাহীন উল্টোপাল্টা আর অশ্লিল ভাষায় ইসলাম সহ বিভিন্ন ধর্মের নিন্দা করে এসেছেন এবং এখনো করেন, গঠনমূলক সমালচনার পরিবরতে। এদেরকে নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে মঞ্চের ইমেজ ভবিষ্যতে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উদাহরণসরুপ, বলা জায়, হুমায়ুন আযাদের ছেলে অনন্য আযাদের মত একজন উগ্রপন্থি নাস্তিক সমর্থক গনজাগরণ মঞ্চের ইমেজের বারটা বাজানোর জন্য যথেস্ট।
(১২)
আজ এই পর্যায়ে এসে কেন জানি মনে হয়, গ্লাসের অর্ধেকটার বেশি খালি।
যদিও গনজাগরণ মঞ্চ সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় মরিচিকার নাম, তারপরও বলতে হয়, গণজাগরণ মঞ্চ একটা সংগঠিত শক্তি যাদের নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক যথেষ্ট শক্তিশালি। তাদের আন্দোলনের সাথে জড়িত সবাই যে ১৪ দলের উমেদার ছিলেন, তাও ঠিক নয়। অসাম্প্রদায়িক আর বিজ্ঞানভিত্তিক ছিন্তা-চেতনা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য, কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা থেকে মানুষকে সচেতন করার জন্য তাআর হতে পারে অনেক বড় একটি প্লাটফর্ম ।
এখন তাদের নেতৃবৃন্দ যদি নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে পেরে, অন্যের এজেন্ডা বাস্তবায়ন ছেড়ে তরুণ সমাজের সত্যিকারের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে পারে, তবেই দেশের জন্য সত্যিকারের মঙ্গলজনক কিছু তারা করতে পারবে। এজন্য তাদের তরুন সমাজের কণ্ঠস্বর শুনতে আর সেটাকে অনুধাবন করার সামর্থ্য রাখতে হবে।
তাহলেই, কেউ বলবেনা যে, তারা ছিল স্রেফ ‘ঝড়ে বক’। তবেই, তাদেরকে সাথে নিয়ে বাংলার তরুণ সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।
©somewhere in net ltd.